আমার_সংসার পর্বঃ ৩

0
300

#আমার_সংসার
পর্বঃ ৩
কলমেঃ আয়েশা সিদ্দিকা (লাকী)

সকাল বেলা অথৈ দরজা খুলতেই দেখলো তার শাশুড়ী উঠানে বসে আছে। চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো লতা এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। উঠলে নিশ্চয় এখনও ঘরে থাকতোনা। ভয়ে ভয়ে ধির পায়ে মরিয়ম বেগমের দিকে এগিয়ে গেলো অথৈ। উনার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

— মা, আজকে কি রান্না হবে যদি বলে দিতেন!

মরিয়ম বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

— রুটি আর তরকারি করো।

— কি তরকারি হবে মা?

— ঘরে যা আছে তাই দিয়ে একটা সবজি রান্না করো।

— আগে রুটি বানাও তারপর সবজি রান্না করো।

অথৈ ভয়ে ভয়ে লতার ঘরের দরজার দিকে তাকালো, লতা উঠেছে কিনা দেখতে। কারন অথৈ রুটি বানাতে পারেনা। রুটি সেঁকা যেমন তেমন হয় কিন্তু বানাতে গেলে হয়ে যায় বাঁকা। সাহস করে শাশুড়ীকে বলেই ফেললো,

— মা, আমি তো রুটি ভালো করে বানাতে পারিনা। ততক্ষণে আমি তরকারিটা রান্না করি? মেজো আপা উঠলে উনি রুটি বানিয়ে দিলে আমি সেঁকে নিতাম।

— আজও ঠিকঠাক মতো রুটি বানাতে পারোনা তাহলে বাপের বাড়ি এতো বছর শিখলে কি?

অথৈ আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেলো। ও খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারলো কাল রাতের রাগ আজ উনি আমার উপর দিয়ে তুলছে। গ্রামে বাড়ি তাই উঠানে মাটির চুলাতেই রান্না করতে হয়। অথৈ রান্নার জন্য সবকিছু গোছাতে গোছাতে লতা উঠে পড়েছে। লতা এসে অথৈকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— রাতে ছেলেটার শরীর খারাপ করছিলো তাই খুব জালিয়েছে। ঘুম হয়নি তেমন একটা তাই উঠতে দেরি হয়ে গেলো। আপা তুমি তরকারি গুলো কেটে ফেলো আমি ততক্ষণে রুটি বানিলে নেই।

— আচ্ছা আপা।

মরিয়ম বেগম যেনো ওত পেতেই ছিলেন কথার জবাব
দেয়ার জন্য।

— তুমি তো আর সারাজীবন তাকে রুটি বানিয়ে খাওয়াবেনা! তারও তো শেখা দরকার নাকি?

— আস্তে আস্তে সব শিখে নিবে মা। আমিও তো পারতাম না, এখনতো সবই পারি। আপাও একসময় সব শিখে যাবে।

— বানাতে বসলে তবেই তো শিখবে, হাত পা গুটিয়ে নিয়ে বসে থাকলে তো কোনোকালেও শিখতে পারবেনা।

বারান্দায় বসে বসে সব কথায় শুনছিলেন রহমান সাহেব। এবার তিনি নেমে এসে চুলার পাড়ে একটা টুল নিয়ে বসে বললো,

— বড়ো বউমা!

— জ্বী আব্বা।

— রুটি বানাতে কি কি লাগবে জোগাড় করে নিয়ে এসো তো! আজ রুটি তুমিই বানাবে আমি চুলায় খড়ি ঠেলে দেবো আর তুমি রুটি বানাবে, এসো তো! আর রুটি যেমনই হোক তেমনই সবাই খাবে। কোনো টু শব্দ কেও করতে পারবেনা। যে মুখ খুলবে আজ তার সাথে আমার বোঝাপড়া হবে।

মরিয়ম বেগম রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন সেখান থেকে। অথৈ মনে মনে বললো, যাক মা যেমনই হোক বাবার মতো একজন শশুর পেয়েছি। মরিয়ম বেগম চলে যাওয়ার পর লতা রহমান সাহেবকে বললো,

— আব্বা, আপনি সকাল সকাল মাকে দিলেন তো রাগিয়ে!

— তোমার মা রাগে না কখন আমাকে বলোতো।

রহমান সাহেব কথাটা বলেই হেসে উঠলেন সাথে অথৈ আর লতাও হাসলো।

অথৈ রুটি বানালো আর রহমান সাহেব চুলায় জাল দিলেন। পাড়ার কয়েকজন এসে এমন দেখে আবার ইয়ার্কিও করে গেলো।

রান্না শেষ করে অথৈ ও লতা সব গুছিয়ে নিয়ে মরিয়ম বেগমকে ডাক দিলো। সুমন সবসময় তার নিজের ঘরেই খায় তাই তাকে খাবার ঘরে এনে দিতে হয়। মরিয়ম সুমনের খাবার বেড়ে দিলো। অথৈ সুমনের খাবার নিয়ে ঘরে এলো। অথৈ এসে দেখলো সুমন ফ্রেশ হয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। বিছানার এক পাশে খাবার রেখে অথৈ সুমনকে ডাক দিলো খাওয়ার জন্য।

— এসো খেয়ে নাও।

— তুমি খেয়েছো?

— তুমি তো জানোই সবার খাওয়া শেষ হলে তারপর আমি আর আপা খাই।

সুমন উঠে খেতে বসলো আর অথৈকে বললো,

— এসো তুমিও আমার সাথে খাও।

— না তুমি খেয়ে নাও আমি পরে খাচ্ছি।

— এখন আমার সাথে খাও আবার পরে গিয়ে লতার সাথে খেয়ে নিও।

— না, তুমি খেয়ে নাও। মা যদি দেখে আবার খুব রাগারাগি করবে, তুমি খেয়ে নাও আমি পরে খেয়ে নিবো।

— কেও দেখবেনা আসো। আর এখন থেকে তুমি আমার সাথে বসে খাবে। পরে দরকার পড়লে আবার লতার সাথে গিয়ে খাবে।

সুমনের জোড়াজুড়িতে অথৈ সুমনের সাথে খেতে বসলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সব গুছিয়ে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো অথৈ। কেও কিছু যেনো বুঝতে না পারে তাই লতার সাথে বসে সামান্য কিছু খেয়ে নিলো।

এভাবেই চলছিলো ওদের সাংসার। সুমন সব সময় খেয়াল রাখার চেষ্টা করে, আর যাই হোক বিশেষ করে খাওয়ার কষ্ট যেনো দুই বউ এর কেও না পায়।

সুমনের ছোটো বোন তমা, সে মেয়ে হিসাবে খুব ভালো। ঠিক সুমনের মতোই কিছুটা প্রতিবাদি। অন্যায় সে সহ্য করতে পারেনা। মরিয়ম বেগম যখন লতা বা অথৈ এর সাথে ঝামেলা করে তখন তমা সবার আগে প্রতিবাদ করে। তাই মরিয়মের কাছে বকাও খায় মাঝে মাঝে, তবুও তমা কথা শোনাতে ছাড়েনা। কিন্তু সেটা, বড়ো বোন রিমার সহ্য হয়না। রিমা মায়ের ধাঁচ পেয়েছে বাড়ির বউকে কখনো বাড়ির সদস্যর মধ্যেই ফেলেনা। এটা নিয়ে তমার সাথে মাঝেই মাঝেই লাগে রিমার।

এক সকালে রান্না করতে দেরি হওয়ায় রিমা উঠে চেচামেচি শুরু করে দিয়েছে, কেনো সে সময় মতো খাবার পেলোনা। তমা তার ঘর থেকে সবটা শুনে সহ্য করতে না পেরে বেরিয়ে এসে রিমাকে বললো,

— আপু, তোর যখন এতো সকাল সকাল খিদে পেয়ে যায় তাহলে প্রতিদিন সকালে উঠে নাস্তাটা তুই বানাবি। তোরও সকাল সকাল খাওয়া হবে সাথে আমাদেরও হবে।

তমার এই কথা শুনে রিমা বললো,

— আমি কি বাড়ির কাজের লোক নাকি যে তোদের সবার জন্য রান্না আমাকে করতে হবে?

— তোর কি মনে হয় দুই ভাবি এ বাড়ির কাজের লোক?

— আমি সেটা কখন বললাম!

— তা বললিনা তো কি! তুই যদি একবেলা রান্না করলে কাজের লোক হয়ে যাস তাহলে ওই মানুষ দুটো তো প্রতিদিন তিন বেলা রান্না করে তোদের সবাইকে খাবার গেলাচ্ছে। তাহলে তোর হিসাব মতো তারা এ বাড়ির কাজের লোক। তাই তোদের তিন বেলা রান্না করে করে গেলাচ্ছে।

— তমা তুই মুখ সামলে কথা বল। খুব বেশি বেয়াদব হয়ে গেছিস।

— আমি না, তুই মুখ সামলে কথা বল।

লতা তার ননদের অত্যাচার সহ্য করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে তাই সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওদের কথা কাটাকাটি উপভোগ করছিলো। কিন্তু অথৈ বার বার দু বোনকে থামানোর চেষ্টা করছিলো। এর মাঝেই মরিয়ম বেগম এসে দাঁড়ালেন সেখানে,

— তোদের কি হয়েছে রে সকাল সকাল, এমন চিল্লাচিল্লি করছিস কেনো।

রিমা কাঁদতে কাঁদতে তার মাকে বললো,

— তোমার মেয়ের অনেক সাহস হয়ে গেছে। ও আমাকে কাজের লোকের সাথে তুলনা করেছে মা। এর বিচার যদি তুমি না করো তাহলে আজই আমি এ বাড়ি থেকে চলে যাবো।

— তো চলে যা না! তোকে ধরে রেখেছে কে?

— দেখো মা দেখো, তোমার সামনেই তোমার মেয়ে আমাকে কিভাবে কথা শোনাচ্ছে!

— তমা তুই রিমাকে কি বলেছিস? ও কাঁদছে কেনো?

— যা বলেছি বেশ করেছি। উল্টা পাল্টা কথা বললে আরও বলবো। আর এই আপু এই, তোর বিয়ে হয়ে গেছে তুই শশুর বাড়ি থাকবি। কিন্তু তুই তা না করে বছরের বেশির সময় এখানে কেনো পড়ে থাকিস?তোরও তো একটা সংসার আছে,সেখানে তোর সেখানে শশুর শাশুড়ী ননদ সবাই আছে, এখানে পড়ে থাকার তো মানেই হয়না। পড়ে থাকিস তো ভালো কথা, আবার যাদের সংসারে পড়ে থাকিস আবার তাদের উপরেই ছড়ি ঘুরাস। কেনো করিস এগুলো?

— মা শুনেছো তোমার মেয়ে কি কথাগুলো বলছে?

মরিয়ম বেগম তমার দিকে তেড়ে গেলেন মারার জন্য। সেটা দেখে অথৈ তমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বললো,

— তমা তুমি ঘরে যাও, আর কথা বাড়াইওনা। বড়দের মুখে মুখে কথা বলতে নেই।

— আমি এমন কথা বলতে চাইনি ভাবি। কিন্তু ওর মতো কুটনিকে কথা না বলে থাকতেও পারিনা।

— এবার চুপ করোতো অনেক হয়েছে যাও ঘরে চলে যাও।

এমন সময় সুজন কোথা থেকে হঠাৎ করেই তমার গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বললো,

— লায় পেয়ে মাথায় উঠে গেছিস। কাদের কাছ থেকে শিখছিস এমন বেয়াদবি?

তমা সুজনের দিকে তাকিয়ে বললো,

— ছোটো ভাইয়া বেয়াদবি শেখা লাগে, কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কারো কাছ থেকে শেখা লাগেনা। আর তুই নিজেকাপুরষ বলে মনে করিসনা তোর মতো সবাই। নিজের বউ এর অপমান চেয়ে দেখিস অথচ প্রতিবাদ করার মতো বুকের পাটা তোর নেই। তোকে তো পুরুষ মানুষ বলাই চলেনা।

তমার মুখে কথা গুলো শুনে সুজন তেড়ে যায় তমাকে মারার জন্য। হঠাৎই লতা এসে তমাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। অথৈও আর সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে যায় নিজের কাজে।

চলবে……..

(ভালো লাগলে সবাই কমেন্ট করে সাড়া দিবেন, তাহলে লেখার আগ্রহ বাড়ে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here