#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৩।
রাবীর গাড়ি থেকে নেমে মেহুলের কাছে আসে। সে অস্থির গলায় বলে,
‘কোথায়, মেহুল? ঐ লোকটা কোথায়?’
মেহুল তাকে হাতের ইশারা দিয়ে দেখায়। রাবীর সেদিকে চেয়ে দেখে। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে,
‘চলুন।’
রাবীর মেহুলকে নিয়ে রাস্তার ওপারে যায়। মেহুল তাকে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘শুনুন, একদম ধরে উড়াধুরা মাইর দিবেন।’
রাবীর তার দিকে চেয়ে মুচকি হাসে। সে ঐ ছেলেটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ছেলেটা চোখ মুখ কাচুমাচু করে বলল,
‘সালম স্যার।’
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।’
মেহুল হা করে চেয়ে আছে দুজনের দিকে। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। রাবীর তার দিকে চেয়ে বলল,
‘এই লোকটার উপর আপনার কেন সন্দেহ হয়েছে, মেহুল?’
‘আসলে, উনি তখন থেকে আমাদের দিকে বারবার তাকাচ্ছিলেন। আর এখান থেকে যাচ্ছিলেনই না। তাই আমি ভেবেছি আরকি…’
পাশের ছেলেটি তখন অনুনয়ের সুরে বলল,
‘দুঃখিত ম্যাডাম, আসলে আমি আপনার খেয়াল রাখছিলাম। আমার তাকানোতে আপনার খারাপ লেগে থাকলে আমি সত্যিই দুঃখিত।’
মেহুল রাবীরের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘উনি কে?’
‘উনি আপনার পার্সোনাল গার্ড। আর এখন থেকে উনি আপনার সাথে সাথেই থাকবেন।’
মেহুলের কথাটা শুনে একটু অন্যরকম লাগল। একটা লোক সারাক্ষণ তার পেছন পেছন ঘুরবে, এটা কেমন দেখায়। তাই সে রাবীরকে বলল,
‘কিন্তু, ব্যাপারটা কেমন না? আর আমার তো গার্ডের প্রয়োজন ছিল না। আমার এসবে অস্বস্তি লাগবে, রাবীর।’
‘আমি বুঝতে পারছি, মেহুল। কিন্তু, আপনার সুরক্ষার জন্য এইটুকু আপনাকে এখন মেনে নিতেই হবে। আমার পক্ষে সারাক্ষণ আপনার খেয়াল রাখাও সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আর উনি আমার খুব বিশ্বস্ত লোক। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।’
মেহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদু হাসল। সে আর কী বলবে। আজকাল যা হচ্ছে তাতে করে একটা নিরাপত্তার দরকার ছিল অবশ্য। রাবীর জিজ্ঞেস করল,
‘আপনার আর কোনো অসুবিধা নেই তো?’
‘না।’
‘ঠিক আছে, আমি…’
রাবীরের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই তার ফোন বেজে উঠে। সে ফোনটা হাতে নিয়ে মেহুলের দিকে চেয়ে বলে,
‘এক মিনিট।’
তারপর সে কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে,
‘স্যার, বাংলা বাজার গোডাউনে আগুল লেগেছে। এইদিকে শ্রমিকরা আহাজারি করছে। সবাই দিশেহারা হয়ে দিক বেদিক ছুটছে, স্যার। আমরা কাউকে সামলাতে পারছি না। ফায়ার সার্ভিসের লোকেরাও এখনো আসেনি। মানুষের হৈ চৈ এ চারদিকের অবস্থা খুব খারাপ। কী করব বুঝতে পারছি না।’
রাবীর আতঙ্কিত হয়ে বলল,
‘কী বলছো এসব? ওখানে আগুন লাগল কী করে? আমার শ্রমিকদের দোকান। কীভাবে এসব হয়েছে?’
ওপাশের লোকটা তখন বলল,
‘স্যার, আমাদের যে দারোয়ানের ছিল সে বলেছে, আগুন এমনি এমনি লাগেনি কেউ লাগিয়েছে। কিন্তু, সে কে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। আপনি এক্ষুনি একবার এখানে আসুন।’
রাবীর অস্থির গলায় বলল,
‘ঠিক আছে, আমি আসছি।’
মেহুল রাবীরের অস্থিরতা আর আতঙ্কিত চোখ মুখ দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘কী হয়েছে, আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’
‘আর বলবেন না, বাংলা বাজার গোডাউনে আগুন লেগেছে। আমার শ্রমিকদের দোকান সেখানে। চারদিকে হৈ চৈ লেগে গিয়েছে। আমার এক্ষুনি একবার যেতে হবে। আপনি সাবধানে বাড়ি যাবেন। পরে কথা হবে। আসছি এখন।’
মেহুল রাবীরের সামনে দাঁড়িয়ে ভীত সুরে বলল,
‘এত অস্থির হবেন না। যেখানেই থাকবেন সাবধানে থাকবেন। আর প্লিজ একটু সময় করে আমাকে ফোন দিয়ে আপডেট জানাবেন।’
‘হ্যাঁ, আপনি চিন্তা করবেন না। বাড়ি যান। আমি সাবধানেই থাকব।’
রাবীর আর এক মুহুর্তও দাঁড়ায়নি। গাড়ি নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে। মেহুলের বুকের ভেতরে খচখচ করছে। ভয় হচ্ছে। এখন রাবীরের জন্য বড্ড দুশ্চিন্তা হয় তার। চারদিকে যা বিপদ, লোকটা একটু সাবধানে থাকতে পারলেই সে বাঁচে।
মেহুল বাসায় ফিরে অল্প কিছু খেয়ে নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়ে। ফোনটা হাতে নিয়ে ফেইসবুকে ঢুকতেই বাংলা বাজারে আগুনের একটা ভিডিও চোখের সামনে চলে আসে তার। চট করে উঠে বসে সে। আগুন তো ছোটখাটো ভাবে লাগেনি। বিশাল আগুন লেগেছে। মেহুলের মনে আরো ভয় জাগে। সে ছুটে টিভির রুমে যায়। টিভি ছেড়ে খবরের চ্যানলে গিয়ে দেখে সবখানেই এই আগুনের ফুটেজ’ই চলছে। আগুন এখনো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। চারদিকে মানুষ ছোটাছুটি করছে। রামিনা বেগম সেই মুহূর্তে রুমে এসে বললেন,
‘দুপুর থেকেই দেখছি এই অবস্থা। এখনো নাকি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। কী যে হবে কে জানে?’
মেহুল মায়ের দিকে চেয়ে অসহায় সুরে বলে,
‘মা, ওখানে তো রাবীরও গিয়েছেন।’
রামিনা বেগম আঁতকে উঠে বলেন,
‘কী? কেন?’
‘এট নাকি উনার লোকদের গোডাউন। উনাকে ফোন দিয়ে বলেছেন আর উনিও চলে গিয়েছেন। আগুনের অবস্থা দেখেছো, আমার তো এখন ভয় করছে মা।’
‘না না, কিছু হবে না। জামাই নিরাপদেই থাকবেন। টিভিতে দেখ না। ঐ যে ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা কাজ করছে। আগুন নিভে যাবে।’
মেহুল টিভির সামনে থেকে আর নড়ল না। টানা দু ঘন্টা যাবত সে টিভির সামনেই বসে আছে। টিভিতে লাইভ টেলিকাস্ট চলছে। সাংবাদিকদের সামনে এই মুহুর্তে রাবীর দাঁড়িয়েছে। তাকে সাংবাদিকরা নানা প্রশ্ন করছেন। আগুন কীভাবে লাগল, কিংবা কে লাগাল এইসকল বিষয়ে। মেহুল ক্ষিপ্ত হয়ে মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
‘আশ্চর্য, আগুন কীভাবে লেগেছে সেটা কি উনি জানেন নাকি? সাংবাদিকদের কি আর কোনো কাজ নেই? আজাইরা সব প্রশ্ন করেন।’
রামিনা বেগম বললেন,
‘জায়গাটা রাবীরের। আর এখানে কাজও করে তার লোকেরাই। তাই তাকেই এই প্রশ্নগুলো করা হবে, এটাই তো স্বাভাবিক।’
রাবীর বেশ সাবলীল ভাবে সব প্রশ্নের জবাব দিল। সে বলল, “তদন্ত চলছে। খুব শীঘ্রই তারা পুলিশের সহায়তা নিয়ে এই আগুনের রহস্য উদঘাটন করবে।”
সাংবাদিকের ব্রিফিং শেষ হতেই মেহুল রাবীরকে কল দেয়। কল রিসিভ করলে মেহুল বলল,
‘আপনি ঠিক আছেন?’
‘হ্যাঁ মেহুল, আমি ঠিক আছি। আপনি চিন্তা করবেন না।’
‘আমি আপনার লাইভ দেখছি। ওখানের আগুন কি পুরোপুরি এখনো নিভিনি?’
‘না, কিছু কিছু জায়গায় এখনো আছে।’
‘আচ্ছা, আপনার আর ভেতরে যাওয়ার দরকার নেই। বিল্ডিংটা যেভাবে পুড়েছে ধসে পড়ার সম্ভবনা আছে। ঐখানের লোকগুলোকে সরে আসতে বলুন।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি।’
মেহুল পুনরায় কিছু বলার আগেই ফোনের ওপাশ থেকে কাউকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়,
‘স্যার, গোডাউনের পেছনের দেয়াল ভাইঙ্গা গেছে। আর ঐডার নিচে আমার কর্মচারী আটকা পড়ছে স্যার। এখন হে কোনোভাবেই বের হইতে পারতেছে না। কিছু করেন স্যার। ওরে বাঁচান।’
রাবীর ফোনের এপারে মেহুলকে বলল,
‘মেহুল, আমি আপনার সাথে পরে কথা বলছি।’
এই বলে সে কল কেটে দেয়। এমনিতেই মেহুল শান্তি পাচ্ছে না। এখন আবার এসব শুনে আরো বেশি অস্থির লাগছে তার। এই লোকটা কী থেকে কি করে বসে কে জানে। মেহুল সোফায় বসে বসে হাত কঁচলাতে থাকে। রামিনা বেগমও চোখ মুখ কুঁচকে ভীত চোখে মেয়ের দিকে চেয়ে আছেন।
কিছুক্ষণ পর খবরে বলল, “বিপদের উপর আরেক বিপদ লেগেছে। আগুন নিভানোর জন্য যারা গোডাউনের ভেতরে গিয়েছিল তারা এখন বের হতে পারছে না। গোডাউনের একপাশের পুরো দেয়াল ধসে পড়েছে। অনেকে নাকি আবার সেই দেয়ালের নিচেই চাপা পড়েছে।”
এই কথা শুনে মেহুলের হাত পা এবার ঠান্ডা হয়ে আসছে। সে তাড়াহুড়ো করে রাবীরকে কল দেয়। কিন্তু তার ফোনে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলছে। মেহুলের ভয়, দুশ্চিন্তা সব বাড়তে থাকে। টিভিতেও আর তাকে দেখা যাচ্ছে না। বুকের ভেতরে ধুকধুক করছে তার। এই লোকটা আজ তাকে দুশ্চিন্তা দিতে দিতে হয়তো মেরেই ফেলবে। সে লাগাতার কল দিয়েই যাচ্ছে। আর রাবীরের ফোনও বারবার সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না’ই বলে যাচ্ছে। মেহুল যে কী করবে বুঝতে পারছে না। রামিনা বেগমও খুব অস্থির হয়ে উঠেছেন।
মেহুল রাবীরের সাথে আর কোনোভাবে যোগাযোগ করতে না পেরে এক পর্যায়ে তার মা’কে কল দেয়।
চলবে….