#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৩৯ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
দিনপুঞ্জিকায় আজ রোববার। ব্যস্ত নগরিতে কোলাহল বাড়ছে ক্রমশ। ইট পাথরের শহরে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো ট্রাফিক জ্যাম। কর্মজীবীদের ছোটাছুটি চলছে নিত্যদিনের মতো। জ্যামে আটকা পড়ে চিন্তায় অস্থির একেকজনের মুখশ্রী। সঠিক সময়ে অফিস পৌঁছাতে না পারলে চাকরি নিয়ে টানাটানি। গাড়ির হনের তিব্র শব্দে যেন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে লোকজন। রেস্টুরেন্টে বসে বসে দিবার জন্য অপেক্ষা করছে মীরা। মেয়েটা বলল আজ দেখা করবে। আহান এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। বরকে এতোদিন দেখে রেখেছে মীরা। সেবা করে অন্যান্য বউদের মতো বরকে সুস্থ করেছে সে। সব ঝামেলা মিটে গেলে পড়ায় মনোযোগ বসায়। আয়ানের সাথে কলেজে যায়, তার সাথেই আসে। আজও কলেজ থেকে সোজা রেস্টুরেন্টে এসেছে। দিবার সাথে দেখা করে বাসায় যাবে। আয়ান আসে পাশেই আছে। সে জানে দিবা আসবে। মীরা বলেছে তাকে। কিন্তু সে সামনে যাবে না। এমনিতেও তার জন্য অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে দিবাকে। তাই আর অশান্তি বাড়াতে চায়না। মীরার ফোনটা আয়ানের কাছেই রেখে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর দিবা এসে উপস্থিত হয় রেস্টুরেন্টে। তার হাতে একটা শপিং ব্যাগ। মীরার সামনের চেয়ার টেনে বসে পড়ে সে। মীরা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জিগ্যেস করে। “কি অবস্থা তোর? এখন কেমন আছিস? মামা তোকে আর কিছু বলেনি তো?”
দিবা মুচকি হেসে বলে, “নাহ্। ভালোই আছি।”
“শপিং করেছিস কি? হাতে ব্যাগ যে।”
“শপিং করিনি। তবে এতে একটা জিনিস আছে। ওটা যার আমি তাকে ফেরত দিতে এসেছি। তাকে না পেলেও তার পরিবারের লোককে দিব।”
মীরা ভ্রু কুচকে জিগ্যেস করে, “কি জিনিস?”
“তোর দেবরের রেখে আসা টেডিবিয়ার। শুধু শুধুই পড়ে আছে। তাই আজ ফেরত দিতে এলাম।”
“এর জন্যই এসেছিস? এটা না দিলে হয়না? রেখে দিতিস।”
“অন্যের জিনিস নিজের কাছে রেখে কি করব।”
“হ্যাঁ, ভালো বলেছিস। কি করবি! কিন্তু জিনিসটা তোর জন্য আনা।”
“আমার জন্য হলেও আমি নিতে পারব না। কিসের ভিত্তিতে নিব?”
—
“মীরা তোমার ফোন। ভাইয়া ক্রমাগত কল দিয়ে যাচ্ছে প্লিজ ধরো ফোনটা।”
আয়ানের আগমনে অপ্রস্তুত ছিল দিবা। ও এখানে কি করছে। তারমানে মীরা বলেছে সে আসছে? আয়ানের চোখ পড়ে দিবার দিকে। চোখাচোখি হয় দুজনার। দিবা অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। মীরা এদিকে আহানের সাথে কথা বলতে থাকে। দিবার সাথে দেখা করতে এসেছে বলে কল কেটে দেয়। আয়ানকে ফোন দিয়ে দেয়। আয়ান চলে যেতে নিলে মীরা বলে, “যেও না। দিবা নাকি তোমাকে কিছু দেবে।”
মীরা দিবাকে যেন একটা গর্তে ফেলে দিল ইচ্ছে করে। আয়ান না বুঝে জিগ্যেস করে, “কি? ঠিক বুঝলাম না।”
দিবা উঠে আয়ানের হাতে শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দেয়। বলে, “আপনার জিনিস।”
আয়ান চেক করে দেখে তার দেওয়া টেডিবিয়ারটা। যেটা দিবা নেয়নি। আয়ান মলিন হেসে বলে, “ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন ছিলনা। রেখে দিতে।”
“অন্যের জিনিস আমি আমার কাছে রাখিনা।”
“অন্যের মনটা তো ঠিকি নিয়ে গেছ।”
কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দিবা আয়ানের চোখে। আয়ানের অবস্থা আগের মতোই। এদিকে মীরা বেশ ভালোই মজা নিচ্ছে। দিবা কিছু না বলে চেয়ারে বসে পড়ে। হঠাৎ একটা মেয়ের আগমন ঘটে। সে এসেই আয়ানকে জড়িয়ে ধরে। আয়ানকে ছেড়ে জিগ্যেস করে, “আরে, কি অবস্থা তোর? কতদিন পর বল।”
“হ্যাঁ তো। তুই কোত্থেকে এলি?”
“মঙ্গল গ্রহ থেকে এসেছি।”
হেসে দিল দুজন। মীরা কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকালেও অন্যজনের চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। কাঁটা চামচ দিয়ে প্লেটে ঘঁষে যাচ্ছে। মীরা এটা দেখেই তো আশ্চর্যের চরম সীমানায়। মেয়েটি বলল, “তা এখানে কি করছিস?”
“ভাবির সাথে এসেছি। এ আমার ভাবি।”
মীরাকে দেখিয়ে আয়ান বলল। মেয়েটি মীরাকে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো। “কেমন আছেন? আমি আয়ানের ছোটবেলার বন্ধু। আমার নাম প্রিতি। আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি এখানে থাকিনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি।”
মীরাও কুশল বিনিময় করে। “আমি ভালো আছি। তুমি ভালো?”
“হ্যাঁ। আচ্ছা আয়ান! ইনি কে?”
দিবাকে দেখিয়ে প্রিতি জিগ্যেস করলো। আয়ান জবাবে বলল, “আমার ভাবির কাজিন।”
প্রিতি দিবাকে বলল, “হাই।”
দিবাও বলল, “হ্যালো।”
“আচ্ছা, টাটা। পরে একদিন এসে অনেক গল্প করব। বায় বায় ভাবি।”
মেয়েটা হেটে চলে গেল। মীরা আয়ানকে বলছে, “মেয়েটা তো বেশ মিষ্টি। কি সুন্দর করে কথা বলে।”
“ও এরকম। সবার সাথে মিশে যায়।”
অন্যদিকে একজন যেন কিছুতেই মেয়েটির প্রসংশা মেনে নিতে পারছে না। মীরা দিবাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, “তোমার উচিৎ ছিল এরকম একটা মেয়ের সাথে প্রেম করা। দেখলে কতো সুন্দর করে আমায় আপন করে নিল।”
বোমা ফাঁটাল মীরা। বিস্ফোরণ হওয়ার আগেই আয়ান গায়েব। দূর থেকে লুকিয়ে দেখছে দিবাকে। দিবা এবার মুখ খুললো। “এতোই যখন ভালো। তাহলে তোর দেবরকে বিয়ে দিয়ে দে না মেয়েটির সাথে।”
“ঠিক বলেছিস। ভাবছি বাসায় গিয়ে জানাব।”
দাঁতে দাঁত পিষছে দিবা। কিন্তু কেন সে সহ্য করতে পারছেনা। এসব নিজেও বুঝে উঠতে পারছেনা। রাগ দেখিয়ে মীরাকে বলে, “আসছি। ভালো থাকিস।”
দিবা উঠে গেল। মীরা বলল, “খাবারটা খেয়ে যা।”
“আমার পেট ভরে গেছে।”
দিবা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। আয়ানও মীরার কাছে আসলো। দুজন দুজনের দিকে তাকালো। এরপর দুজনেই অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়ল। দিবার রেখে যাওয়া খাবারটি আয়ান খেয়ে শেষ করলো। দিবা একটুও খায়নি। এরপর তারা দুজন বাসায় চলে গেল।
–
পড়ন্ত বিকেল। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম দিকে। দূরে তাকালে হালকা হালকা কুয়াশা দেখা যাচ্ছে। পিওয়ামিকে নিয়ে ছাঁদের দোলনায় বসে আছে মীরা। আহানের এখন প্রচুর কাজের চাপ। সকালে যায়, দুপুরে আসে। দুপুরে খেয়ে আবার চলে যায়। আবার রাতে আসে। গুনগুন করে গান গাইছে মীরা। কয়েকদল পাখি এসে ভিড় করেছে ছাঁদে। এটা সেটা টুকিয়ে খাচ্ছে। মীরা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পাখিদের জীবন কত সুন্দর। ডানা মেলে আকাশে ঘুরে বেড়ায়। যেখানে ইচ্ছে করে সেখানে যেতে পারে। একসময় আয়ান ছুটতে ছুটতে এলো মীরার কাছে। মীরা আয়ানকে এভাবে আসতে দেখে জিগ্যেস করলো, “কি হয়েছে? হাপাচ্ছ কেন?”
“মীরা তোমার ভাবির অবস্থা ভালো না। মিরাজ ভাইয়ার সাথে একটু আগে দেখা হয়েছে, উনি ভাবিকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছেন। সাথে তোমার মাও যাচ্ছে।”
মীরা দ্রুত দোলনা থেকে উঠে গেল। চোখ মুখ কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে। পিয়াওমিকে আয়ানের কোলে দিয়ে দৌড়ে ছাঁদ থেকে নেমে গেল। রুমে এসে চুল বেঁধে বোরকা আর হিজাব বেঁধে নিল। মিরাজকে কল দিয়ে জেনে নিল কোন হসপিটালে আছে তারা। মিরাজের দেওয়া ঠিকানায় আয়ানকে নিয়ে চলে গেল মীরা।
হসপিটালের করিডরে পায়চারি করছে মিরাজ। স্নিগ্ধার অসহ্য যন্ত্রণা সে মেনে নিতে পারছে না। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে তার। শেষবার স্নিগ্ধা তার হাত ধরে বলেছিল, “আমার যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে আমাদের সন্তানকে তুমি দেখে রেখো। প্লিজ অন্য কাউকে বিয়ে করো না। আমি সহ্য করতে পারব না।”
কথাগুলো এখনো কানে বাজছে মিরাজের। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো মীরা। সবার চিন্তিত মুখ দেখে মীরাও চিন্তায় অস্থির। সবাই দোয়া করছে স্নিগ্ধার যেন কিছু না হয়।
একজন নার্স এসে মিরাজের কোলে একটা মেয়ে বাচ্চাকে তুলে দিল। হাসি মুখ নিয়ে বলল, “আপনার মেয়ে।”
মিরাজ মেয়েকে কোলে নিল। নার্সের দিকে তাকিয়ে রইলো জিগ্যাসু দৃষ্টিতে। নার্সটি মুচকি হেসে জবাব দিল। “চিন্তা করবেন না। আপনার স্ত্রীও ভালো আছে।”
হাসি ফুটলো মিরাজের মুখে। এক ধ্যানে নিজের নবজাতক মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনবার মাশআল্লাহ বললো। মায়ের কোলে দিয়ে এক জায়গায় গিয়ে মেয়ের কানে আজান দিল সে। মীরা বাচ্চাটিকে নিয়ে কত আদর করছে। সবাই একবার বাচ্চাটিকে কোলে নিল। এরপর নার্স এসে বাচ্চাটিকে নিয়ে চলে গেল। আয়ান মীরার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “আমার একটা ভাতিজা চাই।”
মীরা আয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে বিরক্তি নিয়ে। “এই! মুখ বন্ধ রাখো। লাগামহীন কথা বলবে না।”
“আমি বুঝি একটা ভাতিজা ডিজার্ভ করিনা?”
“না করো না। এতো কথা বলো কেন? ভাবি হই তোমার। মুখ সামলে।”
“তোমরা এমন কেন? একটা বাচ্চা নিলে কি হয়?”
“আবার? তোমাকে বললাম না চুপ থাকতে। চুপ থাকো।”
“এ দেশে ভালো মানুষের ভাত নাই।”
“যেখানে ভাত আছে সেখানে যাও। উল্টো পালটা কথা শুধু।”
মীরা আয়ানের কাছ থেকে চলে গেল। আহানকে ফোন দিয়ে সবটা জানালো। অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় আয়ান মীরাকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বাসায় চলে এলো।
চলবে…