#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম
#ফারজানা_মুমু
[৬]
ঝুমঝুমির নাজেহাল অবস্থা আজ। ছেলে দুটো পড়ছে কম বকছে বেশি। দুজনের কথার ঠেলায় বেমালুম ভুলে যাচ্ছে ঝুমঝুমি। কিন্তু ছেলে দুটো থামছে না। জোরে ধমক দিয়ে বলল, তোমাদের এখন মাইর দিবো আমি। চুপচাপ পড়।
ধমকে কাজ হলো না। ছেলে দুটো দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, ম্যাম আপনাকে আজ যে ভাইয়া পৌঁছে দিয়েছে সে কী আমাদের স্যার?
চোখ বড় করে তাকালো ঝুমঝুমি।
-” আমি এবার সত্যিই রেগে যাচ্ছি। ওই ছেলে তোমাদের স্যার নন। সমস্যা পড়েছিলাম সাহায্য করেছে। বুঝা গেছে? নেক্সট টাইম এভাবে কথা বললে তোমাদের আর পড়াবো না।
দমে গেল ছেলে দুটো। ঝুমঝুমির কাছে পড়তে ওদের ভীষন ভালো লাগে কিছুতেই ছাড়তে চায় না ম্যামকে। যদি সত্যি-সত্যিই না পড়ায়, তাই মুখ কালো করে দুজন সরি বলে পড়তে শুরু করল। আড়ালে হাসলো ঝুমঝুমি।
মনে মনে বলল, বিচ্ছু ছেলেপিলে। ছেলে-মেয়ে একসাথে থাকলেই লাভার ভেবে বসে। হায়রে কলিযুগ।
__________
নির্জন রাস্তা। পথেঘাটে দুয়েকজন ব্যাস্ত মানবের দেখা পাওয়া যায়। একা একটি মেয়ে আপন মনে নির্জন-নীরব রাস্তায় হাঁটছে। অন্ধকার ধরণীতে কৃত্রিম সোনালী রঙের রশ্মি। হলদেটে আলোয় নিরিবিলি নিঃশব্দে হাঁটা তরুণীটির প্রতি কেউ-কেউ আড়নজর দিচ্ছে কেউই বা দিচ্ছে না। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই নিঃসঙ্গ মেয়েটির। সামনের পথটুকু হেঁটে বাস স্টেশনে অপেক্ষা করতে হবে। বাস আসতে এখনও পনেরো-বিশ মিনিট বাকি। ঝুমঝুমি স্টেশনে এসে ঘাড় ঘুরিয়ে জনমানব খোঁজে পেলনা। একাকি শুনশান নীরব রাস্তা তবুও ভয় পাচ্ছে না ও। মনেমনে ভেবে চলেছে সামনের মাস থেকে কীভাবে চলতে হবে। ছোট বোনকে কোচিং সেন্টারে ভর্তি করাতে হবে এক্সট্রা টাকার প্রয়োজন। নিজের খরচ,বোনের খরচ,মায়ের খরচ সবমিলিয়ে বড় অংকের অর্থের প্রয়োজন। এমাসে আবার ঝর্ণাকে ডক্টর দেখাতে গিয়ে ভালো টাকাই খরচ করতে হয়েছে। লোহার বেঞ্চে বসে কপালে আঙ্গুল চেপে হিসাবে ব্যাস্ত ঝুমঝুমি। এখন বুঝে বাবা নামক মানুষটি কত কষ্ট করত। পরিবারের সকলের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য কত কষ্ট করে বাবারা। ঈদের সময়গুলোতে পুরনো পোশাকে খুশি থেকে পরিবারের সদস্যদের নতুন পোশাক কিনে দেয় নিঃস্বার্থ।
-” অন্যর পুরুষত্বে আঙ্গুল তোলার আগে নিজের চরিত্রের কালো দাগের কথা মনে রাখতে হয়। আমি ফুলের মত পবিত্র মেয়ের পিছনে ঘুরছি না,আমি ঘুরছি কলঙ্গের দাগ লাগানো চাঁদের পিছনে। তাছাড়া আমার পুরুষত্বে সমস্যা আছে কি নেই জানার জন্য হলেও তো আমায় বিয়ে করতে হবে? নাকি বিয়ের আগেই জানতে চাস আমি সচল না অচল? যেভাবেই প্রমাণ দিতে বলিস আমি সেভাবেই প্রমাণ দিবো।
দৃষ্টি নিচু রেখে মেঘের কথাগুলো গিললো ঝুমঝুমি। হিজাবে আঙ্গুল গলিয়ে নির্লিপ্ত চোখজোড়া মেঘকে দেখে নিলো। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি,দৌড়াদৌড়ি,ছোটাছুটি করে ক্লান্ত সে। সন্ধ্যায় ভেবেছিল কিছু খাবে কিন্তু টাকার কথা মনে হতেই ক্ষুধার জ্বালা ভুলে গিয়ে পড়াতে চলে যায়। পড়ানোর সময় আন্টি এক কাপ চা ও বিস্কিট দিয়েছিল সেগুলোই বিনাবাক্যে পেটে চালান করেছিলে। ক্ষিধে সামান্য কমলেও পুরোপুরি কমেনি। মাথায় প্রচণ্ড ব্যাথা। সামনের মাস কীভাবে চলবে ভাবতে পারছে না। টিউশনি বাড়াবে আরেকটা। এতক্ষণ ধরে ভাবছিল এসব কিন্তু এখন মেঘের অপমান করা কথায় স্পষ্ট ভাষা খোঁজে পাচ্ছেনা। আজ সারাদিন ওর চরিত্র নিয়ে কথা শুনতে-শুনতে হতাশ। সহজ কণ্ঠে বলল,
-” আমার চরিত্রে দাগ পড়েছে আমি জানি মেঘ ভাই। আপনারাও জানেন তারপরেও এতবার কেন বলা লাগে? আপনাদের মুখ ব্যাথা হয় না? আমার কিন্তু শুনতে-শুনতে কান পঁচে গেছে। এসব কথা আর কান দিইনা আমি। আমাকে অপমান করে আপনারা কি মজা পান বুঝিনা। আচ্ছা আপনাকে রিজেক্ট করার জন্য আমায় জ্বালাতে আসেন তাই তো? ধ’র্ষি’তা মেয়ে আপনার মত সুদর্শন ছেলে রিজেক্ট করেছে মানতে ইগোতে বাদে তাই আমায় কষ্ট দিতে চান? আমি তো সয়ে গেছি কষ্ট পাইনা আর। তাহলে বারবার একথা বলছেন কেন? আমি আপনাকে আবারও রিজেক্ট করলাম। আপনাকে আমি বিয়ে করব না। যে ছেলে মেয়েদের সম্মান দিতে পারে না,দূর্বল জায়গায় আ’ঘা’ত সৃষ্টি করে আমি তাকে বিয়ে করব না।
বাস চলে আসলো। ঝুমঝুমি দাঁড়িয়ে পড়ল। বাসে উঠতে যাবে তখন আবারও পিছু ঘুরল। মেঘ তখনো কঠিন চোখে চেয়ে আছে। ঝুমঝুমি বলল, আমায় কয়েকটা দিন সময় দিন মেঘ ভাই। ভালো জব পেলেই মা-বোনকে নিয়ে আসবো। আমাদের তিনজনের মুখ আপনাদের কাউকে দেখাবো না। এইটুকু উপকার করেন প্লিজ,সারাজীবন মনে রাখব।
বাসে উঠে পড়ল ঝুমঝুমি। প্রতিবাদী কন্ঠস্বর আজ চাপা পড়েছে। আহত মনকে সচল করার চেষ্টা বারবার নেতিয়ে দিচ্ছে। উঁচু মাথাকে টেনে-হিচড়ে নিচু করা হচ্ছে। বুকের ভিতরে থাকা আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে চাইছে। বুকে রাজ্যর ব্যাথা,নিঃশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট। ভালো থাকার জন্য লড়াই করতে গিয়েও পিছিয়ে পড়ছে। অভিভাবকহীন থাকা অনেক কষ্টের। বাবার ছায়া মাথায় না থাকার কষ্ট হারেহারে টের পাচ্ছে এখন। ছোট্ট গাছে শক্ত খুঁটি না থাকলে ঝড়ের তান্ডবে নিমিষেই ভেঙে পড়ে। ঝুমঝুমিও ভেঙে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত আপনজনদের কাছ থেকে অপবাদ শুনতে-শুনতে তিলে-তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
__________________
দুটো দিন নির্ভেজালে কেটে গেল। শরীর ও মন পূর্বের চেয়ে ফুরফুরে। চেয়ারে হেলান দিয়ে জানালার বাইরে চোখ রেখে নীরাকে উদ্দেশ্য করে বলল তৃষ্ণা,
-” টাকা পয়সা জমা দেওয়া শেষ কিন্তু ঝুমিকে বলতে ভয় হচ্ছে। ও যদি না যায় তখন কি হবে?
-” আমিও ভয় পাচ্ছি। যেভাবেই হোক রাজি করাতে হবে।
চুল মুছতে-মুছতে এদিকে আসছিল ঝুমঝুমি। বান্ধবীদের কথা শুনে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো, আবার কোন আকাম করেছিস দুজন?
ভয়ে মুখ চুপসে গেল দুজনের। নীরাকে ইশারায় বলতে বলল তৃষ্ণা। ঢোক গিলে নীরা বলল, ডিপার্টমেন্ট ট্যুরের কথা শুনেছিস?
-” হুম। শুনলাম বৃহস্পতিবার রাতে যাত্রা দিবে। তিনদিনের ট্যুর।
-” আমরা যাচ্ছি ট্যুরে।
হাত ফসকে গামছা পরে গেল ঝুমঝুমির। নীরা-তৃষ্ণা মুখ খিচে ঝুমির রিয়েকশন দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলল। রেগে উঠল ঝুমঝুমি।
-” আমাকে না জানিয়ে টাকা দিতে কে বলেছে? আমি যাব না।
-” তাহলে আমরাও যাব না।
গোলগোল চোখে তাকাল ঝুমঝুমি। কপালে হাত রেখে বলল, তোরা সবসময় আমায় ঝামেলা ফেলিস কেন?টাকা কই পাইলি? তাছাড়া আমার টিউশনি,কোচিং আছে যেতে পারবো না।
-” ছুটি নিবি। শোন,তুই যেতে না চাইলে আমরাও যাব না।
তৃষ্ণা মন খারাপ করে বলল, আমি জীবনেও ঘুরাঘুরি করি নাই। ভাবছিলাম এবার খুব মজা করব কিন্তু হলো না।
বান্ধবীদের মুখ ভার দেখে হতাশ হলো ঝুমঝুমি। দুটোই নাটকে এক্সপার্ট। না জানিয়ে আকাম-কুকাম করে ফাঁ’সি’য়ে দিবে। ঘুরাঘুরি ওর ভালো লাগে না এখন আর কিন্তু কে বুঝাবে এই দুই মেয়েকে।
-” ওকে যাব তবে নেক্সট টাইমের জন্য ওয়ার্নিং দিচ্ছি এধরনের ভুল যেন না করা হয় তাহলে ফলাফল খুব বাজে হবে।
নীরা-তৃষ্ণা প্রসারিত হাসলো। ওয়ার্নিং-টয়ার্নিং ভুলে গিয়ে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরল। ওরা ঝুমঝুমির মন ভালো করার জন্যই ঘুরাঘুরির প্ল্যান করেছে। না জানিয়ে কলেজে টাকা দিয়েছে। প্রকৃতির মাঝে ডুবে থাকলে মনের কষ্টরা দূর হতে পারে। শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারবে মেয়েটা। অধিক ভালোবাসে মেয়েটাকে ওরা।
__________________
ঠোঁটে সিগারেট জ্বালিয়ে বাজারের দিকটায় যাচ্ছে হিরণ। ঠোঁটে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে নীরার সামনে ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
-” ক্যান আই হেল্প ইউ?
হিরণকে দেখে নীরার ভিতর আত্মা কেঁপে উঠল। মনে পড়ল সেদিনের ঘটনা।
-” নো,থ্যাংকস।
-” আরেহ আরেহ ভয় পাচ্ছ কেন? পুরনো কথা ভেবে? আমি ওসব ভুলে গেছি। ভালো হয়েছে আমাদের পোশাক নষ্ট করে। এখন নতুন পোশাক কিনে আনছি। ওইটা নষ্ট করবে?
লাগাম ছাড়া কথা হিরণের। নীরা ঘাড় বাঁকিয়ে তৃষ্ণাকে খোঁজতে ব্যাস্ত। ও’কে একা দাঁড় করিয়ে মাছ কিনতে গেছে তৃষ্ণা। নীরা মাছ বাজারে যেতে পারে না বমি পায়।
-” কথা বলছো না কেন? তুমি তো আমার মতই, বেপরোয়া। (বেপরোয়া কথাটা ঝুঁকে বলল হিরণ)
-” বিরক্ত করছেন কেন?
-” শুনেছি মেয়েরা ঠোঁটকাটা,বেপরোয়া,ভিলেন,নেশাখোর ছেলে বেশি পছন্দ করে। সবগুলোই আমার মাঝে বিদ্যমান। প্রেম করতে পারো।
-” নেশাখোর ছেলে আমার পছন্দ নয় ।
-” কিন্তু আমি যতটুকু শুনেছি সিগারেট খাওয়া ছেলে তোমার ভীষন পছন্দ। কালো ঠোঁটের পুরষের প্রতি তুমি ফিদা হয়ে যাও।
-” মিথ্যা বলবেন না। আমি কখনোই এধরনের কথা বলিনি।
-” বলিনি তবে বলতে কতক্ষন।
হিরণের ফোন আসলো। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ধমকে উঠল হিরণের বাবা। বলল, হা’রা’ম’জা’দা, আমাকে একা দাঁড় করিয়ে আপনে কার সাথে কথা বলেন? মেয়েটা কে?
-” আমার গার্লফ্রেন্ড আব্বা। মেয়েটা প্রেম বুঝে না তাই প্রেম বুঝাতে এসেছি। আপনি চাইলে ছেলের হবু বউকে প্রেমের ইস্কুলে ভর্তি করাতে পারি।
-” বাপের সাথে এভাবে কথা কেউ বলে? মানসম্মান রাখলেন না আমার। আপনার জন্য এবার আমি ইলেকশনে ভোট পাব না। প্রেম পরে করবেন এখন তাড়াতাড়ি আসেন। সভার আয়োজন শুরু হয়ে গেছে।
হিরণ ফোন কাটল। নীরাকে উদ্দেশ্য করে বলল,গার্লফ্রেন্ড বিদায়। তোমার শশুরমশাই ডাকছেন। পরে কথা হবে।
হিরণ চলে গেল। নীরার ক্যাবলাকান্তের মত তাকানো ছাড়া কিছু পারলো না। মনে মনে বলল,সাংঘাতিক ছেলে।
হিরণ গাড়ির সামনে দাঁড়ালো। মেয়র হান্নান ছেলের পানে কটমট দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, বাপ আপনার স্বভাব-চরিত্র কবে ভালো হবে?
হিরণ ফিচেল হেসে বলল, আপনার বৌমারে বিয়ে করার পর থেকে চরিত্র ভালো হয়ে যাবে। আব্বা আপনি আম্মারে কেমনে পটাইছেন ? সাজেস্ট মী।
মেয়র হান্নান কপাল চাপড়ে বলেন, লজ্জা অনন্ত রাখেন বাপ। সামনে ইলেকশন ঝামেলা সৃষ্টি কইরেন না। বিরোধী দলের ছেলেরা ওৎ পেতে আছে।
-” আব্বা চিন্তা করবেন না। আষাঢ় থাকতে আপনার পদ কেউ নিতে পারবে না।
##চলবে,
গল্পে এবার মজা হববে 😋।