যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া #আনিশা_সাবিহা পর্ব ২৯

0
690

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৯

ভোর তখন সাড়ে পাঁচটা। রাতে প্রবল ঝড়ের পর আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। আকাশে লাল লালিমার মাঝে সবে সূর্যের চিহ্নের দেখা মিলছে। পরিবেশটা শীতল। মোহ তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠল। মাঝখানে মোটা কাঁথা নিয়ে গুটিশুটি হয়ে ঘুমাচ্ছে ইথান। তার অন্যপাশে রাবেয়া বেগম। গত রাতে মোহ এই ঘরে ইথানকে নিয়ে ঘুমোতে আসায় বেশ অবাক হয়েছিলেন রাবেয়া বেগম। তবে মোহ ঝড়ের কারণে ভয় লাগছে এই বাহানার দ্বারা রাবেয়া বেগমকে সামলে নিয়েছে।

বিছানা থেকে আস্তে করে নেমে দুয়ার খুলে পাশের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় মোহ। কোনোরকমে এলোমেলো বিরক্তিকর চুলের খোঁপা করে খটখট শব্দ করে হালকা করে খুলে নেয় দরজা। একটু ফাঁক করতেই অন্ধকার রুমে আলো ছড়িয়ে পড়ে। ঘরে উঁকি দিয়ে স্বচ্ছের অবয়ব ফুটে ওঠে মোহের চক্ষুদ্বয়ে। খালি গায়ে উপুড় হয়ে বেঘোরে ঘুমিয়ে যাচ্ছে লোকটা। না চাওয়া সত্ত্বেও তপ্ত শ্বাস ফেলে ঘরে ঢুকল মোহ। যে করেই হোক স্বচ্ছকে এখন বের করতে বাড়ি থেকে। দাদীজান দেখে ফেললে ভয়ঙ্কর বিপদ!

চৌকির কাছে গিয়ে শুকনো গলায় নিচু স্বরে স্বচ্ছকে ডাকে মোহ।
“শুনছেন! ভোর হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠুন।”

ঘুমন্ত স্বচ্ছের কোনো হেলদোল হলো না। শুধু কেঁপে উঠল মৃদু চওড়া শরীরটা। মোহ আবার ডাকল।
“এত বেঘোরে কেউ ঘুমায়? আল্লাহ জানে দাদীজান একবার বুঝে গেলে কী অবস্থা করে! তার আগেই দ্রুত উঠুন প্লিজ।”

আগের মতোই কোনো সাড়া পেল না মোহ। এবার কিছুটা বিরক্ত হলো সে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বচ্ছের বাহুতে হাত রাখল ডাকতে। তৎক্ষনাৎ যেন মনে হলো তার হাত পুড়ে যাচ্ছে। দ্রুত হাত সরিয়ে ফেলল মোহ। আতঙ্কে ছেয়ে গেল চোখমুখ। খুব সাবধানে স্বচ্ছের কপালে হাত রেখে বুঝল মানুষটার প্রচণ্ড জ্বর এসেছে। পুড়ে যাচ্ছে গা। টেনশনে এবার মোহের মাথার স্নায়ুগুলি ছিঁড়ে যাবার উপক্রম। একদিকে দাদীজানের ভয় অন্যদিকে লোকটির এই অবস্থায় কোনদিক সামলাবে বোধগম্য হলো না তার। আর কিছু না ভেবে দ্রুতই বারান্দা থেকে বাটি নিয়ে রুমাল ভিজিয়ে স্বচ্ছের নিকট এলো। স্বচ্ছের দ্রুত সুস্থ হওয়া প্রয়োজন।

এখনো উপুড় হয়েই ঘুমাচ্ছে স্বচ্ছ। মোহ বারবার ডেকেও তাকে সোজা করতে পারছে না। একসময় স্বচ্ছের হাত টেনে ধরল মোহ। হুঁশে না থাকা স্বচ্ছ নড়েচড়ে উঠে কষ্ট করে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। আধো চোখ মেলে মোহকে আবছা দেখে তাড়াহুড়ো করে প্রশ্ন করার চেষ্টা করল,
“সকাল হয়ে গেছে? কয়টা বাজে?”

“সকাল তো হয়েছে। কিন্তু এই অবস্থায় আপনি যেতে পারবেন? মনে তো হয়না।”

“কেন কী হয়েছে আমার? একদম ফিট আছে। আন্ডারেস্টিমেট করো আমায়? আমি যেতে…”

কাঁপা স্বরে কথাগুলো বলে শেষ করতে পারল না স্বচ্ছ। তার আগেই গভীর ঘুমে চলে গেল সে। মোহ চটে গেল খানিকটা। কপালে ভেজা রুমাল রেখে ফুঁসে উঠে বলল,
“শরীরের জোর কমেছে। কথার জোর কমেনি।”

দুয়েকবার করে রুমাল মাথায় দিয়ে ঘর থেকে বাহিরে এলো মোহ রাবেয়া বেগম উঠেছে কিনা তা দেখতে। বাহিরে এসে হাফ ছাড়ল সে। হাতে ব্রাশ নিয়ে খালি পায়ে উঠান পেরিয়ে বড়ো দরজাটা খুলল। বাহিরের আবহাওয়া উপভোগ করতে বেশ লাগছে তার। বড়ো শ্বাস ফেলে হালকা করার চেষ্টা করল নিজেকে। দেখতে লাগল চারপাশটা। গ্রামের ছেলেমেয়েরা শহরের ছেলেমেয়েদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি চঞ্চল হয়। তার প্রমাণ এই ভোরে উঠে টিউশনে পড়তে যাওয়া। মোহ বাচ্চা ছেলেমেয়েদেরকেই দেখছিল ব্রাশ করতে করতে। আচমকা একটি বাচ্চা ছেলে এসে দাঁড়াল তার সামনে। হাসিমুখে জানতে চাইল,
“আপা! কিরাম আছো?”

ছেলেটির নাম শান্ত। মোহ তাকে চেনে। গ্রামে দুষ্টুমির জন্য তার নামডাক অনেক। মোহও বিপরীতে হেসে জবাব দিল,
“হ্যাঁ ভালো আছি। তুই?”

“আমিও তো হেব্বি আছি। তোমারে দেইখা একটা কথা মনে পড়ল। তাই জিগাইতে আইয়া পড়লাম।”

“কী কথা?”

“কালকে রাত্রে তোমাগো বাড়ির খোঁজ করতাছিল একটা লোক। আমি ঠিকানা কইয়া দিছি। লোকটা কি তোমাগো বাড়িতে আইয়া পৌঁছায়ছে? দেইখা মনে হইতেছিল তোমাগো বাড়ি আগে কোনোদিন আহে নাই। আমারে নিয়া যাইতে কইতাছিল।”

মোহের ভ্রু দু’টো আপনাআপনি জড়িয়ে গেল। প্রথমেই স্মরণে এলো স্বচ্ছের কথা। অতঃপর ভাবল, উনি নাকি আত্মীয়দের বাড়ি এসেছেন? অনেক ভেবে জিজ্ঞেস করল,
“লোকটা কী প্রশ্ন করছিল তোকে?”

শান্ত একটু ভেবে বলল,
“কইতাছিলেন, আজহার সাহেবের বাড়ি চিনো তুমি? আমি তোমার নাম কইতেই সে কইল, হ তোমারই বাড়ি।”

মোহের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে গেল এবার। শুধাল,
“দেখতে কেমন? সুন্দর? চোখের মনির রঙ কি অন্যরকম? জামা কী কালার পরে ছিল?”

এত প্রশ্ন শুনে বিভ্রান্ত হলো শান্ত৷ মাথা চুলকে বলল,
“এতকিছু কেমনে কমু? আন্ধার ছিল তো। বাট গাড়ি লইয়া আইছিল মনে হয় আর ভালো কইরা হাঁটতে পারতাছিল না। পায়ে সমস্যা হইছিল মনে হয়।”

মোহ এবার পুরোটা ধরে ফেলল। নিশ্চিত হয়ে গেল স্বচ্ছের উদ্দেশ্যই ছিল তার বাড়ি অবধি আসা। নিজেকে ধাতস্থ করে দ্রুত শান্তকে বলল,
“আচ্ছা তুই যা।”

শান্ত চলে গেলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল মোহ। রাগে শরীর রি রি করে উঠল তার। হাত মুঠো করে বলল,
“মিথ্যুক মানুষ একটা! চোরকে বিশ্বাস করা যাবে তাও এই আহিয়ান স্বচ্ছকে বিশ্বাস করা যাবে না।”

মোহ ধুপধাপ শব্দ করে বাড়িতে ঢুকল। প্রথমে রাবেয়া বেগমের ঘরে উঁকি দিয়ে এরপর স্বচ্ছের ঘরে ঢুকতেই মোহ দেখল স্বচ্ছ উঠে বসে মাথা নিচু করে বসে আছে। প্রথমেই মোহের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করল লোকটি মিথ্যে কেন বলল? কিন্তু স্বচ্ছের বেগতিক অবস্থা দেখে নিজেকে সামলে নিলো মোহ।
“উঠে পড়েছেন? কেমন লাগছে এখন?”

স্বচ্ছ অস্পষ্ট জবাব দিলো,
“মাথাটা ঘুরছে।”

মোহ তেতে উঠে বলে,
“ঘুরবেই। মিথ্যাবাদীদের এমনই হয়।”

স্বচ্ছ মাথা সোজা করে মোহের পানে সরু দৃষ্টি রাখে। মোহের কথা না বুঝে বলে ওঠে,
“কী? কী বললে তুমি?”

“জ্ঞানী ব্যক্তিরা এক বলাতেই সব বুঝে ফেলে। যা বলার বলেছি। বুঝতে চাইলে বুঝে নিন। নয়ত বুঝতে হবে না।”

“সবসময় তোমার বাঁকা উত্তর পাই কেন বলো তো? একটা অসুস্থ মানুষকেও ছাড় দেবে না তুমি? এতটা নির্দয়া কী করে হলে?”

মোহ কিছু বলল না। চুপ করে বাহিরে চলে গেল। কিছুসময় পর হাতে ভেজা কাপড় নিয়ে এসে স্বচ্ছের দিকে এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
“এই নিন। এটা দিয়ে পুরো শরীর মুছে নিন। জ্বর এসেছে আপনার।”

স্বচ্ছ তার দুর্বল চোখ পাকিয়ে বলল,
“পুরো শরীর?”

“হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি নিন ধরুন। হাত-পা সব মুছে নিন। আরাম লাগবে। আর জ্বর কমলেই চলে যাবেন প্লিজ!”

“তোমার সামনেই প্যান্ট খুলব এখন?”

স্বচ্ছের আচমকা এই কথায় মোহের নেত্রপল্লব বৃহৎ আকার ধারণ করল। একপ্রকার আশ্চর্য হয়ে বলল,
“কী?”

“না মানে তুমি হাত-পা মুছতে বললে। সেটার জন্য তো শরীর সব কাপড় খুলতে হবে তাই না? এজন্য বলছিলাম তোমার সামনেই খুলব? ব্যাপারটা বেশি হয়ে যাবে না?”

মোহ রাগে, লজ্জায় কাঁপতে শুরু করল। পিছু ফিরে দরজার দিকে যেতে যেতে বিড়বিড়িয়ে ওঠে,
“বেয়াদব লোক!”

চুলোর কাছে বসে ভাত রান্না করছেন রাবেয়া বেগম। চুলোটা আগের। আধুনিক গ্যাস, ইলেকট্রিক চুলো দিয়ে উনার চলবে না। উনি আগের চুলোতেই অভ্যস্ত। মোহ তার পাশেই বসে আছে আনমনে। ইথানের ঘুমটা এখনো ভাঙেনি। মোহ নিজের মনে ভেবে যাচ্ছে যা হচ্ছে একদমই ঠিক হচ্ছে না। সে ইতিমধ্যে আন্দাজ করে নিয়েছে স্বচ্ছের মনের অনুভূতির উপস্থিতি। বিষয়টা মোহের কাছে সুন্দর লেগেও লাগছে না। কোথাও একটা খুঁতখুঁত করছে। সরোয়ার সাহেবের কথা বারবার মস্তিষ্ক মনে করিয়ে দিচ্ছে। স্বচ্ছের এমন আচরণ যে এবার সরোয়ার সাহেবের কথাগুলো সত্যি বানিয়ে দিচ্ছে ভেবেই আঁতকে ওঠে মোহ। সে চায়না ওই মন্ত্রী সাহেবের কথা মিলে যাক। এতে তার কথার দাম যে কমে যাবে এবং এটা তার কাছে খুবই অসম্মানের।

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। আজকের পর্ব ছোটো হয়ে যাওয়ার জন্য দুঃখিত।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here