শেষটা_সুন্দর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ২৪।

0
819

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৪।

‘মা, আপনার ছেলে তো আমার কলও ধরছে না।’

‘টিভি তে তো দেখছ’ই কী অবস্থা, ও হয়তো ফোন ধরার অবস্থাতেই নেই।’

‘আমার উনার সাথে লাস্ট কথা হয়েছিল ঐ বিল্ডিংটার দেয়াল ধসে পড়ার আগে। এরপর থেকে এখন আর একবারও কথা হয়নি। আমার তো এখন খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে, মা।’

রাবীরের মা মৃদু হাসলেন। বললেন,

‘যাক, এখন আমার দুশ্চিন্তার ভাগ নেওয়ার জন্যও একজন চলে এসেছে। তবে এইতো কেবল দুশ্চিন্তার শুরু। এখনো তো পুরো জীবন পড়ে আছে এর জন্য।’

মেহুল সোফায় বসল। টিভির উপর থেকে চোখ সরছে না তার। কোনো নতুন আপডেটও পাচ্ছে না।
রাবীরের মা বললেন,

‘রাবীর ঠিক আছে। আমার আর তোমার ভালোবাসা আছে তো ওর সাথে। তুমি চিন্তা করো না।’

‘আচ্ছা মা, যদি আপনার সাথে কথা হয়, তাহলে আমাকে কিন্তু অবশ্যই বলবেন।’

‘ঠিক আছে।’

মেহুল কল কাটার পর রামিনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

‘বেয়ান কী বলেছেন?’

‘উনি ম্যান্টালি খুব স্ট্রং, মা। হয়তো দুশ্চিন্তা নিতে নিতে এখন আর এসব ছোট খাটো ব্যাপারে উনি এত অস্থির হন না। আমাকে বলেছেন, এ তো সবে শুরু। ভবিষ্যতে নাকি এমন দুশ্চিন্তা আরো নিতে হবে।’

‘হ্যাঁ, তা তো নিতে হবেই। নেতার বউ হয়েছিস, দুশ্চিন্তা কি আর এত সহজে পিছ ছাড়বে। তোকেও তোর শাশুড়ির মতোই স্ট্রং হতে হবে।’

মেহুল নিরস মুখে মৃদু আওয়াজে বলল,

‘হু।’

________

ঘড়িতে দশটা বাজে। মেহুলের চোখ মুখ ফুলে আছে। তার মা বাবা তার পাশেই বসে আছেন। একটু আগেই রাবীরের কল এসেছে। ফোন দিয়ে বলেছে, সব ঠিক আছে। সবাইকে ঠিকঠাক মতো বিল্ডিং এর ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। যারা চাপা পড়েছিল তাদেরকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর এসবের মাঝে সেও বেশ অনেকটাই ব্যথা পেয়েছে। একজন লোককে বের করতে গিয়ে পায়ের অনেকটা অংশ ছিলে গিয়েছে তার। হাতেও জখম লেগেছে বেশ। এখন সে হসপিটালেই আছে। আর মেহুল এই কথা শোনার পর থেকেই কেঁদে কেটে অস্থির যে সে হসপিটালে যাবে। কিন্তু, রাবীর তাকে কোনোমতেই সেই অনুমতি দিচ্ছে না। হসপিটালে এই সময় অনেক সাংবাদিক আছেন। সে চায় না, তারা কেউ তার স্ত্রীকে এভাবে দেখুক। আর ঐদিকে মেহুলও জেদ দেখাচ্ছে। কিন্তু, রাবীরের কাছে এই মুহুর্তে এই জেদের কোনো মূল্য নেই। সে উল্টো বলেছে, ঐদিকের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে সে নিজেই এসে মেহুলের সাথে দেখা করে যাবে।

তখন বারোটা বাজেনি। মেহুল খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছে। রাগ, জেদ, কষ্ট, অভিমান সবই লাগছে তার। মনে মনে তাই ঠিক করেছে রাবীরের সাথে কথাই বলবে না। এই লোকটার কাছে তার এত চিন্তার, এত অস্থিরতার কোনো মূল্যই নেই। আর একবারও তাকে কল দেয়নি। বলেছিল আসবে, তাও তো আসেনি। তাই সেও আর কল দিবে না, আর কোনো খোঁজ নিবে না। থাকুক সে তার মতো। তার এত এত দুশ্চিন্তার যার কাছে কোনো মূল্য নেই, সেও তাকে কোনো মূল্য দিবে না। এই বলে মেহুল চক্ষু মুদন করে। কিন্তু ঘুমাতে পারে কই। চোখের সামনে তো রাবীরের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে। তার ক্লান্ত কন্ঠস্বর যে কানে বাজছে। এভাবে ঘুমানো যায়?

________

ঘুমের বাজেই মাথার ভেতরে ক্রিং ক্রিং করে একটা শব্দ বাজছে। মেহুলের তখন ভ্রু জোড়া কুঁচকে আসে। স্বপ্নে এমন অদ্ভুত শব্দ কোথ থেকে তৈরি হচ্ছে। মেহুল হাঁসফাঁস করছে। তবুও চোখ মেলে তাকাচ্ছে না। কিন্তু, সেই শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। মেহুলের মস্তিষ্ক এক পর্যায়ে সেটা আর নিতে পারে না। মিটমিট করে তাকায় সে। বোঝার চেষ্টা করে শব্দটা কোথ থেকে আসছে। কিঞ্চিত সময় যেতেই সে বুঝতে পারে শব্দটা তার ফোনের। সে উঠে বসে। ফোনটা খুঁজে বের করে। তাকাতে পারছে না। তাও চোখ কচলিয়ে চেয়ে দেখে রাবীর কল করছে। সে কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে রাবীর বলে,

‘ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?’

মেহুল বলে,

‘হু।’

‘আমি দরজার বাইরে। একটু কষ্ট করে এসে দরজাটা খুলতে পারবেন?’

মেহুল ফোনটা চোখের সামনে ধরে সময় দেখে। দেড়টা বাজছে। মেহুল আবার ফোন কানে নিয়ে অবাক হয়ে বলল,

‘আপনি এইসময় এখানে কেন এসেছেন?’

‘আপনি না আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন। এখন একটু তাড়াতাড়ি এসে দরজাটা খুলুন। আমি আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।’

‘আচ্ছা দাঁড়ান, আসছি।’

মেহুল কোনোরকমে মুখটা ধুয়ে ওড়ানাটা গায়ে দিয়ে এক দৌড়ে দরজার সামনে যায়। তারপর আস্তে করে দরজাটা খুলে। রাবীরকে দেখে বিস্মিত হয় সে। তার হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ করা। রাবীর আস্তে আস্তে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। মেহুল দরজাটা আটকে দিয়ে রাবীরের পেছন পেছন যায়।

রাবীর ক্লান্ত শরীরে বিছানায় গিয়ে বসে। মেহুল দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। রাবীরের সাদা পাঞ্জাবীর আর এক অংশ সাদা রইল না। কপালে গালে কালো কালো ছাপ। চোখে মুখেও স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। রাবীর মেহুলের দিকে চেয়ে বলল,

‘আপনাকে দুশ্চিন্তা দেওয়ার জন্য আমি দুঃখিত। তখন এমন একটা পরিস্থিতিতে ছিলাম যে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। দাঁড়িয়ে আছেন কেন, এখানে এসে বসুন।’

‘না, মা’কে বলে আসি।’

‘এই না না, মা’কে এখন আর ডাকার কোনো দরকার নেই। মা বাবা জেগে যাবেন বলেই কলিং বেল না দিয়ে আপনাকে কল দিয়েছি। থাক উনাদের এখন আর জাগিয়ে কষ্ট দিবেন না।’

মেহুল তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রাবীরের দিকে চেয়ে আছে। রাবীর মৃদু হেসে বলে,

‘রেগে আছেন?’

মেহুল সেই প্রশ্নের জবাব দেয় না। জিজ্ঞেস করে,

‘পায়ে আর হাতে কি খুব বেশি ব্যথা পেয়েছেন?’

‘না, একটু ছিলে গিয়েছে শুধু।’

‘একটু ছিলে গেলে এত বড়ো ব্যান্ডেজ কেউ লাগায় না।’

মেহুলের কথা শুনে রাবীর বুঝতে পারে মেয়েটার অভিমান হয়েছে। তাই সে উঠে দাঁড়িয়ে মেহুলের কাছে যায়। মেহুল ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘উঠছেন কেন? বসে থাকুন।’

রাবীর তার কথায় সাড়া দেয় না। সে মেহুলের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মেহুল নিচের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাবীর কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে তার মুখের দিকে। তারপর হুট করেই জড়িয়ে ধরে তাকে। মেহুল হতভম্ব হয়ে যায়। রাবীর তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরেছে। রাবীরের এইটুকু স্পর্শেই যেন শরীর জমে গিয়েছে তার। সে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেবল। রাবীরের শরীরের উষ্ণতা যেন টের পাচ্ছে। সে ঢোক গিলে। রাবীর মৃদু স্বরে বলে,

‘আমার উপর রাগ করে থাকবেন না প্লিজ। আমি বুঝতে পারছি আপনার হয়তো এত দুশ্চিন্তা সহ্য করার অভ্যাস নেই। কিন্তু, এখন থেকে যে অভ্যাস করে নিতে হবে মেহুল। আমাদের জীবনটাই দুশ্চিন্তা দিয়ে ভরা। আর এখন তো আপনিও আমার জীবনেরই অংশ; তাই না চাইতেও এই দুশ্চিন্তার ভার আপনাকেও নিতে হবে। আমি নিরুপায় মেহুল, আপনাকে আমি কষ্ট দিতে চাইনি।’

মেহুল স্তব্ধ। রাবীর হয়তো কোনো উত্তরের অপেক্ষা করছে। তবে মেহুল মুখে কিছু না বলে আলতো করে তাকে জড়িয়ে দেয়। রাবীরের যেন এইটুকুতেই শান্তি পায়। তার এত ক্লান্তি, এত অবসাদের মাঝেও যেন তৃপ্তি খুঁজে পায় সে। মেহুল চোখ বুজে নিশ্বাস ফেলে বলে,

‘আপনাকে বলেছিলাম, ঐ বিল্ডিংটার ভেতরে যাওয়ার দরকার নেই। তাও আপনি গিয়েছেন। আর এত ব্যথাও পেয়েছেন। তারউপর তখন আমার ফোনও ধরছিলেন না। আরেকটু হলে তো আমাকেই হসপিটালে নিতে হতো।’

রাবীর ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। বলে,

‘ভাগ্যিস, আজ এত কিছু হয়েছিল। নাহলে বুঝতাম কী করে যে মিসেস মেহুল খান যে তার নেতা সাহেবকে এত ভালোবাসে।’

মেহুল এই কথা শুনে রাবীরকে ছেড়ে দাঁড়ায়। মুখ কালো করে বলে,

‘জি না, মোটেও আমি আপনাকে ভালোবাসি না।’

রাবীর ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,

‘আচ্ছা, তাহলে এত দুশ্চিন্তায় অস্থির কেন হয়ে উঠছিলেন শুনি?’

‘ওটা তো কেবল দায়িত্ববোধের খাতিরে। ঐসব ভালোবাসা টালোবাসা কিছুই না।’

রাবীর তখন তার দিকে কিছুটা এগিয়ে আসে। মেহুল পিছিয়ে দরজায় পিঠ ঠেকায়। রাবীর তার মুখ বরাবর মুখ এনে বলে,

‘কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা দায়িত্ববোধ এইটুকু বোঝার বয়স আমার আর আগেই হয়ে গিয়েছে, মিসেস মেহুল খান। তাই আপনাকে আর কষ্ট করে মিথ্যে বলতে হবে না।’

মেহুল শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাবীর তার চোখ মুখ ভালোভাবে পরখ করে বলে,

‘চিন্তাই চিন্তাই তো চোখ মুখ বিষন্ন হয়ে গিয়েছে। নিজের একটু ভালোভাবে যত্ন নিবেন। আসছি আমি, দরজাটা এসে আটকে দিয়ে যান।’

‘আপনি চলে যাবেন?’

রাবীর ঘুরে তাকিয়ে বলে,

‘আপনি বললে থেকে যেতে পারি।’

‘না, দরকার নেই। মাও নিশ্চয়ই ঐদিকে টেনশন করছেন। সাবধানে বাড়ি যান।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here