কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন #পার্ট_৩৭

0
590

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৩৭
জাওয়াদ জামী

টেনশন নিতে না পেরে জ্ঞান হারায় আরমান। ওকে নেয়া হয় কেবিনে। ডক্টর এসে চেইক করে জানায়, সমস্যার কিছু নেই। অতিরিক্ত টেনশনে তার এই অবস্থা।

শ্রীজা ভাইয়ের বেডের কাছে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ওর এই মুহূর্তে ভিষণ হাসি পাচ্ছে। কিন্তু আরমানের যেকোন সময় জ্ঞান আসতে পারে ভেবে সেই ইচ্ছেকে জলাঞ্জলী দেয়।

জ্ঞান ফিরলে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে আরমান। কতক্ষণ সে এভাবে বিছানায় শুয়ে আছে!
আরমানকে উঠতে দেখে কেবিনে থাকা নার্স নড়েচড়ে বসে।

আরমানকে হাতের ক্যানুলা খুলতে দেখে নার্সটি কথা বলে।

” স্যার, এভাবে খুলছেন কেন? আপনার স্যালাইন এখনও শেষ হয়নি। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, স্যার। ”

” আপনি আমাকে খুলতে সাহায্য করুন। নইলে আমি এসব ছিঁড়ে ফেলব। আমাকে আমার স্ত্রীর কাছে যেতে হবে। ” আরমানের গুরুগম্ভীর গলার কথা শুনে নার্সটি আর কথা বাড়াতে সাহস পায়না। সে চুপচাপ আরমানের হাতের ক্যানুলা খুলে দেয়।

আরমান কেবিন থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে আসে। ওকে বেড়িয়ে আসতে দেখেই ওর ছোট মামা সেখানে এসে দাঁড়ায়।

” তুমি এভাবে উঠে আসলে কেন! স্যালাইন তো এখনও শেষ হয়নি! আমি মাত্রই তোমার কেবিন থেকে বের হয়েছি, আর এই সুযোগে তুমি এমন কান্ড ঘটালে! ”

” মামা, কান্তা কোথায়? ও কেমন আছে? ”

আরমানের মামা বুঝতে পারে তার ভাগ্নেকে এবার আর আটকে রাখা যাবেনা।

” এস আমার সাথে। ” বলেই আতিক সাহেব তার ভাগ্নেকে নিয়ে সামনে হাঁটা ধরলেন।

আরমানকে নিয়ে তিনি এসে দাঁড়ালেন অন্য একটা কেবিনের সামনে। আরমানকে ইশারা করতেই সে কেবিনের দরজা খুলে হন্তদন্ত হয়ে ঢোকে।

আরমানকে ঢুকতে দেখে সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। সবাই ভাবছে, এই ছেলেটাকে স্যালাইনের সাথে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছে। এখনই তার ঘুম ভাঙ্গার কথা নয়। কিন্তু সে এখন ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কিভাবে সম্ভব!

সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখেও আরমান পরোয়া না করে এগিয়ে যায় বেডে শোয়া কান্তার দিকে। তার আগেই ওর সমানে এসে দাঁড়ায় শ্রীজা।

” ভাইয়া, এই নাও তোমার প্রিন্সেসকে। একদম তোমার কার্বনকপি। দেখ কেমন ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে আছে। ”

শ্রীজার বাড়ানো হাতের দিকে তাকিয়ে থমকে যায় আরমান। একটা ছোট্ট পুতুল শ্রীজার কোলে হাত-পা নাড়ছে। ওকে দেখে আরমানের পা কাঁপছে। আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসছে ওর গলা। চোখ কোনে জমা হয় পানি। সৃষ্টিকর্তা ওর চাওয়া পূরণ করেছে! অবশেষ মা এসেছে ওর ঘরে! যাকে সে মেয়ের রূপে পেতে চেয়েছিল।
কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়েকে কোলে নেয় আরমান। ছোট্ট করে চুমু দেয় মেয়ের কপালে। আর তাতেই সেই পুতুল ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠে। আরমান চমকে তাকায় শ্রীজার দিকে। ওর মনে প্রশ্ন জমা হয়, ওর স্পর্শে প্রিন্সেস হঠাৎ কেঁদে উঠল কেন? ভাইয়ের চোখে ভাষা বুঝতে পেরে ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে শ্রীজা।

” চিন্তা করোনা, ভাইয়া। পুতুলে ক্ষুধা পেয়েছে, তাই কাঁদছে। তুমি ওকে নিয়ে ভাবির কাছে যাও। ”

আরমান প্রিন্সেসকে নিয়ে ধীর পায়ে কান্তার কাছে যায়। কান্তা ওকে দেখে মিটমিটিয়ে হাসছে। সেই সাথে কেবিনের সবারই ঠোঁটে হাসির রেখা। সবাই ভাবছে, এই ছেলেটা এত বউ পাগল কি করে হয়েছে!
এবার আরমান কেবিনের বাকি সবার দিকে নজর দেয়। ওর মামী, খালা ও আকলিমা খানম সবাই মুখ টিপে হাসছে।

” মা’কে পেয়ে কেমন বোধ করছ, আরমান? তোমার মেয়ে একদম তোমার মতই হয়েছে। তুমিও ছোটবেলায় এমন গোমড়ামুখো ছিলে। আর এভাবেই ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে। ” আরমানের বড় মামী হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেন।।

মামীর কথা শুনে আরমান শুধু হাসে। মেয়ের কপালে আরেকটা চুমু দিয়ে, ওকে কান্তার দিকে এগিয়ে দেয়।

” বউমা, তুমি পাখিটাকে খাওয়াও। আমরা একটু বাহির থেকে আসছি। ডক্টর তোমাকে কবে রিলিজ দেয়, সেটা একটু শুনে আসি। যদি আজকেই রিলিজ দেয়, তবে আমি আর দেরি করবনা। নাতনিতে নিয়ে সোজা বাসায় যাব। তোমার শ্বশুর তোমাদের অপেক্ষায় ছটফট করছে। ” আকলিমা খানম ওদেরকে একা থাকার সুযোগ করে দিয়ে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।

আরমান নেশাক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে কান্তার দিকে। ওর মনে উথালপাথাল ইচ্ছেরা হাতুড়ি পেটাচ্ছে নিষিদ্ধ কিছু করতে। কিন্তু আপাতত উথাল-পাথাল ইচ্ছেদের দমিয়ে রেখে, কান্তার চোখেমুখে পরপর অনেকগুলো চুমু খায়।

” তুমি ঠিক আছ, বউ? আরেকটু হলে আমি ম’রে’ই যেতাম। এত কষ্ট হয় কেন বলতো? মনে হচ্ছিল আমার কলিজা কেউ টেনে ছিঁ’ড়’ছি’ল। তুমি সহ্য করেছ কেমন করে! তোমার এই অবস্থার জন্য নিজেকে দোষী মনে হচ্ছিল। এটাই প্রথম এটাই শেষ। আরেকটা সন্তানের জন্য বায়না কিছুতেই করতে পারবেনা বলে দিলাম। এত টেনশন আমি নিতে পারবনা। ”

” আমাকে দেখুন, আমি একদম সুস্থ আছি। মা হতে গেলে একটু কষ্ট সহ্য করতেই হয়। এতেই তো মা হওয়ার স্বার্থকতা। আজ নিজেকে পরিপূর্ণ নারী মনে হচ্ছে। সেই সাথে আপনাকে পূর্ণ করতে পেরে নিজেকে গরবিনী মনে হচ্ছে। তবে আপনার শেষ অনুরোধ আমি রাখতে পারবনা। আমার তিনটা সন্তান চাই। একটাকে নিজের বুকে পেয়েছি, এবার আর দু’জনের আসার অপেক্ষা। ”

” হোয়াট! তিনটা! ইম্পসিবল। আমার শুধু তোমাকে চাই। তিনটা সন্তান হলে তুমি আর তুমি থাকবেনা। বাচ্চাদের সামলাতে গিয়ে আমাকে সময় দিতে পারবেনা। আমাদের একটা প্রিন্সেসেই চলবে। আল্লাহ ওকে নেক হায়াত দিন। ওকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত করার দ্বায়িত্ব তোমার। আর আমি ওর চলার পথটা মসৃণ করার দ্বায়িত্বে থাকব। এটাই আমার শেষ কথা। ”

” সেটা আর এক বছর পর দেখা যাবে। আগামী পাঁচ বছরে আমার বাড়ি জুড়ে তিনটা ছানাপোনা হেসে-খেলে বেড়াবে। এটাই আমার স্বপ্ন। এবং এটাই ফাইনাল। আপনি যদি আমার স্বপ্নে বাগড়া দেন তবে আমি রুম বদলাতে বাধ্য হব। ”

” এই বউ, এই। এসব কি বলছ? আমি তোমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারবনা। তোমাকে জড়িয়ে না ধরলে আমার ঘুম আসেনা, তুমি এটা খুব ভালো করেই জানো। তাই এমন হিটলারের মত কথা বলবেনা। তোমার সকল স্বায়ত্তশাসন মেনে নিলেও এইটা মেনে নিবনা। প্রয়োজনে পাঁচ বছরে তোমাকে দশটা ছানাপোনা গিফ্ট করব। আমার কাছে শোয়ার দ্বায়িত্ব তোমার, আর তোমাকে ছানাপোনা গিফ্ট করার দ্বায়িত্ব আমার। আমি এই ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। বাসায় চল। আগামী ছয়মাসের মধ্যে আরেকবার সবাইকে সুসংবাদ দিব। ” আরমানের এরূপ নির্লজ্জ কথাবার্তা শুনে কান্তা লজ্জায় চোখ বন্ধ না। ও ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে আছে। আরমান এক দৃষ্টিতে কান্তার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে।

আরমানের ঘোর কাটে মেয়ের কান্নার শব্দে। কান্তাও চোখ খুলে মেয়ের কান্না থামানোর চেষ্টা করে।

” আপনি বাইরে যান। আমি মেয়েকে খাওয়াব। ”

” খাওয়াও। তোমাকে কে মানা করেছে! মেয়েকে খাওয়ানোর সাথে আমার বাইরে যাওয়ার সম্পর্ক কি! আমার মেয়েকে এভাবে অভুক্ত রাখার সাহস কোথায় থেকে পাও! ”

” আপনি বাহিরে না গেলে আমি ওকে খাওয়াতে পারছিনা। ” দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে কান্তা।

” এই যে লজ্জাবতী? আমার কাছে এত লজ্জার কিছুই নেই৷ এতদিন ধরে সংসার করছ, আমাকে কামনার আ’গু’নে জ্বা’লি’য়ে-পু’ড়ি’য়ে খাক করে দিয়েছ, তোমার তনু-মনের মালিক বানালে তবুও এত লজ্জা কোথায় থেকে আসে? এমনতো নয় যে তোমার শরীরের খাঁজ আমি চিনিনা। যেখানে তোমার শরীরের প্রতিটি লোমের গোড়ায় আমার বিচরণ, সেখানে তোমার লজ্জা পাওয়াটা নিতান্তই হাস্যকর। ”

কান্তা এবার রে’গে যায়। ও মেয়েকে নিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে, ওকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
আরমান কান্তার কান্ড দেখে মনে মনে একদফা হাসে। তবে কান্তাকে সুস্থ দেখে ও হাঁফ ছাড়ে। আরমান ভেবেছিল কান্তাকে বোধহয় সি সেকশনে নিতে হবে। কিন্তু না কান্তা স্বাভাবিকভাবেই সন্তানের জন্ম দিয়েছে।

আরমানের ছোট মামা ডক্টরের সাথে কথা বলে ঠিক করলেন, কাল সকালেই কান্তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হবে। ডক্টর জানিয়েছে, মা ও মেয়ে দুজনেই সুস্থ থাকায়, বাসায় নিয়ে যেতে কোন সমস্যা নেই।
আজ যেহেতু রাত হয়েছে। আকলিমা খানমও চাচ্ছেননা তার নাতনিকে রাতে বাসায় নিয়ে যেতে। তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় আগামীকাল সকালে কান্তাকে বাসায নেয়া হবে।

কিছুক্ষণ পর আকলিমা খানম সবাইকে নিয়ে বাসায় চলে যায়। শুধু শ্রীজা আর আরমান হসপিটালে থেকে যায়।আরমানের খালা, মামী কান্তার কাছে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু আরমান জোড় করেই তাদেরকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।

আরমান সারারাত মেয়ের পাশে বসে থাকে। কান্তাকে ঘুমানোর সুযোগ দিয়ে ও মেয়ের খেয়াল রেখেছে। মেয়ে বারবার বিছানা নষ্ট করলে ও অপটু হাতে পরিষ্কার করে দিয়েছে। শ্রীজা ভাইকে অনেকবার বলেছে, ও পরিষ্কার করবে কিন্তু আরমান শোনেনি।

পরদিন সকালে আরমানের খালা ও মামী হসপিটালে আসে ওদেরকে নিতে। হসপিটালের যাবতীয় ফর্মালিটি কমপ্লিট করে ওরা বাসায় রওনা দেয়।

কান্তা ড্রয়িংরুমে পা দিয়েই স্তম্ভিত হয়ে গেছে। পুরো বাড়ি সাজানো। পুরো মেঝেয় ফুলের কার্পেট। দেয়ালে বড় করে লিখা, ওয়েলকাম হোম, আওয়ার লিটল প্রিন্সেস। জ্বলজ্বল করছে লিখাগুলো।
আকলিমা খানম ও শহিদ আহমেদ অধির আগ্রহে নাতনিকে বরণ করতে অপেক্ষা করছে।

আরমান মেয়েকে কান্তার কাছে দেয়৷ কান্তা ফুলের বিছানা পা দিয়ে মাড়িয়ে এসে দাঁড়ায় শহিদ আহমেদের কাছে।
শহিদ আহমেদ কাঁপা কাঁপা হাতে নাতনিকে কোলে নেন। আনন্দে দুই ফোঁটা অশ্রু টুপ করে পরে তার চোখ থেকে। আকলিমা খানমকে ইশারা করতেই সে একটা খাম ধরিয়ে দেয় প্রিন্সের হাতে।

” বউমা, এখানে আমার নাতনির জন্য গিফ্ট আছে। সাবধানে খামটা রেখে দিও। আমার বাড়িতে কত বছর পর অথিতি আসল। আমি এই আনন্দ কাকে দেখাই। আজ নিজের কলিজা কে’টে দিতে ইচ্ছে করছে তোমাকে। তুমি বেঁচে থাক মা। সুখে থাক। ”

শহিদ আহমেদের কাছ থেকে প্রিন্সেসকে কোলে নেয় আকলিমা খানম। তার চোখমুখে উপচে পড়ছে খুশি।

সবকিছু দেখে আরমান গোপনে চোখের পানি মুছে।

বিঃদ্রঃ প্রিয় পাঠক/পাঠিকাগন আরমান-কান্তার প্রিন্সেসের নাম আপনারাই রাখুন। ‘ ক ‘ দিয়ে একটা নাম দিন। যার নাম ভালো লাগবে, সেটাই প্রিন্সেসের নাম হবে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here