আমার_সংসার পর্বঃ ৮

0
299

#আমার_সংসার
পর্বঃ ৮
কলমেঃ আয়েশা সিদ্দিকা (লাকী)

অথৈ ও লতা সকালের নাস্তা বানাতে ব্যাস্ত। এরই মাঝে মরিয়ম বেগম এসে বসলেন ওদের দুজনের পাশে। মরিয়ম বেগম কোথা থেকে শুরু করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলোনা তাই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বললেন,

— বড়ো বউমা, ছোটো বউমা তোমাদের সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।

লতার বুকের ভেতরটা কেমন যেনো ছ্যাৎ করে উঠলো। এই বুঝি ইফতারি পাঠানো নিয়ে কিছু বলবে। অথৈ আর লতা একে-অপরের দিকে একবার তাকলো তারপর লতা বললো,

— কি কথা মা! বলুন!

— তোমরা দুজনের কেও তোমাদের বাপের বাড়িতে বলোনা ইফতারি পাঠানোর কথা।

লতা যেনো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাঁচলো। লতা ভাবতেও পারেনি এমন একটা কথা সে তার শাশুড়ীর কাছ শুনবে। অথৈ কিছুটা অবাক হয়েই মরিয়ম বেগমের দিকে তাকালো, তারপর জিজ্ঞেস করলো,

— কেনো মা? কাল তো আপনিই বললেন বাবার বাড়িতে জানাতে, তাহলে আজ আবার নিষেধ করছেন কেনো?

মরিয়ম বেগম বুঝতে পারলো কাল রাতে সুমনের সাথে এসব নিয়ে যে অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছে সেগুলোর কিছুই জানেনা দুই বউ এর এক বউও।

সত্যিই অথৈ বা লতা দুজনের কেওই জানেনা এ বিষয়টা। সুমন যখন ঘরে আসে ততক্ষণে অথৈ ঘুমিয়ে পড়েছিলো। সুমন যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলো ব্যাবসা নিয়ে আব্বার সাথে কিছু কথা আছে তোমার যাওয়ার দরকার নাই ওখানে। তাই আর অথৈ ওদিকে যায়নি। আর সুজনও লতাকে এ বিষয়ে কিছুই বলেনি। বলবে কি করে! সে নিজে যে কতটা ছোটো মনের মানুষ সেটা সুমন তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই ছোটো মনের পরিচয় নিজের বউয়ের কাছে আর দেবে কি করে সে! তাই সুজন ও চুপচাপ ছিলো।

অথৈ আবার জিজ্ঞেস করলো,

— কি হলো মা, কিছু বলছেন না যে!

— এমনি নিষেধ করেছি। তা ছাড়া আমার বাড়িতে তো কোনো কিছুর অভাব নেই যে তোমাদের বাপের জিনিস আনতে হবে! আল্লাহ পাক আমাকে যথেষ্ট দিয়েছে। তাই অন্য কারো জিনিসের দরকার নেই আমার।

মরিয়ম বেগমের মুখে এমন কথা শুনে অথৈয়ের থেকে লতা অবাক হয়েছে বেশি। কারন বিয়ে হয়ে আসার পর এই প্রথম আজ মরিয়ম বেগমের অন্যরকম এক রুপ দেখছে। একবার একটা কথা মুখ দিয়ে বললে সেটা ফিরিয়ে নেয়ার বান্দা মরিয়ম বেগম না। আজ হঠাৎ উনার কি এমন হলো যে, কথা ঘুরিয়ে নিলেন। লতা নিজেকে বিশ্বাসই করতে পারছেনা।

তবে যাই হোক না কেনো, আমি অনেক খুশি হয়েছি। আল্লাহ পাকের দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া যে উনি উনার মত পাল্টেছেন। তা না হলে আমি কি করে বাবার বাড়িতে কথাগুলো বলতাম এটা ভেবে ভেবে মনে হচ্ছিল আমি কখন যেনো মরে যাবো।

মরিয়ম বেগম চলে গেলেন লতা আর অথৈ রান্না বান্না শেষ করে মরিয়ম বেগমকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তারপর যে যার ঘরে চলে গেলো। মরিয়ম বেগম একে একে সবাইকে খেতে দিয়ে দিলেন। খেয়ে দেয়ে পুরুষ মানুষ গুলো সবার কাজে চলে গেলে লতা আর অথৈ খেয়ে নিলো। এভাবেই ভালো মন্দ সবটা মিলিয়ে ভালোই চলছে মরিয়ম বেগম এর সংসার। তবে মরিয়ম বেগম আগের থেকে অনেকটা বদলে গেছে। বাড়ির বউদের উপর অমানবিক ব্যাবহার গুলোও অনেকটা কমে গেছে।

আজ সকাল ৮ টা বেজে গেছে মরিয়ম বেগম এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। ঘরের বাইরে থেকে লতা কয়েবার ডাক দিলেও ঘরে গিয়ে ডাকার সাহস হয়নি তার। কারন মরিয়ম বেগমের ঘুমের মধ্যে ডাকা টা পছন্দ করতেন না উনি। কিন্তু বেলা গড়িয়েই চলেছে তাই অথৈ সাহস করে ঘরে ঢুকলো শাশুড়ীকে ডাকার উদ্দেশ্যে। অথৈ এর একটা চিৎকারে লতা এবং রহমান সাহেব দুজনে হাজির হলো ঘরে। মরিয়ম বেগমের কোনো সাড়াশব্দ নেই। মুখ এক পাশে বেঁকে গেছে। চোখ গুলো একনজরে তাকিয়ে আছে একই দিকে। রহমান সাহেব যখন ঘর থেকে বেরিয়েছেন তখনও সব ঠিক ছিলো। মরিয়ম বেগম নাকি কথাও বলেছে রহমান সাহেবের সাথে। অথৈ নাকে হাত দিয়ে দেখলো নিঃশ্বাস চলছে। লতা তড়িঘড়ি করে বাইরে এসে বাড়ির কাজের ছেলেটাকে পাঠালো সুমন বা সুজন যে কোনো একজনকে খুঁজে আনতে।

রীমা ও তমাও এসে বসেছে মায়ের পাশে। বেশকিছু সময় পর সুমন আসলো। সুমন মায়ের এই অবস্থা দেখে বুঝতে পারলো স্ট্রোক করেছে তাই আবার বেরিয়ে গেলো গাড়ির খোঁজে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা মাইক্রোবাস এর ব্যাবস্থা করা হলো। লতা তার ছোটো বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে থেকে গেলো। অথৈ, সুমন, তমা, আর রহমান সাহেব গেলো মরিয়ম বেগমের সাথে। কুষ্টিয়া হসপিটালে ভর্তি করা হলো। রাস্তায় আসতে আসতে মরিয়ম বেগম নিস্তেজ হয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছিল অজ্ঞান হয়ে গেছে। পুরো দিন যাওয়ার পর সন্ধ্যায় মরিয়ম বেগমের জ্ঞান ফিরলো। জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে মরিয়ম বেগম। স্যালাইন চলছে, অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। কোনো কথা বলতে পারছেনা শুধু সবার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। ডাক্তার বিভিন্ন টেস্ট করালো, সব রিপোর্ট দেখে বললেন ব্রেইন স্ট্রোক করেছে। খুব দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে এবং চিকিৎসা হবে অনেক ব্যায়বহুল। সুমন ডাক্তারকে চিকিৎসা শুরু করতে বলে দিলো।

পুরোটা রাত কখনও অথৈ, কখনও সুমন, আবার কখনও তমা বসে বসে সেবা করেছে। রহমান সাহেব হাসপিটালের পাশে এক আত্বিয়ের বাড়িতে ছিলেন। ফজরের আজান দিতেই অথৈ উঠে বসে। সুমন বসে আছে তার মায়ের পাশে আর তমা মায়ের বিছানার এক কোনে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। সুমন অথৈকে দেখে বললো,

— আমাকে বাড়ি যেতে হবে। টাকা যা এনেছিলাম সব শেষ। ব্যাংক থেকে টাকা উঠাতে হবে।

— তাহলে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ো। যেনো তাড়াতাড়ি আবার ফিরে আসতে পারো।

— তুমি কি যাবে বাড়ি? গেলে তাড়াতাড়ি নাও আবার আমার সাথে চলে আসবে।

— আমি গেলে তমা কি একা সামলাতে পারবে মাকে।

আজান দিতেই রহমান সাহেবও চলে এসেছে হাসপাতালে। সুমন আর অথৈ এর কথা শুনে রহমান সাহেব বললো,

— বড়ো বউমা তুমি যাও সমস্যা নাই, আমি আছি তমা আছে সব সামলে নেবো।

— পারবেন তো আপনারা?

— হ্যাঁ পারবো ভাবি তুমি নিশ্চিন্তে যাও।

— আচ্ছা থাকো তাহলে আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবো তোমার ভাইয়ার সাথে।

সুমন আর অথৈ বেরিয়ে পড়লো। বাড়িতে পৌঁছে সুমন ব্যাংকের কাগজ পত্র গুছিয়ে নিয়ে অথৈকে বললো সুজন বাড়িতে আছে কি না ডেকে দিতে। অথৈ বাড়ি ফিরে রীমাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে লতাকে ডাক দিলো। লতা তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো তার শাশুড়ী এখন কেমন আছে। লতা আর অথৈয়ের মাঝে কথার এক পর্যায়ে এসে রীমার কথা জিজ্ঞেস করলো,

— মেজো আপা, এসে থেকে রীমাকে কোথাও দেখছিনাতো?

— রীমা কাল দুপুরেই তার শশুর বাড়ি চলে গেছে।

অথৈ কিছুটা অবাক হয়ে লতার দিকে তাকিয়ে বললো,

— মায়ের এই অবস্থায় রীমা বাড়ি চলে গেলো!

— হ্যাঁ গেলো। আপা তোমার কি মনে হয়! মায়ের সেবাযত্ন আর সংসারের কাজ কর্ম করার জন্য ও থাকবে?

— সত্যিই আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি এ কেমন মেয়ে! সারাবছর এখানে পড়ে থাকে আর যেই মায়ের শরীর খারাপ হলো আর অমনি পালিয়ে গেলো!

— গেলো কিনা সেটা তো দেখতেই পাচ্ছো।

সুমন ঘর থেকে বেরিয়ে বললো,

— অথৈ তোমাকে পাঠিয়েছিলাম সুজনকে ডেকে দিতে। তুমি সেটা ভুলে গল্প করতে লেগে গেছো?

অথৈ সত্যি ভুলেই গেছিলো সুজনকে ডাকার কথা। লতা তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে সুজনকে ডেকে দিলো। সুজন বাইরে এসে বললো,

— ভাইয়া ডাকছিলে আমাকে? মায়ের কি অবস্থা! মা কেমন আছে এখন?

— মা আছে মোটামুটি, খুব একটা ভালো না। কিছু টাকা লাগবে তোর কাছে যা আছে দে আর আমি কিছুটা ব্যাংক থেকে উঠিয়ে নেবো।

— আমি টাকা কোথায় পাবো? যা ছিলো সবটাই ব্যাবসায় লাগিয়ে দিয়েছি।

সুমন অবাক সুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। লতা বললো,

— যা আছে তাই দাও যেভাবেই হোক মায়ের চিকিৎসাতো করাতে হবে!

— তোমাকে এতো কথা কে বলতে বলেছে! কি করবো না করবো সেটা কি তোমার কাছ থেকে জেনে তারপর করতে হবে! আমার কাছে আপাতত কোনো টাকায় নাই।আর ব্যাবসার কাজে আজকেই আমাকে ঢাকা যেতে হবে।

— পালাতে চাইছিস? আর আমি দেশের বাইরে থেকে এতো এতো টাকা পাঠিয়েছি তার কিছুই কি নেই তোর কাছে? এতো টাকা কি করেছিস তুই? সব টাকার তবিল গুছিয়ে এখন কাজের বাহানা দেখাচ্ছিস?

— কি আজব! পালাবো কেনো? আমার কাজ থাকলে আমাকে যেতে হবেনা? আর তোমার টাকা সব সংসারের কাজেই শেষ হয়ে গেছে। এখানে আমার তবিল গুছানোর কিছু নাই।

সুমন খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারলো সুজন কি বোঝাতে চাইছে। সুমন আর কথা না বাড়িয়ে অথৈকে বললো,

— অথৈ, তুমি রেডি হয়ে থেকো। আমি এসেই বেরিয়ে পড়বো।

অথৈ মুখে কোনো কথা না বলে শুধু মাথা নাড়ালো। সুজন লতাকে বললো,

— আমি বের হবো সব গুছিয়ে দাও।

লতা অথৈয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

— আপা তুমি খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে নাও ভাইয়া না আসা পর্যন্ত।

কথাগুলো বলেই লতা ঘরে চলে গেলো। অথৈ রান্নাঘর থেকে ভাত আর তরকারি নিয়ে ঘরে চলে গেলো।

চলবে….

(আব্বুকে হারিয়ে প্রায় বছর খানিক হলো। সেই শোক কখনও কাটিয়ে উঠতে পারবো কিনা জানিনা। আম্মু হজ্জ পালনের উদ্দেশ্য গেছেন, আলহামদুলিল্লাহ৷ আমি পুরাই একা হয়ে পড়েছি। তাই মন মানসিকতা খুব খারাপ থাকে সবসময়। গল্প লেখার জন্য একটা স্বাভাবিক মস্তিষ্ক দরকার। আমি ভেতর থেকে ভেঙে পড়েছি একেবারেই তাই গল্প দিতে দেরি হলো, তাই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি সবার কাছ থেকে। সবাই আম্মুর জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ পাক যেনো আম্মুর মনোবাসনা কবুল করে এবং আম্মু যেনো সহিসালামতে দেশে ফিরে আসতে আমাদের মাঝে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here