লুকানো_অনুরক্তি (১৩) রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

0
236

#লুকানো_অনুরক্তি (১৩)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন প্যাঁচ হচ্ছে কথার প্যাঁচ। সব রকম প্যাঁচ থেকে সহজে বের হওয়া গেলেও কথার প্যাঁচে একবার আটকে গেলে সহজে বের হওয়া যায় না। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে মানুষ। উপস্থিত বুদ্ধি লোপ পায়। কথার পিঠে কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারে না।

বয়োজ্যেষ্ঠ শহিদুল হক তেমনি নিজের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা দ্বারা ফাতেমা আমিন কে কথার জালে আটকেছেন। নিজের কথার জালে কোনঠাসা করেছেন ফাতেমা আমিনকে। শহিদুল হক এমন ভাবে প্রস্তাব রেখেছেন ফাতেমা আমিন কে ভাবতে হচ্ছে। বার বার ভাবতে হচ্ছে। সবার কথা যেমন রাখা যায় না৷ তেমনি কারো কারো কথা ফেলাও যায় না। মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তিনি ভেবেই চলেছেন।

শুকনো ঠোঁট জোড়া জিহবা দ্বারা ভিজিয়ে নিলেন তিনি।

‘আসলে দুলাভাই আমি মা। আমার সব দিক ভাবতে হয়। মাথায় রাখতে হয় আমার সন্তানকে যেন কেউ খারাপ না বলে। সমাজে যেন একটু মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে।’

শহিদুল হক কিছু বলতে যাবেন তার আগেই কথায় টান দেন আফসানা খানম।

‘আবার সেই সমাজের কাছে এসে আটকে গেলে। সমাজ কি ভাববে? কি বলবে? সমাজ কে সাইডে রেখে একবার নিজের সন্তানের সুখের কথা ভাবো। সমাজের কথা চিন্তা করে মেয়েটাকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিলে। সেখানে মনের মিল হলো না। শান্তি পেল না। শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদে গড়ালো সম্পর্ক। তখন তোমার এই সমাজই আবার মেয়েটাকে কথা শুনাবে। সমাজ সব সময়ই কথা শুনায়। হউক ভালো বা খারাপ।’

‘আফসানা তুমি থামবে? ফাতেমা কে ভাবতে দাও। ও শিক্ষিত মানুষ। কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ ও বুঝে। ওকে ওর সিদ্ধান্ত নিতে দাও।’

তারপর আবারও নীরবতায় ছেয়ে গেল চারপাশ।

আফসানা খানম উঠে ছেলের কাছে গেলেন। এলোমেলো চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দিলেন পরম মমতায়।

‘আমি জানি ফাতেমার উত্তর না হবে। মন খারাপ করিস না বাবা। এক জীবনে সবার সবকিছু পাওয়া হয় না। কিছু কিছু অপূর্ণতা থেকে যায়। ধরে নে এটাই তোর অপূর্ণতা। সবাই তো আর তোর মায়ের মতো সমাজ কে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারে না। অনেকে সন্তানের থেকেও বেশি সো কল্ড সমাজকে দেখে।’

মাহফুজের র’ক্তিম চোখ জোড়ায় হাহাকার। প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে ভয়। ব্যাকুল চোখ জোড়া তার অবনিতে নিবদ্ধ। কি অদ্ভুত মেয়েটাকে দেখেও আজ তার চোখের তৃষ্ণা মিটছে না। তৃষ্ণা, পিপাসা কেবল বাড়ছে। তবে কি আজই দেখা? বক্ষঃস্থলে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার।

ফাতেমা আমিন অনিমেষ চোখে মাহফুজকে পরখ করল। ছেলেটার চোখে এক সমুদ্র ভালোবাসা ভাসমান। তারপর তার দৃষ্টি অনুসরণ করে অবনির দিকে তাকালেন। অবনি নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে।

ছেলেমেয়ে দু’টো তিনি বার বার দেখলেন। হ্যা বা না কি বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। ক্ষণকাল নিজের মন মস্তিষ্কের সাথে লড়াই করে অবনির হাতটা শক্ত করে ধরেন। নিরেট গলায় বলেন,

‘তোর সাথে আমার একান্তে কিছু কথা আছে। তোর রুমে চল।’

টানতে টানতে অবনিকে নিয়ে চলে গেলেন তিনি।

আফসানা খানম সেদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই শহিদুল হক আটকে ফেলেন উনাকে।

‘তুমি কোথায় যাচ্ছো?’

‘আরে মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেল। এখন নিশ্চয়ই ব্রেইন ওয়াশ করবে।’

‘যা ইচ্ছে তাই করুক। আমি সিদ্ধান্ত ওর উপর ছেড়ে দিলাম। তার সন্তান কে তার থেকে বেশি ভালো তুমি বাসবে না। চুপচাপ বসো এখানে।’

মামুনুর রশীদ দাঁড়ালেও তিনি বাঁধা দেন।

‘তুমিও যাবে না। মনে করো এখানে তোমরা কেউ নেই। শুধু আমি, ফাতেমা আর অবনি ছাড়া। আমি দেখি ফাতেমা কি সিদ্ধান্ত নেয়।’

_______________________

মুখে হাত দিয়ে অবনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। থেকে থেকে কাঁপছে তার শরীর। মেয়ের কান্নায় বুকটা দুমড়ে মুচড়ে আসছে উনার। ফাতেমা আমিন অবনির একটা হাত ধরে কোমল স্বরে শুধালেন,

‘আমায় সত্যি করে বল, তোর সাথে মাহফুজের কোনো সম্পর্ক আছে?’

অশ্রুসিক্ত ঝাপসা চোখে মায়ের দিকে তাকায় অবনি। লালাভ চোখ জোড়া তার ভীষণ জ্বলছে। আচমকাই উনাকে দু’হাতে ঝাপটে ধরে অবনি। বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে বলে,

‘আমাকে এখানটায় লুকিয়ে ফেলো মা। যেন কেউ আর খুঁজে না পায়। কেউ যেন ভালোবাসি বলে মানসিক ভাবে দূর্বল করে না দিতে পারে। নিজের অনুভূতি, অনুরক্তি লুকিয়ে রাখতে রাখতে ক্লান্ত মা আমি। আমার অবাধ্য অনুভূতিগুলো যে বাঁধন ছাড়া হয়ে গেছে। আমি আর এর ভার সইতে পারছি না। আমার বুক ভেঙে আসে। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। আমি আর অভিনয় করতে পারছি না। মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি পরাজিত। বিপরীত পাশের লোহা গলার সাথে সাথে যে আগুনও শিথিল হয়ে এসেছে। কমে এসেছে এর উত্তপ্ততা। শান্ত হতে শুরু করেছে বহ্নিশিখা। আমি এক মুহূর্তের জন্যও মাহফুজ ভাইকে বুঝতে দেইনি।’

অনবরত কথা গুলো বলে কাশতে লাগল অবনি। চোখ জোড়া মুদে আসছে। শরীরও দূর্বলতায় নেতিয়ে পড়ছে। তবে আজ যে চুপ থাকলে চলবে না। মনের কথাগুলো মনে চেপে রাখতে রাখতে মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে সে।

‘নিজেকে কঠিন থেকে কঠিনতম শক্ত খোলসে আবৃত রাখতে রাখতে হাঁপিয়ে গেছি আমি। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আমি তারপরও মাহফুজ ভাইকে বুঝতে দেইনি আমিও একটু একটু করে তার উপর দূর্বল হয়ে পড়ছি। উনার মুখে ভালোবাসি শুনে, উনার পাগলামি দেখে আমারও বলতে ইচ্ছে করতো ভালোবাসি কথাটা। কিন্তু আমি যে আমার মায়ের কাছে ওয়াদা বদ্ধ। আমি আমার মাকে দেওয়া কথা খেলাফ করি কিভাবে? মায়ের দেওয়া শিক্ষার দিকে আঙুল তুলি কিভাবে? আমি এতোটাও খারাপ সন্তান না মা। বার বার ফুফু কে বলেছি আমি হোস্টেল চলে যাবো। ফুফু দিলো না। তাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। নিজের সমস্ত অনুভূতিকে গলা টিপে করেছি হ*ত্যা। আমি চাই না আমার মা আমার উপর নারাজ হউক। আমার দিকে ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকাক। তোমার ঘৃনা ভরা দৃষ্টি আমি সইতে পারবো না। তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে আমি তা মাথা পেতে নিবো। তারপরও আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। আমায় ভুল বুঝো না। উনার সাথে আমার প্রেম গঠিত কোনো সম্পর্ক নেই। ভুল বুঝে আমায় বদদোয়া দিও না। মায়ের দোয়া কিংবা বদদোয়া দুটোই তরবারির চেয়ে ধারালো। আল্লাহর দরবারে বলতে দেরি হয় আর কবুল করতে হয় না।’

মনের চেপে রাখা কথা গুলো বলে মায়ের বুকের সাথে লেপ্টে রইলো অবনি। বুকটা কেমন হালকা লাগছে তার।

মেয়ের মুখ নিঃসৃত হৃদপিণ্ড ছেদ করা প্রতিটা কথা শুনে কিংকর্তব্যবিমুঢ় ফাতেমা আমিন। হতবিহ্বল হয়ে গেলেন পলকে। বিমূঢ় চোখে চেয়ে রইলেন সামনের দেয়ালে। চোখ ভিজতে লাগল উনার। হাত দুটো অবনির পিঠে রেখে বুকে সাথে মিশিয়ে নিলেন আরো। উনার দেওয়া শিক্ষা ভুল না।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়েন আফসানা খানম। সাথে নাদিয়া। শহিদুল হকের নিষেধ থাকা সত্বেও চলে এসেছেন মা মেয়ের কথা শোনার জন্য। নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারেননি। এতোক্ষণ দরজার বাইরে থেকে অবনির বলা প্রতিটা কথা তিনি শুনেছেন।

চমকে উঠে অবনি সহ ফাতেমা আমিন।

‘এখনো তোমার ওই সমাজে কথা ভাববে ফাতেমা? যে সন্তান মায়ের দেওয়া আদেশ, ওয়াদা পালন করতে গিয়ে নিজের ভালোবাসাকে জলাঞ্জলি দিতে পারে। সেই মায়ের কি উচিত না মেয়েকে তার ভালোবাসা ফিরিয়ে দেওয়া? সেই মা কি পারে না মেয়ের অনুভূতিকে সম্মান করতে? জেদ ধরে থেকো না। মেয়েটাকে একটু বুঝো। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়েটাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিলে আদৌও সে সুখী হবে?’

নাদিয়া ফাতেমা আমিনের হাত ধরে অনুরোধের স্বরে বলে,

‘মামি এতোটা কঠোর হয়ো না। আমি জানি আমার ভাই অবনিকে ঠিক কতটা চায়। কতশত পাগলামি করে শুধু অবনিকে পাওয়ার জন্য। একটু নরম হও। আজ তোমার হাতে সবকিছু। তোমার বলা একটা হ্যা এ সুখের একটা সংসার হবে। আর না এ অনেক কিছু বদলে যাবে।’

অবনির এলোমেলো চুলগুলো সস্নেহে কানের উল্টো পিঠে গুঁজে দিলেন তিনি। ঘর্মাক্ত কপালে এঁকে দিলেন সুদীর্ঘ চুম্বন। অবনির মুখটা হাতের আঁজলে নিয়ে কোমল স্বরে বলেন,

‘মায়ের প্রতি সম্মান রেখে সন্তান যদি তার সমস্ত অনুরক্তি অতি সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখতে পারে। অনুভূতিকে গলা টিপে হ*ত্যা করতে পারে। তবে মা কেন পারবে না সন্তানের সেই মৃ*ত অনুভূতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে? মায়েরা তো সন্তানের সুখের জন্য সব পারে।’

#চলবে

আজকের পর্ব ছোট বলবেন না প্লিজ। আবারও গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে আমার। জ্বর নিয়ে লিখেছি। নয়তো বলবেন এমন একটা জায়গা আগের পর্ব শেষ করে আপনাদের অপেক্ষা করাচ্ছি। দোয়া করবেন আমার জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here