কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন #পার্ট_৩৯ জাওয়াদ জামী

0
494

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৩৯
জাওয়াদ জামী

আরমান বেশ কয়েকবার কান্তাকে ফোন দিয়ে পায়না। কান্তাকে না পেয়ে ওর কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট হয়। দুরুদুরু বুকে ফোন করে শ্রীজাকে। শ্রীজা তখন ড্রয়িংরুমে আরাফের সাথে খুনসুটিতে ব্যস্ত ছিল। জাবেদ শহিদ আহমেদের সাথে গল্প করছিল। কান্তা কেবলই কায়াকে ঘুমিয়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমে এসেছে।
শ্রীজা ফোন হাতে নিয়ে দেখল আরমানের নম্বর।
ও কথা না বলে ফোন এগিয়ে দেয় কান্তার দিকে।
কান্তা আরমানের নম্বর দেখে করিডোরের দিকে যায়।

” আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আপনি? ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি। তুমি কোথায় আর তোমার ফোন কোথায়? কতবার ফোন দিয়েছি, জানো? আমি ভয় পেয়ে গেছি। আমাকে হার্ট অ্যাটাক করানোর ধান্দায় আছো? বেয়াদব মেয়ে, একটাবারও ফোন করলে ঠিক সময়ে পাওয়া যায়না। ” আরমানের বকা শুনেও কান্তার কষ্ট হয়না। বরং ওর ভিষণ হাসি পাচ্ছে। লোকটা কত চিন্তা করে ওর জন্য।

” আপনার মেয়েকে ঘুমিয়ে দিচ্ছিলাম। তাই ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছি। পরে আর ভায়োলেন্ট করতে মনে নেই। এরপর ড্রয়িংরুমে এসে বসেছি। সব সময়ই খালি পুলিশি মেজাজ দেখানোর তালে থাকেন! যতসব ভন্ড পাব্লিক। ”

” এই তুমি কি বললে? ভায়োলেন্ট মানে জান? ফোন সাইলেন্ট মোড থেকে নরমাল মোডে আনতে হয়। আর তুমি ভায়োলেন্ট মোডে আনবে, মানে? আর আমি ভন্ড পাব্লিক? অশিক্ষিত মেয়ে ওয়ার্ড মিনিং জানেনা, আবার আমাকে ভন্ড বলে! এই মুহুর্তে আমি তোমার সামনে থাকলে কানের নিচে তবলা বাজাতাম। ”

” পারেনতো ঐটাই। ঘরে বউ কিছু বললে, কানের নিচে তবলা বাজাবেন। বাইরে পাব্লিক কিছু বললে লাঠি দিয়ে পেছনে তবলা বাজাবেন। আপনার জীবনটাই তবলাময়। এক কাজ করেন, চাকরি ছেড়ে তবলার ব্যবসা ধরেন। জীবনে প্রচুর উন্নতি করবেন। ”

আরমান বুঝতে পারছে এখন ও যা-ই কিছু বলুকনা কেন ওর বউ ওকে খোঁ’চা’বে। তাই আপাতত চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এর শোধ পরেও নেয়া যাবে।

” দুপুরে খেয়েছিলে? আমার প্রিন্সেস কেমন আছে? তোমাকে বিরক্ত করেনাতো? ”

” আমরা সবাই দুপুরে খেয়েছি। আপনার প্রিন্সেসও ভালো আছে। ও তো আর বাপের মত হয়নি, যে আমাকে বিরক্ত করবে। আমার সোনা মেয়েটা একদম আমার মত লক্ষ্মী হয়েছে। বাপের মত ত্যাঁদড় হয়নি। ”

” কান্তা। ” দাঁতে দাঁত পিষে বলে আরমান।

” জ্বি, পতি মহাশয়। আজ্ঞা করুন। ”

” আমাকে শুধু ঢাকা আসতে দাও। ”

” এখনই ওয়েলকাম। চলে আসুন। ”

” আচ্ছা রাখছি। ” হাল ছেড়ে দিয়ে বলে আরমান।

” এই না, রাখবেননা। আমার কথা শেষই হয়নি। আর এই কিপ্টে লোক ফোন রেখে দিচ্ছে! বউয়ের প্রতি একটুও দরদ নেই দেখছি কিপ্টেটার! ”

” দেখ, সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম। এখনও খাওয়া হয়নি। বাসায় এসেই আগে তোমাকে ফোন দিয়েছি। কিন্তু তুমি ভালোভাবে একটা কথাও বলছনা। আমি রেগে গেলে তোমাকে কি করতে পারি জান? ”

” আপনি আপাতত আমাকে কিছুই করতে পারবেননা। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। এখন গোসল করে খেয়ে নিন। এরপর ভিডিও কল দিয়েন। ততক্ষণে আপনার প্রিন্সেসও উঠে যাবে। ”

” আরও দশ মিনিট পর গোসল দিব। আগে বউয়ের সাথে কথা বলে নিইন। বউটাকে কতদিন দেখিনি। বউ বিনা বুকের ভিতর শূন্য শূন্য লাগছে। ”

” ঢাকা থেকে গেছেন চারদিন আগে। তাতেই কতদিন হয়ে গেছে! ”

” তুমি এসব বুঝবেনা। ঝগরুটেরা কখনও ভালোবাসা বুঝে। আমার সীমাহীন ভালোবাসা বোঝার ক্ষমতা তোমার মত ঝগরুটে মেয়ের নেই। আমার কাছে একেকটা দিন তোমাকে ছেড়ে থাকার মানে, যুগ-যুগান্তর তোমাকে কাছে না পাওয়ার সামিল। তোমার ঠোঁটের হাসি একদিন না দেখলে নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগে। তোমার তনুর সুবাস না নিলে অপূর্ণতায় আমার তনু-মন ছেয়ে যায়। কিন্তু তুমি বোকা রমনী, আমার চাওয়া আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলেনা। ”

” ওহে চালাক পুরুষ, এবার উঠুন। গোসল সেরে কিছু খেয়ে নিন। এরপর যত খুশি প্রেমালাপ করবেন। ”

” আমার রোমাঞ্চে পানি ঢালতে তুমি সদা তৎপর দেখছি। আজকাল বড্ড বেশি উড়ছ। তোমার পায়ে শিকল পড়ানোর সময় এসে গেছে। আমার নামের প্রেমের শিকল। তখন উঠতে-বসতে আমার প্রেমালাপের সুরে সুর মেলাবে। আজ আমি যেমন ছটফট করছি, সেদিন তুমি এমন ছটফট করবে। প্রেম পিপাসায় তোমার বুকটা খাঁ খাঁ করবে। এই আরমানের ভালবাসা ছাড়া কোন সরোবরের পানিতে এই পিপাসা মিটবেনা। ”

” যেদিন আপনার বউ হয়ে এসেছি, সেদিন থেকেই আমি আপনার ভালোবাসার পিপাসায় পিপাসার্ত। যতই ভালো বাসুননা কেন এই পিপাসা মিটবার নয়। পিপাসা না মিটে বরং বেড়ে যায়। আমার জীবনে আপনাকে পেয়ে আমি গৌরবে গরবিনী। ”

” ভালোবাসি জান পাখি অনেক ভালোবাসি তোমাকে। এবার আমার প্রিন্সেসের কাছে যাও। আমার মেয়েটা অনেকক্ষণ যাবৎ একলা আছে। ”

” আপনিও উঠুন। এভাবে অনিয়ম করবেননা। ”

” হুম। রাখছি। ”

” আরেকটা কথা। ”

” বল। ”

” ভাইয়া এসেছে, আপনার প্রিন্সেসকে দেখতে। ”

” ভাইয়া! ” আরমান একটু অবাক হয়।

” আমার বড় ভাইয়া আর আরাফ। ”

” আচ্ছা! অনেক ভালো হয়েছে তারা এসেছে। তাদের আপ্যায়নে যেন কোন ত্রুটি না হয়। আর তারা যেন কয়েকটা দিন ঢাকায় থাকে। শ্রীজার সাথে আরাফকে ঘুরতে পাঠিয়ে দিও। তোমার কাছে টাকা আছেতো? সেখান থেকে ভাইয়া, আরাফ আর ভাবির জন্য পোশাক কিনে দিও। শোন তোমার কাছে যেই টাকা আছে থাক। আমি এক্ষুনি তোমার এ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাচ্ছি। সেখান থেকে কিনে দিও। ”

” আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন! আচ্ছা, এসব নিয়ে পরে কথা হবে। আপনি আগে গোসল সেরে খেয়ে নিন, প্লিজ। আমি রাখছি। ” ফোন কেটে দেয় কান্তা।

” কান্তা, আসব? ” জাবেদ কান্তার রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।

” এস ভাইয়া। ”

জাবেদ ভেতরে আসলে কান্তা ওকে বসার জন্য চেয়ার এগিয়ে দেয়। জাবেদ বিছানার পাশে চেয়ার টেনে নেয়।
কায়া ঘুমাচ্ছে। আর ওর পাশে আরাফ বসে আছে। শ্রীজা ডিভানে থাকা কাপড়চোপড় গোছাচ্ছে। তবে জাবেদকে ভেতরে আসতে দেখে শ্রীজা বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।

” শ্রীজাপু, তুমি আবার কোথায় যাচ্ছ! ”

” তোমরা কথা বল। আমি পরে আসব। ”

” আমাদের এমন কোন গোপন কথা নেই যে তোমার বাইরে যেতে হবে। তুমি কোথাও যাবেনা। যাও যা করছিলে কর। ”

” শ্রীজা, আমি আসার পর থেকে তোমার সাথে তেমন কথা হয়নি। তুমি এখন এখানে থাকলে, এই সুযোগে গল্প করা যাবে। এস আমার কাছে এসে একটা চেয়ার নিয়ে বস। ” জাবেদ হাসিমুখে বলল।

” ভাইয়া, গল্প করার জন্য আরও অনেক সময় আছে। অনেকদিন পর আপনি বোনকে কাছে পেয়েছেন। দু’জনে মন খুলে গল্প করুন। আমরা বরং কালকে গল্প করব। ” শ্রীজা হাসিমুখে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

জাবেদ ভাগ্নীর মুখের দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এরপর ওর মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয়।

” এগুলো আমার মা’কে পরিয়ে দে। দেখি কেমন লাগে। ” জাবেদ তার হাতে থাকা প্যাকেট বাড়িয়ে দেয় কান্তার দিকে।

” এখানে কি আছে? ” কান্তা অবাক হয়ে জানতে চায়।

” খুলেই দেখ। ”

কান্তা প্যাকেট খুলে অবাক হয়ে গেছে। প্যাকেটে থাকা বক্সের মধ্যে সোনার চেইন, দুল আর চুরি।

” ভাইয়া, তুমি এতসব কিছু ওর জন্য এনেছ! কি করেছ এসব? এগুলো লাগবেনা, ভাইয়া। তুমি আমার মেয়ের জন্য দোয়া কর। ”

” কেন আমার বুঝি ওকে কিছু দিতে ইচ্ছে করেনা? আমাকে পর করে দিসনা, কান্তা। তোর সাথে যে অন্যায় করেছি, জানি তার কোন ক্ষমা নেই। তুই এগুলো নিলে, নিজের কাছে আমার অপরাধ একটু হালকা লাগবে। তুই ফিরিয়ে দিসনা এসব। আমার ছোট্ট মা’য়ের হক আছে তার মামার জিনিসের ওপর। তোর কাছে হাতজোড় করছি। ” জাবেদ কান্তার হাত ধরে কেঁদে ফেলে।

” ভাইয়া, এভাবে বলোনা। ঠিক আছে আমি এগুলো নিব। তবুও তুমি চোখের পানি মোছ। আমি এখনই তোমার মা’কে এগুলো পরিয়ে দিচ্ছি। তুমি দেখে বল ওকে কেমন লাগছে। ”

কান্তা কাঁপা কাঁপা হাতে প্রিন্সেসের গলায় চেইন, হাতে চুরি জোড়া পরিয়ে দেয়। এরপর ফোনে কয়েকটা ছবি তুলে আরমানের কাছে পাঠিয়ে দেয়।

আরমান ফোন হাতে নিয়ে দেখল ম্যাসেঞ্জারে কান্তার অনেকগুলো ম্যাসেজ এসেছে। ও হাসিমুখে ম্যাসেঞ্জার ওপেন করেই হা হয়ে গেছে।
ওর ঘুমন্ত প্রিন্সেসের ছবি। প্রিন্সেসের গলায় চেইন সাথে কারুকার্যখচিত লকেট, হাতে বালা, কানের খাঁজে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে সুন্দর ঝুমকো জোড়া। এতেই যেন পরীর মত লাগছে ওর কন্যাটিকে।
কান্তা ম্যাসেজে লিখেছে, পুতুলের মামা এনেছে।

ম্যাসেজের জবাবে আরমান লিখে, মাশা-আল্লাহ।

শহিদ আহমেদের জোড়াজুড়িতে জাবেদ তিনদিন ঢাকায় থাকে। এই তিনদিনে শ্রীজা আরাফকে নিয়ে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। কেনাকাটা করে।

এই তিনদিনে আতিথিয়তার কোন কমতি রাখেনি আকলিমা খানম। তার আতিথিয়তায় মুগ্ধ হয়ে গেছে জাবেদ। সে মনে মনে ভিষণ খুশি হয় এই ভেবে যে, তার বোন সুখে আছে।

শহিদ আহমেদ শ্রীজাকে টাকা দিয়েছেন জাবেদের পারিবারের সবার জন্য কেনাকাটার করতে। শ্রীজা নিজের পছন্দমত আরাফ, জাবেদ আর শিখার জন্য পোশাক কিনে।

তিনদিন পর জাবেদ বিদায় নেয় বোনের কাছ থেকে। যাবার সময় বোনের মাথায় হাত রেখে কেঁদে ফেলে জাবেদ। শহিদ আহমেদকে তার পরিবারসহ গ্রামে যেতে দাওয়াত দেয়। শহিদ আহমেদ জানান, সুযোগ পেলেই তিনি সবাইকে নিয়ে জাবেদের গ্রামে যাবেন।

জাবেদ যাওয়ার দুইদিন পর কান্তার ফুপু আসে কায়াকে দেখতে। তিনিও অনেক কিছু এনেছেন এই বাড়ির সবার জন্য। তিনি দুইদিন কান্তার সাথে কাটিয়ে মেয়ের বাসায় যান।

কান্তার এই কয়েকটা দিন খুব ভালো কাটে। ভাই , ফুপু আসায় ওর মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেছে।

পনের দিন পর আরমান ঢাকায় এসেছে। এই কয়দিনে মেয়েটা একটু বড় হয়েছে। হাত-পা নেড়ে খেলতে শিখেছে। শব্দ শুনে এদিকওদিক তাকাচ্ছে। আরমান মেয়েকে এতসব কিছু করতে দেখে বাঁধভাঙা খুশিতে কান্তাকে জড়িয়ে ধরে। কান্তা আরমানের খুশির পথে বাঁধা না হয়ে দেখতে থাকে, একজন বাবার উপচে পড়া উচ্ছ্বাস।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here