প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম #ফারজানা_মুমু [৯]

0
360

#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম
#ফারজানা_মুমু
[৯]

মৃদু টিমটিমে আলোয় গোলাকার জলাশয়ে মুক্তোর মত পানির সৌন্দর্য চাঁদের আলোতে দ্বিগুণ বেড়েছে। সিমেন্টের বাঁধা সিঁড়ি ধাপে-ধাপে সাজানো। জলাশয়ের মধ্য সাদা শাপলা চাঁদের আলোতে মুক্তোর মতো চোখে বিঁধছে। বেগুনি রঙের কচুরিপানা চতুর্দিক ঘিরে ধরেছে। আষাঢ় এক পলক জলাশয়ে দৃষ্টি বুলিয়ে ঝুমঝুমিকে দেখতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। আজ ওর মনে অন্যায় একটি আবদার চেপে বসল। ঝুমঝুমির হাত মুঠোয় নিয়ে জলাশয়ে পা ভিজিয়ে প্রিয় মানুষটিকে আলিঙ্গন করে রোমাঞ্চকর মুহূর্ত অনুভব করতে চায় কিন্তু সে নিরুপায়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রমণী তার অবাধ্য ইচ্ছেকে সায় দিবে না বরং উল্টো হৃদয়ে প্রেমের দগ্ধ সৃষ্টি করবে। মনেমনে গোপন নিঃশ্বাস ছেড়ে ঝুমঝুমির মুগ্ধকর মুখশ্রী দেখে ইশারায় সামনে এগুতে লাগলো।

বিমোহিত চোখজোড়া এখনও নির্লিপ্তভাবে জলাশয়ের দিকে চেয়ে আছে। আকাশের চাঁদের প্রতিচ্ছবি জলাশয়ের পানিতে। দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি আকাশের চাঁদ তার সামনে, যাকে ছোঁয়া যায়,স্পর্শ করা যায়। আষাঢ়ের পিছন-পিছন সেখানে গেল। সিঁড়ির লাস্ট ধাপে আষাঢ় জলাশয়ে পা ডুবিয়ে বসল। ইতস্তত করে ঝুমঝুমি দু-সিঁড়ি উপরে বসে শুভ্র রাঙা পা দুটো নিচের সিঁড়িতে রাখল। আষাঢ় থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ায় অসুবিধে হলো না বসতে। ঝুমঝুমির চোখে-চোখ না রাখলেও পানিতে ভেসে উঠা প্রতিচ্ছবিতে ঠিকই চেয়ে রইল। সাদা জামাতে অপ্সরীর মত লাগছে প্রিয় মানুষটিকে। চোখ ঝলসে যাচ্ছে আষাঢ়ের। এরূপ সৌন্দর্য কাছ দেখে দেখার ফলে নিজেকে সুভাগ্যবান মনে হচ্ছে।

আষাঢ় প্রশ্ন করল, কী বলতে চাও?

অপ্রস্তুত হয়ে মাথা ঘুরিয়ে কপালে তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরল। মনের ভিতরে জমানো কথাগুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে বারংবার। সন্দেহর বশে কথাগুলো বলা আদৌ ঠিক হবে কিনা চিন্তা করছে। চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলো আষাঢ়ের প্রজ্বলিত কন্ঠস্বর শুনে।
-” চুপ না থেকে নির্দ্বিধায় বলে ফেলো।

ঝুমঝুমি মানসপটে বলে ফেলল, আমায় ফলো করেন কেন?
-” ভালো লাগে তাই।

আষাঢ়ের সহজ উত্তরে থমকালো ঝুমঝুমি। কিছুক্ষণ ভেবে আবারও বলল, আপনার আসল পরিচয় জানতে পারি?

ঠোঁট কামড় হাসলো আষাঢ়। আগেই বুঝতে পেরেছে ঝুমঝুমি ওকে আজ এসব কথাই বলবে। মেয়েটার চোখে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব ব্যাপার।
-” এমপি আসাদুল্লাহ জেওয়াদ চৌধুরীর ছোট ছেলে আষাঢ় জেওয়াদ চৌধুরী।

ঝুমঝুমি বিস্ময় ভাবে তাকিয়ে রইল। আষাঢ় প্রভাবশালী পরিবারের কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও এমপির ছেলে ভাবেনি। কন্ঠস্বর শুকিয়ে কাঠ হলো। মেঘের ব্যাবহারে অসন্তুষ্ট এখন আবার এমপির ছেলে।
-” আমার টিউশনির খোঁজ আপনি ঠিক করেছেন তাই তো? বাসাও আপনি খোঁজে দিয়েছেন।
-” হুম। তোমার ভালোর জন্যই করেছি। খারাপ করার জন্য নয়।

আষাঢ়কে প্রথম যেদিন দেখেছিল সেদিন থেকেই সন্দেহ হয়েছিল ঝুমঝুমির।

তৃতীয় বর্ষে ভর্তি হবার দিন চটপটি খাওয়ার জন্য তিনজন খোলা জায়গায় চেয়ারে বসে ফুচকা মামাকে দু’প্লেট চটপটি,এক প্লেট ফুচকা দিতে বলল। হোস্টেলের জন্য আবেদন তখনও করা হয়নি। তৃষ্ণা বলেছিল ভাড়া বাসা খোঁজবে। তাদের উল্টো পাশে চেয়ারে হেলান দিয়ে সানগ্লাস টেবিলের উপরে রেখে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতেছিল আষাঢ়। সানগ্লাসে বিষাদ মুখের রমণীকে দেখে ঘাড় পিছনে ঘুরিয়ে এক পলক দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। কান খাঁড়া করে শুনে পাশের টেবিলে বসা তিন রমণীর কথপোকথন। বুঝতে পারে আর্থিক সমস্যার কথা। মেয়েটির খোঁজ নেওয়ার জন্য নিজেই পিছু নেয়। কলেজ থেকে ইনফরমেশন জোগাড় করে বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে ভাড়া বাসা ঠিক করে। বাসার আঙ্কেলকে জানিয়ে দেয় ওরা যত বলবে রাজি হতে বাকি টাকা সে দিবে। কথামত কাজ হয়। ঝুমঝুমিরা মাসের শুরুতেই থাকতে শুরু করে ভাড়া বাসায়। আষাঢ়ের দুর সম্পর্কের মামাতো বোনের ছেলেদের জন্য টিচার খোঁজ ছিল। আষাঢ়ের কাছ থেকে ডিটেলস জেনে ঝুমঝুমির খবর দেওয়া হয়। ব্যাস তারপর থেকেই ঝুমঝুমির অবস্থা আগের থেকে ভালো হতে শুরু করে। দূর থেকে প্রতিদিন ঝুমঝুমিকে দেখত আষাঢ়। তৃতীয় তলার ভাড়াটিয়া চলে যাবার পর চার বন্ধু ওই বাসায় থাকতে শুরু করে। আষাঢ় ঝুমঝুমির সব কথা জানলেও ধ’র্ষ’ণ কিংবা পারিবারিক অবস্থা জানে না। মূলত সে ওসব ব্যাপারে আগ্রহী নয়। ওর আগ্রহ, আকর্ষণ শুধুই ঝুমঝুমি। এই মেয়েটাকে পেলে ওর কিছু চাইনা, কিছুই না। পরিবার যেমন ইচ্ছে তেমন থাক তাতে ওর যায়-আসে না। কিন্তু আষাঢ়ের একটি কথা মাথায় আসছে না ঝুমঝুমি এসব কথা জানলো কি করে। ও তো সব লুকিয়ে-লুকিয়ে করেছে যেন ঝুমঝুমি জানতে না পারে। আবারও মেয়েটির বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে প্রশ্ন করল,
-” তুমি জানলে কী করে?

ঝুমঝুমি হাসলো। বলল, আমার আশেপাশে হুটহাট একটি ছেলেকে দেখতে পাওয়া, দূর থেকে তাকিয়ে থাকা, সামনে আসলেই মাথা নিচু করে চলে যাওয়া। সমস্যায় পড়ার সাথে-সাথেই সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দেওয়া। পিছন থেকে কেউ একজন আমায় সাহায্য করছে, ফলো করছে আমি বুঝব না? যতটা বোকা আমায় ভাবেন আমি কিন্তু ততটা বোকা নই।

আষাঢ় মাথার চুল টেনে ধরে লাজুক হাসলো। ইচ্ছে করেই ঝুমঝুমির নাগের ডগায় ছুঁয়ে দিয়ে বলল, তারমানে আমায় প্রথম দেখায় চিন্তে পেরেছিলে?
-” না চিনার কারণ দেখছি না।
-” বুঝলে কি করে বাসা কিংবা টিউশনি আমি খোঁজে দিয়েছি। অনুমান মিথ্যে হতে পারতো।

প্রসারিত হাসলো ঝুমঝুমি। প্রশ্নের উত্তরে বলল,টিউশনির আপুটা একদিন হুট করেই ওনার দু-ছেলেকে বলে ফেলেছিল, তোমাদের আষাঢ় মামা চকলেট এনেছিল সব খেয়ে ফেলেছে? ছেলে দুটো মাথা দুলিয়ে বুঝায় খেয়েছে। আপুকে দেখতাম সবসময় আমাকে কেমন করে দেখত, কি লাগবে, সমস্যা হচ্ছে কিনা অধীর আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করতো। প্রেম করছি কিনা, বিয়ের কথা চলছে কিনা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে জানতে চাইতো। প্রথম-প্রথম সন্দেহ না হলেও আপনার নাম আচমকা বলার পর সন্দেহ হলো। একদিন বাচ্চা দুটো জিজ্ঞাসা করল ‘ভাইয়া’ স্যার কিনা। ভাইয়া শব্দ উচ্চারণ করার পর দেখলাম ওরা দুজন জিভে কামড় দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে। মনে হয় বড় ভুল করেছে আপনাকে ভাইয়া ডেকে। সন্দেহ গাঢ় হয়।

থামলো ঝুমঝুমি। স্যাঁতস্যাঁতে সিঁড়িতে দুহাত রেখে আবারও বলল, আপনারা যা কিছু করেন না কেন বাসার আন্টি-আঙ্কেল কিছু বলত না বরং উৎফুল্লতা মুখশ্রী বানিয়ে মেনে চলত। আমাদের বিরক্ত করা নিয়ে একবার আন্টিকে বিচার দেওয়ার পর আন্টি আপনাদের কিছু না বলে বরং আপনার সম্পর্কে সুনাম করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন এমনকি মুখ ফসকে বলে ফেলেন আমার কপাল রাজকপাল। সন্দেহর মাত্রা তীব্র থেকে তীব্র হলো। আজ তৃষ্ণা-নীরার কাছ থেকে জানতে পারলাম আমাদের ডিপার্টমেন্টের প্রধান সরাসরি যুক্ত। ইচ্ছে করেই আমাদের এখানে আনা হয়েছে। দুয়ে-দুয়ে চার করতে সময় লাগলো না। সেজন্যই আপনার পরিচয়টা জানতে উৎসুখ হলাম।

আষাঢ়ের মুখ হা হয়ে গেল। মুগ্ধ হলো আবারও। ইশ মেয়েটার মাথায় কত বুদ্ধি মনেমনে কপালে চুমু দিয়ে লজ্জিত হলো। লজ্জাটা ওর খুব বেশি কিনা।
-” হুমায়ূন স্যার বলেছেন,.” অতিরিক্ত রূপবতীরা বোকা হয়, এটা জগতের স্বঃতসিদ্ধ নিয়ম। ” কিন্তু আজ আমার মনে হলো কথাটা সম্পূর্ণ ভুল। প্রমাণস্বরূপ তুমি নিজে। রূপবতী মেয়েরা বোকা হয় না বরং ওরা হয় দারুন বুদ্ধিমতী।

ঝুমঝুমি হাসলো। আষাঢ়ের প্রতি কৃতজ্ঞ সে। অসময়ে আড়ালে থেকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানোর জন্য কিন্তু বিবেক বারবার বলছে অন্যর দয়া নিয়ে,অনুভুতি নিয়ে খেলে ঠিক করছে না। সামনের পথটা ওর জন্য খুবই ভয়াবহ। এগিয়ে যাওয়ার জন্য না আবার পিছিয়ে যেতে হয়। দাঁড়িয়ে পড়ল ঝুমঝুমি। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, আপনকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না। আমাকে সাহায্য করার জন্য আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ঋণি হয়ে থাকবো। ঋণ পরিশোধ করার যোগ্যতা আমার নেই। আমাকে নিয়ে আপনার মনে থাকা অনুভুতি মুছে ফেলুন। এভাবে বলার জন্য আমি সত্যিই ক্ষমাপ্রার্থী।

দ্রুত হেঁটে চলে গেল ঝুমঝুমি। আষাঢ়ের হতাশ মুখশ্রী তখনও চেয়ে আছে পাথর রুপি মেয়েটির পানে। গোপনে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলল, অনুভুতি মুছা যায়না প্রিয়তমা। বরং আমি তোমার মনে আমার জন্য নতুন অনুভূতি সৃষ্টি করব। আমার ভালোবাসার পূর্ণতা আমি লাভ করবই। মন জয় করতে তো হবেই আমাকে মিস তেজপাতা।

___________________

নীরাকে দেওয়ালের সাথে ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে হিরণ। চোখেমুখে দুষ্টুমিতে ভরপুর। নীরা চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। বুকের ভেতর হাতুড়িপেটা শব্দ উচ্চশব্দে বেজে চলেছে। হিরণ অনৈতিক এক কাজ করে বসল। নিজেকে কন্ট্রোল করতে গিয়েও পিছিয়ে পড়ল। নীরার গালে টুপ করে চুমু খেয়ে বসলো। বড় বড় চোখে তাকালো নীরা। পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। পূর্বের ঘটনায় চমকিত সে।
হিরণ বলল, নিজ ইচ্ছে করতে চাইনি মনকে অনেকবার নিষেধ করেছি কিন্তু মন শুনেনি। আমাকে দোষারোপ না করে বেয়াড়া মনকে দোষারোপ কর। আমি ভালো নিষ্ঠাবান সুচরিত্রের ইনোসেন্ট ছেলে। ধোঁয়া তুলসী পাতায় ময়লা থাকতে পারে কিন্তু হিরণের চরিত্রে এক ফোঁটা ময়লা নেই। হিরণ ছেলের চরিত্র ফুলের থেকেও পবিত্র। তবে হিরণ ছেলেটার মন বেয়াড়া। কন্ট্রোলে থাকে না। বুঝেছ নীরু পাখি?

লজ্জায় দৃষ্টি নিচুতে রাখল। হিরণের কথাগুলো ওর দারুন ভালো লেগেছে। ওদের রোমান্টিক সময়ে কাবাবের হাড্ডি হয়ে নিজাম হাজির হলো। ঠোঁটজোড়া একত্র করে গাল ফুলিয়ে বলতে লাগলো,
-” হিরণ তুমি একলা হলে, দিও আমায় ডাক,
তোমার সঙ্গে বিড়ি খেয়ে, নাচবো সারা রাত।

##চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here