#এক_টুকরো_সুখ
#পর্ব_৫
#লেখনীতে_শুভ্রতা_প্রাণ
পেছনে ফিরে দেখি দুপুর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। তাও যে সে হাসি না। এক হাতে পেট চেপে ধরে হাসছে। অদ্ভুত তো! এভাবে পাগলের মতো হাসার কি হলো? আমি জিজ্ঞেস করবো তার আগেই উনি কথা বলতে শুরু করলেন।
“সুন্দরী বুঝি চুরি করতে গেছিলে? কার বাড়িতে গেছিলে গো? আমাকেও সঙ্গে নিতে পারতে। তবে তোমাকে এমন ভূত সেজে ফিরতে হতো না।”
কিহ এত বড় সাহস! আমাকে চোর বলে অপবাদ দেয়!
“এই এই মুখ সামলে কথা বলুন রাতের বাপ কাকু। আমি মোটেই চুরি টুরি করতে যাইনি ঠিকাছে। রান্না ঘরে কাজ করতে গিয়ে কাঁদা মাটি আর কালি লেগে গেছে। এর মানে এই না যে আমি চুরি করতে গেছি।”
“বুঝি গো বুঝি। ধরা খেয়ে এখন বানোয়াট গল্প পাতছো!”
“ধ্যাৎ আপনার সাথে কথা বলাটাই আমার ভুল। সবাই পুকুরে গেলো গোসল করতে আপনি এখানে কেন? আপনিও চুরি করতে যাবেন নাকি? আচ্ছা কি চুরি করবেন বলুন তো? আমাদের ঘরে তো তেমন দামি কিছু নেই।”
সুযোগ বুঝে আমিও গেথে দিলাম। আয়না সুযোগ পেয়ে কাজে লাগাবে না তাই কি হয়? আমাকে চোর বলার শাস্তি তো আপনিও পাবেন রাতের বাপ কাকু। এ তো সবে শুরু। এদিকে দুপুরের তো বিসম খাবার জোগাড়। পুকুরে সবার সামনে গোসল করতে লজ্জা লাগছে বলেই সে কলপাড়ে গোসল করার জন্য বাড়িতে চলে এসেছে। এখানে আয়নাকে খোঁচা মারতে গিয়ে যে নিজেই ফেঁসে যাবে তা জানলে এ মেয়ের পেছনে লাগতো না।
“আমি তো জাস্ট শাওয়ার নেবো বলে এসেছি। সবার সামনে লজ্জা লাগছিলো তাই আরকি।”
আমি হেসে বললাম
“বুঝি বুঝি, সব বুঝি। ধরা খেয়ে এখন বানোয়াট গল্প পাতছেন।”
দুপুর অবাক হয়ে বললো
“আরে এটা তো আমার কথা ছিলো।”
তাকে অবাক রেখেই আমি আবারও নিজের কাজে লেগে পড়লাম। গল্প করে দিন কাটালে চলবে না আমার। কাজ শেষে গোসল করে নামাজ পড়তে হবে। তারপর আব্বার সাথে মুহিনকে নিয়ে বেরোতে হবে। লেখাপড়া তো সেই আপা, দুলাভাই এসেছে থেকেই লাটে উঠে বসে আছে। তাকেও নামাতে হবে। কত কত কাজ বাবা।
আকাশ জুড়ে চলছে কালচে মেঘের খেলা। আবার এক অংশে রোদ্দুরের আনাগোনা। বৃষ্টি নামবে না এমন কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। আবার বৃষ্টি না নামলে বিশ্বাস করার উপায় নেই যে আসলেই বৃষ্টি হবে। আব্বা, দুলাভাই, মুহিন আর রাতের বাপ উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা কেবল আমার জন্য। আমি গেলেই সবাই বাজারের দিকে রওনা হবে। কিন্তু আমি যেতেই পারছি না। যেই না বের হতে নিই অমনি আম্মার এটা লাগবে, আপার ওটা লাগবে তো আপার শাশুড়ি কিছু একটা চেয়ে বসেন। বাইরে দাঁড়িয়ে সবাই আমাকে তাড়া দিচ্ছে। আচ্ছা আমার দোষ কোথায় এরা যদি আমাকে ডাকতে থাকে?
“ছোট আপা আর কত দেরি করবি? বৃষ্টি আসলে আর যেতেই পারবো না। তখন কিন্তু তোর চুল একটাও থাকবে না মাথায়।”
ছোট ভাইও এখন হুমকি দিচ্ছে। কি জীবন আমার? খাটবোও বেশি ঝাড়িও খাবো বেশি আহা।
“দাঁড়া আম্মাকে এটা দিয়েই আসছি।”
আম্মার কাছ থেকে একপ্রকার দৌড়েই বাইরে চলে এলাম। এবার আর কেউ ডাকলেও যাবো না বলে ঠিক করে নিয়েছি। সবাই আমাকে কেন ডাকবে? নিজের কাজ নিজেও তো করা যায় হু।
সাধারণ সুতি একটা সবুজ থ্রী পিচ পরনে আমার। ওড়না দিয়েই মাথায় কাপড় দেওয়া। সাজগোজ বলতে কিছু নেই। আব্বা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন
“মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ। আমার সুখের দিকে কারো নজর না লাগুক। এত সাধারণ বেশেই আমার সুখকে অসাধারণ লাগছে। আমার অভাবের সংসারের #এক_টুকরো_সুখ তুই আয়ু।”
আব্বার কথা গুলো এই প্রথম শুনছি না নয় তবু মনের মধ্যে প্রশান্তি ছুঁয়ে গেলো। মুচকি হেসে চলতে শুরু করলাম সবাই। আমাদের বাড়ির থেকে কিছুটা হেঁটে এগিয়ে না গেলে কোনো ভ্যান পাওয়া যায় না। গ্রামের ভেতরের দিকে মাটির রাস্তা বলে ভ্যান আসে না। তাই হেঁটেই যেতে হবে আমাদের কিছুটা। সবার আগে মুহিন হাঁটছে তার পেছনে দুলাভাই আব্বার সাথে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে আর দুপুর সবার পেছনে।
“তোমার আব্বার কথায় তো কাজ হলো না সুন্দরী।”
হঠাৎ দুপুরের এরকম কথার কোনো মানে খুঁজে পেলাম না আমি। কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে বসলাম।
“মানে?”
তার মধ্যে কেমন গা ছাড়া ভাব। আমি যে প্রশ্ন করেছি তা শুনেছে নাকি না কিছুই বোঝার উপায় নেই। আমার সাথে পা মিলিয়েই সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে।
“মানে এই যে আসার সময় তোমার আব্বা বললেন না তার সুখের ওপর কারো নজর না লাগুক? সেটাতেই কাজ হলো না তাই বললাম আরকি।”
“বুঝলাম না। কার নজর লাগলো? এখানে আমার ওপর কে নজর দেবে?”
তিনি বিস্তর হাসলেন। উমমম ছেলেটার হাসি বেশ সুন্দর।
“ও কিছু না। বলো তোমার লেখাপড়া কেমন চলে? এসএসসি দিয়ে কোন কলেজে যাবে ভেবেছো কিছু? গ্রামে তো কলেজ নেই কোনো। এখান থেকে অনেক দূর হবে তাই না? আচ্ছা তুমি আদৌ কলেজ যাবে তো নাকি বিয়ে শাদী করে শশুর বাড়ি যাবে সুন্দরী?”
“এসব বিয়ে টিয়ে আমার জন্য না। আমি অনেক লেখাপড়া করবো। তারপর উকিল হয়ে আব্বা, আম্মা আর ভাইকে এখান থেকে নিয়ে যাবো। তখন যদি কেউ আমাকে পছন্দ করে তবে ভেবে দেখবো।”
“বাহ্। খুব সুন্দর চিন্তাভাবনা তোমার। আরেকটা কথা মনে রাখবে সবসময় আয়না কখনো কোনো কিছুর বিনিময়েই নিজের আত্মসম্মান খোয়াবে না। সম্মান থাকলে সবাই তোমাকে দাম দেবে, না থাকলে কেউ না। আর যার জন্য তুমি সম্মান খোয়াবে সে নিজেও কিছু দিন পর তোমাকে অবহেলা করবে। তাই যেখানেই যা করো না কেনো নিজের সম্মান নিয়ে কোনো ছাড় কাউকে দেবে না। তাতে সে যেই হোক। তোমার পরিবার, বন্ধু, আত্মীয় বা প্রেমিক। বুঝলে?”
লোকটার কথার মাঝে ডুবে আছি আমি। ঠিকই বলেছে আসলে। সম্মান না থাকলে কেউ দাম দেয় না। খুব সুন্দর করে কথা বলে কিন্তু প্রেমিক? আমার প্রেমিক আসবে কোত্থেকে?
“আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলেন। সবই ঠিক আছে কিন্তু আমার কোনো প্রেমিক নেই আর কখনো হবেও না।”
আমার কথা শুনে প্রথমে বেশ জোরে জোরে হাসলেন দুপুর। বুকের ওপর দুহাত ভাজ করে রেখে বললেন
“এত নিশ্চিত কীভাবে হচ্ছো সুন্দরী? হতেও তো পারে খুব শীঘ্রই তোমার প্রেমিক জুটে গেলো। হুম হুম হুম?”
এই ছেলে আবারও আমাকে খোঁচা মারছে তা বেশ বুঝতে পারছি। তাই কোনো কথা না বলে মুখ ভেংচি দিয়ে সামনে হাঁটা ধরলাম। তা দেখে মুচকি হাসলো দুপুর।
বাজারে গিয়ে ভাইয়ের জন্য সুন্দর দেখে পাঞ্জাবী, শার্ট আর জিন্স পছন্দ করলো দুপুর। তা দেখে আব্বার চোখ মুখ চুপসে গেলো। আর কেউ না দেখলেও আমার নজর এড়ালো না। কারণ আমি তো জানি কেনো আব্বা ভয় পাচ্ছে। অতঃপর আমার জন্য একটা আকাশি গাউন পছন্দ করলেন উনি। আমাদের কিছু বলার সুযোগও দিচ্ছেন না। এবার তো আব্বার সাথে সাথে আমারও চিন্তা হচ্ছে। লোকজনের মাঝে মানসম্মান না যায়! সর্বশেষ পাঁচটা একই রকমের টুপি নিয়ে সবগুলো প্যাক করে দিতে বললেন উনি। আব্বা পকেট থেকে টাকা বের করতে গেলে তার হাত ধরে থামিয়ে দিলো দুপুর। অনেক বলার পরেও শুনলো না। তার কথা টাকা সেই দেবে।
দোকানি সবকিছু প্যাক করার মাঝেই আব্বার কল আসে। তিনি দুলাভাইকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে বলে চলে যান কাজের জায়গায়। আব্বা যাওয়ার কিছু পরেই দুলাভাইও আপার জন্য কিছু কিনবেন বলে চলে যান। আমাকে দায়িত্ব দিয়ে যান দুপুরকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার। বাহ্! যে যার মতো গেলো চলে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এগুলোই ভাবছিলাম। হুশ আসলো মুহিনের ডাকে।
“কিরে ছোট আপা। তুই কি এখানেই থাকার চিন্তা করছিস?”
“হুম হ্যাঁ হ্যাঁ চল বাড়ির দিকে। আপনিও চলুন।”
দুপুরের দিকে চেয়ে কথাটা বলেই সামনে হাঁটতে শুরু করলাম। কিন্তু বেশি এগোতে পারলাম না। থেমে যেতে হলো দুপুরের জন্য।
“আরে বাড়ি যাবো মানে কি? তুমি ঐযে ঐগুলো কিনবে না?”
কিছুই বুঝলাম না ওনার কথায়। ঐগুলো আবার কোন গুলো? আমি কখন কি কিনবো বলেছি? ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলাম। আমাদের চুপ দেখে উনি একহাতে আমার হাত অন্য হাতে মুহিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকলেন। এদিক ওদিক চেয়ে ঢুকলেন কসমেটিকস এর দোকানে। এবার বুঝলাম তার ঐগুলো মানে আসলে কসমেটিকস। কিন্তু আমি তো এগুলো কিনবো না। একে টাকা নেই তারপর আমি তেমন ব্যবহারও করি না এসব।
“খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে যা লাগবে নিয়ে নাও সুন্দরী।”
“আমার এসব লাগবে না। ব্যবহার করি না আমি।”
আমার কথা না শুনেই দুপুর মুহিনকে দেখিয়ে দেখিয়ে অনেক কিছু কিনতে শুরু করলো। আমি পেছনে হুদাই দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো।
“আরে তুমি সেই আয়না না?”
চলবে…?