#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৪১ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
সকালবেলা টুংটাং মেসেজের শব্দে ঘুম ভাঙে আয়ানের। কেউ মেসেজ দিচ্ছে আয়ানকে।হোয়াটসঅ্যাপেও ক্রমাগত মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে। ঘুম ঘুম চোখে আয়ান ফোনটা হাতে নিল। একটা আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ আসতেছে। অজানা ব্যক্তিটি আয়ানকে মেসেজ দিয়ে বলল, “আপনার কি একটুও লাজ সরম নেই?”
এমন একটা মেসেজ পেয়ে লাফ দিয়ে উঠল আয়ান। এরপর দেখে হোয়াটসঅ্যাপেও মেসেজ দিয়েছে। সেখানে লিখেছে, “মেয়ে পটাতে ভালোই কায়দা জানেন। একটা গেলে আরেকটা আসবে।”
“আপনি নাকি ভদ্র, এই তাহলে ভদ্রতার নমুনা?”
“আপনাকে আমার ঘেন্না লাগে। আই হেইট ইউ।”
মেজাজ বিগড়ে যায় আয়ানের। কে এই মেসেজকারী? হোয়াটসঅ্যাপে তার একটা পিক দেওয়া আছে। আয়ান পিকটা জুম করে দেখে একটা মেয়ের ছবি। তবে ছবিটায় সে নিজেকে হাইড করে রেখেছে। তাই আয়ান বুঝলো না এটা কে। আয়ান তাকে রিপ্লাই দিল। “এই যে মিস! অনেক্ষণ ধরেই আপনার বকবক শুনতেছি। সমস্যা কি আপনার?”
মেয়েটি কিছুক্ষণ পর একটি ছবি পাঠায় আয়ানকে। আয়ান দেখে এই ছবিটি তার আর প্রিতির। কাল একসাথে ওরা দুজন ছবি তুলেছে। আয়ান তা ফেসবুক প্রোফাইলেও দিয়েছে। ক্যাপশনে লিখেছে, ‘হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে পেলাম।’
আয়ান বুঝতে পারছেনা এই ছবিটি মেয়েটি কেন তাকে দিল। মেয়েটি বলল, “আপনি ওকে পছন্দ করেন?”
আয়ান ভ্রু কুচকে নিল। মেসেজ লিখলো, “কেন?”
“তার সাথে ছবি তুলে আপনার প্রোফাইলে দিয়েছেন, তার মানে নিশ্চয়ই তাকে আপনি পছন্দ করেন।”
“যদি করেও থাকি, তাহলে আপনার সমস্যা কোথায়? আপনি কে? আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?”
“আপনার ফেসবুক থেকেই আপনার নাম্বার নিয়েছি। আমার অনেক সমস্যা। আপনি একটা ভণ্ড, প্রতারক।”
“আরে ভাই! কে আপনি? কি করেছি আমি?”
“আপনি খারাপ লোক। আপনি না একজনকে ভালোবাসেন? তাহলে অন্য একটা মেয়ের সাথে ছবি তুলে আপ দেন কেন?”
“এক মিনিট! আপনি জানলেন কি করে আমি একজনকে ভালোবাসি?”
“আমি সব জানি।”
“দেখুন মিস। আমার লাইফ, আমার ইচ্ছে আমি কি করব না করব।
“হ্যাঁ সেটাই তো। আপনি তো কাউকে ভালোইবাসেননি।”
“এই, একদম চুপ। অনেক্ষণ ধরে আপনার কথা শুনতেছি। প্রিতি শুধু মাত্র আমার বন্ধু। এর বাইরে কিছু না। আর আমি যাকে ভালোবাসি, সে আমার মনে প্রাণে সবখানে আছে। আমি কাউকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই। আমার ভালোবাসা আপনি বুঝবেন না। তাকে আমি না পেলেও আজীবন ভালোবাসব। সে যদি একবার মুখ ফুটে বলে সে আমাকে ভালোবাসে তাহলে আমি দুনিয়ার কাউকেই পরোয়া করিনা। আমার শুধু সে হলেই চলবে। আপনি কান খুলে শুনে নিন। আই স্টিল লাভ হার।”
আয়ান ফোনটা ছুড়ে মারে বিছানায়। আর কোনো মেসেজও আসেনা তার কাছে।
–
সূর্যিমামার তপ্ত রোদের আলো জানালা ভেদ করে এসেছে মীরাদের রুমে। শীত সকালে এতো সকালে ঘুম থেকে উঠা হয়না মীরার। তবে নামাজ পড়ার জন্য উঠে, আবার ঘুমিয়ে যায়। আহানের উপর শুয়ে আছে মীরা। লোমহর্ষ উন্মুক্ত আহানের বুকের উষ্ণতা মীরাকে আরও কাছে টানছে যেন। আহানের শার্টটি টেনে ধরলো সে। ভারি নিঃশ্বাস উপচে পড়ছে আহানের গলায়। দু’হাতে আকড়ে ধরে আহানকে। আহান নড়েচড়ে মীরাকে নিয়ে ডানপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে। দু’হাতে মীরার কোমর চেপে আরও কাছে টেনে নেয় তাকে। মিষ্টি আলিঙ্গনে নিজেদের হারিয়ে ফেলে তারা।
.
ঘড়ির কাটায় নয়টা বাজছে। আহান থানায় যাওয়ার জন্য রেড়ি হয়ে গেল। মীরা আহানের যাবতীয় সব জিনিস গুছিয়ে দিয়েছে। আহান বেরিয়ে গেল। বাসায় তেমন কোনো কাজ না থাকায় মীরা লাইব্রেরি রুমে এলো। বুকশেলফ থেকে বেছে বেছে একটা বই নিল। চেয়ার টেনে বসে পড়লো ওখানে। মনোযোগ সহকারে বই পড়তে নিল।
বই পড়ার ফাঁকে চারপাশে তাকালো সে। এই ঘরটায় কেমন একটা শান্তি শান্তি অনুভব হচ্ছে তার। কিছুক্ষণ বই পড়ে বইটা বন্ধ করে দিল মীরা। শেলফে রেখে উঠে গেল। রুমের জানালার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল সে। একটা সুন্দর বাগান দেখতে পায়। কত শত গাছ বাগানটায়। মৌসুমি নানা ধরনের ফুল ফুটে আছে। জানালা থেকে বেশ ভালোই সুন্দর লাগছে। সামনে গেলে না জানি কত সুন্দর। বাগানে কখনো মীরার যাওয়া হয়নি। আসলে সুযোগই পায়নি সে। এখানের একটি কোণে নাকি আহানের মায়ের কবর আছে। মীরা এখনো তার শাশুড়ীর কবর দেখতে যায়নি। আহান কখনো তাকে নিয়ে যায়নি। আহান খুব ইমোশনাল। মায়ের কবরের সামনে গেলেই সে আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। ফলস্বরূপ কাঁন্না করতে থাকে বাচ্চাদের মতো। মীরা এই কথাটা শুনেছে আয়ানের কাছ থেকে। তবে আয়ান প্রায় সময়ই কবর জিয়ারত করতে যায়। আহান তার মায়ের কবরের কাছে যেতে ভয় পায়। মীরা একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ল৷ লাইব্রেরি রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল সে। দোতলা থেকে নেমে ড্রয়িংরুমে এলো। মীরার শাশুড়ী পপকর্ন ভাজতেছে। মীরা রান্নাঘরে গেল। তার শাশুড়ী তাকে ভাজা পপকর্ন দিলেন। সে হেসে এক বাটি পপকর্ন নিয়ে সোফায় বসে পড়ল। টিভি অন করে কার্টুন দেখছে আর একটা একটা করে পপকর্ন মুখে পুরছে।
দোতলার বারান্দা থেকে আয়ান নিচে তাকিয়ে মীরাকে দেখতে পায়। সে এখন কার্টুন দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আয়ান মীরাকে কিভাবে ডাকবে বুঝে উঠতে পারছিল না। টব থেকে একটা পাস্টিকের ফুল নিয়ে দোতলা থেকে সোজা মীরার মাথার উপর ফেলল সে। মাথায় কিছু একটা পরায় উপরে তাকায় মীরা। আয়ান হাত দিয়ে ইশারা দিল মীরাকে। পপকর্ন এর বাটি হাতে নিয়েই সে দোতলায় উঠে গেল৷ আয়ানের সামনে এসে জিগ্যেস করে, “এরকম অসভ্যের মতো ফুল ছুড়েছ কেন? ডাকলেই তো পারতে।”
“স্যরি, স্যরি। একটা জরুরী কথা বলার ছিল।”
“কি? আমি কার্টুন দেখব, তাড়াতাড়ি বল।”
আয়ান তার পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল। এরপর একটা নাম্বার এনে তা মীরাকে দেখিয়ে বলল, “এই নাম্বারটা চিন?”
মীরা ভ্রু কুচকে নাম্বারটার দিকে তাকাল৷ কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, “লাস্ট ডিজিট সেভেন জিরো! মনে করতে পারছিনা। দাঁড়াও, আমি ফোন দেখি।”
মীরা আঁচলের নিচ থেকে তার ফোনটা বের করল। কললিস্ট চেক করে একটা নাম্বার পেল সে। আয়ানের দেওয়া নাম্বার এর সাথে মিলিয়ে দেখল। তড়িৎ গতিতে বলল, “এটা তো দিবার নাম্বার। তুমি পেলে কোথায়?”
আয়ান বুঝলো সকালে অজানা মেসেজকারী আসলে কে। মীরাকে সে বানিয়ে বলল, “আসলে মনে পড়ছে না। ওকে, আমি ডিলিট করে দিচ্ছি।”
“আশ্চর্য! ডিলিট করবে কেন?”
“রেখে লাভ?”
“ফোন দিয়ে কথা বলতে পারো।”
“মীরা, আমি তার কেউ নই যে ফোন দিলেই সে রিসিভ করে হেসে হেসে কথা বলবে আমার সাথে।”
“আমি মামাকে বুঝিয়ে বলব।”
“যাকে পছন্দ করি তার থেকেই কোনো রেস্পন্স নেই তার বাবাকে জানিয়ে কি হবে। তুমি এক কাজ করো। এসব ভাবনা বাদ দিয়ে ভাইয়ার সাথে সময় কাটাও। আমাকে নিয়ে এতো ভেবো না।”
আয়ান কথাগুলো বলেই চলে গেল। মীরা মন খারাপ করে নিচে মেনে এলো।
সোফায় বসে ভাবছে আয়ানের বলা কথাগুলো। কি কষ্ট ছেলেটার মনে। দরজা দিয়ে কাউকে আসতে দেখে মীরা উঠে দাঁড়ালো। শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা দিল। একজন মহিলা এসেছেন, এবং তার সাথে একটা মেয়ে। মীরাকে উপেক্ষা করেই তারা ভেতরে ঢুকে গেলেন। মীরার শাশুড়ী সবে রান্নাঘর থেকে বের হলেন। তাদের দেখেই থমকে গেলেন। মহিলাটি মীরার শাশুড়ীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কেমন আছেন ভাবি?”
মীরার শাশুড়ী হেসে জবাব দিল। “ভালো, আপনি ভালো আছেন আপা?”
“হ্যাঁ। ভাইজান কই?”
“অফিসে গেছে।”
মেয়েটি মীরার শাশুড়ীকে সালাম করে বলল, “কেমন আছেন মামি?”
“ভালো। তুমি ভালো?”
“হ্যাঁ।”
মীরা দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে তাদের আলাপ শুনছে। মহিলাটি মীরাকে দেখে মীরার শাশুড়ীকে জিগ্যেস করলেন, “এই মেয়েটা কে ভাবি? শাড়ি পড়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। কে ও?”
“আমার ছেলের বউ।”
“কিহ? আয়ান বিয়ে করে ফেলেছে? কোই আমরা তো জানিনা।”
“আয়ান নয়, আহানের বউ।”
মহিলাটি একটু ঠেস মেরে বললেন, “আপনি আবার কবে থেকে আহানকে ছেলে ভাবতে শুরু করলেন? আপনি তো ওকে পছন্দই করেন না।”
“পুরনো কথা বাদ দিন আপা। বসুন, কথা বলি।”
“আহানের বিয়ে হয়ে গেল, অথচ আমাকে জানাননি।”
“হুট করেই হয়েছে।”
“তা মেয়ের গায়ের রঙ তো চাপা। আমার মেয়ের মতো এতো সুন্দর নয়।”
“ছেলে পছন্দ করে বিয়ে করেছে। তাছাড়া মীরা খুব ভালো একটা মেয়ে। ও আশার পর থেকেই আমার সংসারটা ভরে উঠেছে, আমার ভুল ধারণা ভেঙে দিয়েছে। আজকাল গায়ের রঙ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না আপা।”
মীরার শাশুড়ী মীরাকে ইশারা দিয়ে ডাকলেন। সে আস্তে করে এলো তাদের কাছে। মীরার শাশুড়ী বললেন, “ইনি আহানের ফুপি। আর এ তার মেয়ে।”
মীরা ফুপিকে সালাম করল। ভালো মন্দ জিগ্যেস করল। তার মেয়ের সাথেও কথা বলল মীরা। উনি জিগ্যেস করলেন, “বিয়ে হয়েছে কয়মাস?”
“সাত মাস।”
“খবর নেই?”
মীরা ভ্রু কুচকে জিগ্যেস করে, “কিসের খবর?”
“কিসের খবর বুঝো না? কি ভাবি। কোনো খবর নেই?”
“আমিতো জানি না। তাদের জীবন, তারা বুঝবে।”
“কি বলেন, মেয়ে বাঁজা নাকি?”
মীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এসব কি ধরনের কথা বলছেন উনি। মীরার শাশুড়ী বললেন, “আপা আপনি এসব কি বলছেন? এই যুগে এসে আপনি এসবে বিশ্বাস করেন? ওদের সময় হলেই ওরা বাচ্চা নিবে। এরজন্য মীরাকে অপবাদ দিচ্ছেন কেন না জেনে?”
“ছেলের বউয়ের হয়ে তো দেখছি আজকাল ভালোই কথা বলছ। কি জানি বাবা কি জাদু করেছে সে তোমার উপর।”
ফুপির একটা কথাও মীরার ভালো লাগেনি। তাই সে ওখানে আর এক মুহুর্তও দাঁড়ালো না। ছুটে সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে এলো। রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করলো। সে কি এতোটাই খারাপ? আয়নায় নিজের চেহারা দেখছে সে। মীরার গায়ের রঙ শ্যাম বর্ণের। কিন্তু মীরার চেহারার দিকে তাকালে মায়ার অতল গহ্বরে চলে যাবে যে কেউ। মীরা ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। তাকে দেখতে কি খুব কুৎসিত? আজ প্রথমবার কেউ তাকে তার চেহারে নিয়ে কটাক্ষ করলো। যা খুব বাজে লেগেছে মীরার। বিয়ের পর এই প্রথম কেউ তাকে বাচ্চা না হওয়ায় বন্ধা বলেছে। মীরার খুব কষ্ট হচ্ছে। সে কি তবে আহানকে খুশি রাখতে পারেনি? মীরা বিছানায় বসে দু হাটু ভাজ করে কাঁদতে থাকে। মনে মনে ভাবে বোধহয় সে দেখতে অনেক খারাপ। আহান তাকে পরিস্থিতির চাপে পড়ে বিয়ে করেছে। মীরা প্রবল বেগে কাঁদতে থাকে।
চলবে…