#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৫০
দেখতে দেখতে দিন পনেরো দেদারসে কেটে গেলো। তুরার পরীক্ষাও শেষের দিকে। আজকের পরীক্ষা টা দিতে পারলে হাফ ছেড়ে বাঁচে।
_টানা কয়েক ঘন্টা পরীক্ষা দিয়ে বেরলো তুরা আর ফারিহা, ফাইল টা হাতে নিয়ে বেরচ্ছিল,দুজনেই বেশ ক্লান্ত। এ কয়দিনে তুরার সাথে ফারিহাও পুরোদমে পড়াশোনা করেছে,যার দরুন আশানুরূপ ভালই হয়েছে প্রতিটি এক্সাম
-সাদমান কি চলে গেছে?
-তোকে বলেছি না ওর নামটাও আমার সামনে নিবি না?
তুরা ভারি প্রশ্বাস ফেললো। আর ভাল্লাগে না এভাবে, ফারিহা আর সাদমান তুরার জীবনের নিরবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে গেছে।দুজনের সাথে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা,সম্পর্কের গভীরতায় মিশে গেছে ও,এখন ওদের দুজনকে ছাড়া কিছুই আর ভালো লাগে নাহ।
এতগুলো দিন পার হয়ে গেলো,শুরুতে সাদমানের এড়িয়ে যাওয়াতে ফারিহা বেশ মনোক্ষুণ্ণ ছিলো,বার কয়েক চেষ্টা করেছে ওকে বোঝানোর, কথা বলার কিন্তু সাদমান যেনো নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে একেবারে,কিছুতেই ধরা দেয়না। অবশেষে ফারিহাও একই কাজ শুরু করলো, দুজন দুজনের সাথে কথা অব্দি বলে না কতগুলো দিন।
-আর কতদিন এমন করবি তোরা? হয়েছে টা কি সেটাই তো বুঝতে পারলাম নাহ
-তো সেটা তোর গুণধর বন্ধুকেই জিজ্ঞাসা কর গিয়ে। অনেক দেখেছি ওর ঢঙ আর নাহ। পেয়েছে টা কি,যা খুশি করুক, ওই একটা ছেমড়ি জুটাইছে না? ওই ফেচুন্নির সাথেই ঘুরুক!
বলেই দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরলো, তুরাও পা বাড়ালো ওর সাথে। এদের দুজনকে নিয়ে করবে টা কি!
বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে গেইট থেকে বেরলে সামনে তাকিয়ে দাঁড়াতে গিয়েও দাঁড়ালো না ফারিহা,বরং আরও জোর পায়ে হাঁটা শুরু করলো, তুরা ওকে কিছু বলবে তার আগেই সাদমান বলল
-আব,,পরীক্ষা কেমন দিলে তুরা?
চোখে মুখে বেশ জড়তা,এক হাতে ফাইলটা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে,ফারিহা এগোতে নিলে তুরা হাত ধরে থামালো,তাই গতি থামালেও তাকালো না ফারিহা।
-হ্যাঁ ভালোই দিয়েছি,তোমার কেমন হলো
-ভালো
ছোট জবাব সাদমানের,মুখাবয়ব জুড়ে অস্বস্তি, আর দোমনা ভাব, বার দুয়েক ফারিহার দিকে তাকালো আড়চোখে, কিন্তু ফারিহা ফোনের স্ক্রিনে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ আমতা-আমতা করে সাদমান বলল
-এখন কি বাড়িতেই ফিরবে?
-এসব আজাইরা পেচাল তাড়াতাড়ি শেষ কর,বাড়ি ফিরতে হবে আমাকে
তুরার জবাবের আগেই খিটমিট করে বলল ফারিহা, সাদমান তাকালো কিঞ্চিৎ চোখ ঘুরিয়ে, সে চোখে স্পষ্ট দুঃখ, ক্লেশের ছাপ। কিছু একটা বলতে নিলেও বলল নাহ যেনো।এরই মাঝে আবার একটা বাইক এসে থামলো ওদের সামনে,
টি-শার্ট আর নরমাল প্যান্ট পরা বেশ লম্বা চওড়া একটা ছেলে, ওকে দেখতেই ফারিহা গাল প্রসারিত করে হাসলো, তুরার দিকে তাকিয়ে বলল
-আমি তাহলে গেলাম তুরা,সাবধানে ফিরে যাস কেমন?
বলেই কালো রঙের বাইকটাতে চড়ে বসলো, আগন্তুক ছেলেটার কাঁধে হাত রাখতেই সাঁই করে বাতাসের বেগে তাল মিলিয়ে চলে গেলো দৃষ্টি সীমানার বাহিরে।
সাদমান নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলো ফারিহার যাওয়ার পানে,খানিক চেয়ে চট করে চোখ ফিরিয়ে নিলো, তুরার দিকে তাকাতেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাসলো মৃদু,তবে সেটা যে জোরপূর্বক হাসি তা চক্ষুগোচর হলো না তুরার,তবুও মুখে কিছু বলল নাহ।
-আচ্ছা তুমি আর দেরি করো না,আমিও আসি হ্যাঁ?
বলেই সৌজন্যবোধ দেখানো ভাবে হেসে পা বাড়াতে নিলে তুরা ওকে থামিয়ে বলল
-সাদমান? একটু দাঁড়াও
পা থামিয়ে তাকালো সাদমান,চোখে কিঞ্চিৎ কৌতূহল আর ঠোঁটে বিস্তর অস্বস্তি নিয়ে তাকালো। তুরা ওর দিকে চেয়ে কোনো রকম জড়তা ছাড়া স্পষ্ট করে বলল
-তোমার সাথে কিছু কথা আছে,তোমার কি সময় হবে?
-হ্যাঁ বলো না কি বলবে
সাদমান তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বলল,তুরা খানিক এগিয়ে এলো। রাস্তার পাশে নিরিবিলি একটা স্থানে দাঁড়ালো। সাদমান ও সাথে আসলে তুরা বলল
-তোমার কি হয়েছে বলো তো? বেশ কিছুদিন ধরেই দেখলাম তুমি বেশ আনমনা থাকো। আমাদের সাথে ঠিক করে কথা বলো না,স্পষ্টত এড়িয়ে চলো। ফারিহা বার কয়েক বলেছে আমায়,তোমার সাথেও কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু তুমি ওকে ও এড়িয়ে গেছো। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো একটু স্ট্রেসে আছো, বা আন্টির জন্য টেনসড। কিন্তু এতগুলো দিন পার হয়ে গেলো এখনতো ফারিহাও একই রকম ব্যবহার শুরু করেছে তাই আমি জোর দিয়ে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হচ্ছি,আসলে কি হয়েছে তোমাদের?
সাদমান নিঃশব্দে শুনলো তুরার কথা, মুখাবয়বে বিস্ময় প্রকাশ না হলেও তুরার প্রশ্নে সে বেশ ইতস্তত বোধ করছে সেটা ওর চোখেই দৃশ্যমান। তবুও তুরা আর চুপ করে রইলো নাহ। আবারও বলল
-তোমার এহেন আচারণের কারণ টা কি জানতে পারি? নাকি ফারিহার কথায় সত্যি ধরে নেবো যে আমাদের সাথে থাকতে তোমার আর ভাল্লাগে নাহ,বিরক্ত হও তুমি?
সাদমান হকচকালো। অপ্রতিভ দৃষ্টিতে তাকালো চট করে বলল
-না না কি বলছো,এমনটা আমি ভাবতেও পারিনা। তুমি তো জানো আমি তোমাদের ছাড়া কারো সাথে ঠিক করে কথাটাও বলতে পারিনা,আমার লাইফে মা আর ছোট বোন বাদে তোমরাই আছো,এমনটা ভুলেও নাহ।
খানিক থেমে নিজেই আবারও বলল
-আর ওই তিথি তো শুধু নোটস নেওয়ার জন্যে আমার সাথে দুদিন দেখা করেছিলো,এ বাদে ওর সাথে তেমন কিছুই না
শেষের কথাটা খানিক গলার স্বর নামিয়েই বলল।
তুরা আবারও সাবলীল স্বরে জিজ্ঞাসা করলো
-তাহলে এহেন আচারণের কারণ? আর এড়িয়ে চলাটা ফারিহার ক্ষেত্রেই বেশি করছ,তোমার ব্যবহার ও বেশ আহত,মুখে না বললেও স্পষ্ট বোঝা যায়
সাদমান মাথা ঝুকিয়ে নিলো। উত্তর দিতে যেনো অনিহার থেকে জড়তা বেশি৷ কথার মার প্যাচ ধরতে পারছে না, খানিক আমতা-আমতা করলো অস্থিরচিত্তে। তুরা ওর চেহারা টা ভালো মতো পরখ করলো,কি বুঝলো ওই জানে সাদমানের জবাবের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়ে বলল
-সমস্যা থাকলে থাক,উত্তর দিতে হবে নাহ। আমি কথাগুলো এভাবে বলতে চাইনি,তবে তোমাদের দুজনের হুট করেই এমন গুটিয়ে যাওয়ায় আমিও অনেক দুঃখ পাচ্ছি। ভার্সিটিতে বন্ধু বলতে তোমরা দুজনই।
থাক আজকে আসি এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে অনেকটা।
কিছু একটা বলতে গেলেও বলল না তুরা,অদ্ভুত একটা জড়তা কাজ করলো। ফাইলটা হাতে ধরে এগোতে নিলে পেছন থেকে সাদমানের ডাকে থেমে গেলো
-তুরা?
ঘুরে দাঁড়ালো।কিঞ্চিৎ ভ্রু উচিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দিয়ে তাকালে সাদমান আমতা-আমতা করে বলল
-ওই ছেলে টা কে ফারিহা যার সাথে গেলো?
মুখভর্তি জড়তা ঘিরে ধরলো সাদমানকে। এইটুকু প্রশ্ন করতেই যেনো মিইয়ে যাচ্ছিলো। তুরা স্থির তাকিয়ে রইলো খানিক।
-বলেছিলো তো ওর কোনো কাজিন এসেছে। হয়তো সেই হবে
ছোট জবাব দিলো তুরা,সাদমান আর কথা বাড়ালো না। তুরাকে বিদায় দিয়ে নিজেও হাঁটা ধরলো বাড়ির পথে, তুরা সাদমানের যাওয়ার পানে আহান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো। মাথার ভেতর তার কিছু একটা চলছে,হয়তো স্পষ্ট নাহ।তবে খুব গোজামিলে কিছু!
-বুড়ি,এখানে কি করছিস?
সুপরিচিত কণ্ঠস্বরে ঘুরে তাকালো তুরা, ফাইলটা এক হাতে চেপে এগিয়ে গেলো হাসি মুখে।
-এইতো একটু কাজ ছিলো। তুমি কি এখন বাড়ি ফিরবে ভাইয়া?
মাহিদ হাতের ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে চাবিটা বের করলো। এগিয়ে যেতে যেতে বলল
-হ্যাঁ, তবে তার আগে তোকে বাড়িতে ছেড়ে আসি চল
তুরাও দ্বিমত করলো নাহ। গাড়ির দরজা খুলে বসতে বসতে বলল
-আজকে তাড়াতাড়ি ফিরছো যে?
-হ্যাঁ আজ তো লাস্ট এক্সাম,আর ডিউটি ও ছিলো না আমার।
গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, তুরা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে, খানিক ক্ষীণমতি হয়ে বলল
-মানে আজকে কি সবারই তাড়াতাড়ি ছুটি?
মাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো একবার তুরার কৌতুহলী চেহারার দিকে, গাল ছড়িয়ে হাসলো
-সরাসরি বল না,তোর বর কখন ফিরবে সেটা জানতে চাইছিস
অপ্রস্তুত হলো তুরা,বেশ লজ্জাও পেলো। যতই হোক বড় ভাইয়ের সামনে এভাবে উনার কথা জিজ্ঞাসা করতেও কেমন লাগে। তবুও কপট রাগ দেখিয়ে বলল
-মোটেও না,আমিতো এমনিতেই জিজ্ঞাসা কিরলাম
-হ্যাঁ হ্যাঁ জানি তো। তোর বরের আজ ফিরতে দেরি হবে। ডিপার্টমেন্ট হেড বলে কথা,প্রফেসর সাহেবের আজ কাজ বেশি
ঠোঁট গোল করে ও বলল তুরা, তারপর চুপ করে কিছু একটা ভাবতে লাগলে মাহিদ বলল
-সমস্যা নেই,কাল থেকে ফ্রী আছে তোর বর, আঁচলে বেঁধে রাখিস মন মতো
তুরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো, লজ্জায় গাল গরম হলেও রাগ দেখিয়ে মাহিদের বাহুতে দুটো চা পড় বসিয়ে দিয়ে বলল
-তুমি প্রচন্ড বাঁদর ভাইয়া,খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু
হাহা করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো মাহিদ। তুরাকে আর ঘাটলো নাহ। মাঝ রাস্তায় একবার গাড়ি থামিয়ে পানি কিনে আনলো তুরার জন্যে। তারপর একবারে তুরাকে বাড়িতে রেখে আবারও ফিরে আসলো।
•••
ড্রয়িং রুমে বসে চিপস খাচ্ছে আর মুভি দেখছে তুরা আর রাইমা। চুমকি ফ্লোরে বসে সবজি কাটছে আর হা করে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে।
সময়টা প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সোফাতে বসে পা দুলাচ্ছে আর টিভি দেখছে তুরা। টি-টেবিলের উপর কফি আর ড্রাই ফুড ও রাখা।
আহান ফিরেছে সন্ধ্যার দিকে এসে নাস্তা করে ঘুমিয়েছে। তুরা একবার গেছিলো সন্ধ্যার দিকে, ডাকতে চেয়েছিলো তবে কি মনে করে ডাকেনি, লজ্জা কাটিয়ে উঠতে পারছেনা সে,আহান যতই স্বাভাবিক ব্যবহার করুক তুরা কিছুতেই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে পারছেনা। আহান যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকলেও তুরার ভাব ভঙ্গিতে বেশ জড়তা। আহানকে দেখলে আগে ঝগড়া করতে ইচ্ছে হত,কিন্তু এখন লজ্জা লাগে,শুধুই লজ্জা লাগে, হৃদযন্ত্রে ধুকপুক আওয়াজ হয়,মনে হয় আহানও হয়তো শুনে ফেলবে সেই শব্দ।
হঠাৎ করে দরজার বেল বেজে উঠতেই ধ্যান ভাংলো। রান্নাঘর থেকে রুবি খাতুনের গলা ভেসে এলো
-চুমকি দেখ তো মা কে এসেছে।
তুরা উঠতে গেলেও চুমকি ওকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই গিয়ে খুলল, দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলো এক মহিলা
দেখতে মাঝ বয়সীদের চেয়েও একটু বেশিই বয়স্ক। মোটাসোটা গড়নের। ভেতরে ঢুকেই এদিকে এগিয়ে আসলো, রাইমাকে দেখে বলল
-তুমি রাইমা না?
-জ্বি হ্যাঁ
খানিক হেসে উঠলো রাইমা। মহিলা আবারও বলল
-আমাকে চিনতে পেরেছ তো? আমি ওই তিন নম্বর গলির ফ্ল্যাটেই থাকি
-হ্যাঁ হ্যাঁ চিনতে পেরেছি, আপনি তো এর আগেও দুদিন এসেছিলেন আমাদের বাসায়
ভদ্রমহিলা যেনো খুশি হলো বিস্তর। সোফাতে বেশ আয়েসি ভঙ্গিতে বসে খোশমেজাজে বলল
-আগে তো এদিকে আসতাম প্রায়, হাঁটুতে যা ব্যথা বেড়েছে হাঁটতে পারিনা ঠিক করে, উঠতে গেলেই চিনচিন করে ওঠে। আর বাড়ি থেকেও বেরই না তেমন। আজ কি মনে করে হাঁটতে বেরিয়েছি একটু আর সন্ধ্যা হয়ে গেলো। তাই ভাবলাম এত দূর যখন এসেছিই তোমাদের সাথে দেখা করে যায়।
একদমে কথা গুলো বলল মহিলা, এর মাঝেই রান্নাঘর থেকে রুবি বেরিয়ে এলে উনাকে দেখে বলল
-আরে আপা,কেমন আছেন? এতদিন পর যে!
-এই আছি ভালো মন্দ দিয়েই। এতদিন পরেই আসলাম, কি আর করবো অসুস্থ হয়ে গেছি এখন আর সিড়ি বেয়ে চারতলা থেকে নামতে ইচ্ছে করে না আর এদিকেও আসা হয়না। আজকে এলাম তাই ভাবলাম একটু দেখা করে যাই
-যাক,ভালো করেছেন। আপনি এসেছেন খুব ভালো লাগলো। চুমকি আপার জন্য চা করে আন
রুবির কথার চুমকি মাথা নাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো। রুবি এগিয়ে এসে বসতেই ভদ্রমহিলা বলল
-তা আহান বিয়ে করেছে শুনলাম। ফ্ল্যাটের এক ভাবি বলছিলো। ওর বউ কই? আহানের বউকে দেখতেই তো এলাম
রুবি সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ালো। তুরাকে দেখিয়ে বলল
-ও তুরা, আহানের বউ
মহিলা এতক্ষণে তুরার দিকে তাকালো। এসে থেকে নিজেই বকবক করে যাচ্ছিলো।
তুরাকে দেখতেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলালো। চুমকি চা নাস্তার ট্রে এনে সামনে রাখলে মহিলা নিজে থেকেই চায়ের কাপ তুলে নিলো।
রুবি ইশারা করলে তুরা এসে বসলো পাশে।
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে আছে চুপচাপ, ভেতরে ভেতরে খুব অস্বস্তি হচ্ছে,কারণ যখন থেকে রুবি বলেছে তুরা আহানের বউ তখন থেকেই কেমন করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রাইমাকে উদ্দেশ্য করে বলল
-বাবাহ,রাইমাও তাহলে মা হতে চলেছে। বাহ বাহ,খুব ভালো লাগলো, বেঁচে থাকো
তুরা খানিক হতবাক হলো। মহিলার কথাবার্তা কেমন অদ্ভুত লাগছে। কেমন জেনো মুখের উপর সব বলে দেওয়া পাবলিক টাইপ।
অবশ্য রাইমার দৈহিক গড়নের পরিবর্তন হয়েছে অনেকটা,ফুলে ওঠা পেট দেখে যে কেও ই বলে দিতে পারবে সে সন্তানসম্ভবা। সাথে অনেক গুলুমলু ও হয়েছে, তুরার তো ইচ্ছে হয় বারবার রাইমার গাল দুটো টেনে দিতে।
-তা তোমার কি খবর,বিয়ে তো হয়েছে অনেকদিন ই শুনেছি
তুরা চকিত হয়ে তাকালো, উনার কথার কি জবাব দিবে বুঝতে না পেরে এলোমেলো ঘাড় দুলালো। মহিলা তার ভারি গলায় বলল
-তাহলে তুমি সুখবর কবে দিচ্ছ? বাচ্চা নিয়ে ফেলবা তাড়াতাড়ি, আজকাল কার পুরুষের ঘরে বউ থাকতেও বাইরে ছো মারার অভ্যাস আছে, যদিও আহান মোটেও সেরকম ছেলেদের মধ্যে পরেনা। তবুও স্বামীকে নিজের হাতে রাখার ফরমুলা হলো বাচ্চা। তাইলে স্বামী সবসময় ঘরমুখো ই থাকবে।
তুরার লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে,ইচ্ছে করছে মাটি ফাঁক করে ঢুকে যায় নয়তো এখান থেকে পালিয়ে যাই। শ্বাশুড়ি ননদের সামনে এধরণের কথা শুনে তাকাতে পারছে না মুখ তুলে৷
রুবি খাতুন অপ্রস্তুত হাসলো, এই মহিলার কথা পারার সকলেই জানে, যাকে তাকে যা তা বলে দেয়। কার বাড়ি কি হলো কার সাথে কার বিয়ে হলো কে চলে গেলো এসবের খবর রাখাই তার একমাত্র কাজ যেনো।
-তা আপনার বাড়ির সবাই কেমন আছে, সব ভালো তো?
রুবি খাতুন জিজ্ঞাসা করলো, উনিও তুরাকে আর কিছু না বলে গল্প শুরু করলো রুবির সাথে, হাফ ছেড়ে বাঁচলো তুরা। মহিলা আরও ঘন্টা খানেক গল্প করে তবে বেরলো,তবে যাওয়ার আগে তুরাকে ডেকে বলেছে
-শোনো মেয়ে, যে যাই বলুক তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিয়ে ফেলবা বুঝছ? তাহলে স্বামী আঁচলে আঁচলে থাকবে,যা বলবা শুনবে। আদর সোহাগ করতে এলে একদম বাঁধা দিও না কেমন? মনে রেখ স্বামীর এর ভালোবাসা বেশি বেশি পেতে হলে বাচ্চা দিতে হবে
তুরা শুধু ঘাড় নাড়িয়েছে প্রত্যুত্তরে, কেমন কঠিন কঠিন কথা বলে গেলো,শুরুতে লজ্জা পেলেও পরে মনে হলো একেবারেও খারাপ বলেনি মহিলা।
তবে সেসব আর বেশিক্ষণ মাথায় রাখলো না, আবারও টিভি দেখতে শুরু করলো রাইমার সাথে।
•••
থপ করে ফোনটা খাটের উপর রাখলো আহান,বেশ বিরক্ত লাগছে। তুরা মেয়েটাকে হাতের কাছে পাওয়াই যাচ্ছে না। এমনিই তো আসতে চাইনা আবার রাইমাকে পেয়ে সারাদিন ওর গলায় গলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
রাত এগারোটা বেজে গেছে অথচ ঘরে আসার নাম নেই। খানিক বসে থেকে উঠে দাঁড়ালো, ঘর থেকে বেরিয়ে রাইমার ঘরের দিকে গেলে দরজাটা আধখোলা দেখে নক করলো দরজায়।
-কে আহান,আই ভেতরে আই
রাইমার গলা আসলো ভেতর থেকে, আহান দরজাটা পুরো খুলে ঘরে ঢুকলে দেখলো রাইমা খাটে বসে ফোন টিপছে আর তুরা পাশেই শুয়ে আছে, শুয়ে বললে ভুল হবে ও তো ঘুমিয়ে আছে। আহান ভীষণ ক্ষুব্ধ হলো,তাকে অপেক্ষায় রেখে ঘুমানো হচ্ছে এখানে আরামে! ঘুমানো বের করছি।
চোখ মুখ স্বাভাবিক রেখে এগিয়ে গেলো সামনের বুকসেলফের দিকে,বেশ কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করে একটা বই বের করলো। বইয়ের পৃষ্ঠা খুলতে খুলতে আড়চোখে তাকাল রাইমার দিকে,
ও অন্যদিকে ঘুরে ফোন টিপটে ব্যস্ত, আহান পা টিপে আস্তে করে তুরার কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর কোমরে সজোরে একটা চিমটি দিয়ে তড়িৎ বেগে আবারও সরে আসলো
ঘুমের মাঝে পেটের কাছে খুব জোরসে লাগায় হুড়মুড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলো তুরা
-বাবাগো,মাগো আমার পেট ফুটো হয়ে গেলো গো..
তুরার আকস্মিক চিৎকারে ভড়কে গেলো রাইমা। ফোন রেখে ব্যস্ত স্বরে তুরাকে বলল
-কি হয়েছে তুরা,কি হলো চেঁচাচ্ছিস কেনো?
তুরা এখনো আহানের চিমটি দেওয়া জাগায় হাত দিয়ে ডলছে, খুব জোরেই লেগেছে,ইস ফুটো হয়ে গেলো পেট টা। আহানের ভীষণ হাসি পেলো তবুও ঠোঁট চেপে স্বাভাবিক গলায় বেশ গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল
-কি সমস্যা, এভাবে মাঝরাতে চেঁচাচ্ছ কেনো তুমি
আহানের ধমকানির স্বরে তুরা অসহায় চোখে তাকালো ওর দিকে, কাঁদো কাঁদো গলায় বলল
-আমার পেটে পিঁপড়ে কামড়ে দিয়েছে, খুব জোরে কামড়েছে ফুটো হয়ে গেলো আমার পেট
বলেই ভ্যা করে কেঁদে উঠলো, তুরার কান্না দেখে রাইমা বেশ অস্থির হয়ে এগিয়ে গেলো, ওকে ধরে বলল
-কোথায় লেগেছে দেখি, থাক কাঁদিস না বোন ঠিক হয়ে যাবে, আমিতো বিছানা ঠিক করেই ঝেরেছি,পোকা তো দেখতে পেলাম নাহ
আহান এবার ওদের কথার মাঝে বলল
-ভুলভাল স্বপ্ন দেখেছে হয়তো, ওর তো অভ্যাস আছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে বলে ভূত ওর পায়ে সুরসুরি দিয়েছে, আজ আবার পিঁপড়ের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে।
রাইমার হাসি পেলেও মুখ টিপে রাখলো, বেচারি কিভাবে কাঁদছে ও হাসলে নিশ্চয়ই কষ্ট পাবে। তুরাকে শান্তনা দিয়ে কিছু বলবে তার আগেই আহান বলল
-নিজে তো রাতভর হাত পা ছুড়াছুঁড়ি করবা আবার ভুলভাল কথা বলে অন্যের ঘুমটাও হারাম করবা
তুরার ভীষণ মন খারাপ হলো, সত্যিই পিঁপড়ে কামড়েছে তাকে,এখনো ব্যাথা করছে,জায়গা পেটে না হলে তো দেখিয়ে দিতো নিশ্চিত লাল হয়ে গেছে!
খানিক মুখ ভার করে বসে ভাবলো তবে তার ঘুমানো একেবারেই সুবিধার নয়, হাত পা ছুড়াছুঁড়ি করার অভ্যাসটা খুব তার, এমতাবস্থায় যদি রাইমার কোথাও লেগে যায়? ঘুমু ঘুমু চোখে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো তুরা
-আপু আমি বরং ও ঘরেই ঘুমাই,তুমি থাকো হ্যাঁ
বলেই ঢুলতে ঢুলতে বেরিয়ে গেলো। আহার ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বইটা ভাঁজ করে নিজেও বেরিয়ে গেলো
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
#Humu_♥️