তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব – ৩২ ||

0
535

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৩২ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

“আমি তোমাকে ভালোবাসি দিবা। তুমিও কি আমায় ভালোবাসবে?”
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করতে করতে বাহিরে বেড়িয়েছিল দিবা। তেমন কেউই উঠেনি এখনো। নিজের ফুলগাছগুলো দেখছিল সে। সকাল বেলায় কতটা সতেজ লাগছে ওদের। এমন সময় পিছন থেকে পুরুষালি কণ্ঠে চমকে উঠে পিছনে তাকায় দিবা। আয়ানের এ কথাগুলো শুনে দিবার চোখ যেন বড়ো বড়ো হয়ে গেল। আশেপাশে কাউকে দেখতে পায়নি সে। যদি কেউ আয়ানের বলা কথাগুলো শুনে নিত, তাহলে কি হতো? ভেবেই বুক কাঁপছে দিবার। আয়ানকে কোনো জবাব না দিয়েই দৌড়ে ঘরের ভিতর ঢুকে যায় সে। চোখ মুখে পানি ছিটিয়ে কুলি করে হাত মুখ ধুয়ে নেয়।

সকালবেলা সবাইকে নাশতা দেওয়া হলো। মীরা নিজে নাশতা না করে আহানের জন্য সেটা নিয়ে গেল। কে জানে খেয়েছে কিনা! সারারাত আহান মীরার জন্য অপেক্ষা করেছে। মীরা একবারও তাকে বলে যায়নি কোথায় গিয়েছে সে। এখনো আসার নামই নেই। এদিকে সারারাত জেগে থেকে এখন মাথা ব্যথা করছে আহানের। মীরা নাশতা নিয়ে আহানের কাছে এলো। আহান একটা বালিশে নিজের পিঠ ঠেকিয়ে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। মীরা নাশতাটা আহানের সামনে রেখে কিছু না বলে চলে যেতে নেয়। আহান পিছন থেকে গম্ভীর গলায় মীরাকে ডাকে। “মীরা দাড়াও।”
মীরা থামে। আহান উঠে মীরার কাছে আসে। মীরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মীরা অন্যদিকে মুখ করে। আহান বলে, “কোথায় ঘুমিয়েছ রাতে? তোমার কোনো আইডিয়া আছে সারারাত আমি তোমার জন্য জেগে ছিলাম। তুমি আসবে না এটা বলে গেলেই তো হতো। আমার খুব টেনশন হচ্ছিল জানো।”
মীরা আহানের দিকে ফিরে বলে, “আমি তো বলিনি আমার জন্য অপেক্ষা করতে। জেগে থাকতেও বলিনি। আমার কাজ আছে, নাশতাটা খেয়ে নিবেন।”
এই বলে মীরা চলে যেতে নিলে আহান পিছন থেকে মীরার হাত শক্ত করে ধরে। হাত টেনে নিজের সামনে নিয়ে আসে তাকে। মীরা হাত ছাড়ার জন্য জোরজবরদস্তি করছে। আহান একিভাবে তার হাত ধরে আছে। মীরা বলে, “ছাড়ুন আমার হাত। লাগছে আমার।”
আহান মীরার হাত ছেড়ে দেয়। আগে গিয়ে দরজা বন্ধ করে আসে। আহানের এমন কাজে মীরা অবাক হয়ে যায়। আহান মীরার কাছে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমি যা বলছি তার উত্তর দিয়ে যাও মীরা। বলো কেন তুমি এমন করলে। এখনো কেন এমন বিহেভ করছ?”
“আমি আপনাকে কৈফিয়ত দিতে পারব না।”
“বলতে তুমি বাধ্য মীরা।”
আহানের ধমকে মীরা কেঁপে উঠে। আহানের চোখে রাগ দেখতে পাচ্ছে সে। মীরাকে চুপ থাকতে দেখে আহান আবারও বলে। “মীরা! আমি কিছু জিগ্যেস করেছি।”
“আপনার জন্য। আপনি আমাকে কাল কষ্ট দিয়েছেন। তাই আসিনি।”
“কি করেছি আমি? আমার জানামতে আমি কোনো ভুল করিনি মীরা, যার কারণে তুমি কষ্ট পাবে।”
“ভুল তো করেছেনই। আমার সাথে আপনি স্টেজে উঠেননি। জানেন, হলুদের অনুষ্ঠানে কাপলরা একসাথে উঠে হলুদ করে। আর আপনি? আপনাকে আমি বলা সত্ত্বেও আপনি আমাকে না করে দিয়েছেন। আমারও তো ইচ্ছে করে বলুন, নিজের বরের সাথে একসাথে স্টেজে উঠতে। ছবি উঠাতে। কিন্তু আপনি তো দূরেই সরে গিয়েছেন। সবাই হাসাহাসি করছিল। বলেছে বউকে রেখে ভাইয়ের সাথে স্টেজে উঠেছে বর। আমার কতটা খারাপ লেগেছে জানেন?”
“এর জন্য তোমার মন খারাপ? মীরা! আমি জানতাম না এমন কিছু হবে। আমি বিয়ে বাড়িতে খুব একটা যাইনি। তাই এসব রিচুয়েল ও জানিনা। আমি ভেবেছিলাম বড়োরা আছে। যদি মাইন্ড করেন। তাই লজ্জায় উঠিনি। আমি সত্যিই ভাবিনি যে এটা এতো দূর গড়াবে। আমি তোমায় কষ্ট দিতে চাইনি মীরা। প্লিজ তুমি মন খারাপ করে থেকো না।”
“বুঝেছি। আমি এখন বাহিরে যাব। সরুন।”
“মীরা খুব কষ্ট পেয়েছ? স্যরি।”
আহানের হঠাৎ মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়। সে কপাল ভাজ করে বিরক্তি নিয়ে কপালে হাত দিল। মীরা এটা লক্ষ্য করে। সে দ্রুত আহানের হাত ধরে বলে, “কি হয়েছে আপনার?” চিন্তিত কণ্ঠ মীরার। আহান এড়িয়ে বলে, “জাস্ট একটু মাথা ব্যথা। তুমি যাও কোথায় যাবে। আমি ঠিকাছি।”
“না আমি যাব না। দেখি এদিকে আসুন।”
মীরা আহানকে ধরে বিছানায় বসায়। নাশতার প্লেট থেকে কিছু খাইয়ে আহানকে একটা ব্যথার ঔষধ খাইয়ে দিল সে। তারপর একটা বালিশ ঠিক করে তাতে আহানকে শোয়ালো। আহানের একটা হাত ধরে কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে বসে আছে সে। “আমার জন্যই এসব হয়েছে। স্যরি।”
আহান ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিব্র মাথা ব্যথা করছে তার। মীরা এখনো তার পাশে বসে হাত ধরে আছে। আহানের এতো কিছু খেয়াল নেই। সে আস্তে আস্তে ঘুমের দেশে চলে গেছে। মীরা নিজে নিজেই বলে, “আমি আপনাকে কষ্ট দিয়েছি। আমার জন্যই কাল আপনি জেগে ছিলেন। আর এখন মাথা ব্যথা করছে আমার জন্যই। স্যরি আহান। প্লিজ ক্ষমা করে দিন আমাকে।”


“তোর দেবর আমাকে আজ কি বলেছে জানিস?”
বিয়েতে কি পড়বে সেসবই দেখছিল মীরা। এমন সময় দিবার কথায় সেগুলো দেখা বাদ দিয়ে দিবার পানে চায় সে। না জানার ভান করে বলে, “কি বলেছে?”
“সে নাকি আমাকে ভালোবাসে। মীরা তুই ভাবতে পারছিস বাড়ির কেউ এই কথা জানলে কি হবে?”
“ঠিক কি বলেছে সে?”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি দিবা। তুমিও কি আমায় ভালোবাসবে? সিরিয়াসলি এটা কোনো প্রপোজ হলো? কেউ এভাবে প্রপোজ করে? আর তুই জানিস আমি তখন সবে ব্রাশ করছিলাম। না জানি সে কি ভেবে আমায় এসব বলল!”
“তো তুই কিভাবে প্রপোজ চাচ্ছিস? আলিশানভাবে?”
“ধ্যাত! আমি কোনো প্রপোজই চাচ্ছিনা ওনার কাছ থেকে। আমার এসবে কোনো ইন্টারেস্ট নেই।”
“বাট আয়ান তোকে পছন্দ করে দিবা।”
“সেটা তার সমস্যা। তুই তোর দেবরকে বলে দিবি আমাকে যেন এসব আর বলতে আসে।”
“আমার দেবর দেখতে নাকি?”
“বিষয়টা খারাপ আর ভালোর না। এটা আমার বাবা মায়ের সম্মানের প্রশ্ন। প্লিজ তুই তোর দেবরকে বোঝা।”
“হুম। ভাবছি।”
অতঃপর মীরা গভীর ভাবনায় মনোযোগ দেয়। দিবা যা বলল এসব আয়ানের কানে তোলা কি ঠিক হবে? যদি তার মন ভেঙে যায়? মীরা কিছুতেই আয়ানকে ভেঙে যেতে দিবে না। সে কথা দিয়েছিল, দিবাকে রাজি করাবে। যে করেই হোক, দিবাকে বোঝাবে মীরা। দরকার পড়লে একেবারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে।

.

রাস্তার পাশ দিয়ে একটা ফুসকাওয়ালা যাচ্ছিল। বারান্দা থেকে তাকে দেখেই মীরা লাফিয়ে উঠল। সে দিবাকে টেনে নিয়ে চলে গেল নিচে। ইরাকে সাজাতে পার্লার থেকে একটা মেয়ে এসেছে। তারা আর ইরাকে ডিস্টার্ব করল না। মীরা আর দিবা মিলে রাস্তায় গিয়ে ফুসকাওয়ালাকে বাড়িতে ডেকে নিল। ফুসকাওয়ালা বাড়িতে আসতেই, অনেকে খুশি হয়ে যায়। মীরা আর দিবা ঝাল ঝাল টক দেওয়া ফুসকা অর্ডার করে। দুজনেই তৃপ্তী ভরে খেতে থাকে। কয়েকজনও ওদের সাথে এসে ফুসকা খেতে থাকে। মীরা আর দিবা যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কে কত প্লেট ফুসকা খেতে পারে তা দেখছে। অলরেডি চার প্লেট খাওয়া হয়ে গেছে তাদের। দূর থেকে মীরাকে পরপর এতো ফুসকা খেতে দেখে মেজাজ বিগড়ে যায় আহানের। সে দ্রুত এগিয়ে আসে মীরার দিকে। মীরার হাত ধরে ওখান থেকে তাকে টেনে নিয়ে আসে। মীরা যেতে যেতে বলছে। “আরে, ছাড়ুন আমায়। আমার ফুসকা!”
“রাখো তোমার ফুসকা। কত প্লেট খেয়েছ আজ?”
“পাঁচ প্লেট।”
“কাজ হয়েছে। খাও, আরও বেশি করে খাও। তুমি আজ বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারবে না।”
“কেন?”
“একটু পরেই বুঝতে পারবে। রুমে যাও। আমি বিল মিটিয়ে তাকে বিদায় দিয়ে আসছি।”
“আপনি জানেন দিবা আর খেতে পারেনি। আমি পাঁচ প্লেট খেয়েছি। কিন্তু ও চার প্লেট খেয়েই আর খেতে পারলো না।”
আহান মুচকি হেসে বলল, “তোমার এই হাসিটা কিভাবে হাওয়া হয়ে যায়, একটু পর টের পাবে।”
“কেন?”
“এর উত্তর এখন পাবে না। পরে যখন নিজের সাথে ঘটবে তখন ঠিকই উত্তর পেয়ে যাবে।”
আহান মীরাকে রুমে এগিয়ে দিয়ে সে বাহিরে চলে যায় ফুসকাওয়ালার বিল মিটিয়ে দিতে।


বমি করতে করতে অবস্থা যায় যায় মীরার। সবে রেড়ি হয়েছিল ইরার কাছে যাবে বলে। এমন সময় তার অস্বস্তি হতে থাকে। বমির ভাব হতেই দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে যায় সে। এরপর গড়গড় করে বমি করে দেয়। আহান আপাতত রুমে নেই। পরনের শাড়িটায় বমি লেগে ভরে গেছে। এখন ওকে আবার পাল্টাতে হবে। আবার নতুন করে সাজতে হবে। টেপ ছেড়ে কুলি করে সে। চোখে পানি দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে নেয়। আহান ঘুরতে ঘুরতে রুমেই এসেছিল। মীরা রেড়ি হয়েছে কিনা তা দেখার জন্য। ওয়াশরুমে পানির আওয়াজ পেয়ে সে মীরাকে ডাকে। মীরা বেরিয়ে আসে। মীরার অবস্থা দেখে আহান হা করে থাকে। বলে, “তুমি উত্তর চেয়েছিলে না? এবার পেয়েছ উত্তর? কেন তোমায় বললাম এতো ফুসকা না খেতে? বেশ ভালো হয়েছে। এবার তুমি কিভাবে যাবে?”
মীরা এগিয়ে এসে বলে, “আপনি খুব খুশি হয়েছেন না?”
“ভিষণ! আমার কথা না শুনলে এসবই হবে।”
মীরা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবারও তার বমি পায়। সে মুখ চেপে ধরে ওয়াশরুমে চলে যায়। বমি শেষে নিজেকে পরিষ্কার করে আসে। আহান এর মধ্যেই মীরার ড্রেস ও অন্যান্য জিনিসপত্র রেড়ি করে রাখে। মীরার জন্য এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে আসে। মীরা বেরুতেই আহান মীরাকে লেবুর শরবত দেয়। মীরা তা খেয়ে নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আহানের সামনে। “স্যরি। আপনার কথা আমার শোনা উচিৎ ছিল।”
“এখন স্যরি বলে লাভ নেই। ড্রেস চেঞ্জ করে নাও। আমি একটু পর আসছি। বিয়ে শুরু হয়ে যাবে। ফাস্ট।”
আহান চলে যায়। মীরাও নিজেকে গোছাতে থাকে।

ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে পর পর দু দফা বমি করেছে দিবা। বমি করে হাফিয়ে গেছে সে। পাশ থেকে আয়ান ওকে একেরপর এক টিস্যু দিচ্ছে এগুলো পরিষ্কার করার জন্য। দিবা এসেছিল ছাদে কয়েকটা ছবি তুলতে। কিন্তু এর মধ্যেই সে বমি করে দেয়। হতাশ লাগছিল তার কাছে। এগুলো এখন কিভাবে পরিষ্কার করবে তা ভেবে। ঠিক তখনই আয়ান এসে দিবার সামনে টিস্যু ধরে। আয়ানকে দেখে একটু বিরক্ত লাগলেও এখন পরিস্থিতির কারণে তার হাত থেকে টিস্যু নিতে হয়েছে দিবাকে। এরপর আয়ানকে দেখা যায় এক বোতল পানি নিয়ে আসতে। সচরাচর ছাদে কেউ উঠেনা তাই আয়ান আর দিবাকে কেউ দেখেনি। আয়ানের কাছ থেকে পানি নিয়ে সে চোখে মুখে পানি দেয়। আয়ান ওকে আরও কিছু টিস্যু দেয়। দিবা অসহায় হয়ে সেগুলো নিয়েই এক দৌড় দেয় ছাদ থেকে। আয়ান বোকার মতো ওদিকেই তাকিয়ে রইলো। দিবা এতক্ষণে নিচে নেমে গেছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here