বাতাসে_প্রেমের_আভাস (পর্ব-৫) লেখনীতে— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

0
297

#বাতাসে_প্রেমের_আভাস (পর্ব-৫)
লেখনীতে— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

রুমের এক কোণে চুপটি করে বসে আধ্রিকা মিসবাহ্’কে নিয়ে ভাবছে। লোকটা সেদিন ফেরার পথে তাকে ‘ভালো থেকো’ বলেছিল। তুমি করে বলেছিল। আচ্ছা, আপনি থেকে হঠাৎ তুমিতে এলো কেন? তবে সেও কি তেমন কিছু অনুভব করে যেমনটা আধ্রিকা করে! আধ্রিকা নিজেই ভেবে পাচ্ছে না তার অনুভূতিটার নাম কি! কি নাম দেওয়াই বা যায় এই অনুভূতিকে? এটা কি কেবল ইগোর খেলা নয়? অন্য কিছু আছে এতে! আধ্রিকা তো ইগো ভেবেই বসে ছিল। অথচ এখন মনে হচ্ছে অন্য কিছু। এই যে একটু আগে ভাবী এসে জানালো মিসবাহ্ আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। প্লেনে আছে এখন। কথাটা শুনে তার এত কেন ক’ষ্ট হচ্ছে? মিসবাহ্’কে কেন চোখের সামনে দেখতে ইচ্ছে করছে? কেন মনের মধ্যে মানুষটাকে একটু ছুঁয়ে দেখার সাধ জাগছে? কেন? এসবের কি জবাব আছে? কোথায় গেলে পাওয়া যাবে সেই জবাব! আধ্রিকার চোখে পানি টলমল করছে। না! লোকটা নিশ্চয়ই সেরকম কিছু অনুভব করে না।

দুই দিন আগেই তো তাদের বাড়ি থেকে মিসবাহ্’দের দাওয়াত করা হয়েছিল। মিসবাহ্ ব্যস্ততা দেখিয়ে দাওয়াতটা ফিরিয়ে দিয়েছে। কেন দাওয়াতটা ফিরিয়ে দিয়েছে সে? আধ্রিকাকে কি তার একটু দেখতে ইচ্ছে করেনি? অথচ বোকা আধ্রিকা তার আসার অপেক্ষায় প্রহর গুণছিল। কখন সে আসবে, কখন এক পলক দেখবে! মিসবাহ্ সোশ্যাল মিডিয়াতে নেই। আধ্রিকার কাছে মিসবাহ্’র কোনো ছবিও নেই যে একটু দেখবে। মিসবাহ্ মানুষটা তাকে এমন ভাবে ঘোরের মধ্যে ঘিরে রেখেছে যে তার সব কিছুতেই দিশেহারা লাগছে। আধ্রিকার কানের কাছে এখনও বাজছে আকর্ষণীয়, গম্ভীর, ভারী গলার স্বরটা। তার কানের কাছে এখনও মিসবাহ্’র গলার স্বরটা বাজছে। কেন! আধ্রিকার গাল বেয়ে টুপ করে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। লোকটা তাকে উ’ন্মা’দে রূপান্তর করে ফেলছে। জা’দু করে রেখেছে কোনো। কিন্তু কেমন জা’দু? কালো জা’দু নাকি লাল জা’দু? আধ্রিকার নানী বলেন লাল জা’দু হলো প্রেমের জা’দু। ওটা ভালো জা’দু। একবার কারো উপর তার প্রয়োগ ঘটলে কোনো ভাবেই ছোটানো যায় না। বড়ই অসম্ভব সেই জা’দু থেকে মু’ক্তি লাভ করা। এই জা’দু হঠাৎ এমন সুখের সাগরে ভাসায় আবার হঠাৎ করেই এত ক’ষ্ট আর দুঃখ কুঁড়িয়ে আনে যার কোনো শেষ নাই। কখনো হাসায়, কখনো কাঁ’দা’য়। এই জা’দুতে রো’গ হয়। প্রথমে হয় মনে তারপর মন থেকে দেহে। দেহের রো’গটা ঠিক করা গেলেও মনের টা ঠিক হয় না। আজীবন মনের মধ্যে থেকে যায়। হয় সুখ হয়ে নয়তো দুঃখ হয়ে। আধ্রিকার এখন মনে হচ্ছে লাল জা’দুটাই তার উপর মিসবাহ্ করেছে।

———————————————————————-

অনুর আজ গায়ে হলুদ। আধ্রিকা এসেছে সন্ধ্যার একটু আগে। আজকে তার চাকরীর ইন্টারভিউ ছিল। আসার পর থেকেই বেশ কিছু মহিলার ক’টু কথা তার কানেও এসেছে। তার থেকে চার বছরের ছোট মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অথচ তার বিয়ের কোনো নাম গন্ধ নেই। আদৌ বিয়ে হবে কিনা সেটাতেও নাকি স’ন্দে’হ আছে। আধ্রিকার মনে হলো মহিলা গুলো ইচ্ছে করেই শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছে। আগের আধ্রিকা হলে মুখের উপর অনেক কিছু বলে দিতো। এখনকার আধ্রিকা বলেই বোধ হয় পারছে না। বয়স এখন তার ছাব্বিশ বছর ছুঁই ছুঁই। এখন আর আগের মতো ছটফটে স্বভাব নেই। দুই বছর আগেও সে ছিল আপনখেয়ালি। আর আজ তাকে সমাজকে ভ’য় করে চলতে হয়। নিয়ম মানতে হয়। বড়দের মুখের উপর এখন আর জবাব দেয় না। আধ্রিকা আজ এখানে আসত না। বিশেষ কারণেই এসেছে। বিশেষ কারণটি হলো একজন বিশেষ মানুষ আসবে। মানুষটি কখন কীভাবে যে বিশেষ হয়ে উঠল তার জীবনে সে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি। গত দুইটা বছর আনমনে সে মানুষটিকে ভালোবেসেছে। কারণে কিংবা অকারণে।

পরশু দিন সন্ধ্যায় তার বাবা তাকে ড্রয়িং রুমে ডেকে পাঠায়। সে সেখানে উপস্থিত হতেই তিনি জানান,

-‘তোমার বিয়ে নিয়ে কোনো চিন্তা ভাবনা আছে? বয়স তো হয়েছে। পড়ালেখাও শেষ। এখন নিশ্চয়ই বিয়ে করতে তোমার আপত্তি থাকার কথা নয়।’

আধ্রিকা কি বলবে ভেবে পেল না। আসলেই! আর কত কারণ দেখাবে? সে নিজেও এখন হাপিয়ে গেছে। তাকে চুপ থাকতে দেখে তার বাবা পুনরায় বললেন,

-‘দ্যাখো! তুমি আমার মেয়ে। আমার দায়িত্ব। আমার তোমাকে সুপাত্রে দান করতে হবে। আমার শখ তোমার বিয়েটা দেখে যাওয়ার। শরীরের যা অবস্থা আমার ভ’য় হয়। আদৌ কি আমি দেখে যেতে পারব কিনা তোমার বিয়ে!’

বাবার কথা শুনে আধ্রিকার খুব ক’ষ্ট হলো। সে বলল,
-‘বাবা এসব কেন বলছ?’

-‘বলার দরকার আছে দেখেই বলছি। তোমার নিজস্ব পছন্দ থাকলে আমাদের জানাতে পারো। বিচার বিবেচনা করে দেখব আমরা। সেটাও তো তুমি করছ না। দ্যাখো, নিজস্ব পছন্দ যদি না থাকে তাহলে আমি তোমার কাছে একজনের জন্য বলতে চাইছি।’

-‘কার জন্য?’

-‘মিসবাহ্ ছেলেটা ভীষণ ভদ্র, নম্র একটা ছেলে। তার স্বভাব চরিত্র সবই আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। ছেলেটাও এখনও বিয়ে করেনি। যদিও প্রথমেই তুমি তাকে বিয়ে করবে না বলেছ। কিন্তু তোমার কাছে যথাযথ কোনো কারণও আমি খুঁজে পাই নি। তারপরেও তোমার কথা ভেবেই বিয়েটা তখন ভাঙতে হয়েছে। কিন্তু এভাবে কত? সমাজে চলতে হলে সামাজিকতা রক্ষা করে চলতে হবে। তাছাড়া ফরজ কাজ হলো বিয়ে। মিসবাহ্’র মা গত কাল আমাকে ফোন করেছেন। মিসবাহ্ দেশে এসেছে। তিনি চাইছেন তোমার সাথে তার ছেলের বিয়েটা হোক। এখন তুমি কি বলো! যা-ই বলার বলো। জোর করে তো আর বিয়ে দিব না তোমায়।’

মিসবাহ্’র আগমনের বার্তা আধ্রিকার কানে তখনই এসেছিল। সে স্তব্ধ চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে ছিল কেবল। মিসবাহ্ এসেছে! দুই বছর তো হয়ে গেছে। সেও বিয়ে করেনি আর! অনেক কিছুই ভাবল আধ্রিকা। ভাবতে ভাবতেই তার চোখ ছলছল করে উঠল। মাইমুনা ননদের দিকে তাকালো। আধ্রিকা তাকে একদিন বলেছে যে তার পছন্দের মানুষ আছে। কে সে মানুষ সেটা বলেনি। আধ্রিকার চোখে পানি দেখে সে নিজেও ক’ষ্ট পায়। মিসবাহ্ যদিও তারও পছন্দের কিন্তু আধ্রিকা যেহেতু অন্য কাউকে পছন্দ করে সেহেতু জোর করে তার উপর একটা সম্পর্কে চাপিয়ে দেওয়ার তো কোনো মানে হয় না। তাই আধ্রিকা জবাব দেওয়ার আগেই সে ফট করে জানালো,

-‘বাবা আধু একজনকে পছন্দ করে।’

কথাটা শুনে আধ্রিকার বাবা, মা, ভাই সবাই বেশ অবাক হলো। আধ্রিকাও চমকে তাকালো ভাবীর দিকে। আধ্রিকার বাবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

-‘বৌমা কি ঠিক কথা বলছে? কাউকে পছন্দ করো! সত্যি করে বলবে কিন্তু!’

আধ্রিকা থতমত খেয়ে গেল। সত্যি করে বলার হলে তো সত্যিই সে কাউকে পছন্দ করে। কিন্তু সেই কেউ তো মিসবাহ্। আর এই কথা সে কখনো মুখ ফুঁটে বলতে পারবে না। পারবে না কারণ সে নিজেই ভুলটা করেছে। তার ভুলের জন্যই আজ সে এটা বলতে পারবে না। সেদিন নিজে মিসবাহ্’কে রিজেক্ট করে আজ পছন্দ করার কথাটা যদি বলে নিশ্চয়ই সবাই তাকে নিয়েই হাসবে! তাই সে ছোট করেই জানালো,

-‘হ্যাঁ।’

ভদ্রলোক মেয়ের থেকে না শুনতে চেয়েছিলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল তার ভেতর থেকে। শেষ একটা আশা ছিল সেটাও এখন আর নেই। গা ছাড়া ভাব নিয়েই বলল,

-‘ছেলেটা কে?’

-‘পরিচিত। মানে তোমরাও চিনো। আমি বলব সময় হলে। আমাকে একটু সময় দাও!’

অতঃপর সেখানেই এই আলাপের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু আধ্রিকা মিসবাহ্’র দেশে আসার খবর শুনেই ম’রি’য়া হয়ে উঠেছে তার সাথে দেখা করার। তখনই সে খবর পায় অনুর হলুদে মিসবাহ্ আসবে। তাই সে আজ এখানে এসেছে। একমাত্র মিসবাহ্’র জন্যে!

সব মেয়েরা শাড়ি পরলেও আধ্রিকা শাড়ি পরল না। সে কেমন নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছে। তাহসানের বউ রূপা এসে তাকে বারবার করে শাড়ি পরতে বলল। সে পরল না। তার স্পষ্ট মনে আছে। শেষবার যখন শাড়ি পরেছিল, যার জন্য পরেছিল সে তাকে ভালো করে দেখেওনি। আজ আর শাড়ি পরে কি হবে! আজকেও নিশ্চয়ই দেখবে না। চিনবে কিনা সেটাতেই স’ন্দে’হ আছে। লোকটার যা ভাব!

আটটার দিকে প্রায় সব মেহমান হাজির হয়। তনুর শ্বশুরবাড়ির সবাইও এসে গেছে। আধ্রিকা তনুর রুমে বসে ছিল। তার বুকটাও দুরু দুরু করছিল। মিসবাহ্’র জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল অথচ এখন মিসবাহ্ যখন এসে পড়েছে তখন তার সম্মূখীন হতে ভ’য় পাচ্ছে। মিসবাহ্ যদি তাচে না চেনার ভান করে? যদি সত্যিই না চেনে! তাছাড়া কি কথা বলবে? কি বলার আছে?

আধ্রিকার ভাবনার মাঝেই কেউ একজন এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। চমকে উঠে মানুষটিকে দেখেই সে সংকুচিত হয়ে গেল। মিসবাহ্’র মা তার চিবুক টেনে ধরে বলল,

-‘কেমন আছো মা! তোমাকে কত করে বললাম আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসার জন্য একবারও গেলে না। কতদিন পর দেখলাম! কত বড় হয়ে গেছ!’

নিজেকে সামলে নিয়ে আধ্রিকা ভদ্র মহিলাকে সালাম করল। কিছুক্ষণ কথা বলল। না দেখা করার জন্য অনেক বাহানা, ব্যস্ততা দেখালো।

হলুদ অনুষ্ঠান শুরু হতেই সবাই ছাদে চলে গেল। আধ্রিকা রুম থেকে সবার শেষে বের হলো। তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। কেমন কেমন লাগছে। মৃদু পায়ে ছাদের সিঁড়িতে উঠতে নিলেই কেউ একজন তার পাশে এসে দাঁড়ায়। আকস্মিক কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সে পাশ ফিরতেই মিসবাহ্’কে দেখল। সাথে সাথেই কোথাও কিছু থেমে গেল। কিছু নয় সবই বোধ হয় থেমে গেল। মিসবাহ্ আগের চেয়েও এখন আরো বেশি সুন্দর হয়ে গেছে বোধ হয়। আর তার হাসি! ওই তো সেই সুন্দর মন ভোলানো হাসি। মিসবাহ্’র ঠোঁটে সর্বদা এই হাসিই তো লেপ্টে থাকে। আধ্রিকা কিছু বলতে পারল না। মিসবাহ্ নিজেই বলল,

-‘কেমন আছেন?’

বহু ক’ষ্টে নিজেকে শক্ত রেখে আধ্রিকা ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি এনে জবাব দিল,

-‘ভালো। আপনি?’

-‘আমিও ভালো আছি।’

আধ্রিকা সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। মিসবাহ্ ও পাশাপাশিই আসছে। আধ্রিকা গা কাঁপছে। মিসবাহ্’র পারফিউমের ঘ্রাণটা তাকে যেন কোনো আবেশে ঘিরে রেখেছে। মনে হচ্ছে এখনই তার শরীর নিজের ভর ছেড়ে দিবে আর সে পড়ে যাবে। শরীরের অবস্থা অস্বাভাবিক লাগছে খুব। সে সিঁড়ির হাতলটা শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল। মিসবাহ্ ও থেমে গেল। বলল,

-‘আর ইউ ওকে?

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে মাথা ঝাকিয়ে আধ্রিকা কোনো মতে বলল,

-‘হুম।’

-‘দেখে তো মনে হচ্ছে না।’

-‘আমি ঠিক আছি।’

আধ্রিকা পুনরায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। এবার এত জোরে পা চালালো যে মিসবাহ্’র আগেই ছাদে প্রবেশ করে এক কোণায় গিয়ে চুপটি মে’রে বসে রইল।

মিসবাহ্ ধীরে সুস্থে ছাদে উঠল। এর সাথে ওর সাথে হেসে কুশলাদি বিনিময় করল। আধ্রিকা দূর থেকেই তাকে আড়চোখে দেখল। হলুদ পাঞ্জাবীতে লোকটাকে বেশ মানিয়েছে। বয়সও তো বোঝা যাচ্ছে না। কত হবে বয়স? ত্রিশ, বত্রিশ? একটু জানতে পারলে ভালো হতো।

অনুকে হলুদ ছুঁইয়ে আধ্রিকা ভাবল নিচে চলে যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা কেউ ভালো চোখে দেখবে না। এমনিতেও কিছু মহিলা তাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে ফুসুর ফাসুর করছে। আধ্রিকা ছাদের এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালো। ফুরফুরে বাতাসে তার মনটা ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছিল। সে সামনে তাকিয়ে সবার হৈ হুল্লোড় দেখতে লাগল। মণিকাকে দেখতে পেল তার দুই মাসের বাচ্চা কোলে নিয়ে এক জায়গায় থম মে’রে বসে আছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে সে খুব বি’র’ক্ত। পাশে এক ভদ্রলোক বসা। মাথার চুল তার খুব একটা নেই। পেটটাও ফুল ফেঁপে আছে। বয়সের একটা ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার। লোকটা মণিকার স্বামী। বিসিএস ক্যাডার। দুই বছর আগে মিসবাহ্ যখন বিদেশে চলে যায় তার তিন মাস পরেই মণিকার এই লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে। বর্তমানে লোকটার করা কান্ডকলাপে আধ্রিকার হাসি পাচ্ছে। বউয়ের অভিমান ভাঙাতে, বি’রক্তি কমাতে কেমন কেমন অঙ্গভঙ্গি করছে। একবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তো একবার গাল ধরে টানছে। আধ্রিকার বড্ড হাসি পায়। সে মুখে হাত চেপে ধরে পেছন ফেরার সময় দেখল মিসবাহ্ এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। তার হাসিটা থেমে গেল মিসবাহ্’কে দেখে। অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল কেবল। মিসবাহ্ বলল,

-‘কি ব্যাপার! এত হাসছেন যে?’

-‘না এমনিতেই।’

-‘ওহ আচ্ছা।’

আধ্রিকা চোখ মুখ শ’ক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখে কোনো রা নেই। মিসবাহ্ ও নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর একসময় নিরবতা ভাঙল। বলল,

-‘মুখটা এমন করে রেখেছেন কেন? হাসতেই তো সুন্দর লাগছিল।’

কথাটা শোনার পর আধ্রিকা চোখ বড় বড় করে মিসবাহ্’র দিকে তাকিয়ে রইল। সে বিশ্বাস করতে পারছে না মিসবাহ্ এমন কিছু বলেছে। অবাক হলেও শান্ত গলায় প্রশ্ন করল,

-‘এখন কি অকারণে হি হি করে হাসব!’

-‘এতক্ষণ যে কারণে হাসছিলেন সেই কারণেই না হয় হাসতেন।’

আধ্রিকা পেছন ফিরে দেখল মণিকার স্বামী এখনও হাস্যকর কাজগুলো করছেন। সে চোখ সরায় সেদিক থেকে। মিসবাহ্’র দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘হাসি পাচ্ছে না।’

-‘তাই বলুন।’

আবারো কিছুক্ষণ নিরবতা। আধ্রিকা এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। অ’স্ব’স্তি হচ্ছে তার। মিসবাহ্ তার নড়চড়ের কারণটা বুঝতে পারল। বুঝতে পেরে মৃদু হাসল। আধ্রিকাকে বলল,

-‘আপনি শাড়ি পরলেন না যে!’

আধ্রিকা এবারও বিস্মিত হলো। বলল,

-‘আমি কেন শাড়ি পরব?’

-‘না মানে সবাই তো পরেছে।’

আধ্রিকার রা’গ হলো। বাহ্! সবাইকে খুব ভালোই নোটিস করছে তো লোকটা।

-‘আমি তো আর সবাই না। আমার এত সুখও নেই আর শখও নেই।’

মিসবাহ্ আধ্রিকার চোখে চোখ রাখে। তারপর খুব ভারী স্বরে বলল,
-‘কেন নেই?’

আধ্রিকা সেই চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারল না। সে আশেপাশে তাকালো ভালো করে। সবাই ব্যস্ত। ভীড়ের মাঝে এদিকে কেউ দেখছে না। সে বলল,

-‘আপনি দেশে ফিরেছেন কবে?’

-‘এক সপ্তাহ হয়ে গেছে।’

-‘ওহ।’

-‘আপনি জানতেন না?’

-‘আমি কীভাবে জানব!’

-‘আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো জানেন।’

আধ্রিকার গলাটা হঠাৎ করেই কেঁ’পে উঠল। কাঁ’পা গলাতেই সে বলল,
-‘কেউ যদি জানাতে চাইত তবে ঠিকই জানতাম।’

-‘সে জানাবে কি করে? জানানোর পথই তো ছিল না।’

আধ্রিকা মিসবাহ্’র দিকে তাকালো। মিসবাহ্ আগে থেকেই তার দিকে চেয়ে আছে। আধ্রিকা এবার আর চোখ সরালো না। বলল,
-‘পথের দিশা জানতে চাইলে বাতলে দিতাম।’

-‘অনেক আগেই জানতে চাওয়া হয়েছিল। তখন মুখ ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।’

আধ্রিকার চোখ ভিজে আসছিল। মিসবাহ্ আবারও তার সেই চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘আজ কেন পথের দিশা দিতে চাইছে?’

-‘আজ মন তাকে ডাকছে।’

-‘মনে তো অন্য কেউ আছে।’

-‘অন্য কেউটা আর কেউ নয়। সেই পথ না জানা পথিক নিজেই।’

আবারও কিছুসময় দুজনে চুপ ছিল। বাতাস হচ্ছিল। আধ্রিকার চুল বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। সে চুল সামলানোয় ব্যস্ত হলো না। বরং অবাধ্য চুলকে উড়তে দিল। তখনিই নিরব পরিবেশটায় মিসবাহ্ তার গমগমে স্বরে ডেকে উঠল,

-‘আধ্রিকা!’

আধ্রিকা জলদি করে পাশ ফিরল। তার চোখ থেকে মাত্রই টুপ করে এক ফোঁটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল। এই ডাকটাই তো সে শুনতে চেয়েছে। মাসের পর মাস, দিনের পর দিন এই মানুষটার গলায় একবার নিজের নামটা শোনার জন্য আকুল হয়ে ছিল সে। এই তো বহু প্রতীক্ষিত সে সময়। এই তো পাশে সেই মানুষটা।

মিসবাহ্ পকেট থেকে নিজের রুমালটা বের করে আধ্রিকার দিকে এগিয়ে দিল। আধ্রিকা হাত নিল। চোখ মুছল। মিসবাহ্’কে ফেরত দিতে গিয়েও দিল না। হাতের মুঠোয় রেখে দিল। মিসবাহ্ বলল,

-‘আমার দিকে তাকাও।’

আধ্রিকার মনে হচ্ছে এবার সে হাউমাউ করেই কেঁদে দিবে। মিসবাহ্ যে তাকে তুমি করে বলছে। সে মিসবাহ্’র দিকে তাকালো। মিসবাহ্ বলল,

-‘এখন কি পথের দিশা দেওয়া যাবে অসহায় পথিককে?’

আধ্রিকা কথা বলতে পারল না। মাথা নাড়ে শুধু। অর্থাৎ দেওয়া যাবে। মিসবাহ্ ঠোঁট চেপে হাসল। অবশেষে আধ্রিকার মনে তার জন্য জায়গা তৈরি হয়েছে। কেন যেন তার এই বিশ্বাস ছিল একদিন আধ্রিকাও বাতাসে প্রেমের আভাস পাবে। যেমনটা সে পেয়েছিল। আশা সে ছেড়েই দিয়েছিল। সেদিন যতখন সুইমিনপুলের পাশে আধ্রিকা আর সে একসাথে বসে ছিল, আধ্রিকা তার সাথে কথা বলতে এসেছিল তখনই তার মনের মধ্যে একটা আশার সঞ্চার হয়েছিল। তার মন বলছিল আধ্রিকা হয়তো আসবে। ধরা দিবে। সময় লেগেছে অনেক। অবশেষে যে ধরা দিল এটাই অনেক। মিসবাহ্ আধ্রিকাকে বলল,

-‘পথিক কি দিকনির্দেশকের হাতটা ধরতে পারে? না মানে হারিয়ে যাওয়ার ভ’য় আছে।’

আধ্রিকা ল’জ্জা পেল। ঠোঁটের কোণে তার হাসি ফুঁটল। মিসবাহ্’র হাতটা নিজে থেকে ধরল। মিসবাহ্ কোমল হাতটা তার শ’ক্ত হাতের সাথে চেপে ধরল। এমন ভাবে আ’ক’ড়ে ধরল যেন ছাড়া পেলেই হারিয়ে যাবে তার প্রাণপাখি।

সমাপ্ত।

(বাতাসে প্রেমের আভাস কার কাছে কেমন লেগেছে জানাতে ভুলবেন না। আর আমার পক্ষ থেকে ভালোবাসা পাঠক সমাজের জন্য। ছোট গল্পের শেষ গুলো এমনই হয়। কেউ আবার বিয়ে দেখার অনুরোধ করবেন না। সেটা নিজেরা ভেবে নিবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here