#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম
#ফারজানা_মুমু
[১১]
আষাঢ়ের পৃথিবী থমকে গেল। বারবার ঝুমঝুমির বলা শব্দটি কানে বেজে চলেছে। কয়েক মুহূর্ত নিরব থাকল। হৃদয়ের বিশাল ঢেউ শান্ত হতে চাইছে না। শব্দ বের হচ্ছে না কন্ঠস্বর থেকে। প্রিয় মানুষটির অপ্রিয় সত্য কথাটি কোনোভাবেই মানতে পারছে না। মেয়েদের মত ঠোঁট কামড়ে চোখের পানি গিললো। নিজের অবস্থার মজবুত করে বলল, তুমি আ’মৃ’ত্যু পর্যন্ত শুধু আমার। তোমার অতীত নিয়ে আমার যায়-আসে না। তোমাকে আমি ভালোবাসি কথাটি যেমন সত্য তেমনি তোমার অতীতকে আমার প্রত্যাখ্যান করা সত্য। দোষ থাকলে দোষারোপ করা যায় কিন্তু আমি তোমার দোষ খোঁজে পাইনি দোষারোপ করার প্রশ্নই আসেনা। বিশ্বাস রাখো আমি কখনোই তোমাকে তোমার অতীত নিয়ে টানবো না। তাছাড়া আষাঢ়ের ভালোবাসা তুচ্ছ নয় যে সামান্য বাক্যতে শেষ হবে। আমার প্রেমের সূচনা তুমি ছিলে, উপসংহারে তুমিই থাকবে। ঝুমঝুমি নামের হীরা পাথরকে আমি কখনই হারাতে চাইনা। পাথরের হৃদয়ে অতি যত্নে নাম লিখে বুঝিয়ে দিবো আমি তোমায় কতখানি ভালোবাসি।
ঝুমঝুমির অতীত সম্পর্কে বিস্তারিত বলল ঝুমঝুমি। সব শুনে আষাঢ় কিছুক্ষণ অদ্ভুদ চাহনিতে তাকিয়ে ছিল ঝুমঝুমির পানে। নিজেকে ধাতস্থ করে উপরের কথাগুলো এক নিমিষে বলে ফেলল। গোপনে নিঃশ্বাস ছেড়ে ঝুমঝুমি বলল,
-” আবেগ,মৌহ সব সময় থাকে না আষাঢ়। আপনি আমায় ভুলে যান।
-” আমার বয়সটা আবেগের নয় ঝুমি। তোমাকে ভুলে থাকার চেয়ে নিজেকে শেষ করা শ্রেয়।
-” নিব্বাদের মতন কথা বলবেন না।
-” তুমি বাধ্য করছ। আমাকে মেনে নাও।
ঝুমঝুমি কথা এড়ানোর জন্য বলল, আমরা এখান থেকে যেতে চাই।
আষাঢ় শান্ত চাহনি ফেলে বলল, বিকালে যাত্রা দিবো তোমরা রেডি থেকো।
ঝুমঝুমি চলে গেল। আষাঢ়ের সামনে দাঁড়ানোর সাহস তার হচ্ছে না। ঝুমঝুমির মনে হলো হঠাৎ এই লোকটাকে দেখলে ওর সব এলোমেলো হয়ে যায়। কঠিন হতে পারে না। চাইলেও ভুলতে পারে না। মনের দিক থেকে পজিটিভ আভাস পাচ্ছে সে কিন্তু উপর থেকে নেগেটিভ। লোকটার কথাগুলো আফিমের মত। হ্যালুসিনেশন হয় তখন নিজের মধ্য থাকে না ঝুমঝুমি।
ঝুমঝুমির যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল আষাঢ়। হৃদয়ে মহাপ্রলয় সৃষ্টি করে মেয়েটা তাকে কষ্ট দিচ্ছে। ভালোবাসায় এত কষ্ট থাকলে কখনোই ভালোবাসতো না। প্রেয়সীর হৃদয় ছুঁয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা করতো না। খুবই নিষ্ঠুর ওর প্রেয়সী। হৃদয়ে প্রেম সৃষ্টি করা মানে মরুভূমিতে হাল চাষ করা। কবে যে শুনতে পারবে নিষ্ঠুর প্রেয়সীর কাছ থেকে প্রেমের শব্দযোগ।
জমিদার বাড়ির বিশাল বৈঠক খানায় চলছে ঝগড়া। তৃষ্ণার চেঁচামেচিতে রুমে থাকা যাচ্ছে না। কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে পাশের বাড়ির আন্টিদের মতন ঝগড়া করে যাচ্ছে তৃষ্ণা। নীরা নিরন্তন চুপ থেকে আড়চোখে হিরণকে দেখছে। হিরণ মাঝে-মধ্যে ইশারায় চুমু ইশারা করতেই লজ্জায় আপেল রূপ ধারণ করে সে। অন্যদিকে তৃষ্ণার সাথে কথায় না পেরে মিরাজ হার স্বীকার করে। তৃষ্ণার মুখশ্রী জুড়ে খুশির জোয়ার। জয়ী হওয়ার কারণে ভাব কিছুটা বেড়েছে। তবে মনে-মনে ঠিক করেছিল যদি ঝগড়ায় জিততে না পারে থু-থু ছিটাবে মিরাজের উপর। থু-থু ফেলতে হলো না তার পূর্বেই মিরাজ চুপ। নাজিম এতক্ষণ ধরে উৎসাহ দিচ্ছিল মিরাজকে। শেষমেষ বন্ধুর পরাজয় মেনে আশ্বাস হারিয়ে তৃষ্ণাকে বলল, আমি জানতাম আমার বন্ধু তোমার সাথে পারবে না। মনে-মনে কিন্তু আমি তোমার দলেই ছিলাম।
আমার বন্ধু হেরে গিয়ে স্বীকার করল পরাজয়
ঝগড়ায় পারদর্শী ঝগড়াটে তৃষ্ণার হলো জয়।
মিরাজ ফিক করে হেসে দিল। তৃষ্ণা গরম চোখে তাকালো। নাজিমের উদ্দেশ্য বলল, আপনাকে আমাদের দেশ ডিজার্ভ করে না নাজিম ভাই। আপনার তো খুব টেলেন্ট। গরু ছাগলদের সাথে থেকে-থেকে ভালো না হয়ে বিপথে যাচ্ছেন।
নাজিমের মনে ধরল তৃষ্ণার কথা। হিরণ ও মিরাজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, আমাদের অপমান করলে?
তৃষ্ণা বলার আগেই নাজিম বলে ফেলল, গরু-ছাগলদের আবার কীসের অপমান,তোদের সাথে থেকে আমার চলল মানসম্মান।
হিরণ ও মিরাজ, নাজিমকে চ্যাংদোলা করে বাইরে নিলো।
-” আজ তোর মান সম্মানের কালি না লাগা অব্দি ছাড়ছি না। কবিতা বলিস তাইনা আজ দেখব তুই কত প্রকার কবিতা বলতে পারিস।
ওদের কাহিনী দেখে নীরা-তৃষ্ণা জোরে-জোরে হাসতে লাগলো। তৃষ্ণার মনে হলো ট্যুরে আসাটা সার্থক হলো। না হলে কত বিনোদন যে মিস করতো।
______________________
গোধূলি লগ্ন থেকেই সুরের মাধুরী শোনা যাচ্ছে। বিনোদনের জন্য রয়েছে নাজিম। আষাঢ় প্রিয় মানুষটিকে উদ্দেশ্য করে গান গাইছে,
আমার এই আঁধার, আমার কবিতা
সময়ের পাতায় যা লিখে চলি,
ছিল সবি তোমারি , আছে আজো তোমার
আঁধারের নির্জনতায়
এই নিজুম রাতে একা আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে,
চিৎকার করে বলতে চাই তোমায় আমি,
ভালোবাসি
শুধু তোমায় ভালোবাসি
এ . . এখনো
শুধু তোমায় ভালোবাসি।
আমার এই ভোরের আলোয় ছুটে চলা
শুধুই কল্পনায় ছুঁতে চাওয়া
তুমি রাতের আঁধার ঘিরে এলে, তুমি আমার ভোরের আলোয় পাওয়া
অন্তহীন এ পথে
এই ভোরের স্তব্ধতা ভেঙ্গে দিয়ে লাল আকাশে চির ধরিয়ে
চিৎকার করে বলতে চাই তোমায় আমি,
ভালোবাসি
শুধু তোমায় ভালোবাসি
এ . . এখনো
শুধু তোমায় ভালোবাসি
ঝুমঝুমি জানালার গ্লাস খুলে দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। আষাঢ়ের বলা গান তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা সে জানে তবুও কোনো প্রকার হেলদোল করেনি। ভাবখানা এমন যেন সে কিছুই শুনেনি। আষাঢ়ের মনক্ষুন্ন হলো। ঝুমঝুমির সাড়া পাওয়ার জন্য নীরাকে বলল, তোমার বান্ধবী গানে তুলো গুজেছে? আমার কথা শুনছে না।
নীরা বলল, ও বেশি কথা বলে না। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে।
আষাঢ় ওহ বলে চুপ করে রইল। তারপর হিরণের দিকে চেয়ে ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে ইশারা করল। হিরণ ঠোঁট চেপে ভাবলো। হাসির উত্তরে হাসি দিয়ে চোখ টিপলো। পিছন ফিরে মিরাজ,নাজিমকে চোখে ইশারা করতেই ওরা মুচকি হাসলো। মিরাজ পিছনে ঘুরল, তিনজন মেয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসেছে। কন্ঠস্বর ভারী করে বলতে লাগলো, সাপপপপপপপপ পিছনে।
ঝুমঝুমি প্রথম হকচকিয়ে উঠলেও শব্দ করল না। নীরা-তৃষ্ণা চিল্লিয়ে উঠল। দুজন মেয়ের চিল্লানো শুনে গাড়ি থামালো আষাঢ়। ভ্রু কুঁচকে গেল ওর। যার জন্য মিথ্যা অভিনয় সে কত সুন্দর চুপচাপ বসে আছে। সাপের কথা শুনে কোনো প্রকার রিয়েক্ট করল না। আষাঢ়ের মন মাঝে-মধ্যে চিন্তিত হয়। এই মেয়ে কী মাটির তৈরি জানতে বড্ড ইচ্ছে করে। আশাহত হয়ে পিছনে ঘুরল দেখল ঝুমঝুমি নির্লিপ্ত নির্বিকার ভাবে বসা। তৃষ্ণা-নীরা ভয়ে কাবু। হিরণ আষাঢ়কে বলল,
-” দোস্ত, ভাবী তো আনকমন পারসন। কোনো কিছুই ওর মনকে জাগাতে পারে না। এ মেয়েরে তুই সহজে পাবি না।
-” তবুও আমি ওর থাকতে চাই হিরণ। আমার অস্তিত্ব জোরে শুধু ঝুমঝুমি। নিষ্ঠুর ঝুমঝুমি।
তৃষ্ণা-নীরার চেঁচামেচিতে এবার মুখ খুললো ঝুমঝুমি। ধমকে বলল, গাঁধীর দল গাড়িতে সাপ আসবে কীভাবে? ভয় দেখাচ্ছে আমাদের বুঝিস না?
দুজন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চারদিক বুলিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে মিরাজকে বকা শুরু করে । মিরাজ কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনতে লাগলো।
আঁধার নামলো ধরিনি জুড়ে। ঝুমঝুমির হঠাৎ অস্বস্তি বোধ করল। মনে-মনে দুআ করল এখনই যেন এই সমস্যায় পড়তে না হয়। সমস্যাটা সত্যি হলে লজ্জিত হবে। নীরাকে ফিসফিসিয়ে বলল, রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ানোর জন্য। ক্ষুধা পেয়েছে ওর।
নীরা ভ্রুকুটি করলেও ঝুমঝুমির মুখশ্রী জুড়ে বিন্দু-বিন্দু ঘাম দেখে চিন্তায় পড়ে গেল। আষাঢ়কে বলল ওদের ক্ষুধা পেয়েছে।
নামিদামি এক রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামলো। ভিতরে ঢুকে প্রথম লেডিস ওয়াশরুমে ঢুকলো ঝুমঝুমি। সন্দেহ ঠিক হলো। ইরেগুলার পিরিয়ড ওর জীবনটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বুঝে উঠার আগেই হয়ে যায়। আজ এমন সময়ে হয়েছে ওর মাথা কাজ করছে না। নীরা-তৃষ্ণাকে ডেকে সমস্যার কথা জানানোর পর দুজনেই হতাশ হলো। কত করে বলেছে গাইনী বিশেষজ্ঞ ডক্টর দেখানোর জন্যে কিন্তু ঝুমঝুমি দেখায় না। কারণ, ডক্টরের কাছে যাওয়া মাত্রই অনেকগুলো পরীক্ষা করতে বলে। অনেক টাকা খরচ করতে হয়। বাধ্য হয়েই ভোগ করে ইরেগুলার পিরিয়ড সমস্যা।
তৃষ্ণা বলে, তুই এখানে দাঁড়া আমি সিনোরা কিনে আনছি।
নীরা ঝুমঝুমির পাশে রইল তৃষ্ণা একা চলল।
অনেকক্ষণ ধরে টেবিলে বসে থেকে আষাঢ় উঠে দাঁড়াল। বন্ধুদের উদ্দেশ্য বলল, তোরা বস আমি আসছি। ওরা আসলে খাবার অর্ডার করিস।
আষাঢ় রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে দেখল দূরে তৃষ্ণাকে দেখা যাচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে বিড়বিড় করল, তৃষ্ণা ওখানে কী করছে?
প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য তৃষ্ণার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, কী হয়েছে তৃষ্ণা? তুমি এখানে কি করছো? ঝুমঝুমি কোথায়?
##চলবে,
আমার পা ভেঙে গেছে ডক্টর বলছে ঠিক হতে এক/ দেড় মাস লাগবে। নড়াচড়া করা যাবে না সম্পূর্ণ বেড রেস্ট। এ অবস্থায় আম্মু ফোন দিচ্ছে না। যখনই ফোন হাতের কাছে পাচ্ছি তখনি লিখছি। হাঁটতে না পারায় ফোন নিজে নিতেও পারি না। সবাই দুআ করবেন আমার জন্য।
এই গল্পটা একজন মেয়ের। গল্পে অনেককিছু থাকবে যা বাধ্য হয়েই লিখছি। ঝুমঝুমির সমস্যাটা আজকাল অনেক মেয়েদের হচ্ছে, অনেক মেয়েদের মধ্য কারো চিকিৎসা করার সামর্থ্য নেই।