বৃষ্টিভেজা_আলাপন (১৩)

0
334

#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (১৩)

“ডক্টর,হি ইজ ফাইন?”

“কুল। আপনি নিজেই একজন ডাক্তার। এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই।”

লাবণ্য তবু শান্ত হতে পারল না। ডাক্তার নাফিস বেশ মনোযোগ দিয়ে রিপোর্ট গুলো দেখছে। লাবণ্য’র সাহস হয়নি রিপোর্ট দেখার।
“মিস্টার অভিরাজ মানসিক ভাবে বেশ শকে আছেন। ওনার শারীরিক স্বাস্থ্যে কিছুটা অবনতি এসেছে। শরীর দূর্বল আর আলো বাতাসের অভাব রয়েছে। কিছু মেডিসিন দিয়ে দিচ্ছি দূর্বলতা কেটে যাবে। তবে শরীরে আলো বাতাসের স্পর্শ লাগাতে হবে।”

ডাক্তারের কেবিন থেকে বের হয়ে অভি’র কেবিনে এল লাবণ্য। পুরোটা রাত ওর চোখে ঘুম নেই। ছেলেটা হুট করেই গত রাতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সারারাত স্যালাইন দেওয়া হলো। এভাবে চললে বাঁচবে মানুষটা?

অভি’র হাতটা ধরতেই লাবণ্য’র বুকটা হু হু করে উঠল। কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। এদিকে সমান তালে কল করছে অভি’র বোন ইরা। গত মাসেই মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। এরই মধ্যে খবরটা পৌছে গেছে তার কানে। লাবণ্য পুরো ঘটনা বললেও শান্তি পেল না মেয়েটা। লন্ডনের মতো জায়গা থেকে সেদিন ই রওনা দিয়ে দিল। অভি’র ফ্যাকাশে মুখটা লাবণ্যকে আরো ভেঙে দিল। আর কত সহ্য করবে সে?

আমিনা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। নিষ্প্রাণ দেহটা বিছানায় এলিয়ে আছে অভি। মায়ের ছোঁয়া তার হৃদয়কে শীতল করে দিচ্ছে।
“অভি, বাবা কেমন লাগছে এখন?”

“ঠিক আছি মা।”

“না খেলে আবার শরীর খারাপ করবে। একটু খেয়ে নে সোনা।”

“ইচ্ছে করছে না।”

“ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে অভি। এভাবে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। শরীরে আলো বাতাস না লাগালে পাথর হয়ে যাবি।”

“এমনিও আমি পাথর হয়ে গেছি লাবণ্য।”

বিষন্ন হয়ে এল লাবণ্য’র মুখশ্রী। ছেলেটা এত বেশি বুঝে কেন?

বিকেল বেলা অভিকে নিয়ে গার্ডেনে বের হলো লাবণ্য। এই বাগানটা বড়ো শখ করে গুছিয়েছিল অভিরাজ। আর তার সঙ্গ দিয়েছিল ইরা, লাবণ্য। অথচ সময়ের স্রোতে বাগানটায় ভুলেও পা রাখে না অভি। কত বছর হয়ে গেল নিজ হাতে গাছ গুলোকে পানি দেওয়া হয় না। কচি নরম গাছ গুলোর মাঝে নিজের অতীত খুঁজে পেল সে। বহু দিন পর আজ নিজ হাতে গাছ গুলোকে পানি দ্বারা সিক্ত করল। ওর এই একটুখানি স্বাভাবিক অবস্থাও যেন লাবণ্য’র চোখে অমৃত।

রাতের খাবারটা একসাথেই খেল সবাই। ইরা এভাবে চলে আসায় একটু রাগ দেখাল অভি। সে বুঝতে পারল তার শারীরিক অসুস্থতা তার পরিবারকে কতটা পীড়া দেয়।
“তোমার কিছু হলে আমি তো শেষ হয়ে যাব ভাইয়া। তুমি এমন করো কেন?”

“পরের বার এত রিক্স নিয়ে চলে এলে মা র খাবি ইরা।”

“তার মানে সামনেও এমন কিছু হবে?”

এ প্রশ্নের জবাব এল না ছেলেটির থেকে। সে মাছের কাটা ছাড়াতে ব্যস্ত। কাটা ছাড়াতে ছাড়াতে উষশী’র কথা মনে পড়ল। মেয়েটি কাটা বাছার জন্য মাছ খেত না। তারপর অভি যখন মাছ খাওয়ানো শিখাল সে থেকে দু বেলাই মাছ মাছ করে পাগল করে ফেলত। সেই মেয়েটা আজ কোথায় আছে অভি’র জানা নেই। তার দেহ মন পুরোটাই অতীতের মাতম তুলল। হাহাকার যেন ছিঁড়ে ফেলল বুক।

অতীত

আকাশ ডাকতেই খেয়াল হলো অভিরাজের। উষশী’র মসৃণ সুতার ন্যায় চুল গুলো এখনো মুঠোতে। উষশী ও তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। একটু অস্বস্তি বোধ করল অভি। অথচ এর বিন্দুসম দেখা গেল না উষশীর মাঝে। অভিরাজ চোখ নামিয়ে ফেলল। এর মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।
“নেমে আসো।”

“যাব না।”

“আরে!”

“থাকতে দেন না একটু।”

“নো। একটুও না। জ্বর এসে যাবে।”

“কিছু হবে না।”

“বাচ্চাদের মতো করো না উষশী।”

“আমি তো বাচ্চাই।”

বাক্যটিতে কিছু ছিল। অভি’র দৃষ্টি শীতল হয়ে এল। বৃষ্টির জলে ভিজতে লাগল দুজনা। উষশী চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। তার গোলাপি রঙা ঠোঁট যেন আরো বেশি গোলাপি হয়ে এসেছে। সুন্দর মুখটা জলসিক্ত। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে পনেরো বছর বয়সী কিশোরী। অভিরাজ এই মুহূর্তে মেয়েটিকে যুবতী রূপে দেখতে লাগল। তার কোমল পা দুটো যেন পদ্মফুল।
“অভি, উষশী কোথায় তোরা। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। এই কোথায় তোরা।”

ডাকতে ডাকতে ছাদে চলে এসেছে লাবণ্য। ওদের ভিজতে দেখে বলল,”পাগল হয়ে গিয়েছিস?”

“উষশী চলো।”

“না, না আর একটু প্লিজ।”

“অভি দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

“উষশী আসছে না।”

“টেনে নিয়ে আয়। উফ আমার ঘরের জানালা গুলো খুলে রেখে এসেছি। ওকে দ্রুত নিয়ে আয় অভি।”

উষশী যাবে না বলেই স্থির করেছে। বৃষ্টি যেন ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়েছে। অভিরাজ এবার রাগান্বিত বোধ করল।
“এখনি নামবে তুমি।”

“প্লিজ আর একটু।”

কোনো কথাই গায়ে মাখল না অভিরাজ। উষশীকে নিয়ে নেমে এল। উষশী বৃষ্টির জলে ভিজে একাকার। সে তবু তাকিয়ে রইল ছাদের পানে। বিন্দু বিন্দু জল কণা গুলো ছাদে থাকা গাছ গুলোকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। কি সুন্দর মনোরম এই পরিবেশ।

ঈশান দোলনায় বসে বসে ফোনে যেন কি করছে। ছেলেটার কথা বার্তা উষশীর হৃদয় ছুঁয়েছে। সে পেছনে এল দাঁড়াল।
“হাই। আই ক্যান সিট নেক্সট টু ইউ?”

“ইয়া সিউর।”

“তোমার মন খারাপ?”

“কেমন করে বুঝলে?”

“তোমার চোখের দৃষ্টি পড়ে।”

“তুমি আই রিড করতে পারো?”

“কখনো কখনো।”

“ফাইন। তুমি এখানে কি করছো? সবাই তো মজা করছে।”

“তোমাকে দেখে এলাম।”

“বন্ধুত্ব করতে চাও?”

“ইয়াহ।”

ঈশান পুরোপুরি মুখোমুখি হয়ে বসল। উষশী সুন্দর এক বিদেশিনী। তার কোমল চুল আর সুন্দর দুটো চোখ দেখল সে।
“হোয়াট ডু ইউ সি অন মাই ফেস?”

“ইউ আর বিউটিফুল লিটল গার্ল।”

“হা হা। সবাই এটা বলে।”

“বিকজ ইউ ডিজার্ভ ইট।”

“থ্যাংক ইউ। বাট তুমি কেন মন খারাপ করে আছ?”

“কাউকে বলবে না তো?”

“একদম ই না।”

“ওকে। এক্সচুয়ালি আমি আমার কাজিন সিস্টারকে খুব ছোট থেকে লাইক করি। বাট উই হেভ সাম রেস্টিকশন। সো আই কুড নট এক্সপ্লেইন মাই ফিলিংস।”

উষশী গোমড়া মুখ করে বলল,”ভেরি স্যাড।”

তৎক্ষণাৎ হেসে উঠল ঈশান। হাসতে হাসতে ছেলেটার চোখের কোণে জল চলে এসেছে।
“তুমি বিশ্বাস করলে এসব?”

“কেন করব না?”

“ফুলিস গার্ল।”

“এতক্ষণের সব মিথ্যে ছিল?”

“ইয়াহ। আই এম জাস্ট জোকিং।”

“বাট হোয়াই ডু আই থিংক দিস ইজ ট্রু।”

“ছোট মানুষ তুমি।”

ঈশানের ভেতর থেকে নিশ্বাস বেরিয়ে পড়ল। উষশী ভেবে পেল না কোনটা ঠিক। সে শুধু তাকিয়ে রইল।

অলকদের বাড়ি’র সবার খাওয়া প্রায় শেষ। এখন ড্রয়িং এ বসে আড্ডা চলছে। এক পাশে বাড়ির সব বাচ্চারা। উষশীকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে ডাকল অভি।
“এদিকে এসো উষশী।”

“জী?”

“কোথায় ছিলে?”

“উপরের ঘরে।”

“খাবার খেলে না যে।”

“ক্ষিধে পায় নি তো।”

“আচ্ছা বসো। এরা হচ্ছে সব আমাদের ফ্যামিলি মেম্বার। উই অল হেভ আ নাইস রিলেশনসীপ।”

সকলের সাথে পরিচয় হলেও উষশীর ভেতরে আনন্দ নেই। সেটা লক্ষ্য করেই আলাদা হলো অভিরাজ। ট্রেরেসে এসেও অন্যমনস্ক হয়ে রইল মেয়েটি।
“হোয়াট হ্যাপেন উষশী?”

“আমার খুব খারাপ লাগছে।”

“ঘরে যাবে?”

“নো।”

“তাহলে?”

“ঈশান নামের ছেলেটা বড়ো বিষণ্ন হয়ে আছে। ওর মনের ভেতর খুব কষ্ট বোধহয়।”

“ও এমনি। সিরিয়াস কিছু না। একদম মন খারাপ করবে না। আচ্ছা চোখ বন্ধ করো তো।”

উষশী চোখ বন্ধ করল। মৃদু হাওয়ায় নড়ছে মেয়েটির বাদামী রঙা চুল। ওর দিক থেকে নজর হটিয়ে পকেট থেকে কিছু একটা বের করল। খানিক বাদে নিজের গলায় শীতল কিছুর আভাস পেল উষশী। চোখ খুলতে চাইলেই বাঁধা দিল অভিরাজ।
“চোখ বন্ধ।”

“কি করছেন?”

“কথা নয় উষশী।”

“আমার সুরসুরি লাগছে।”

“দাঁড়াও একটু।”

“হয়েছে?”

“এই তো। এবার চোখ খুলো।”

নীল রঙের পাথরটা একটু বেশিই সুন্দর। উষশী’র ফর্সা গলায় বেশ সুন্দর লাগছে। অভিরাজের দিকে না তাকিয়েই উষশী বলল, “এটা তো অনেক সুন্দর। এই পাথরের কস্ট তো অনেক। আমায় কেন দিলেন?”

“দিতে পারি না?”

“কস্টলি তো।”

“তো?”

“আমার জন্য এত গুলো টাকা…”

“এত হিসেবি কেন তুমি?”

“হিসেব ছাড়া জীবন চলে?”

“তা চলে না। ছোঁয়ার জন্য গিফ্ট কিনতে গিয়েছিলাম। তখনি এটা নজরে এল। তোমার কথা মনে পড়ছিল। তাই নিয়ে এলাম।”

“থ্যাংক ইউ।”

জবাবে মৃদু হেসে উঠল অভিরাজ। তার এই হাসি দু নয়ন ভরে দেখছে উষশী। মেয়েটার কোমল ত্বকে হাওয়া এসে সুরসুরি দিচ্ছে। এক অন্যরকম সুখ অনুভব হলো। হুট করেই ভীষণ ভালো লাগছে মেয়েটির।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ ন‍ৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here