এক_টুকরো_সুখ #পর্ব_২০

0
304

#এক_টুকরো_সুখ
#পর্ব_২০
#লেখনীতে_শুভ্রতা

কথায় আছে ভরসাযোগ্য পুরুষের কাছে নারী অবোধ শিশুর ন্যায়। তাঁদের সান্নিধ্যে সকল বাছ-বিচার ভুলে বসে। আয়নার অবস্থাও বর্তমানে ঠিক তেমন। তার কাছে নিজের আব্বা আনাস মিয়া এবং সদ্য বিয়ে করা স্বামী দুপুর, দুইজনই অত্যন্ত ভরসার স্থল। এটাই হয়তো কারণ আয়নার অহেতুক অভিমানের। নিজে ভুল করে আবার নিজেই অভিমান করাটা অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হলেও এমনটা আমরা মাঝে মধ্যেই করে থাকি। অধিকাংশ কাছের মানুষ গুলোর সাথেই করে থাকি। কখনো বা তাঁদের আরো কাছে পাওয়ার আশায় আর কখনো বা পরিস্থিতির শিকার হয়ে। পরিস্থিতি যে মাঝে মধ্যেই আমাদের মস্তিষ্ককে প্রায় অকেজো করে দেয়, এটা অস্বীকার করবার যো নেই।

আব্বা আর দুপুরের ওপর সামান্য কিছু সময় রাগ বা অভিমান পুষে রাখলেও তা দীর্ঘস্থায়ী করতে সক্ষম হলাম না আমি। হয় আমার ঘটের মরিচা পরিষ্কার হলো বা রাগ-অভিমান করা আমার কম্ম নয়। আব্বাও সকাল হতে না হতেই স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। একটু কিছু দরকার হতেই সেই আয়ু মা বলে চেঁচিয়ে ওঠা, হুড়মুড় করে আমার কাজ করা দেখে মুচকি হাসা, কথায় কথায় মাথায় হাত বুলানো, সবই আগের মতো। দুপুরের সাথে খুঁটিনাটি নিয়ে খুনসুটিও বদলালো না এক বিন্দুও।

নিজের নিয়মেই দিন পার হয়ে যেতে থাকলো। কোনো কিছুর জন্যই থেমে রইলো না। না তো কারো জীবনে সুখের জোয়ার দেখে আর না তো কাউকে দুঃখের সাগরে ভেসে যেতে দেখে। মানুষের জীবন যেভাবেই যাক না কেনো প্রকৃতি নিজের চিরবহমান রূপ, চঞ্চলতা কখনো একফোঁটাও বদলায় না। বদলানোর ব্যাপারটা যুক্তিতেও টেকে না। কেনো না পৃথিবীর এত এত মানুষের একেক জনের জীবনের জটিলতা, দুঃখ একেক রকম। এবার প্রকৃতি যদি সবার দুঃখে একবার করে থামতে যায় তবে তার ফল যে কেমন বিদঘুটে হবে তা কল্পনা করতেও ভয় হয়।

“আমার ভাবতে লজ্জা করছে যে তোমরা আমার গর্ভের সন্তান, কাজী বংশের রক্ত, সারা এলাকায় সৎ-ব্যাক্তিত্ববান-পরিশ্রমী হিসেবে নামডাক যার সেই আব্দুল্লাহ কাজীর সন্তান। তোমাদের কি বিন্দু পরিমানও লজ্জা হচ্ছে না আপন ভাই বোনের মাঝে মৃত বাবার সম্পত্তি নিয়ে টানাহ্যাচড়া করতে?”

আনোয়ারা বেগম, আব্দুল্লাহ কাজীর প্রিয়তমা স্ত্রী। বয়স আন্দাজ করা খানিকটা কঠিন বৈ কি। তার ছেলেমেয়েদের অনেকের ছেলে-মেয়ে বিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে এবং তাঁদেরও সন্তান-সন্ততি আছে। তবু মহিলা এখনো বেশ টনটনে। এখনো অবধি তিনি একা একা হেঁটে ছেলেমেয়েদের বাড়িতে চলাচল করেন। আপাতত তিনি নিজের সন্তানদের আচরণে প্রচন্ড বিরক্ত। মরহুম স্বামীর কষ্টে অর্জিত ধন-সম্পদ নিয়ে এসব ঝামেলা তার সহ্য হচ্ছে না। তাই নিজের ছয় ছেলেমেয়েকে একসাথে কাছে ডেকেছেন।

নিজের মায়ের কথায় কোনো রকম জবাব দিতে পারলেন না তারা। তাঁদের চুপ করে থাকতে দেখে আনোয়ারা বেগমের ক্রোধের আগুনে যেন ঘি ঢালা পড়লো।

“চুপ করে আছো কেনো আহাম্মকের দল? সমস্যা টা কি তোমাদের? ছোট বেলা থেকে আমি তোমাদের এই শিক্ষা দিয়েছি যে বাবা মা মরতে না মরতেই তোমরা টাকা-পয়সা ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি শুরু করবে?”

আনোয়ারা বেগমের বড় ছেলে মাহবুব এবার মুখ খুললো।

“কিন্তু মা আমরা তো কেউ এগুলো নিয়ে কথা তুলিনি। আমরা তো ভালোই ছিলাম বাবার ব্যবসা আর যার যার সংসার নিয়ে। তোমার অতি আদরের ছোট ছেলে আহাদই তো সবাইকে এক এক অজুহাত করে ডেকে আনলো। আমাদের দোষ কোথায় এখানে?”

“বড় ভাই তো ঠিক কথাই বলছে মা। আমরা কেউ কি কখনো জায়গা-জমি বা ব্যবসা ভাগাভাগি করার কথা তুলেছি? শুরু থেকেই তো বাবা যেমন বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন সেভাবেই সবাই একসাথে চলছি। হ্যাঁ থাকছি হয়তো আলাদা বাড়িতে কিন্তু রোজগার তো একসাথেই। আবার বোনেরা কেউ এলেও আমরা এই বাড়িতে চলে আসি। নিজেরা থেকেই জামাই গুলোর যত্ন করি। তুমি কি কখনো নিজের ছোট ছেলের দোষ দেখবে না মা?”

আনোয়ারা বেগম নিজের মেজো ছেলে আর বড় ছেলের কথায় বুঝলেন তারা আসলেই ভুল কিছু বলেনি। স্বামী তার মেয়েদের যথেষ্ট ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছেন। তারা কখনো কিছু চাইতে এ মুখো হবে না। শুধু রাবেয়া একটু অভাবে থাকে কিন্তু তবু আনাস মিয়া জান থাকতে কখনো শশুরের পয়সার দিকে ফিরেও চাইবে না। বড় দুই ছেলে দিব্যি আছে ব্যবসা আর সংসার নিয়ে। যত ঝামেলা আহাদের। এখানে মূল মন্ত্র যে ছেলের বউয়ের তা বুঝতে আর বাকি নেই তার।

“তবে তোমরা সবাই এখন চাইছো টা কি? সকলে একসাথ যখন হয়েছো তখন একটা কিছু ফয়সালা আজই হয়ে যাক। কার কার সম্পত্তি ভাগ করা দরকার বলে মনে হচ্ছে বলো আমার কাছে।”

কেউ টু শব্দ করলো না। এমনকি আহাদ কাজী নিজেও চুপ রইলেন। কিন্তু তা দেখে ভেতরে ভেতরে একজন জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে উঠলো। সবাইকে চুপ দেখে সংসারে আর ভাঙ্গন লাগবে না ভেবে যখন আনোয়ারা বেগম স্বস্তির নিঃশাস ফেলবেন ঠিক তখনই তার ছোট পুত্রবধূ কথা বলে উঠলেন।

“আমি চাই আম্মা সম্পত্তি ভাগ হোক। বড় ভাই আর মেজো ভাই তো নিজেদের মতো জায়গা কিনে বাড়ি করে আলাদা হয়ে গেছেন। তাঁদের কোনো ঝামেলা ঝঞ্ঝাট নেই বললেই হয়। এমনকি তাঁদের তো মেয়ের বিয়ে দেওয়াও শেষ। বছরে প্রায় দুইবার করে আপনার প্রতি মেয়ে বাপের বাড়ি আসে। আর এসেই এই পুরোনো বাড়িতে। বাকি দুই বাড়িতে কেউ কখনো ওঠে না। যত ঝামেলা সব আমার। ভাবিরা তো এসে দু’চারটে কাজ করে নিজেরাও গল্পে মজেন। খেটে মরি আমি। আমার রিমুর বিয়ের বয়স হচ্ছে। এখন এত ঝামেলা আমি নিতে পারবো না আম্মা।”

আনোয়ারা বেগম অবাক হলেন। এই ছোট বউটাকে যখন তিনি পছন্দ করে বাড়িতে আনেন তখন তার বয়স একদমই কম। ঠিকমতো কোনো কাজ জানতো না। তিনিই শিখিয়ে পড়িয়ে বড় করে নিয়েছেন। নিজের মেয়েদের থেকে কখনো আলাদা করে দেখেননি। বাকি দুই বউও ছোট বোনের মতো দেখেছে তাকে। এখন সেই ছোট বউয়ের মুখে এমন কথা শুনে সবাই বেশ কষ্ট পেলো বৈ কি। কিন্তু কিছু করার নেই। মানুষ তো এভাবেই সবসময় বদলে যায়। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সব ভাগাভাগি করে দেবেন।

“ঠিক বলেছো ছোট বউ। সব ঝামেলা তুমি একা কেনো সামলাতে যাবে? আমার মেয়ে ঝামেলাও আমারই সামলাতে হবে। চিন্তা করো না তুমি। ছয় ভাইবোনকে তাঁদের অধিকার অনুযায়ী ভাগ করে দেবো আমি। আর এই পুরোনো বাড়ি থাকবে আমার। যত দিন বাঁচি এখানেই থাকবো। আর মরার পর যদি কখনো আমার মেয়ে জামাই বেড়াতে আসে তবে তারাও এখানে থাকবে। নিজেরা রেঁধে-বেড়ে খেয়ে চলে যাবে। তোমাদের বিরক্ত করতে যাবেনা। এখন সবাই যার যার কাজে যাও,ঠিক সময়ে নিজের ভাগ পেয়ে যাবে।”

কেউ আর কিছু বলার সাহস পেলো না। ছেলেমেয়েরা বুঝলো তাঁদের কারণে মা এই শেষ বয়সে এসে বেশ বড়োসড়ো একটা আঘাত পেলেন। ছোট বউকে মা কতটা ভালোবাসতেন তা তো তাঁদের অজানা নয়। তার এমন ব্যাবহারে ভেঙে পড়েছেন অনেক। সবাই নিজের মতো চলে গেলো। থেকে গেলো শুধু ছোট মেয়ে রাবেয়া কিন্তু তিনিও কোনো শব্দ করতে সাহস পেলেন না নিজের মায়ের গম্ভীর মুখভঙ্গি দেখে।

আয়োনারা বেগমের চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। পাড়াপড়শী কথায় কখনো কান না দিয়ে সে নিজের ছেলের বউদেরকে ভালোবেসেছেন। মেয়ের মতো আদর করেছেন। অথচ তার আশেপাশেই কত ছেলের বউয়েরা দিন রাত খেটেও শাশুড়ির মন পায়নি। আর আজ সেই ছেলের বউয়েরাই তার মেয়েদের ঝামেলা বলছে! দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। আয়ুটা বোধহয় আরো আগে শেষ হলেই ভালো হতো। এত ভাঙাচোরার মাঝেও তিনি নিজের কথা রাখলেন। সম্পত্তির ভাগ বুঝিয়ে দিলেন নিজের ছয় সন্তানকে। তিনি পুরোনো বাড়িতে একাই রয়ে গেলেন একজন পরিচারিকা সাথে নিয়ে। বড় ছেলেরা জোর করেও তার সিদ্ধান্ত বদলাতে পারলো না। অতঃপর আবারও যে যার জীবন নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।

নাজমুল মেম্বারের ছেলে নাঈম জেলের মধ্যেই ব্লেড দিয়ে হাতের শিরা কেটে ফেলেছিলো। সেখান থেকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে নিজের দলবলের সাহায্যেই নাকি সে পালিয়ে গেছে। সারা এলাকায় ছড়িয়ে গেছে এ কথা। আবার হতেও পারে পুলিশ নিজেই তাকে ঘুষ খেয়ে ছেড়ে দিয়েছে। এখন গল্প ফাঁদছে পাবলিকkকে খাওয়ানোর জন্য। আমার কাছে অন্তত তাই-ই মনে হলো। কারণ নাঈম ভাইয়ের মতো লোক কখনো নিজের ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু তারপরেও সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজের পড়ালেখায় মন দিলাম আমি। আম্মা আর মুহিন বাড়ি ফিরতেই দুপুরও ঢাকায় ফিরে গেছে। আমাকে আব্বা রেখে গেছেন হোস্টেলে। এখানে থেকেই কোচিং, কলেজ করে জীবন চলে যাচ্ছে আমার।

আজ কলেজ আগে আগে ছুটি হয়ে যাওয়ায় ক্যামপাসে বসে একটা বই দেখছিলাম। কলেজ ছুটি হওয়ার পরে কোচিং করে তবে হোস্টেলে ফিরি আমি। গিয়ে আবার আসতে দেরি হয়ে যায়। তাই একেবারেই ফিরি। আজ আগে আগে ছুটি হয়ে যাওয়ায় সময় একটু বেশি বটে তবে আমার আর যেতে ইচ্ছে করছে না। বাড়ি থেকে দূরে থেকে বোধহয় অলস হয়ে যাচ্ছি দিনকে দিন। এসব ভাবনার মাঝেই পরিচিত কণ্ঠস্বর পেয়ে মাথা তুলে চাইলাম।

“আরে আয়না একা একা বসে আছো কেনো? আমাকে কল করলেই হতো। ছুটে চলে আসতাম আমি।”

আমার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ইনি এখানে কেনো? বেশ তো একা একা বসে ছিলাম আল্লাহ তুমি একে কেন পাঠাতে গেলে? না জানি এখন কত বছর ধরে বকবক করবে। মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে বললাম।

“না না ঠিক আছে। আসলে একটু পরেই কোচিং তো তাই এখানে একটু বসে ছিলাম আরকি। তা আপনি এখানে কি করছেন রাফিদ ভাইয়া?”

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here