তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম #তাহিরাহ্_ইরাজ #পর্ব_২৬

0
630

#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৬

মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ভেসে আসছে সুমধুর আযানের ধ্বনি। সময় হয়েছে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের। নিদ্রা হালকা হলো মেয়েটির। নিভু নিভু চোখে একটিবার তাকিয়ে নিজ অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলো। স্বল্পক্ষণেই বোধগম্য হলো সে কোথায় রয়েছে। কর্ণ কুহরে আযানের ধ্বনি পৌঁছাতেই বালিশের পাশে থাকা ওড়না নিয়ে মাথায় দিলো। ঠোঁট নাড়িয়ে জবাব দিতে লাগলো আযানের। আযান শেষ হতেই অধর কোণ প্রসারিত হলো। বাম পার্শ্বে তাকাতেই চোখের তারায় দৃশ্যমান হলো একান্ত মানুষটি। দু হাতের মধ্যিখানে তাকে কেমন করে আবদ্ধ করে রেখেছে! যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে। মানুষটিকে এখন যতটা নিশ্চিন্ত, নীরব দেখাচ্ছে গত রাতে ঠিক তার বিপরীত ছিল। সদা প্রাণবন্ত মানুষটির অধরে লেপ্টে ছিল অবর্ণনীয় খুশির রেখা। চোখেমুখে তৃপ্তির ছাপ! আর তা অবলোকন করে সে-ও যে প্রচুর প্রশান্তি অনুভব করছিল। কাছের মানুষটির সুখদুঃখ এভাবেই বুঝি বিপরীত জনে প্রভাব ফেলে! হয়তো হাঁ। এই মানুষটি তো ধীরে ধীরে তার কাছের, খুব কাছের একজন হয়ে উঠছে। যার হাসিতে খুশি সে। দুঃখে দুঃখ ভারাক্রান্ত! আচ্ছা ভালোবাসা নামক মহাব্যাধি কি এত সহজেই সংক্রমণ করে? তাদের বিয়ের বয়স তো মাত্র তিনমাস। এতেই দু’জনের হৃদয়ে ‘লাভ ট্রি’ বেড়ে উঠতে আরম্ভ করেছে! এ-ও সম্ভব? হয়তো হাঁ। চার বর্ণের ভালোবাসা যে বড্ড আনপ্রেডিক্টেবল! অভাবনীয়। কখন কিভাবে সংক্রমিত করবে জানা নেই কারোর। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় তার থেকে এই মানুষটির চাওয়া-পাওয়া, মুগ্ধতা, আকুলতা বড্ড বেশি। মাত্র তিন মাসেই এতখানি আকুলতা? নাকি এই আকুলতার পেছনে লুকায়িত ভিন্ন সত্য? জানা নেই।

উষ্ণ শ্বাস ফেলে তূর্ণ’র বাহুবন্ধনী হতে আস্তে ধীরে নিজেকে মুক্ত করে নিলো দুয়া। গলায় ওড়না জড়িয়ে উঠে বসলো। অর্ধাঙ্গের বাহুতে হাত রেখে আস্তে আস্তে ডাকতে লাগলো,

” শুনছো? ওঠো। আযান দিয়েছে। ”

” হুঁ। ”

অস্ফুট স্বরে জবাব দিলো তূর্ণ। ক্ষণিকের মধ্যেই আঁকড়ে ধরলো মেয়েটির কটিদেশ। শিউরে উঠলো দুয়া। শুকনো ঢোক গিলে একটু ঝুঁকে পড়লো। মানুষটির বাহুতে হাত বুলাতে বুলাতে ডাকতে লাগলো।

” শুনছো? আযান দিয়েছে। নামাজ পড়বে না? ওঠো। নামাজের সময় চলে যাচ্ছে তো। ”

ধীরে ধীরে নেত্রপল্লব মেলে তাকালো তূর্ণ। চক্ষুতারায় দৃশ্যমান হলো মাইরা’র মায়াবী বদন। মুচকি হাসলো তূর্ণ। হঠাৎই স্বল্প উঁচু হয়ে টুপ করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো ললাটে। তার হাসিতে সংক্রমিত হয়ে মেয়েটিও মিষ্টি করে হাসলো। লাজুক সে হাসি। তূর্ণ বিমুগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে দেখলো অধরে লেপ্টে থাকা হাসিটুকু!

দুয়া’র পরীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে তিনদিন পূর্বে। আপাতত সে ছুটি কাটাচ্ছে। আগামী সপ্তাহ থেকেই দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস আরম্ভ হতে চলেছে। ছুটি বলতে এই সপ্তাহটুকু ই। তাই তো নিজের মর্জি মাফিক দিন কাটাচ্ছে ননদ-ভাবী যুগল।
.

সাময়িক সময়ের জন্য কিচেন হতে বিতাড়িত তাসলিমা। কেননা আজ কিচেনে দায়িত্বরত ওনার আদরের পুত্রবধূ এবং কনিষ্ঠ কন্যা। ওনার ঠাঁই হয়নি। ওনাকে এক বাক্যে বলা হয়েছে ” তুমি রেস্ট নাও। ” ব্যাস।‌ কিইবা করার আছে? উনি চিন্তিত বদনে কিচেন ত্যাগ করলেন। দুই অনভিজ্ঞ পিচ্চি কিচেনের দায়িত্ব নিয়েছে। রান্নার নামে স’র্বনাশ না করে ফেলে? পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দুয়া এবং তৃষা।

” বেবি দুয়া! আজ কি তৈরি করবি রে? ”

” জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ। ”

তৃষা বিরক্ত হয়ে বললো, ” রাখ তো তোর ওয়াচ। বললে হয় টা কি? ”

” এক্সাইটমেন্ট নষ্ট হয়ে যায়। ”

” হ। ” ভেংচি কাটলো তৃষা।

দুয়া একটি চালনি হাতে নিয়ে তাতে বিটেন রাইস রাখলো। সিঙ্কের নিম্নে গিয়ে ভালোমতো চাল ধৌত করতে লাগলো। তৃষা কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে। দুয়া ধৌতকৃত চাল নরম করার উদ্দেশ্যে দশ মিনিটের জন্য রেখে দিলো একপাশে। তৃষা জিজ্ঞেস করলো,

” এবার কি করবি রে? ”

সিদ্ধ আলু দেখিয়ে দুয়া বললো,

” এগুলো ম্যাশ করবো। ”

” চমৎকার! দে দে আমায় দে। আমি ফটাফট করে ফেলছি। ”

তৃষা নিজ উদ্যোগে আলু ম্যাশ করতে এগিয়ে গেল। এই ফাঁকে দুয়া অন্যান্য উপকরণ কাটতে লাগলো। খানিক বাদেই শোনা গেল করুণ স্বর,

” বেবি? ম্যাশ ক্যামনে করে? ”

কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হলো দুয়া’র। ওর কাছ থেকে সিদ্ধ আলুগুলো নিয়ে ম্যাশ করতে লাগলো। আর দেখিয়ে বললো,

” এভাবে করে। বুঝেছিস? ”

” অফকোর্স বুঝেছি। এটাকে ম্যাশ বলে? আগে বলবি না? ”

দাঁত কেলিয়ে হাসলো তৃষা। দুয়া নিঃশব্দে হেসে উঠলো। একটি বাটিতে ছাঁকা আলু রাখলো। অতঃপর ভিজানো পোহা, গ্রেটেড গাজর, গ্রেটেড পনির বা চানা, স্বাদে নুন, কালো মরিচ গুঁড়ো, গরম মরিচ গুঁড়ো, কাটা আদা, কাটা সবুজ মরিচ, ধনিয়া পাতা এবং শেষ পর্যন্ত লেবুর রস যোগ করলো। ভালভাবে সংযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সমস্ত উপাদান মিশ্রিত করতে লাগলো। সহজ কাজ দেখে তৃষা উৎসাহী কণ্ঠে বললো,

” এটা সহজ আছে। আমায় দে তো। ”

” তুই আসলেই পারবি? নাকি আবার আকাম? ”

” এই না না। সত্যি পারবো। ”

সরে দাঁড়ালো দুয়া। প্রায় মিশ্রিত উপাদান ভালোমতো মিশ্রণ করে কাজ পূর্ণ করলো তৃষা। দুয়া মিশ্রণের একটি অংশ হাতে নিলো এবং প্রতিটিকে একটি কাটলেটে আকার দিতে লাগলো। এ দেখে তৃষা নিজেও কাটলেট তৈরি করতে চেষ্টা করলো। কিন্তু বেচারির হচ্ছে না ঠিকমতো। রাগে গজগজ করতে করতে কতক্ষণ গা’লমন্দ করলো মিশ্রণকে। সশব্দে হেসে উঠলো দুয়া। অবশেষে দু’জনে মিলেমিশে বেশ কতগুলো কাটলেট আকারে তৈরি করলো। বড় করে হাঁফ ছাড়লো তৃষা। মেয়েটা এতেই কাহিল।

দুয়া প্রতিটি পোহা কাটলেট একের পর এক ময়দার পেস্ট এবং তারপরে রুটির টুকরো টুকরো করে কোট করলো। তৃষাও বাকী কাটলেটগুলি একইভাবে প্রস্তুত করতে সহায়তা করলো। অতঃপর দুয়া সমস্ত কাটলেট তেলে ভেজে নিলো। ‘ভেজিটেবল পোহা কাটলেট’ প্রস্তুত‌। তৃষা সার্ভি প্লেট ধরে দাঁড়িয়ে। তাতে একে একে কাটলেট গুলো রাখলো দুয়া। কাটলেট এর সঙ্গী হিসেবে ঠাঁই পেল তেঁতুলের চাটনি।

তৃষা লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাটলেটের দিকে।

” ইয়াম্মি লাগছে রে বেবি। আমি খাবো। ”

তৃষা হাত বাড়াতেই দুয়া ট্রে সরিয়ে নিলো।

” একদম না। আগে বড়রা খাবে। তারপর আমরা। ”

” আরে বেবি একটু খাইতে দে না। এমন করোছ ক্যান? দেখি লবণ মরিচ ঠিক আছে কিনা। কম-বেশি হলে তো বড়রা পঁচা বলবে। ”

” তা-ও তুই পাবি না। ”

দুয়া জিভ দেখিয়ে ভেংচি কাটলো। অতঃপর ট্রে হাতে প্রস্থান করলো সেথা হতে। তৃষা বিড়বিড় করে বললো,

” শ*তান মাইয়া। এক পিসও খাইতে দিলো না। ”
..

গোধূলি লগ্ন। লিভিং রুমে বসে আলাপচারিতায় লিপ্ত পরিবারের সদস্যরা। নিজাম সাহেব এবং নাজমুল সাহেব ব্যবসায়িক আলাপ করছিলেন। তাসলিমা এবং আনোয়ারা বেগম আরেক সোফায় বসে। তূর্ণ এবং নিশি পাশাপাশি বসে একই মোবাইলে ভিডিও দেখছে। তখনই সেথায় উপস্থিত হলো দুয়া।

” ট্যান ট্যানা। নাস্তা হাজির। ”

সকলে তাকালো দুয়া’র দিকে। দুয়া মিষ্টি হেসে টি টেবিলের ওপর স্ন্যাকস্ এর ট্রে রাখলো। আনোয়ারা বেগম মুচকি হেসে বললেন,

” আরে নানুভাই? এ কি দেখছি? আজকের নাস্তা তোমার বানানো? ”

দুয়া কিছু বলার পূর্বেই ছুটে এলো তৃষা। বাংলা সিনেমার মতো চেঁচিয়ে প্রতিবাদ জানালো,

” নাহ্! ”

হতবিহ্বল সকলে। তৃষা লাজুক হেসে মিনমিন করে বললো,

” ওর সাথে আমিও ছিলাম। ”

তূর্ণ প্রশ্ন করে বসলো,

” শুধুই সাথে ছিলি? নাকি হাতও লাগিয়েছিস? ”

” অফকোর্স লাগিয়েছি। এই বে.. থুক্কু ভাবি। বল আমি ছিলাম না? ”

দুয়া দাঁত কেলিয়ে হাসলো।

” আমি কি জানি? আমি তো নাস্তা বানানোয় বিজি ছিলাম। ডানে বায়ে অত দেখিনি। ”

তৃষা ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

” জীবনে প্রথমবারের মতো রান্নার ব্যাপারে ক্রেডিট পাওয়ার সুযোগ পেলাম। সেইটাও কেড়ে নিবি? ”

দুয়া হেসে চলেছে। তৃষা বিড়বিড় করে কিছু ছোট্ট অভিশা*প দিলো। এই যেমন: ভাই ভাবী যেন ক্রিকেট টিমের প্যারেন্টস্ হতে পারে।

দুয়া সকলের হাতে ভেজিটেবল পোহা কাটলেট তুলে দিলো। তূর্ণ’র হাতে দিতেই সে মিনি প্লেটে থাকা কাটলেট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,

” রেসিপি কি রে? করলার তৈরি না তো? খাওয়া যাবে?”

দুয়া কটমট করে তাকিয়ে জবাব দিলো,

” তোমার জন্য স্পেশাল মিষ্টি করলা দিয়ে বানিয়েছি। অনেক মজা। খাও খাও। ”

তূর্ণ নাকমুখ কুঁচকে ফেললো। এমন ভাব যেন পৃথিবীর সবচেয়ে অখাদ্য ওকে খেতে দেয়া হয়েছে। দুয়া তাতে পাত্তা না দিয়ে নিশি’র হাতে কাটলেট তুলে দিলো।

” আহা হা! মাশাআল্লাহ্! কি মজা হয়েছে মামণি! কাটলেট তো নয় যেন অমৃত। ”

বাবার ভুল শুধরে দিলো তূর্ণ।

” আব্বু এটা স্পাইসি ডিশ। তোমার মিষ্টি ডিশ নয় যে অমৃত বলছো। ”

থতমত খেলেন নিজাম সাহেব। আমতা আমতা করে বললেন,

” মি মিষ্টি! আমার মিষ্টি ডিশ মানে কি? হাঁ? ”

” কেন? ভুলে গেলে? রোজ দু-টো গোলাকার সাদা কালো মিষ্টি। হুঁ? ”

খুকখুক করে কাশতে লাগলেন নিজাম সাহেব। তাসলিমা স্বামীর পানে গরম চাহনিতে তাকিয়ে। ডায়বেটিকস এর রোগী কিনা রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে দু’টো মিষ্টি লুট করছে! নিজাম সাহেব স্ত্রীর চাহনি লক্ষ্য করে ছেলেকে চোখ গরম দিলেন। কিন্তু তূর্ণ মহাশয় তা দেখলে তো? সে তেঁতুলের চাটনি মেখে কাটলেট খেতে ব্যস্ত। ইতোমধ্যে তিনটে খাওয়া শেষ। চতুর্থ পিস হাতে। সকলেই দুয়া’র প্রশংসা করলো। একমাত্র তূর্ণ বাদে। সে পঞ্চম পিস হজম করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললো। সকলের অগোচরে তাকালো অর্ধাঙ্গীর পানে। চোখে চোখ পড়তেই চোখ টিপে দিলো তূর্ণ। হকচকিয়ে গেল দুয়া! বক্র হাসলো মানুষটি। তাতেই প্রশংসা অনুধাবন করে লজ্জা মিশ্রিত হাসলো দুয়া।

” সত্যিটা আর কতটা লুকাবেন ফুফু আম্মা? এবার তো মুখ খুলুন। সে রাতে কি হয়েছিল এ টু জেড বলুন। উই আর ইগারলি ওয়েটিং। বলুন বলুন। ”

আঁটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ। চরমভাবে ধ*রাশায়ী করেছে ফুফু শাশুড়িকে। কি হতে চলেছে এবার? অবশেষে বিবাহ রহস্য উদঘাটন হতে চলেছে কি?

চলবে.

[ পর্বটি একটু ছোট হয়েছে। আগামী পর্বে হতে চলেছে রহস্য উদঘাটন। সকলে প্রস্তুত তো রহস্য উ*ন্মোচন করতে? ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here