স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি #পর্ব_০৩ #লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

0
874

#স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
#পর্ব_০৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

স্যার রুম থেকে বের হতেই ক্লাস রুমটা কোলাহলে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। স্মৃতি বিরক্ত মাখা মুখ করে বসে আছে। তখনই স্মৃতি সামনে এসে দাঁড়ায় মেঘ। মেঘ স্মৃতিকে গম্ভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিল। নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে নিয়ে, একটু ভাব নিয়ে স্মৃতিকে উদ্দেশ্য করে বলল।

–স্যার আজকে ক্লাসে দেরি করে আসলো। তুই একটা প্রতিবাদও করলি না। কথা গুলো বলেই চিন্তিত হয়ে স্মৃতির দিকে তাকালো মেঘ।

–ওসব প্রতিবাদ করা সিনেমায় মানায়। বাস্তবে না। কাল্পনিক জিনিসকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করিস না। কল্পনা আর বাস্তব কখনো এক হতে পারে না৷ মানুষ বাস্তবে সুখী হতে পারে না বলেই, কল্পনাকে নিজের মন মতো গড়ে তুলে। নিজের সব চাওয়া পাওয়া কল্পনার মধ্যে পূর্ণ করে। তাই তো মানুষ বাস্তবের চেয়ে কল্পনায় বেশি সুখী। আমি যদি স্যারের দেরি করে আসার জন্য প্রতিবাদ করতাম। তাহলে স্যার আমাকে ক্লাস রুম থেকে বের করে দিত। স্যারের সাথে বেয়াদবি করার ফলে পেতাম বড় কোনো শাস্তি। সিনেমার মতো আমার প্রতিবাদ করা দেখে ক্লাসের সবাই তালে তাল দিত না। স্যারের একটা ধমকে সবাই চুপসে যেত। আমার প্রতিবাদ স্যার বসে বসে দেখতো না। স্যার যদি একবার বলতো।তিনি আমাদের ক্লাস উনি বর্জন করবে। তাহলে সবাই আমাকেই কলেজে থেকে বের করার জন্য আন্দোলন শুরু করে দিত। কথা গুলো বলেই স্মৃতি হনহন করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। মেঘ হতভম্ব হয়ে স্মৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করে রেখেছে। রোহান এসে মেঘের কাঁধে হাত রাখলো।

–সাধারণ একটা কথা বললাম। আমাকে এতগুলো ভাষণ শুনিয়ে দিয়ে গেল। মেয়েটা বড্ড অভিমান করেছে। চল সবাই মিলে কিছু একটা করি। যাতে মেয়েটার অভিমান কিছুটা কমে যায়। মেঘের কথায় রোহান ভাবতে শুরু করল। কিভাবে স্মৃতির রাগ ভাঙানো যায়।

একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে অভ্র আর স্রুতি। পিনপিনে নিরবতা কাজ করছে দু’জনের মাঝে। স্রুতি ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে। প্রিয় মানুষটাকে প্রথম কাছ থেকে দেখার অনুভুতিটাই আলাদা। পুরো শরীরে মৃদু ভাবে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। অভ্র বারবার স্রুতিকে নিজের মনের কথা গুলো বলার চেষ্টা করছে। কথা গুলো বলতে গিয়েই বাবা-মায়ের হাসোজ্জল মুখ গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তার সুখের জন্য তার বাবা-মাকে সে কিভাবে কষ্ট দিবে। এমন তো না যে তার বাবা মা তার ভালোবাসাকে মেনে নেয়নি। মেনে নিয়েছিল তো! সে-ই থাকেনি। এখানে তার বাবা-মায়ের কোনো দোষ নেই। আমার সুখের জন্য আমার বাবা-মা আমার ভালোবাসা মেনে নিল। আমি কেনো তাদের সুখের কথা ভেবে বিয়ে করতে পারবো না? বাবা-মাকে খুশি করার জন্য আমি স্রুতিকে বিয়ে করে নিলাম। কিন্তু মেয়েটাকে ভালোবাসতে পারবো তো? একটা মেয়ের স্বামী তার পুরো দুনিয়া হয়। সেই দুনিয়াই যদি গোলমালে হয়। তাহলে মেয়েটা কিসের ভরসায় সংসার বাঁধবে। বাবা-মাকে খুশি করতে গেলে নিজেকে খুশি করতে পারছি না। নিজেকে খুশি করতে গেলে বাবা-মাকে খুশি করতে পারছি না। হে আল্লাহ আপনি আমাকে কোন পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিলেন। আমি চারিদিকে অন্ধকার দেখছি। আপনি আমাকে সঠিক পথের সন্ধান দিন। অভ্রকে অস্থির হয়ে পড়তে দেখে, স্রুতি শান্ত কণ্ঠ বলে উঠলো,

–আপনি ঠিক আছেন? আমার সাথে বসে থাকতে আপনার অসুবিধা হচ্ছে? আপনার অস্বস্তি হলে আমাকে বলতে পারেন। আমি এখানে থেকে চলে যাব। শ্রুতির সহজ সরল কথায় অভ্র একবার স্রুতির দিকে তাকালো। শ্রুতির দৃষ্টি তার দিকে বিদ্যমান দেখে, দ্রুত দৃষ্টি নত করে নিল। নিজেকে স্বাভাবিক করে নেওয়ার ভান ধরে অভ্র বলে উঠলো,

–আপনি কেমন আছেন? এমনিতেই পরিচিত হবার জন্য আপনাকে ডেকেছি। আপনাকে আমি সেভাবে চিনিনা। ভাবলাম বিয়ে আগে যদি একটু চেনা জানা হয়। তাহলে দু’জনের জন্য ভালো হয়। অভ্রের কথায় লাজুক হাসলো স্রুতি। মানুষটার সামনে বসে থাকতে ভিষণ লজ্জা কাজ করছে। একটু আগে সাহস করে প্রশ্ন করলেও, এখন সব সাহস হাওয়ার সাথে মিলিয়ে গিয়েছে। মনে এসে ধরা দিয়েছে একরাশ ভয় আর লজ্জা। স্রুতিকে ভয় পেতে দেখে অভ্র বলে উঠলো,

–আমাকে ভয় পাবেন না। আমি আপনার ক্ষতি করতে আসি নাই। আমাকে ভরসা করতে পারেন। আমি আপনাকে আজ কয়টা কথা বলতে চাই। আপনি আমার স্ত্রী হবেন। সে হিসেবে আমার অতীত জানার অধিকার আপনার আছে। আমি একটা মেয়েকে অনেক ভালোবাসতাম। তখন আমি বেকার ছিলাম। তার সব চাওয়া পাওয়া পূর্ণ করতে পারতাম না। একদিন সে এসে আমাকে বলল। তার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। আমি তাকে বললাম। চলো দু’জন পালিয়ে যাই। সে আমাকে বলল। আমি বেকার। নিজেই বাবা-মায়ের ঘাড়ে বসে খাই। তাকে বিয়ে করে কি খাওয়াবো? আমি নিজেই খেতে পাবো না৷ তাকে বিয়ে করে নিয়ে আসলে নাকি, না খেয়ে মরতে হবে। তার বিলাসিতার জীবন অনেক পছন্দের। তাই সে তার থেকে দিগুন বয়সী লোককে বিয়ে করে ফেলে। সে আমাকে ভুলে স্বামী সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই আছে। হয়তো আমার কথা তার মনেও পড়ে না। কিন্তু আমি তাকে আজও ভুলতে পারি নাই। ভালোবাসাটা হয়তো আমার দিক থেকে ছিল। তাই আমি ভুলতে পারছি না। তার জায়গায় অন্য কাউকে কল্পনা করতে, আমার এখনো কষ্ট হয়। আপনাকে ভালোবাসতে পারবো কি না৷ তা আমি জানিনা। তবে স্বামী হিসেবে যে আমার দায়িত্ব সেটা সব সময় পালন করে যাব। কথা গুলো বিয়ের আগেই বলে নিলাম৷ কারন বিয়ের পরে আপনি যেন আমাকে কোনো প্রকার দোষারোপ করতে না পারেন। আমি বাবা-মাকে অনেক বুঝিয়েছি। আমি বিয়ে করতে চাই না। তারা আমার কোনো কথাই শুনছে না। আমার জন্য তারা বহু কষ্ট পেয়েছেন। দীর্ঘ রজনী নয়নে অশ্রু ঝরিয়েছে। আমি আর তাদের কষ্ট দিতে চাই না। তাই নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে, বিয়ে করতে চাইছি।

অভ্রের কথা শুনে স্রুতির বুকের মধ্যে চিনচিন করে উঠলো। সে কি অসহ্য যন্ত্রনা। অভ্রের কথা গুলো বলার কি খুব দরকার ছিল। কিছু কথা আড়ালে থাকাই ভালো। সব কথা বাহিরে প্রকাশ করে দিলে, নিজের বলতে আর কিছু থাকলো না। ভেতরটায় হাহাকারে ভরে উঠেছে। মানুষটার সামনে আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তার আগেও কেউ মানুষটাকে ভালোবেসে ছিল। ভাবতেই কলিজা ছিঁড়ে বের হয়ে আসতে চাইছে। স্রুতি কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,

–আমার মনে হয় একটা সম্পর্ক জোর করে টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না৷ আপনি ভয় পাবেন না। আপনার বা আপনার পরিবার কাউকেই ছোট হতে হবে না। আপনি নিশ্চিতে থাকুন। আপনার মনের আশা আমি পূর্ণ করে দিব৷ আপনার আর কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। আমি বাসায় যাব। স্রুতির কথা শুনে অদ্ভুত ভাবে হাসলো অভ্র। স্রুতি আর বসে থাকতে পারলো না। ভিষণ কান্না পাচ্ছে তার। সে নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করল। অভ্র স্থির দৃষ্টিতে স্রুতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে-ও স্থান ত্যাগ করল।

বাসায় হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করল স্রুতি। তার বাবা সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিল। মলিন মুখখানা নিয়ে বাবার পাশে বসলো। মেয়েকে মনমরা হয়ে বসতে দেখে, খবরের কাগজ রেখে মেয়ের দিকে নজর দিলেন আবিদ রহমান। স্রুত অশ্রুসিক্ত নয়নে বাবার দিকে তাকিয়ে, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,

–আব্বু তুমি আমাকে কতটুকু ভালোবাসো? মেয়ের প্রশ্নে হতভম্ব হয়ে গেলেন আবিদ রহমান। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

–বাবা-মায়ের ভালোবাসা পরিমাপ করা যায়!

–আমার ইচ্ছের মূল্য তোমাদের কাছে কতটুকু? আমার চাওয়া পাওয়ার কোনো মূল্য তোমাদের কাছে আছে? মেয়ের কথায় চিন্তিত হয়ে পড়লেন আবিদ রহমান। মেয়ের অদ্ভুত কথায় অবাক না হয়ে পারছেন না। সব ধৈর্য সীমা অতিক্রম হয়ে যাচ্ছে। আবিদ রহমান কঠিন কণ্ঠে বলল,

–হেয়ালি আমার একদম পছন্দ নয়৷ সোজাসুজি কথা বলতে পারলে, আমার সামনে কথা বলতে আসবে। আর না হলে আমার সামনে কথা বলতে আসার দরকার নেই। বাবার কথা গুলো কর্ণকুহরে আসতেই স্রুতি সোজাসাপটা বলল,

–আমি এই বিয়ে করতে চাই না। দয়া করে এই বিয়ে ভেঙে দাও। আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করে দিও না। আমার জীবনের থেকে, এই বিয়ে যদি আগে হয়। তাহলে তোমরা আমাকে বিয়ের জন্য জোর করবে। আর আমি যদি তোমাদের কাছে মূল্যবান হই। তাহলে আজ সন্ধ্যার মধ্যে তাদের বাসায় গিয়ে বলবে, তোমরা এই বিয়ে দিতে চাও না। কথা গুলো বলে এক মুহুর্ত বিলম্ব করল না। উঠে দাঁড়ালো। মুনিয়া বেগম ক্রোধিত হয়ে স্রুতির দিকে এগিয়ে আসতে চাইলে, স্রুতির বাবা হাত দিয়ে ইশারা করে থামিয়ে দেয়। মেয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল।

–বেশ আমি তাই করবো। তোমার যেমনটা ইচ্ছে, আমি আজকেই বিয়ে ভেঙে দিয়ে আসবো। আমাদের এতটা খারাপ বাবা-মা মনে করো না। নিজেদের ইচ্ছে তোমার ওপরে চাপিয়ে দিব। নিজের রুমে গিয়ে বিশ্রাম করো। এসব নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না৷ স্রুতি আর দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে নিজের কক্ষের দিকে ছুটে গেল। স্রুতি চলে যেতেই আবিদ রহমান বুকে হাত চেপে ধরলেন। ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা তৈরি হয়েছে। মুনিয়া বেগম স্বামীর কাছে এসে বসলেন। স্বামীর পাশে বসে ধীর কণ্ঠে বলল,

–কি দরকার ছিল। মেয়ের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়ার। বুকে ব্যথা করছে। অতিরিক্ত চিন্তা করছো। বিয়ের জন্য না করতে হবে না। আমরা স্রুতিকে বুঝিয়ে বলবো। অর্ধাঙ্গিনীর কথায় মলিন হাসলো আবিদ রহমান। তাচ্ছিল্য করে বলল,

–আমাকে এত খারাপ বাবা মনে হয়৷ আমি মেয়ের সুইসাইড নোট পড়তে পারবো না৷ তবে মেয়েটাকে শান্তিতে বাঁচতে দিতে পারবো। আমি মেয়ের লাশের পাশে বসে বলতে পারবো না। তোর কোথায় কষ্ট হয়েছে? আমাকে একবার জানাতে পারতি। আমি তোর সব সমস্যা দূর করে দিতাম। আক্ষেপ নিয়ে এটা বলতে পারবো না। তুই আমাকে তোর মনের কথা জানিয়ে ছিলি৷ আমি তোর কথাকে গুরুত্ব দেয় নাই। আমি এটা শুনতে পারবো না৷ জন্ম যারা দিয়েছিল। তারাই দেয়নি বাঁচতে। আমাকে পাষাণ বাবার কাতারে ফেলো না স্মৃতির মা৷ আমার কাছে আমার সন্মানের থেকে আমার মেয়েরা আগে। তাদের ভালো থাকা আগে। আমি দুনিয়ায়র অনেক কিছু দেখেছি। আমি চাই না। আমার একটা সিদ্ধান্তের জন্য আমার মেয়ের প্রাণ যাক। স্বামী কথা শুনে মুনিয়া বেগমের কলিজা শীতল হয়ে গেল। মানুষটা এত ভালো কেনো? আজ মানুষটাকে নিয়ে তার প্রচুর গর্ব হচ্ছে, তার মতো করে যদি সবাই ভাবতে পারতো। তাহলে অনেক গুলো বাচ্চা মেয়ে জীবন বেঁচে যেত। শান্তিতে ক’টা দিন বাঁচতে পারতো।

ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিল রহমান শেখের পরিবার। এমন সময় দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। রোকেয়া বেগম এসে দরজা খুলে দিল। আবিদ রহমান আর মুনিয়া বেগমকে দেখে, আচমকা মুখে হাসি ফুটে উঠেলো। তাদের ভেতরে আসতে বলল রোকেয়া বেগম। আবিদ রহমান ও তার অর্ধাঙ্গিনী মলিন মুখ করে বাসার মধ্যে প্রবেশ করল। সবাই খুশি হয়ে তাদের ভালো-মন্দ প্রশ্ন করতে লাগলো। আবিদ রহমান হেয়ালি না করে সোজাসাপটা বলল,

–কথাটা আপনি কিভাবে নিবেন। তা আমি জানিনা। অতন্ত্য দুঃখের সাথে জানাচ্ছি। আপনার ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিব না। আশা করি আমার সমস্যাটা বুঝবেন। আমার মেয়ে এই প্রথম মুখ ফুটে আমার কাছে কিছু চেয়েছে। আমি তাকে না করতে পারি নাই। মেয়ের মন না থাকলে, আমরা তাকে জোর করে বিয়ে দিতে পারি না। আবিদ রহমানের একটা কথায় নিস্তব্ধ হয়ে গেল পুরো ড্রয়িং রুম। অদ্ভুত ভাবে অভ্রের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। দু’জন মানুষের মাথা নত হয়ে আছে। পিনপিনে নিরবতা কাজ করছে সবার মাঝে। অস্থির হয়েছে উঠেছে অভ্রের মন। তবে কি তার জন্য সমস্ত খুশি এক নিমিষেই দুঃখে পরিণত হবে?

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here