#স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
#পর্ব_০২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
চারদিকে কোলাহল পরিপূর্ণ পরিবেশ। পুরো বাসা জুড়ে গিজগিজ করছে মেহমান। সকালের শান্ত বাসাটা হঠাৎ করে এতটা অশান্ত হয়ে উঠলো কেনো? স্মৃতি সেটাই বুঝতে পারছে না। তার মা বলল তাদের ফ্লাটে নতুন ভাড়াটিয়া আসছে। তাদের অনেক দূরে বাসা। সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রান্না করে উঠতে পারে নাই। সেজন্য তাদের সকলের জন্য রান্নার আয়োজন করা হয়েছে। আজ দুপুরে তারা সবাই স্মৃতিদের বাসায় খাবে। কিন্তু স্মৃতির মায়ের কথা বিশ্বাস হলো না। সন্ধিহান দৃষ্টিতে বাসাটা পর্যবেক্ষণ করছে। আপাতত মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেওয়ার প্রয়োজন। তাই সে বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। নিজের রুমে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিল। অতিরিক্ত কোলাহলের জন্য নিদ্রা দেশে তলিয়ে যেতে পারছে না স্মৃতি। সন্ধ্যার আজান কানে আসতেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো স্মৃতি। দুপুরে ছটফট করতে করতে কখন যে ঘুমিয়েছে। তা জানা নেই তার। সে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। অজু করে এসে নামাজ শেষ করে। নিচে নামলো। নিচে এসে হতভম্ব হয়ে গেল। তাদের পুরো বাসা ফাঁকা। কারো টু শব্দ তার কর্ণকুহরে এসে পৌঁছালো না। বিস্ময় নয়নে বিশাল ড্রয়িং রুমটার দিকে তাকিয়ে আছে স্মৃতি। ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে, গ্লাসে পানি ঢালছিল। এমন সময় দরজার কাছে থেকে কিছু মানুষের বাক্য কর্ণকুহরে ভেসে এলো। অপরিচিত কারো কথা কর্নপাত হতেই দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল। পর্দার আড়াল থেকে দেখার চেষ্টা করছে কে এসেছে? দু’জন মধ্য বয়ষ্ক মানুষ এসেছেন। একজন ছেলে, একজন মেয়ে। সাথে একটা ছেলে আর মেয়ে রয়েছে। মানুষ গুলোকে দেখে স্মৃতির ললাটে কয়েকটি ভাজ পড়লো। সে আর কোনোকিছু ভাবতে পারলো না। রুমের মধ্যে এসে পড়ার টেবিলে বসে পড়লো। কিন্তু শান্তিতে দুই মিনিট পড়তে পারলো না। বাহির থেকে শোরগোল শোনা গেল। বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো। তখনই স্মৃতির আম্মু মুনিয়া বেগম আছেন। মেয়ের মাথায় কাপড় দিয়ে ড্রয়িং রুমে নিয়ে যান। সেখানে স্মৃতির পরিবারের সকলে উপস্থিত রয়েছে। স্মৃতির বড় বোনকে একটা শাড়ি পড়িয়ে, তখন যেই ছেলেটিকে দেখেছিল স্মৃতি। সেই ছেলেটির পাশে বসিয়ে রেখেছে। স্মৃতির আম্মু মুনিয়া বেগম সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল।
–এটা আমার ছোট মেয়ে। পুরো নাম চৈতি রহমান স্মৃতি। পড়াশোনায় অনেক ভালো। আমার মেয়ের কোনো বাজে রিপোর্ট নেই। ছোট মেয়েটাকে নিয়ে, আমাদের অনেক স্বপ্ন। মেয়েটা বড় হলে ডক্টর হবে। ওর বাবা প্রতি রজনীতে ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, এবার ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আমার স্মৃতি। মুনিয়া বেগমের কথা শুনে, রহমান শেখ বলে উঠলেন।
–আপনার দুই মেয়ে রুপে মাশাল্লাহ। কিন্তু গুনে কেমন? সেটা তো জানা হলো না। রহমান শেখের কথা শুনে, স্মৃতির বাবা আবিদ রহমান বললেন।
–আমার বড় মেয়েটা আলহামদুলিল্লাহ সবকিছু পারে। আমার বড় মেয়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। সে পুলিশ হবে। একটা এক্সিডেন্ট আমার মেয়ের স্বপ্ন গুলোকে তার সাথে নিয়ে চলে গিয়েছে। তার পরে থেকে আমার মেয়ে আর স্বপ্ন দেখেনি। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে না। তাই আমরা আর ওকে চাপ প্রয়োগ করি নাই। আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে, আমাদের করতে পারেন। সব সত্যি কথা বলবো। মিথ্যা বলে, আমাদের কোনো লাভ নেই। আবিদ রহমানের কথায় অভ্রের বাবা রহমান শেখ বলে উঠলো।
–আমরা একটা মেয়ে চাই। কাজের লোক না। কাজের লোক রাখার মতো ক্ষমতা আমার আছে। আপনার মেয়ের থেকে বেশি কিছু চাই না। শুধু আমাদের ভালোবাসলেই হবে।
–আমার বড় মেয়েটা অনেক মিশুক। খুব সহজে সবার সাথে মিশতে পারে। রান্নার কাজও মোটামুটি ভালো পারে। তাই বড় মেয়েকে নিয়ে বলতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমার ছোট মেয়ে হলে সমস্যা হতো। আমার ছোট মেয়েটা সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে পড়ে থাকে। সংসারে কাজ কি? সে হয়তো জানে না। আমরাই তাকে কাজ করতে দেই না। ওর একটা বাজে অভ্যাস আছে। ও বেশি মানুষ পছন্দ করে না। সবার সামনে সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। আমার ছোট মেয়েটা বড্ড এলোমেলো। বাবার কথায় স্মৃতির মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। রাগান্বিত হয়ে চলে আসতে লাগছিল। তখনই স্মৃতির চোখ আটকায় দরজার কাছে। সে কি সত্য দেখছে নাকি মিথ্যা। স্মৃতির দৃষ্টি উপেক্ষা করে আরাভ গিয়ে রহমান শেখের পাশে গিয়ে বসলেন। রহমান শেখ সবার সাথে আরাভের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
–এটা আমার ছোট ছেলে আরাভ মুনতাসীর। পাশের কলেজে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে। আর আমার বড় ছেলে ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার। সবকিছু দেখলাম। আমাদের মেয়েকে বেশ পছন্দ হয়েছে। এই বিয়েতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আপনারা আমাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে পারেন। আপনারা অনুমতি দিলে, আমরা আজই স্রুতিকে আংটি পড়িয়ে রেখে যেতে চাই। রহমান শেখের কথা শুনে, আবিদ রহমান বলে উঠলো।
–আমাদের মতামত নেওয়ার আগে, ছেলে মেয়ের মতামত নেওয়াটা আগে জরুরি। বিয়ে তো আর ছেলে খেলা নয়। বিয়ে হচ্ছে সারাজীবনের বিষয়। ওরা দু’জন সারাজীবন এক সাথে থাকতে পারবে কি-না। সেটা ওদের মুখ থেকে জানা দরকার। আবিদ রহমানের কথা শেষ হবার সাথে সাথে অভ্র কিছু বলার জন্য উদ্যত হয়েছিল। তখনই রহমান শেখ ছেলের দিকে রক্তিম চোখে দৃষ্টিপাত করল। বাবার দৃষ্টি উপেক্ষা করার মতো দুঃসাহস তার নেই। সে মাথা নুইয়ে নিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল।
–আমার কোনো আপত্তি নেই। আব্বু আম্মুর পছন্দই আমার পছন্দ। আমাদের দিক থেকে কোনো আপত্তি নেই। আপনার মেয়ের আপত্তি আছে কি না? আপনার মেয়ের মতামত নিন। ছেলের কথা শুনে, অভ্রের আম্মু রোকেয়া বেগম রাগান্বিত হয়ে ছেলের দিকে দৃষ্টিপাত করল। অভ্রের বেশি কথা বলা একদম পছন্দ নয় রোকেয়া বেগমের। গম্ভীর কণ্ঠ করে বলল।
–প্রয়োজনের বাহিরে অতিরিক্ত কথা বলা উচিৎ নয় বাবা। মায়ের ক্ষোভ বুঝতে পেরে নিরব হয়ে গেল অভ্র। আরাভ আর আরাভের ছোট বোন আকাশী দু’জন নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। আরাভের মধ্যে কোনো অনুভূতি নেই। এমন ভাব ধরে আসে আছে। তাকে বসে থাকার জন্যই এখানে ডাকা হয়েছে। আকাশী আগ্রহী হয়ে সবকিছু দেখছে। আরাভ এমন ভাব করছে যেনো সে স্মৃতিকে চিনেই না। কোনোদিন দেখেই নাই। সকাল বেলা এতগুলো অপমানের প্রলেপ লাগিয়ে দিল। স্মৃতি হালকা হেসে সবার থেকে বিদায় নিয়ে নিজের কক্ষে চলে গেল।
অভ্রের পরিবার স্রুতিকে আংটি পড়িয়ে রেখে চলে গেল। এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অভ্র আর শ্রুতির বিয়ে। দুই পরিবারের এসে ধরা দিয়েছে খুশির আমেজ। সবার মুখে হাসির রেখা রাজত্ব করছে। স্রুতি নিজের ফোন বের করে অভ্ররে হাসোজ্জল একটা ছবি দিকে তাকিয়ে আছে। দুই মাস আগে থেকে তাদের বিয়ে কথাবার্তা চলছে। দুই মাস আগে থেকে দুই পরিবারের খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। প্রথম যেদিন অভ্রকে দেখেছিল। সেদিন হৃদস্পন্দনের গতিবেগ অস্বাভাবিক ভাবে বেড়িয়ে গিয়েছিল। প্রথম দেখাই ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করেছিল। তারপরে প্রতিদিন ছবিটা দেখতে দেখতে আর কল্পনা করতে করতে মানুষটার অজন্তেই মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলছে স্রুতি। সে তো মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলছে। মানুষটা কি তাকে ভালোবাসবে? ভাবতেই হৃদমাঝারে ভয় গুলো এসে হানা দিল। মানুষটার সাথে কথা বলার ভিষণ শখ স্রুতির। কিন্তু ভয় আর লজ্জায় তা প্রকাশ করা হয়ে উঠেনি।
আরাভ ল্যাপটপে কাজ করছিল। এমন সময় দরজার কাছে থেকে গম্ভীর কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে এসে পৌঁছালো।
–তুই কি ব্যস্ত আছিস? বলল অভ্র।
–প্রয়োজন থাকলে বলতে পারো। হেয়ালি একদম পছন্দ নয়। তুমি আমার বড় ভাই। তোমাকে সামনে বসিয়ে রেখে, অবশ্যই আমি কাজকে গুরুত্ব দিব না। বড়দের অসন্মান করার মতো বেয়াদবি আব্বু আম্মু আমাকে শিখিয়েছে। বলল আরাভ।
–সব সময় এত সিরিয়াস হয়ে থাকিস কেনো? বলল অভ্র।
–আমি সিরিয়াস হয়ে থাকি কেনো? এটা জানতে এসেছো?আরাভের কথায় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অভ্র।
–আমি বিয়েটা করতে চাই না। তুই জানিস আমি মায়রাকে আজও ভুলতে পারি নাই। এতগুলো বছরেও তার প্রতি আমার ভালোবাসা এতটুকু কমে নাই। আমি মায়রার জায়গা অন্য কাউকে দিতে পারবো না। আব্বু আম্মু কেনো বুঝতে পারছে না? জোর করে কখনো ভালোবাসা হয় না। মন থাকবে একজনের কাছে? আর সংসার করবো আরেক জনের সাথে, এটা কোনো জীবন হতে পারে। বলল অভ্র।
–তুমি তার জন্য তিন বছর অপেক্ষা করেছো? আমি হলে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করতাম না৷ সেদিনই আরেকটা বিয়ে করে নিতাম। কাউকে ছাড়া কারো জীবন থেমে থাকে না। সে তোমাকে ছাড়া থেমে নেই। তোমার সাথে বেইমানি করে, স্বামী সন্তান নিয়ে বেশ ভালো রয়েছে। তুমি বিয়ে করছো না বলে, তোমার আড়ালে তোমার কথা অন্যকে শুনিয়ে হাসছে৷ তুমি একটা ভালো মেয়ে ডিজার্ভ করো ভাইয়া। আমি যতদূর জেনেছি স্রুতি আপু খুব ভালো একটা মেয়ে। আপুকে বিয়ে করলে তোমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত হবে আনন্দময়। আমার বক্তব্য আমি রাখলাম। তোমার জীবন তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে। তাই হবে। একটা কথা মাথায় রেখো। তোমার আর স্রুতি আপুর বিয়ের কথা প্রচুর লোক জানাজানি হয়েছে। আব্বু আম্মু তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়েটা ভেঙে দিবে। কিন্তু তারা যে ভেতর থেকে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। সেটা কি তুমি অনুভব করতে পারবে। তাদের ছোট হৃদয়টা কতটা আহত হবে। একটা বার অনুভব করে দেখো।বলল আরাভ।
–তোর কাছে থেকে সাজেশন নিতে আসি নাই। আব্বু আম্মুকে বল। আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। সে আমাকে ঠকিয়েছে বলে, আমিও তাকে ঠকাবো। বলল অভ্র।
অভ্রের কথায় কথায় মনে মনে তাচ্ছিল্য করে উঠলো আরাভ।
–একটা সময় আসবে। তখন প্রচুর আফসোস করবে। বিয়েটা আগে কেনো করোনি? সমস্যাটা তোমার ভাইয়া। তোমার সমস্যার কথা আমি কেনো আব্বু আম্মুকে বলতে যাব? নিজের সমস্যার কথা নিজে গিয়ে বলো। আমাকে আর বিরক্ত করো না। আমাকে প্রশ্ন তৈরি করতে হবে। বলল আরাভ। অভ্র বিরক্ত হয়ে আরাভের রুম থেকে বের হয়ে আসলো। মস্তিষ্ক একদম শূণ্য হয়ে গিয়েছে। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সে কি করে বিয়েটা ভাঙবে। সে চায় না অকারণে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হোক। সে আদৌও অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসতে পারবে? তার দ্বারা যদি স্রুতির কোনো ক্ষতি হয়। তাহলে এটা সে কিভাবে মেনে নিবে? প্রতিটি বাবা-মা-ই চায়। তাদের সন্তান ভালো থাকুক। আমাকে ভালো রাখতে গিয়ে, আমার ভালো থাকাটাই কেঁড়ে নিচ্ছো আব্বু আম্মু। মনের অজান্তে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো অভ্রের।
পরের দিন সকাল বেলা, আজকে স্মৃতি আগে কলেজে এসেছে। তার বন্ধুদের সাথে দেখা হয়েছে। তবে কথা হয়নি কারো সাথে। স্মৃতি একা একা বসেছিল। তখনই তোহা আর মেঘলা এসে স্মৃতির পাশে বসে। তাদের দেখে স্মৃতি দেখেও না দেখার ভান ধরে বসে থাকে। দু’জন বাহারি রকমের কথা বলে, স্মৃতিকে মানানোর চেষ্টা করছে। তাদের সব চেষ্টা বৃথা চলে গেল। তারা স্মৃতির মুখ দিয়ে একটা বাক্য উচ্চারন করাতে পারলো না। হতাশ হয়ে দু’জন চুপ হয়ে গেল। স্মৃতি একটু পর পর হাতের ঘড়ির দিকে নজর আটছে। ক্লাসের সময় দুই মিনিট পেড়িয়ে গিয়েছে। এখনো স্যারের আসার নামে কোনো খোঁজ নেই। কালকে সে একটু দেরি করে এসেছিল। হাজার রকমের কথা শুনতে হয়েছিল। আজকে স্যার দেরি করছে। তার বেলায় সাত গুন মাফ। স্মৃতির ভাবনার মাঝে হন্তদন্ত হয়ে আরাভ রুমে প্রবেশ করল। কোনো কথা না বলে, হাতে থাকা বইটা খুলে পড়াতে শুরু করল।
চলবে…..