#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৮
বারংবার নেত্র যুগলের পলক ফেলে সামনে থাকা এই মানবটি বাস্তব কিনা সেটা যাচাই করা শেষ হচ্ছে না মোহের। আশেপাশে তীব্র দুর্যোগের কথা যেন ভুলেই গেল। প্রকৃতির আন্দোলনে দুজনের কেউই সাবধান হওয়ার চেষ্টা না করে বোঝার চেষ্টা করছে তাদের চোখের সামনে থাকা মানুষটা এত সাধনা এবং আকাঙ্ক্ষার পর সত্যিই তাদের সামনে? সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে নিজের একহাত দিয়ে মোহ ছুঁয়েই ফেলল সেই মানুষটিকে। স্বচ্ছের কাঁদায় মাখামাখি শার্টে নিজের মসৃন হাতটা রাখতেই ভেজা অনুভব করল মোহ। আকাশসম বিস্ময় নিয়ে প্রথমে স্বচ্ছের শার্ট হাত রাখার দিকে তাকাল। স্বচ্ছ তার ভেজা হাত মোহের হাত উপর রেখেছে। চক্ষুদ্বয় বড়ো বড়ো করে স্বচ্ছের ধূসর অক্ষিগোলকের দিকে চাইতেই স্বচ্ছ ফিসফিসিয়ে বলে,
“একা একটা সরল সোজা ছেলে পেয়ে সুযোগ নিতে চাইছ?”
মোহ বিলম্ব না করে হাত নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,
“ছি! অসভ্য চিন্তাভাবনা।”
“যেভাবে বুকের উপর হাত রাখলে আমি তো ভাবলাম…”
মোহ স্বচ্ছকে পুরো কথা বলতে না দিয়ে নিজে বলে উঠল,
“যার যেমন মানসিকতা। আমি তো শুধু হঠাৎ আপনাকে এখানে দেখে চমকে গিয়েছিলাম। ভাবতেও পারিনি এটা সত্যিই আপনি। তাই একটু চেক করে দেখছিলাম।”
“চেক করে কী বুঝলে? বাস্তব তো?”
মোহ কিছু বলবে তার আগেই মটমট শব্দ করে বড়ো আম গাছের ডাল ভেঙে গেল। মোহ তা উপলব্ধি করে দ্রুত স্বচ্ছের শার্ট খামচে ধরে তাকে টান দিলো নিজের দিকে। ভুলবশত নিজেকে সামলে উঠতে না পেরে মোহের সঙ্গে মিশে গেল স্বচ্ছ। তবুও রক্ষা হলো না। স্বচ্ছের হাতের বাহু ঘেঁষে নিচে পড়ে গেল ভারি ডালটা। বাহুর একাংশ ছিলে গেল স্বচ্ছের। সেসবে খেয়াল হয়েও হলো না তার। সে যেন অন্য দুনিয়ায় ভাসছে। যেমনটা, বহু খোঁজাখুঁজির পর কাঙ্ক্ষিত মূল্যবান রত্নের দেখা মেলার পর ভার মনটা প্রশান্তির বাতাস পায় ঠিক তেমন। তবে মোহ সরে গিয়ে স্বচ্ছের বাহুটা ধরে চিন্তায় পড়ে গেল বেশ। পুরো হাতেই র/ক্তার/ক্তি অবস্থা দেখে হকচকিয়ে উঠল। সেসব আবার ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে।
“আপনার অবস্থা তো ভালো নয়। আমার সাথে চলুন। ঝড়ের মাঝে তো যেতে পারবেন না কোথাও।”
স্বচ্ছ অকপটে বলল,
“আমার হাঁটতে ভীষণ সমস্যা হচ্ছে মিস মোহ। যন্ত্রণা করছে অনেক।”
মোহের রাগ হলো কিছুটা। এই অবস্থায় কে আসতে বলেছে এতদূর? কোনো কী দরকার ছিল? কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বলে উঠল,
“আমার কাঁধে হাত রেখে ভর দিয়ে যেতে পারেন। তাহলে পায়ে চাপ কম পড়বে।”
মোহের দ্বিধা বেশ ভালোমতোই বুঝতে পারল স্বচ্ছ। তার দিকে তাকিয়ে শুধাল,
“তুমি এটাতে কমফোর্ট ফিল করবে?”
মোহ আমতা আমতা করল। স্বচ্ছ মৃদু হেসে নিজের হাত বাড়িয়ে বলল,
“শুধু হাতটা ধরো। তাহলেই হবে। আমরা পুরুষ মানুষ বুঝলে? তোমাদের মতো এক আ/ঘাতে কপোকাত হবো না।”
“সেকারণেই তো সেদিন বাইক এক্সি/ডেন্টে পড়ে ছিলেন মাঝরাস্তায়। এই নারীর সাহায্য না পেলে বুঝতে পারতেন কত ধানে কত চাল!”
“খোঁটা দিচ্ছো?”
“খোঁটা নই সত্যিটা বোঝাচ্ছি। হাতটা ধরুন। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি।”
স্বচ্ছ বিনাবাক্যে মোহের চিকন হাতখানা ধরল এবার। অতঃপর হেসেই বলল,
“এই তুলো দিয়ে তৈরি পেন্সিল ধরে ভেতর অবধি যাব আমি? ছিঁড়ে যাবে না তো?”
ক্রুদ্ধ নজরে চাইল মোহ। রাগে গজগজ করে বলল,
“ছিঁড়লে আপনারই কয়েকটা হাড় ভাঙবে পড়ে গিয়ে। আমার কী?”
স্বচ্ছকে নিয়ে গিয়ে আস্তে করে ঘুমন্ত ইথানের পাশে বসাল মোহ। ফিসফিস করে বলল,
“আস্তে কথা বলবেন। আপনার পাশে ইথান আর পাশের ঘরে দাদীজান ঘুমায়।”
“আমি তো ভিজে গেছি। আমার জন্য…”
স্বচ্ছের মুখ সজোরে চেপে ধরে মোহ। পুরো কথাটা সম্পূর্ণই করতে দেয় না তাকে। কেননা, স্বচ্ছ উঁচু গলায় কথা বলছে। তার মুখ চেপে ধরে চোখ বড়ো বড়ো করে ইথানের দিকে তাকায় মোহ। অতঃপর স্বচ্ছকে ইশারা করে বলে,
“গলা নামিয়ে কথা বলুন। নয়ত কথা বলতে হবে না। চুপ থাকুন।”
স্বচ্ছ আর কিছু বলে না। মোহ সরে আসে। অতঃপর একটা টাওয়াল নিয়ে এসেই স্বচ্ছের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“মাথা আর গা মুছে নিন। আমি ওই রুমে গিয়ে স্যাভলন নিয়ে আসছি। আর কোনো আওয়াজ করবেন না।”
স্বচ্ছ ঘাড় কাঁত করে সম্মতি দিলেই দরজা পেরিয়ে পাশের ঘরে রাবেয়া বেগমের ঘরে প্রবেশ করল মোহ। রাবেয়া বেগমের চোখ সবে লেগে এসেছে। ভিড়িয়ে রাখা দরজায় সামান্য শব্দ হতেই চোখ মেলে তাকালেন উনি।
“মোহ তুই এহন কী করস? কিছু লাগব?”
কথা শেষ হতে না হতেই মোহের কাপড়ে কাঁদার দাগ দেখে ফের জিজ্ঞেস করলেন,
“কাপড়ে কাঁদা লাগাইলি কই থাইকা?”
মোহ তাড়াহুড়ো করে জবাব দিলো,
“ওইযে দরজা লাগাতে বললে না? পড়ে গিয়েছিলাম তখন পা পিছলে।”
রাবেয়া বেগম চকিতে তাকিয়ে হুড়মুড় করে উঠে বসেন। বিচলিত হয়ে বলেন,
“বলিস কী? লাগে নাই তো আবার?”
“ওই আরকি একটু আধটু ব্যথা পেয়েছি। তাই একটু স্যাভলন নিতে এসেছিলাম।”
“ওইযে দেখ শোকেসের উপরেই আছে। চল আমি তোরে লাগাইয়া দিই স্যাভলন। ভুলই হইয়া গেছে। এই ঝড়ে দরজা লাগাতে বলা উচিত হয় নাই। চল দেখি কোথায় কোথায় লাগল! তোর ঘরে চল। আমার ঘরে আলো কম।”
মোহ ভড়কে গেল তৎক্ষনাৎ। রাবেয়া বেগম উঠে দাঁড়ালেন মোহের ঘরে যেতে। মোহ তাড়াহুড়ো করে বলল,
“তেমন কোথাও লাগেনি দাদীজান। আমি তো লাগিয়ে নিতে পারব স্যাভলন। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। বিছানা ছেড়ে উঠতে হবে না।”
রাবেয়া বেগমের জবাবের অপেক্ষা না করেই হাতে স্যাভলন নিয়ে ছুট লাগাল মোহ।
একহাত দিয়ে জোরে জোরে নিজের মাথার ঘন চুল মুছতে থাকে স্বচ্ছ। দুহাত না লাগালে কোনোমতেই ঠিক করে মুছতে পারছে না। অন্যহাতের অবস্থা একেবারেই বিমূঢ়। ভেজা শার্ট একটু খুলবে সেটাও পারছে না একহাতে। চুল মুছে মুখে টাওয়াল স্পর্শ করতেই অন্যরকম ঘ্রাণ এসে ঠেকল স্বচ্ছের নাকে। বেশ জোরে নিশ্বাস নিয়ে আবারও নিলো ঘ্রাণ। এটা সম্ভবত মোহের শরীরের ঘ্রাণ। প্রতিটা মানুষেরই আলাদা ঘ্রাণ থাকে। তবে সেই মানুষ সেটা বুঝতে পারে না। অপর মানুষ তা ভালোভাবেই বুঝতে পারে। যেমনটা এখন স্বচ্ছ বুঝছে। স্বচ্ছ নিশ্চিত হলো এটা মোহের টাওয়াল। দ্রুত মুখ মুছে টাওয়াল নিচে নামিয়ে জোরে জোরে দম নিলো সে। এই ঘ্রাণে আকর্ষণ আছে। যেটাতে স্বচ্ছ আতঙ্কিত!
মোহ এসে ঝটপট দরজার কপাট আঁটকে দিলো। একবার রাবেয়া বেগম জেনে গেলে কী যে কেলেঙ্কারি হবে তার ঠিক নেই। স্বচ্ছ অবাক পানে প্রশ্ন করে,
“কী হলো?”
মোহ ক্রোধের সহিত বলে,
“এসে তো বিপদ বাড়িয়ে দিয়েছেন আমার। দাদীজান জানলে আমাকে সাথে আপনাকেও জানে মে/রে ফেলবে। কে আসতে বলেছিল আমার এখানে? কেন এসেছেন?”
স্বচ্ছ বিব্রত হলো। ভেতরের বিশাল ইগো জাগ্রত হলো। বেশ দম্ভ নিয়ে বলল,
“তোমার কাছে আসব? আমার মাথা খারাপ নাকি? নিজেকে এত ইম্পর্ট্যান্ট মনে করো বুঝি? আমি আসলে এদিকে আমার একটা আত্মীয় থাকে তাদের বাড়িতে আসতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। আমি তো জানতামও না তুমি এখানে আছো।”
কথাগুলো কর্ণকুহরে যাওয়া মাত্র কান গরম হয়ে যায় মোহের। লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারে না সে। পায়ের নখগুলো কুঁকড়ে যায়। সে কিনা ভেবেছিল স্বচ্ছ তার জন্য এসেছে! এই ভেবেই নিজের ভাবনাগুলোকে ধমক দেয় সে মনে মনে।
“হাত জ্বলছে। স্যাভলন নিয়ে কি দাঁড়িয়েই থাকবে?”
স্বচ্ছের কথায় খানিকটা চমকে উঠে নিজের ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দিতে গিয়ে খেয়াল করে স্বচ্ছ ভালো করে নিজের গা মুছতেই পারেনি।
“আপনি তো শরীর মুছতে পারেননি ঠিক করে এখনো। এই অবস্থায় স্যাভলন লাগানো আর না লাগানোর সমান কথা।”
“কী করে মুছব? আমার এক হাতের অবস্থা বেহাল!”
“আমি সাহায্য করব?”
“অস্বস্তি না লাগলে করতে পারো।”
স্বচ্ছের স্পষ্ট উত্তর মোহ পাল্টা প্রশ্ন করে,
“আপনার অস্বস্তি লাগবে না?”
স্বচ্ছ স্বাভাবিকভাবেই বলল,
“আমার লজ্জাবোধ কম। ছেলেরা খালি গায়ে সারা রাজ্য ঘুরে বেড়াতে দ্বিধাবোধ করবে না।”
মোহ কথা না বলে স্বচ্ছের ভেজা শার্টের বোতাম খুলতে সাহায্য করো। স্বচ্ছের উদাম গায়ে নিজের টাওয়াল ঠেকাতেই স্বচ্ছ নড়েচড়ে বলে ওঠে,
“তোমার টাওয়াল আমার নাকের কাছ থেকে দূরে রাখবে।”
মোহ বোকা বনে যায়। সরল মনে শুধায়,
“কেন?”
স্বচ্ছ ঢক গিলে বলল,
“ব্যস…এমনিই। দূরে রাখবে আমার নাকের কাছ থেকে।”
মোহ বিভ্রান্ত হয়ে মনে রাজ্যের অস্বস্তি নিয়ে স্বচ্ছের গা মুছিয়ে দেয়। স্বচ্ছ অন্যদিকে মুখ করে থাকে। অতঃপর মোহ নিজের টাওয়াল নাকে ঠেকিয়ে ভাবে, তার টাওয়ালের কি এতই বাজে গন্ধ করছে? স্বচ্ছ দৃশ্যটি অবলোকন করে। ভাবে, মেয়েটা তো বুঝবে না সেই গন্ধে কী বিপত্তি ঘটবে! একবার তা নাকে প্রবেশ করলে দ্বিতীয়বার ঘ্রাণ নিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে মন। স্বচ্ছ চায় না নিজের মানসম্মানের দফারফা করতে। মোহ যত্নের সহিত নিজের রুমাল দিয়ে স্যাভলন লাগিয়ে রুমাল হাতে পেঁচিয়ে দিয়ে বলে,
“এখানে ব্যান্ডেজ পাবেন না। তাই রুমাল পেঁচিয়ে দিলাম।”
স্বচ্ছ জবাব দেয় না। আঁড়চোখে মোহের পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মোহের কথায় চমকে ওঠে। মাত্র দুদিনের তৃষ্ণা মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তার। মনটা এত লাগামহীন হচ্ছে কেন? তার মানসম্মানের দফারফা না করে কি মন থামবে না?
মোহ মনোযোগ দিয়ে স্বচ্ছকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
“এই অসুস্থতা নিয়ে আপনি আত্মীয়দের বাড়িতে আসতে গেলেন কেন? পায়ে তো সমস্যা ছিলই এখন হাতও জ/খম হয়ে গিয়েছে। আর কোথাও কি লেগেছে আপনার? তাহলে বলুন দেখি স্যাভলন দিয়ে দিই!”
মোহের বিচলিত কণ্ঠ নাড়িয়ে দিলো স্বচ্ছের হৃদয়। তার জন্য মোহের অস্থিরতা দেখতে বেশ লাগে। ফট করে স্বচ্ছ বলে উঠল,
“বুকে ঢুকতে পারবে?”
নয়ন দুটোর পলক পড়া বন্ধ হলো মোহের। স্বচ্ছের কথা বোধগম্য হলো না তার। বিস্ময় নিয়ে শুধাল,
“জি? বুঝলাম না?”
“বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা করেছে দুদিন ধরে। তাই বললাম। সেখানে স্যাভলন লাগিয়ে দিয়ে পারবে কিনা!”
মোহ তৎক্ষনাৎ চিন্তিত হয়ে বলে ওঠে,
“তাহলে তো আপনার ডাক্তার দেখানো উচিত। দেখান নি?”
“দেখাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মনে হলো, ডাক্তার এর কোনো সুরাহা বের করতে পারবে না। তাই যে ডাক্তার সুরাহা করতে পারবে তার খোঁজে বেরিয়েছিলাম। এখন ব্যথাটা নেই বললেই চলে।”
মোহ চটে গিয়ে বলল,
“আমাকে বোকা পেয়েছেন? গ্রামে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন বললেই হলো!”
স্বচ্ছ একহাতে মোহের কপালের পাশে গুঁতো দিয়ে বলল,
“ওসব তোমার এই নিষ্ঠুর মস্তিষ্কে ঢুকবে না।”
মোহ মুখ বাঁকিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে দেখল। ঝড়ের বেগ কমার নাম নেই এখনো। এই মুহূর্তে স্বচ্ছকে যেতে দেওয়া অমানবিক কাজ হবে বটে। অপরদিকে দাদীজান বিষয়টা জেনে গেলেও যা-তা অবস্থা হয়ে যাবে। মাথায় জং ধরে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো মোহের। বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
“আপনি তো এই অবস্থায় কোথাও যেতে পারবেন না।”
স্বচ্ছ ইথানের পাশে ফট করে গা এলিয়ে শুয়ে নির্লিপ্তে বলল,
“যেতেই বা চাচ্ছে কে?”
মোহের ভ্রু দুটো বেঁকে গেল স্বচ্ছের এরূপ কথায়। স্বচ্ছ মুখ ফসকে বলে ফেলা কথা সামলাতে বলে ওঠে,
“মানে, ঝড় উঠেছে। আমি একটা অসুস্থ, দুর্বল মানুষ। কী করে যাব বলো?”
তপ্ত শ্বাস ছাড়ল মোহ। বলল,
“ঠিক আছে। আপনি এই ঘরে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি ইথানকে নিয়ে দাদীজানের কাছে যাচ্ছি। আর হ্যাঁ বাহিরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। ঘরের ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ করবেন না। মনে থাকবে?”
স্বচ্ছ হ্যাঁ বা না কিছুই বলে না। শুধু ঘরের আশপাশটা দেখে নেয়। ইটের পাকা ঘর। কোনো প্লাস্টার করা হয়নি। সামান্য লাইট কোনোরকমে জ্বলছে। উপরের ফ্যানও কতক্ষণ ঘুরবে ঠিক নেই। যা ঝড় উঠেছে কারেন্ট যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। সেই সাথে শক্ত চৌকিতে খানিকটা অসুবিধাবোধ করলেও প্রকাশ করেনা স্বচ্ছ। কথায় আছে, কিছু পেতে গেলে কিছু ত্যাগ করতে হয়। স্বচ্ছ না হয় মোহের দেখা পেতে এসে নিজের স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করল! মোহ আস্তে করে ইথানকে কোলে উঠিয়ে নেয়। বাচ্চাদের ঘুম বেশিই গাঢ় হয়। এতে সুবিধা বেশিই। অতঃপর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে বলে,
“যাচ্ছি তাহলে।”
মোহ পা বাড়ালেই হুট করে পিছু ডাকে স্বচ্ছ। উৎসুক হয়ে মোহ ফের ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালে স্বচ্ছ প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“তোমার ফোন বন্ধ রেখেছ কেন?”
মোহ সত্যি এড়িয়ে বলল,
“এমনিই। তাছাড়া আমার খোঁজ নেওয়ার তেমন কেউ নেই।”
“সেটা কী করে জানলে? যে কেউ নেই?”
“ওমনেই জেনেছি।”
স্বচ্ছ চাপা সুরে আওড়ায়,
“এমন তো হতেও পারে কেউ তোমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য উদ্ভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে? হতেও পারে তোমার ফোন বন্ধ পেয়ে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে? তোমার খোঁজ না পেয়ে পাগল প্রায় হয়ে গেছে! হতে পারে না?”
মোহ মৃদু হাসে। হাসিতে কিছুটা তাচ্ছিল্য মিশে ছিল তার। বলে,
“হতে পারে না এমন। কারণ আমার এমন বিশেষ কেউ নেই। এক বাচ্চার মা জানলেই নাক সিটকায় সকলে। তাই কারোর বিশেষ কেউ হওয়ার আশা করি না।”
মোহ চলে গেল। তবে তার কথাগুলো দ্বারা স্বচ্ছের মনকে বিভ্রমে ফেলে দিয়ে চলে গেল। স্বচ্ছ যখন মোহকে ভেবেছে তখন তার মস্তিষ্ক কখনো তাকে বাচ্চার মা হিসেবে ভাবেই নি। শুধু ভেবেছে এক জেদি নারী! এই আপসহীন রমনীর জন্য সে বিভোর হয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসার রঙ লেগেছে কি তবে?
বাবার সামনে মাথা নত করে বসে আছে সৌমিত্র। মুখ শুঁকিয়ে উঠেছে তার। বারবার তৃষ্ণা পাচ্ছে। একমাত্র সরোয়ার সাহেবের সামনেই দমে যায় সৌমিত্র। সরোয়ার সাহেব নির্লিপ্তে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন। একসময় শান্ত গলায় ছেলেকে প্রশ্ন করেন,
“তোমার ভাই গিয়েছে বললে যেন?”
সৌমিত্র নিচু সুরে বলল,
“বন্ধুর বাড়ি। আমাকে এটাই বলে গিয়েছে বাবা। এটাই জানি আমি।”
সরোয়ার সাহেব বড়ো শ্বাস নিয়ে সোফায় ঠেস দিয়ে বসলেন। হালকা হাসলেন। উনার হাসিতে যে বিপদ লুকিয়ে আছে সেটা ভালো করেই জানে সৌমিত্র। সরোয়ার সাহেব সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অংশ টেবিলে রেখে বললেন,
“আমি তোমাদের বাপ হই সৌমিত্র। রাজনীতিতে সারাদিন এদিকওদিক থাকি বলে তোমাদের দিকে আমার নজর থাকেনা এটা ভাবার দরকার নেই। তোমাদের প্রতিটা পায়ের ধাপ আমার নজরে থাকে।”
“বাবা আসলে…”
“স্বচ্ছ ওই শরীর নিয়ে গাজিপুরের একটা গ্রামে গেছে। কেন গেছে?”
সৌমিত্র জিহ্বা দিয়ে নিজের শুষ্ক ঠোঁট ভেজালো। ঢক গিলে বলল,
“বাবা ভাইয়া আসলেই জেনে নিও। আমি উঠি।”
সরোয়ার সাহেবকে শান্ত থাকতে দেখে দ্রুত পায়ে উঠে চলে গেল সৌমিত্র। সরোয়ার সাহেব আরেকটা সিগারেট ধরালেন। বড়ো ছেলের মতিগতি সুবিধার মনে হচ্ছে না উনার কাছে। কিছু একটা চিন্তা করে ফোন হাতে নিয়ে কাকে যেন কল করে বললেন,
“ইয়াকীন! কাল সন্ধ্যায় একবার আমার সাথে দেখা করবি। তোর জন্য একটা কাজ আছে আমার কাছে।”
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]