অমানিশায়_সেই_তুমিই #লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা ১৫.

0
440

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১৫.

সকাল সকাল উঠে মেঘালয়া ফ্রেস হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। সকাল সাতটা বাজে ঘড়িতে। আজকে সূর্যের তেজ তুলনামূলক কম মনে হলো। এখনও তেমন ঝাঁজাল হয়ে ওঠেনি। সকালের নির্মল বাতাসে দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে নিলো মেঘালয়া। জীবনটাকে আজকাল একদম ভালো লাগে না তার। এই ছোট্র জীবনে কিছু দিনের ব্যবধানে তার সঙ্গে বহু তিক্ত ঘটনা ঘটে গেছে। যা ছিল তার জন্য সম্পূর্ণ ভাবনাতীত। একটা ভুল তাকে বাস্তবতার দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। সে মোটেই এত তাড়াতাড়ি এত বড়ো আর বুঝমতি হয়ে উঠতে চায়নি। তার সেই চঞ্চলতা, আহ্লাদ, আত্মমর্যাদাবোধ; সবই কেমন বাস্তবতার সংস্পর্শে জ্বলে ছাই হয়ে গেল। সে কতটা নিচু হয়ে উঠেছে সকলের চোখে। তাতে কি বিশেষ কোন লাভ হয়েছে! সে ভেবেছিল, এভাবে নিজের ভুলটা মেনে নিয়ে চুপ থাকলে হয়ত সকলের মন গলবে, তাকে সকলে আবারও গ্রহন করে নেবে।

ভুল এই ভাবনাটা ভেঙে দিয়েছে সকলে। সে এমনিতেও তাদের সম্মুখে খারাপ, আর ভালো হওয়ার চেষ্টাটাও করবে না। ইরাজের কথা মনে পড়ল। আপন মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল মেঘালয়া। ভালোবাসা! ইরাজ এটাকে ভালোবাসা বলে? যেখানে, তিক্ততা আর কিছুই নেই। মেঘালয়া নিজের জন্য কিছু করতে চায়। নিজেকে সে আত্মনির্ভর হিসেবে দেখতে চায়, যাতে সে প্রতিনিয়ত হাজারটা ভুল করে গেলেও কেউ যাতে তাকে নিচু চোখে দেখে, অবহেলা না করার সুযোগ পায়। সে করবে, আরো ভুল করবে, বারবার ভুল করবে। সে দেখতে চায় সকলে এবার কি করে?

ভয়ানক এক জিদের অঙ্গীকার করে বসল মেঘালয়া নিজের সঙ্গে। বারান্দা থেকে চলে এলো। রুম থেকে বেরোনোর সময় ভুলেও একবার তাকাল না বিছানায় শায়িত ঘুমন্ত ইরাজের দিকে। মুখভঙ্গি কঠিন তার, সেই বাচ্ছাসুলভ মেঘালয়াই যে এটা, তা চেনার উপায় নেই এই মেঘালয়াকে দেখে। রান্নাঘরে এসে দাঁড়াল আস্তে করে। আনতারা খানম এখনও আসেন নি সেখানে। আয়েশা কাটাকুটি করছে। সে নিঃশব্দে রান্নাঘরে প্রবেশ করে ছোট একটি পাত্র হাতে নিলো। আয়েশা ব্যস্ত হয়ে বলে, “ভাবীমণি! আপনার কি লাগব, আমারে কন। আমি কইরে দিই।ʼʼ

মেঘালয়া গম্ভীর স্বরে জবাব দিল, “প্রয়োজন নেই। নিজের কাজ করুন, আমি করে নিচ্ছি।ʼʼ

আয়েশা আর কিছু বলতে পারল না। মেঘালয়া আপন মনে দুই কাপ কফি বানিয়ে নিলো। তা কফিমগে ঢেলে ট্রেতে তুলে রান্নাঘর থেকে বের হবার মুহূর্তে আনতারা খানম আসলেন সেখানে। মেঘালয়া তাকাল না সেদিকে, নির্বিকার চিত্তে ট্রে নিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে। আনতারা খানম লক্ষ্য করলেন, মেঘালয়ার মুখে স্পষ্ট তিক্ততা।

মেঘালয়া ইমতিয়াজ সাহেবের রুমের বারান্দায় এসে দাঁড়াল ইমতিয়াজ সাহেবের সম্মুখে। তিনি বসে আছেন ল্যাপটপ কোলে। পাশেই খবরের কাগজ। হয়ত খবরের কাগজওয়ালা মাত্রই দিয়ে গেছে, তা ওভাবেই পাশে রেখে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছেন তিনি। মেঘালয়ার উপস্থিতিতে চমকে তাকালেন সেদিকে। ওকে দেখেই সুন্দর এক হাসি দিয়ে বললেন, “আরে আম্মাজান যে! এত সকালে ঘুম ভেঙেছে আজ, ব্যাপার কি? প্রতিদিন তো দেখাই পাই না।ʼʼ

মেঘালয়া চমৎকার হাসল, “আজ থেকে পাবে। নাও তোমার কফি।ʼʼ

কফির মগ হাতে তুলে দিল মেঘালয়া। তা হাসিমুখে নিলেন ইমতিয়াজ সাহেব। কফিতে চুমুক দিতে দিতে ইশারা করলেন মেঘালয়াকে সামনের মোড়ায় বসতে।

“শরীর কেমন যাচ্ছে তোমার, বাবাই!ʼʼ

“আলহামদুলিল্লাহ ভালোই যাচ্ছে রে, মা। তবে একটুতেই খুব ক্লান্ত হয়ে উঠি আজকাল বুঝলি! আমার বাঁদর কি করছে? নিশ্চয়ই চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে। তার হাতে কাজবাজ দিয়ে যে নাতি-নাতনি নিয়ে অবসরে যাব; তা আর হয়ে উঠছে না বলেই আরো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি দিন দিন।ʼʼ —শেষের কথাটা বেশ ঢং করে বললেন ইমতিয়াজ সাহেব।

মেঘালয়া মাথা নত করে হাসল। ইমতিয়াজ সাহেব যে, কথার মাঝে নাতি-নাতনির ইঙ্গিত দিলেন, তা বুঝেই মূলত মেঘালয়ার এই অদ্ভুত হাসি। প্রসঙ্গ বদলাতে বলল,

“আব্বু কেমন আছে, বাবাই!ʼʼ

“তোর আব্বু আজকাল খুব অলস হয়ে গেছে রে! আমি তার জন্য অপেক্ষায়, তৃষ্ণার্ত প্রেমিকের মতো বিরহে ডুবে মরি, তার পাত্তা নেই। কল দিলে বলে, আজ একা চালিয়ে নে, পরে টরে দেখব।ʼʼ

মেঘালয়া এমন একটা কথা শুনে চোখ বড়ো-বড়ো করে তাকাল। তা দেখে ইমতিয়াজ সাহেব শব্দ করে হাসলেন। বললেন, “তোরাই শুধু পারিস? আমি আর হেলাল বয়সকালে কত মেয়ের ব্যাগের খাবার চুরি করে খেয়েছি। কত মেয়ের গায়ে ব্যাঙ ছুঁড়ে দে ছুট। সে মেয়ে ব্যাঙ দেখে পালাবে নাকি আমাদের তাড়া করবে।ʼʼ

এ পর্যায়ে মেঘালয়ার হাসতে হাসতে দম বন্ধ অবস্থা। ইমতিয়াজ সাহেব মুগ্ধ হয়ে দেখলেন, মনে হলো, সেই ছোট্র মেঘালয়া খিলখিলিয়ে হাসছে যেন! আস্তে করে বললেন, “মাশা-আল্লাহ!ʼʼ

তা বোধহয় কানে গেল মেঘালয়ার। হাসি থামিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল। ইমতিয়াজ সাহেব শান্ত স্বরে বললেন, “থামলি কেন, মেঘা! কতদিন পর তোর খিলখিল হাসির রব শুনলাম। হাসতে ভুলিস না, মা। হাসিই তো একমাত্র বস্ত; যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে অমর করে। যে হাসতে ভুলে যায়, সে তো দুনিয়া থেকে মুছে যায় রে, মেঘা!ʼʼ

মেঘালয়া চোখটা কি সিক্ত হয়ে উঠল না! সে দ্রুত মাথা নত করে নিলো। ইমতিয়াজ সাহেব আদুরে গলায় বললেন, “তোর মামনি যা বলে ওসব ধরিস না। ও এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। সংসার জীবন এমনই হয় বুঝলি! একটু টানপোড়েন না থাকলে যে তাকে সংসারধর্ম বলা যায় না। একটু মানিয়ে নিয়ে চল, সৃষ্টিকর্তা কোন কষ্টই তার সৃষ্টিকে বেশিদিন ভুগতে দেন না।ʼʼ

মেঘালয়ার চোখ থেকে এক ফোঁটা তরল টপ করে পড়ল কোলের ওপর রাখা হাতের কব্জির ওপর। ইমতিয়াজ সাহেব এগিয়ে এসে মাথায় হাত দিলেন। মুখটা উচু করে ধরতেই ভেসে উঠল, মেঘালয়ার অশ্রুসজল মুখটা। বুকটা ভার হয়ে উঠল। যত্ন করে নিজের হাতে চোখের জল মুছে দিলেন তিনি। মেঘালয়া যেন আরও সায় পেয়ে গেল। ডুকরে কেঁদে উঠল আবারও। এবার একহাতে আগলে নিলেন ইমতিয়াজ সাহেব মেঘালয়াকে। অপর হাত মেঘালয়ার মাথায় রেখে বিলি কাটতে কাটতে বললেন,

“কি হয়েছে রে পাগলি! আব্বুর কথা মনে পড়ছে? যাবি? নিয়ে যাব!ʼʼ

মেঘালয়া মুখ তুলে চাইল, কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, “বাবাই! আমি যে ভুলটা করেছিলাম, তার শাস্তি ফুরোচ্ছে না কেন? আর কত সহ্য করলে এই ভুল আমার পিছু ছাড়বে বলো তো?ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব মৃদূ হাসলেন, “বোকা মেয়ে! কে বলেছে এসব ভুলের শাস্তি? তুই যা করেছিস, তোর বয়সে মানুষ তার চেয়ে বড়ো বড়ো ভুল এমনকি পাপ করে বসে। তোর সঙ্গে যা হচ্ছে তাকে ভুলের শাস্তি ভাবছিস, নিজের বোকামিতে। জীবনে এমন অনেক যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়, যার জন্য কোন ভুলের প্রয়োজন হয় না। জীবন বড়োই বৈচিত্র্য রে মা! জীবনকে ব্যাখ্যা করা যায় না, আর না যায় পরিকল্পনামাফিক পরিচালনা করা। বরং জীবন আমাদের যেভাবে পরিচালনা করে; সেভাবে চলা ছাড়া উপায় থাকে না। হেলাল তোকে বড়ো আহ্লাদে মানুষ করেছে, দুনিয়ার জটিলতা থেকে বাঁচিয়ে নিজের কাছে আগলে রেখেছিল, তাই এসব নতুন মনে হচ্ছে। অথচ সকলের জীবনেই এমন টানপোড়েন রয়েই যায় আজীবন; সেখানে ভুলের প্রয়োজন নেই।ʼʼ

কথাগুলো শুনতে শুনতে মেঘালয়ার ভেতরে অদ্ভুত এক সান্তনা চলে এলো। তবে ইমতিয়াজ সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বড়ো মায়া অনুভূত হলো। মানুষটা আসলেই অমায়িক। এও যে বাপ, মেঘালয়ার আরেক বাপ; ওর বাবাই!

ইমতিয়াজ সাহেব ধমকে উঠলেন, “আবার কাঁদছিস? কিছু বলছি না বলে স্পর্ধা বেড়েছে? চোখ মুছে ফেল! নয়ত নিয়ে গিয়ে শিশুতোষ স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আসব। এত বড়ো মেয়ে এভাবে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদে?ʼʼ

মেঘালয়ার জানে, বাবাই ওর মন ভালো করতে এসব বলছে। চোখে পানি নিয়েই ঠোঁটে হেসে ফেলল, সঙ্গে হাসলেন ইমতিয়াজ সাহেব। মেঘালয়ার গুমোট হয়ে থাকা মনটা আচমকা বড়ো হালকা লাগে। এতক্ষণে কফি নিশ্চয়ই ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে দুজনের!

চলবে..

[ জানি পর্ব একটু ছোটো হয়েছে। প্রতিদিন ১৫০০+ শব্দ থাকে। আজ হাজার খানেক। পড়ালেখার চাপে একটু ব্যস্ত সময় কাটছে। তবে আগামী দিন ইনশা-আল্লাহ বড়ো করে দেব পর্ব। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন❤️🌸]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here