প্রেম_প্রেম_পায় #স্বর্ণালী_সন্ধ্যা পর্ব চার

0
888

#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব চার

৪.
ফায়াদ হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করলো হাস্পাতালের। কেবিনে গিয়ে দেখলো অপরাজিতা ফোপাচ্ছে।তাকে দেখতে পেয়ে অপরাজিতা নার্স টাকে খুজছিল। ফায়াদ দেখলো অপরাজিতা বামহাতে প্লাস্টার করা। এবং ডান হাতে কিছুটা জখম হয়ে গিয়েছে।পায়েও হয়তো ব্যথা পেয়েছে।মেয়েটাকে দেখতে খুব দূর্বল লাগছে।যাকে কিশোর বয়স থেকে চাঞ্চল্যে দেখেছে তাকে চুপচাপ দেখলে হয়তো ভালো লাগে না। সেই প্রথম দেখার পর থেকে ফায়াদের সাথে অপরাজিতার প্রায়ই কোনো না কোন ভাবে দেখা হয়ে যেত।বাবার বন্ধুর আত্মীয় হওয়ার সুবাধে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও দেখা হয়ে যেত।দেখা হতে হতে কিভাবে যে মেয়েটা ফায়াদকে মন দিয়ে বসলো তা তার জানা নেই। তারপর তো তার পাগলামি শুরু যা এখনো পর্যন্ত বিদ্যমান।ফায়াদ কিছু বলে না এর জন্য আবার সায় ও দেয় না। সে আসলে কি চায় নিজেও বুঝার চেষ্টায় আছে।

ফায়াদ কিছুটা রাগ নিয়ে এগিয়ে গেল অপরাজিতার দিকে। ফায়াদকে রেগে তাকাতে দেখে অপরাজিতা চোখ বুজে মাথাটা অন্য দিকে ঘুড়িয়ে তাড়াতাড়ি করে বলল,
‘মারবেন না প্লিজ। এমনিতেই ব্যাথা পাইসি। আর ফোন চালাবো না রাস্তায়। তবুও মারবেন না!’

ফায়াদ জানতো এমনি কিছু হয়েছে। এই মেয়ের একটা বাজে অভ্যাস হচ্ছে রাস্তায় ফোন চালানো।সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে শান্ত স্বরে বলল,
‘এক্সিডেন্ট কিভাবে হয়েছে?’

শান্ত স্বর শুনে তো অপরাজিতার আরো ভয় লাগছে।অপরাজিতাকে কিছু বলতে না দেখে ধমকে উঠলো ফায়াদ,
‘বল না কেন?’

ধমক শুনে কেদে উঠলো অপরাজিতা। বাসায়ও বকা খাবে সে। কাদতে কাদতে বলল,
‘বকেন কেন? এমনিতেও বাসায় বকা খাবো।ব্যথা পাইছি তারউপর সবাই বকবে।ভালো নাই বাসলেন! আমার প্রতি কি একটু মায়াও লাগে না আপনার?আমি তো ভালোবাসি। কেমন নিষ্ঠুর দের মতো এসেই ধমকাচ্ছেন।আমার তো কষ্ট লাগে।আপনার সময় নষ্ট করেছি বলে বিরক্ত হচ্ছেন? তাহলে চলে যান৷আমিই বা কি করব আমার সবকিছুতেই আপনাকে মনে পড়ে তাই ডেকে ফেলেছি।আপনি চলে যান। লাগবে না কারো ভালোবাসা।লাগবে না কারো মায়া।’

বলেই ফুপাচ্ছে সে। শেষ কথাটায় যেন অভিমান ছিল।ভালোবাসা না পাওয়ার অভিমান।অপরাজিতার কথা শুনে ফায়াদ আর ধমকালো না।বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো অপরাজিতার পানে।তারপর নিঃশব্দে পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে ভাবে বলল,
‘বেশি ব্যথা পেয়েছো?’

অপরাজিতা ফুপাতে ফুপাতে বলল,
‘হুম’

‘কিভাবে হয়েছে এসব’

‘বাইক আসছিল সামনে থেকে। দেখি নি। বাইকওয়ালার চিৎকারে ছিটকে সরতে গিয়ে বা হাতের উপর বাজে ভাবে পড়ে গিয়েছি।’

ফায়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
‘আর কোথাও লেগেছে?’

‘না।’

‘বাসায় বলেছো?’

‘বকা দিবে।’

ফায়াদ নিজেই অপরাজিতার ফোন থেকে জানিয়ে দিল তার মা-বাবাকে। অপরাজিতার মা বাবা আসার আগ পর্যন্ত অপরাজিতার সাথেই রইল।সে নিজেও ডক্টর হওয়ার সুবাদে ডক্টরকে বলে আবার চেক করালো অপরাজিতাকে। সব কিছু বুঝে এসে অপরাজিতার পাশে বসলো।তার কিছুক্ষণ পর কেবিনে বেশ অস্থিরতা নিয়ে প্রবেশ করলো রামিসা বেগম এবং আসিফ ইসলাম। তাদের দেখে ফায়াদ একটু পিছনের দিকে সরে গেল।অপরাজিতার মা বাবা কেবিনে প্রবেশ করেই অপরাজিতাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। রামিসা বেগম রেগে বলছেন,
‘রাস্তা ঘাটে হাটার সময় চোখ কই থাকে তোর? চোখ কপালে তুলে রাখিস? কত বলি সাবধানে চলবি। আমার কথা তো ভাল্লাগে না। আমাকে অশান্তি না দিলে তো চলে না।’

আসিফ ইসলাম ব্যথিত স্বরে বললেন,
‘এগুলো কিভাবে হলো আম্মাজান? সাবধানে কেন চলো না।’

রামিসা রেগে উনাকে বললেন,
‘এই একদম দরদ দেখাবেন না৷ আপনার জন্য এই মেয়ে এতো আশকারা পাইছে৷ তিন বেলা যদি মাইর দিতাম তাহলে আর বাদরামি করতো না।’

অপরাজিতা মাথা নিচু করে কাদো কাদো হয়ে বলল,
‘বকো কেন? ব্যথা পাইছি তো।’

রামিসা আরো কিছু বলতে গিয়েও পারলেন না৷ সন্তানকে এরকম অবস্থায় দেখে উনার যে ভিতরটা জলে যাচ্ছে।কোনো মাকে যদি ফোন দিয়ে বলা হয় তার মেয়ে এক্সিডেন্ট করছে তাহলে তার অনুভূতি কেমন হতে পারে? রাগ দেখাতে গিয়ে কেদে দিলেন৷ মেয়েকে বুকে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘আমার ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে তোকে এভাবে দেখে।তুই একটু দেখেশুনে চললেই তো হয়। সকালেও ভালো দেখেছি। আর এখন হাতের কি অবস্থা!ইশ!’

আসিফ ইসলাম দেখছেন সে দৃশ্য। একেই বুঝি মা বলে! শাসনও করবে আবার ভালোও বাসবে।তারও ভিতরটা পুড়ছে। কিন্তু তাকে তো শক্ত থেকে সামলাতে হবে। তিনিও যদি স্ত্রী এর মতো কাদেন তাহলে পরিস্থিতি তো হাওয়ায় ভেসে যাবে। বাবাদের যে কঠোর হতে হয়।
আসিফ ইসলাম বেশ কিছুক্ষন পরে ফায়াদকে খেয়াল করলেন।ফায়াদকে দেখেই তিনি বললেন,
‘দেখেছো! ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে তোমার কথা ভুলেই গেছি।’

ফায়াদ ভদ্রতার সহিত বলল,
‘সমস্যা নেই আংকেল।আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না।’

‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা।মেয়েটার সাথে থাকার জন্য আর আমাদের জানানোর জন্য।’

‘ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবেন না আংকেল।’

‘ তোমাকে অনেক দিন পর দেখলাম। তোমার মা বাবা কেমন আছে?’

‘আছে আলহামদুলিল্লাহ। আংকেল আসেন বাহিরে কথা বলি।আর অপরাজিতার রিপোর্ট নিয়ে কিছু কথা আছে।’

তারা কথা বলতে বলতে কেবিনের বাহিরে চলে গেল। রামিসা বেগম সেদিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কি সুন্দর নম্র ভদ্র একটা ছেলে আবার ডাক্তারও।ইশ এমন একটা ছেলে যদি আমার থাকতো!’

মায়ের কথা শুনে অপরাজিতার মনে লাড্ডু ফুটছে । কিন্তু মায়ের পরবর্তী কথা শুনে লাড্ডু গুলোতে যেন পিপড়া ধরে গেল।

‘কত সুন্দর বড় ভাইয়ের মতো তোকে এতক্ষন আগলে রাখলো। তাই না?’

মায়ের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো সে।প্রতিবাদ করে বলল,
‘মা!! এমন ভাই আমার লাগবে না! ভাই তাও উনি? ইয়াক!আস্তাগফিরুল্লাহ!আল্লাহ মাফ করো।তওবা তওবা!’

রামিসা বেগক অবাক হয়ে বললেন,
‘আশ্চর্য তো এমন করছিস কেন?’

‘উফ মা কথা বলো না তো।তোমার আজগুবি কথা শুনে হাত ব্যথা বেড়ে গেছে লাগতেছে।’

‘সেকি!’

কেবিনে প্রবেশ করল ফায়াদ। রামিসা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আন্টি আংকেল নিচে গাড়ি দাড় করিয়েছে। আপনাদের যেতে বলেছে।অপরাজিতার সব আমি বলেছি আংকেলকে উনি আপনাকে বুঝিয়ে দিবেন।’

‘ধন্যবাদ বাবা।তুমি কত সুন্দর সামলে নিলে সবকিছু।’

অপরাজিতা মুখ ভেঙচি কাটলো। ফায়াদ দেখলো কিন্তু কিছু বলল না। রামিসা বেগম অপরাজিতাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। গাড়িতে সবাইকে উঠিয়ে দিল ফায়াদ। সকলকে বিদায় জানিয়ে সেও রওনা দিল বাসার উদ্দেশ্যে। বিকেলে বাসা থেকে বের হয়েছিল। এখন বাজে রাতের সাতটা।বাসায় পৌঁছাতে তার নয়টা বাজলো।কারন তার বাসা কিছুটা দূরেই। ক্লান্ত দেহ নিয়ে সোজা রুমে চলে গেল। আখি বেগম রুমে এসে ছেলেকে ক্লান্ত দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কিছু খেয়েছে নাকি। ফায়াদ মিথ্যা বলল।এমনিতেও তার গলা দিয়ে এখন খাবার নামবে না।
বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে অনেক সময় পেরিয়ে গেল। ঘুমেরা যেন বিদায় নিয়েছে আজ।দেহের সাথে মনটাও ভীষণ ক্লান্ত আজ। ভিতরটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে।কার জন্য এই অস্থিরতা? তবে কি মেয়েটার অসুস্থতা ছুয়ে দিল তাকে! সে কি ব্যথিত সেই অষ্টাদশীর ব্যথায়?

প্রথমবারের মতো ফায়াদ নিজে থেকে কল দিল অপরাজিতা কে। রিসিভ হলোনা।একবার..দুইবার..বেশ কয়েকবার কল দিল,কোনো রেসপন্স নেই। ঘুমাচ্ছে হয়তো ঘুমের ঔষধ খেয়ে।সেই বলেছিল ঘুমের ঔষধ খাওয়াতে নাহয় ব্যথায় ঘুমোতে পারবে না। কিন্তু মন তো মানছে না ফায়াদের।আজ মনে হচ্ছে হৃদয় টা বড্ড তৃষ্ণার্ত কারো আওয়াজ শুনার জন্য। আরও একটা রাত নির্ঘুম কেটে যাবে।স্বাক্ষী রয়ে যাবে অন্ধকার এই চার দেয়াল। ফায়াদের কানে বাজছে, ‘ ভালো নাই বাসলেন!’
আসলেই কি ভালোবাসে না সে? নাকি বাসে?মনটা এতো অবাধ্য কবে থেকে হলো।কতবার জিজ্ঞেস করেছে সে ভালোবাসে কিনা? কিন্তু মন যেন তাকে গোলকধাঁধায় রাখতে পছন্দ করে। সরাসরি উত্তর সে দিচ্ছে না। তার শাস্তি স্বরূপ ফায়াদকে আরো একটি রাত কাটাতে হচ্ছে কারো ভাবনাতে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here