#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩
সিনথি আপুর হলুদ সন্ধ্যা। অতিথিরা সকলে চলে এসেছে। শুরু হয়ে গিয়েছে অনুষ্ঠান। একে একে পরিবারের সদস্যরা সকলে আপুকে হলদে রাঙা করে দিলো। এবার আমার আর তৃষার পালা। লেহেঙ্গা সামলিয়ে দু’জনে গিয়ে দাঁড়ালাম আপুর সম্মুখে। ইশ্! হলদে আভায় আপুকে মাশাআল্লাহ্ কি সুন্দর লাগছে! কারোর নজর না লেগে যায়! বিয়ে ঠিক হওয়ার পর সব মেয়ের সৌন্দর্য ই কি এভাবে বৃদ্ধি পায়? বোধহয় হ্যাঁ। আমি হলুদের বাটি হতে দু হাতের আঙ্গুলে হলুদ মেখে নিলাম। প্রথমে তৃষা অতঃপর আমি। আপুর নরম তুলতুলে দু কপোলে আলতো করে হলুদ বাটা মেখে দিলাম। তৃষার দুষ্টু কথায় লাজুক হেসে উঠলো আপু। আমি মুগ্ধ নয়নে অবলোকন করলাম সে লজ্জা মিশ্রিত হাসি।
আপুকে হলুদ ছুঁয়ে দিয়ে আমরা দুজনে এক পাশে সরে দাঁড়ালাম। দেখতে লাগলাম চারিদিক। হঠাৎ আমার নজরে পড়লো আমার বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক। হলুদ পাঞ্জাবি পরিহিত যুবকের হাতে দামী ক্যামেরা। একটু পরপর সে ফটো তুলছে। আর আমি যদি ভুল না হয়ে থাকি তবে সে আমার ফটোই তুলছে। এ কেমন অভদ্র আচরণ! বিনা অনুমতিতে একটি মেয়ের ফটো তুলছে! বিন্দুমাত্র বোধ নেই? মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। কিন্তু সকলের উপস্থিতিতে অভদ্র আচরণ করা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ। তাই দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম। সে শুধু আরেকবার ফটো ক্লিক করুক তখন আমি..! আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো সম্মুখে অতি সন্নিকটে পুরুষালি উপস্থিতিতে। হকচকিয়ে গেলাম আমি! তূর্ণ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আমার সামনে। উনি মোবাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই আমাদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
” নিশি ওরা ওদিকে তোদের খুঁজছে। ফটাফট ওদের কাছে যা। ”
” আচ্ছা ভাইয়া। ”
সম্মতি জানিয়ে তৃষা আমার হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। গন্তব্য নিশিপু আর তার দলবল। হাঁটতে হাঁটতে একবার অবশ্য পিছু ঘুরে তাকালাম। কিছুটা অবাক হলাম তূর্ণ ভাইয়ার কর্ম দেখে! সে ওই ছেলেটার কাছে যাচ্ছে কেন? স্বল্প সময়ের মধ্যে বিষয়টা বোধগম্য হতেই এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠল অধর কোণে। নিশ্চিন্তে তৃষার সাথে পা বাড়ালাম।
•
আঁধার রজনী। হলুদের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়েছে ঘন্টা দেড়েক আগে। এই মুহূর্তে আমরা মেয়ে কাজিনরা মিলে আড্ডায় মেতে উঠেছি। বিছানায় গোলাকার হয়ে বসে আছি আমি, তৃষা, নিশিপু, সিনথিপু আর বড়াপু। সকলের মধ্যমণি হবু কনে সিনথিপু। নিশিপু দুষ্টু কণ্ঠে বলে উঠলো,
” সিনথিপু! তোমাকে আজকে হলুদের অনুষ্ঠানে যা লাগছিল না! একদম চোখধাঁধানো সৌন্দর্য যাকে বলে। তা বলছি হবু জিজু ফটো পেয়েছে? নাকি বেচারা বউয়ের ফটোর অভাবে অনাহারে ভুগছে? ”
সশব্দে হেসে উঠলাম সবাই। নিশিপু যেমন টোনে বললো, না হেসে উপায় আছে কি? সিনথিপু লাজে রাঙা হয়ে বললো,
” ধ্যাৎ! তোরা যে কি শুরু করেছিস না? সেই সন্ধ্যা থেকে শুধু লজ্জাই দিয়ে যাচ্ছিস। ”
তৃষা কিছু বলার পূর্বেই আমি বলে উঠলাম,
” আজ তো সবে শুরু। এরপর বিয়ে, রিসিপশন পার্টি সর্বশেষ তোমাদের মধুমাখা মধুচন্দ্রিমা! লাজে লাজে হতে চলেছে তোমার দি ওয়েডিং সাগা। ”
তৃষা হাসিমুখে সম্মতি পোষণ করে বললো,
” একদম। আজ তো শুধু তোমায় লজ্জা দিচ্ছি। কাল বিয়ে। আসুক আমাদের জিজু। ওনাকে বুঝিয়ে দেবো লজ্জা কত প্রকার ও কি কি। ”
তৎক্ষণাৎ আপত্তি জানালো সিনথিপু।
” খবরদার! ওনার সাথে অত ফাজলামি করবি না কিন্তু। ”
বড়াপু হাই তুলে বললো,
” কি দিনকাল এলো রে! বিয়ে হতে না হতেই বরের তরফদারগিরি শুরু! ”
সিনথিপু লাজে মুখখানি নত করে ফেললো। মিনমিনে গলায় বললো,
” তুমিও তো বিয়ের আগে এমন করেছিলে। ”
” বুইন রে তোর মতো এত করিনি। আর তোদের রিশাদ ভাইয়াও তোর জনের মতো এত পা’গলপ্রেমী ছিল না। ”
চকিতে চমকালাম আমরা! আমি তৎক্ষণাৎ ন্যা কা আহাজারি করে বললাম,
” ওহ্ মাই আল্লাহ্! এসব কি শুনছি? আমার কানে কি ময়লা জমেছে? না মানে আমি ভুলভাল কি শুনছি? রিশাদ ভাইয়া নাকি পা’গল প্রেমী ছিল না! ও এম এ! ”
বড়াপু ফটাফট আমার বাহুতে লাগিয়ে দিলো গাট্টা।
” ড্রামাবাজ! বড় বোনের সাথে ফাজলামি হচ্ছে? ”
নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলাম আমি। ডান কাঁধ হতে চুল সরিয়ে ভাব নিয়ে বললাম,
” ইহা ফাজলামি নয়। একদম হাচা কথা। এখানকার সকলে সাক্ষী। কি রে তৃষা বল। ”
তৃষা সাথে সাথে বললো,
” সাক্ষী মানে? আমরা তো রাজসাক্ষী। রিশাদ ভাইয়া যে রোমান্টিক ছিলো। ছিলো বলছি কি? এখনো আছে। সে তো বিয়ের সময়.. ”
আর বলা হলো না। বড়াপুর চোখ রাঙানি দেখে তৃষা ফুস! মুখ টিপে হেসে উঠলাম। নিশিপু এতক্ষণ নীরব দর্শক ছিল। সে যেই না কিছু বলতে যাবে ওমনি আমাদের টায়ার পাংচার! এই রে খালামণি আসছে!
” তানজি! নিশি! এই কোথায় তোরা? ”
ডাকতে ডাকতে খালামণি হাজির। চমকে গেল সে! কেননা ভদ্র বাচ্চার ন্যায় আমরা বিছানা এবং ফ্লোরে নিজ নিজ শোবার স্থান দখল করে শুয়ে রয়েছি। খালামণি ছোট ছোট চোখ করে বললো,
” সব কয়টা একসাথে! এখুনি রুমের লাইট বন্ধ চাই। তাড়াতাড়ি সব ঘুমিয়ে পড়। কাল বিয়ে মনে আছে কি? রাতভর আড্ডা দিলে নববধূ তো ঘুমের ঘোরে দুলতে দুলতে বিয়ের আসরে যাবে। সেটা কি খুব ভালো হবে? ”
আস্তে ধীরে না বোধক মাথা নাড়ালাম আমরা।
” মনে থাকে যেন। এখন সব কয়টা ঘুমিয়ে পড়। গুড নাইট। আল্লাহ্ হাফিজ। ”
খালামণি নিজেই রুমের আলো নিভিয়ে দিলো। অতঃপর দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। বড় শ্বাস ফেলে আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম। হায়! কি আর করার? বন্ধ করে নিলাম চক্ষু জোড়া। ইটস্ স্লিপিং টাইম!
•
সকাল সকাল হৈচৈ! বিরক্ত বোধ করে ঘুমকাতুরে আমি দেহে কাঁথাটা আরো ভালোমতো জড়িয়ে ডান কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম। কি সুন্দর খাবারদাবার ভাসছে চোখের পর্দায়! আকস্মিক ধাক্কা! ভেঙে চুরমার হয়ে গেল আমার স্বপ্নটা। অসম্ভব রাগ নিয়ে চোখ মেলে তাকালাম আমি। নয়নতারায় বন্দি হলো তৃষার দাঁত ক্যালানো হাসি। মেজাজ আমার বিগড়ে একশো আশি হলো। কাঁথাটা ছিটকে পাশে ফেলে দিলাম। বসলাম উঠে। তৃষা যেই না কিছু বলতে যাবে মা”রলাম ওর পিঠ বরাবর শক্তপোক্ত এক ঘু ষি! কঁকিয়ে উঠলো মেয়েটা। ক্ষ্যা পা কণ্ঠে বললো,
” ওই ছে ম ড়ি! গায়ে বেশি জোর হইছে? দিলি তো আমার সুন্দর মসৃণ পিঠটা ভাইঙ্গা। ”
” ভাঙ্গছি। বেশ করছি। তুই যে আমার সাধের ঘুমটা ভেঙে দিলি? তার বেলায়? ”
” ভাঙ্গমু না তো কি করমু? মামিজান রুটি বেলুনি হাতে তেড়ে আসছে। বাঁচতে চাইলে ফটাফট উঠ। ”
কিহ্! মামি তেড়ে আসছে! ইন্না লিল্লাহ! আমাকে আর পায় কে? দ্রুততম গতিতে উঠে পড়লাম। তৃষার সহায়তায় গুছিয়ে ফেললাম ফ্লোর বেড। ইতিউতি না করে পোশাক নিয়ে ছুটলাম ওয়াশরুমে।
___
তাড়াহুড়ো করে ডাইনিং রুমে এসে বসলাম। শূন্য রুম। সকলের খাওয়া-দাওয়া শেষ। শুধু আমিই বাকি। ইশ্! আম্মু যদি একবার জানতে পারে না? আমার পিঠে কাঠ ভাঙ্গবে! হাতে মোটেও সময় নেই। কেউ যে খাবার বেড়ে দিবে তা তো দুঃস্বপ্ন! কিইবা করার আছে? নিজে নিজেই বেড়ে নিতে হবে। আমি যেই না প্লেটে ভাত নিবো অমনি আমার বাম পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো কেউ। আকস্মিক এমন হওয়ায় কেঁপে উঠলো অন্তর আত্মা! বুকে থু থু ছিটিয়ে বামে তাকালাম। ওমনি মেজাজের দফারফা! তূর্ণ ভাইয়া! তাই তো বলি এমন কুকর্ম কে করতে পারে? তূর্ণ ভাইয়া অবাক চাহনিতে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন। এহেন চাহনিতে বিব্রত বোধ করলাম। দৃষ্টি সরিয়ে মৃদু স্বরে বললাম,
” এভাবে কি দেখছো? ”
” তোকে। ”
চমকে তাকালাম তার দিকে। আমাকে দেখছে! আমাকে আবার দেখার কি আছে? নতুন দেখছে নাকি? মনের কথা মনে চেপে না রেখে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,
” আমাকে দেখার কি আছে? নতুন দেখছো নাকি? ”
” জ্বি না। তোকে নতুন দেখার কি আছে? তোকে তো সেই শিশুকাল থেকেই দেখে আসছি। ”
” আচ্ছা? তাহলে কি দেখেছিলে? ”
তূর্ণ ভাইয়া চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। ঘামে ভেজা শার্ট কাঁধ থেকে সামান্য সরিয়ে দেহে বাতাস ছুঁয়ে নিতে নিতে বললেন,
” দেখছিলাম তোর আশ্চর্যান্বিত আরেক রূপ! মানে তোর মতো কুমড়োপটাস, অকর্মার ঢেঁকি কিনা নিজে নিজে খাবার বেড়ে খাচ্ছে! ও আল্লাহ্! এ দিন দেখার আগে আমায় অন্ধ করে দিলে না কেন? ”
ওপর দিকে তাকিয়ে কথাটা শেষ করলেন উনি। আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
” আমি কুমড়োপটাস? অকর্মার ঢেঁকি? তাহলে তুমি কি হাঁ? আস্ত এক দেশী খোসায় বিদেশি প্রোডাক্ট। ”
আমার কথা শুনে তূর্ণ ভাইয়া বুঝি আকাশ থেকে ধপাস করে পড়লো। অবাক চাহনিতে বললো,
” আমি দেশী খোসায় বিদেশি প্রোডাক্ট? ”
” একদম। কোনো সন্দেহ নেই। ”
” পুতলা রে! তোর মুখটা আজকাল বড্ড চলছে। গুরুজনদের সম্মান করে কথা বলতে হয়। জানিস না? ”
আমি ব্যাঙ্গ করে বললাম,
” জ্বি জানি। কিন্তু তুমি বোধহয় জানো না ছোটদের কেও স্নেহ করতে হয়। ”
” কে বলেছে জানিনা? অফকোর্স জানি। ছোটদের স্নেহ করতে হয়। পাশাপাশি আদরও করতে হয়। তো আয় বাবু আয়। তোকে আদর করে দিই। ”
তূর্ণ ভাইয়া দুই হাত দু’দিকে ছড়িয়ে আমাকে আহ্বান করতে লাগলো। ছিঃ! এ তো নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মা রা হলো! তড়িৎ বেগে চেয়ার ত্যাগ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। উনি ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে আমায় শুধোলেন ‘কি?’.
” নাথিং! ”
মেজাজ খারাপ করে দিয়ে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কি! আমি আর অহেতুক কথা বাড়ালাম না। নিজের প্লেটে ভাত ও সবজি নিয়ে ওখান থেকে চলে যেতে উদ্যত হলাম। কেননা এখানে থাকলেই অশান্তি। যেই না ডাইনিং ত্যাগ করবো অমনি শুনতে পেলাম তূর্ণ ভাইয়ার কণ্ঠ।
” এই পুতুল! আমার খাবার সার্ভ করে দেবে কে? কুমড়োপটাস! এই? ”
আমি আর দাঁড়ালাম না। গজগজ করতে করতে চলে গেলাম ওখান থেকে। মহাশয় এখন একাকী বসে বসে সারেগামাপা করুক!
চলবে.
[ আসসালামু আলাইকুম পাঠক বন্ধুরা। সবে মাত্র গল্প শুরু হয়েছে। কাহিনী পুরোপুরি বিন্যাস হতে কয়েক পর্ব তো লাগবেই। আশা করি পাঠকরা ধৈর্য ধরে গল্পটি পড়বে এবং তাদের ভালো লাগবে ‘ তুমি হৃদয়ে লুকানো প্রেম ‘. ]