#এক_টুকরো_সুখ
#পর্ব_২
৳#লেখনীতে_শুভ্রতা_প্রাণ
আজ বাদে কাল ঈদ। আজ বিকেলেই নাকি আমার আপার শশুর, শাশুড়ি আমাদের বাড়িতে আসবেন। আপার একমাত্র ননদ এই ঈদে বাবার বাড়িতে আসবেন না বলে নিজের মায়ের কাছে জানিয়েছেন কাল দুপুরে। সে তার স্বামীর গ্রামের বাড়ি যাবে। মেয়ে আসবে না শুনে আপার শাশুড়ি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উনি আর ওনার স্বামী একা বাড়িতে ঈদ করবেন না বরং ছেলে আর ছেলের বউয়ের সাথে আমাদের বাড়িতে ঈদ করবেন। আপার শশুর শাশুড়ির আসার খবর শুনেই কাল আব্বা অমন চুপসে গেছিলেন। পরে ফিরলেন বেশ রাত করে। সাধারণত আব্বা অত রাতে ফেরেন না। মা, আপা, দুলাভাই, ভাই সবাই শুয়ে পড়েছিল। শুধু আমি জেগে ছিলাম কারণ আব্বার সাথে ছাড়া রাতে খাওয়া হয় না আমার। আবার ক্ষিদে থাকলে ঘুমও আসে না। রাতে আব্বা এসে চুপচাপ ঘুমুতে চলে যাচ্ছিলো। তখন আমিই পেছনে থেকে ডাক দিই।
“খাবে না আব্বা?”
আমার হঠাৎ ডাক শুনে যেন আব্বা খানিক চমকে উঠলেন। একটু চুপ থেকে বললেন
“তুই এখনো জেগে আছিস কেন আয়ু?”
আমি এগোতে এগোতে বললাম
“আব্বা আমি কোনো দিন রাতে তোমার সাথে ছাড়া খাই? আর তুমি তো মাত্রই আসলে বাড়িতে। তুমি কি আমায় না খেয়ে ঘুমুতে বলছো? চাল বাঁচাতে চাও নাকি হু!”
এক ভ্রু উঁচিয়ে চেয়ে রইলাম আব্বার দিকে। আব্বা যেন আরো খানিক গম্ভীর হয়ে গেলেন। অবাক হলাম আমি। সাধারণ সময় হলে আব্বা হেসে লুটোপুটি খেতেন আমার কথা শুনে। কেনোনা বাড়ির অন্য সবার তুলনায় আমার সাথে অনেক বেশি মিশে থাকেন আব্বা।
“কিছু কি হয়েছে আব্বা?”
দুই পাশে মাথা নেড়ে না বললেন আব্বা। আর কোনো কথা না বলেই রান্না ঘরের দিকে যেতে থাকলেন। আমিও পিছু নিলাম। আমাদের ছোট দাওয়া পাকা করা টিনের বাড়িটাই তিনটা ঘর। একটাতে আব্বা মা, একটাতে আমি আর একটাতে ভাই থাকে। আপার বিয়ের আগে আমি আর আপা একসাথে থাকতাম। আজ আপা আর দুলাভাই আমার ঘরে বলে আমি ভাইয়ের ঘরে নিচে বিছানা করে ঘুমাবো। খাওয়া দাওয়া সব রান্না ঘরেই হয়।
আব্বা রান্না ঘরে এসেও চুপ করে বসে রইলেন। আমার মনে হয় আমাকে আর ভাইকে কিছু কিনে দিতে পারেনি ঈদে তাই হয়তো মন খারাপ। আমাদের অনেক ভালোবাসেন কিনা। আব্বার মন ভালো করার জন্য খাওয়ার পরে আব্বাকে মনের কথাটা বলবো ভাবলাম। অনেক খুশি হবেন আব্বা এটা ভেবেই আব্বার সামনে ভাত বেড়ে রাখলাম।
আব্বা হাত ধুয়ে ভাত মেখে আমাকে খাওয়াতে থাকলেন। কিন্তু নিজে খেলেন না। যা আমাকে আরো অবাক করলো। বাড়িতে যা কিছুই হয়ে যাক না কেনো আমি কখনো আব্বাকে না খেয়ে থাকতে দেখিনি। মার সাথে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেলেও আব্বা নিজের খাওয়া দাওয়া সব সময় ঠিক রাখেন। তবে আজ হঠাৎ কি হলো?
“আব্বা তুমি খাও।”
“এখন থেকে নিজের হাতে খেতে শিখে নে আয়ু। যাতে করে আমি না থাকলে তোকে রাতে না খেয়ে থাকতে না হয়। নিজের কাজ তোকে সব সময় নিজেকেই করতে হবে। মনে রাখবি সব সময় আমি ছাড়া তোর আর কেউ নেই। আব্বা না থাকলে তোর তুই ছাড়া কেউ থাকবে না। তখন কিন্তু ছোট খাটো কষ্টে ভেঙে পড়বি না।”
অবাক হয়ে গেলাম আমি। আব্বা হঠাৎ এসব বলছে কেনো? আমি তো জিজ্ঞেস করলাম খাওয়ার কথা। আর আমার কেউ নেই মানে? মা, ভাই, আপা তো আছে। হ্যাঁ হয়তো আমার সাথে কড়া কথা বলে কিন্তু ভালোও তো বাসে। আমার পরিবার তো ওরাই।
“এগুলো কি বলছো আব্বা? থাকবে না কেনো তুমি? কোথায় যাবে? আর আমি তো তোমাকে খাওয়ার কথা বললাম। সব কথা পরে বলো আগে খেয়ে নাও তো।”
বলেই নিজের হাতেই আব্বার মুখে খাবার তুলে দিলাম। আব্বাকে অনেক ভালোবাসি আমি। সবার থেকে বেশি। আব্বাকে ছাড়া যেখানে রাতে খাইনা সেখানে আব্বা না খেয়ে থাকবে এটা কি করে হতে দেবো। তাই নিজেই খাইয়ে দিলাম। হঠাৎ দেখলাম আব্বার চোখ ছলছল করছে। হয়তো অতিরিক্ত আনন্দে। খাওয়া শেষ করে সব গুছিয়ে রেখে বসলাম আব্বার পাশে। আমাকে জানতেই হবে আব্বার হঠাৎ এরকম চুপচাপ হয়ে যাওয়ার কারণ কি।
“কি হয়েছে আব্বা? দুপুরে ফোনে কথা বলার পর থেকেই তোমাকে এরকম মনমরা লাগছে কেনো? তুমি কি ভাই আর আমাকে ঈদে কিছু দিতে পারোনি বলে মন খারাপ করে আছো? আরে আমার কিছু লাগবে না। আমি তো বড় হয়ে গেছি আর তাছাড়া আমি কি ঈদের দিন বাড়ির বাইরে যাই যে আমার নতুন কাপড় ছাড়া চলবে না? আর ভাইয়ের কথা ভেবো না। আমার জমামো কত গুলো টাকা আছে। টিফিন আর টিউশন এর টাকা থেকে জমানো। ওখান থেকে ভাইকে কিছু কিনে দেবো। এবার হাসো!”
আমার কথা শুনেও আব্বা হাসলেন না। ভীষণ অভিমান হলো আব্বার ওপর। নিজের জমানো টাকা থেকে ভাইয়ের ঈদের কাপড় কিনে দিতে চাইছি দেখেও আব্বা খুশি হলেন না? অথচ আমি ভেবেছিলাম কতই না খুশি হবেন আব্বা। আমার ভাবনার মাঝেই আব্বা হঠাৎ বলে উঠলেন
“কালকে তোর আপার শশুর শাশুড়ি আসবে আয়ু। আমাদের বাড়িতে থেকে ঈদ করবেন এবার ওনারা। তোর আপার ননদ আসবে না বলে ওনারা একা বাড়িতে থাকতে পারবেন না। তাই এখানে আসতে চাইছেন। মেয়ে আসবে না তা আগে জানলে নাকি রুবি আর তোর দুলাভাইকে পাঠাতো না এখানে।”
প্রচন্ড রাগ হলো। এ কেমন মানুষ! ছেলের শশুর বাড়িতে কে ঈদ করতে যায়? কেমন রুচি এদের?
“কিন্তু আব্বা…”
আমি আর কিছু বলার আগেই আব্বা আবার শুরু করলেন
“ওনারা আসলে ঈদের নতুন কাপড় না দিতে পারলে লোকে মন্দ বলবে রে আয়ু। কিন্তু আমার হাতে তো অত টাকা নেই। হাজার খানেক টাকা রেখেছিলাম সবার সালামি হিসেবে। এখন আবার টাকা কোথায় পাবো বল!”
এবার নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আব্বা তো ভুল কিছু বলেননি। নিজের বেতন, বোনাস সব মিলিয়েই আপা, দুলাভাই এর মার্কেট আর বাজার করে এনেছেন। এখন টাকা কোত্থেকে আসবে? আমাদের তো আর ব্যাংক ব্যালেন্স নেই। হঠাত মনে পড়লো নিজের জমানো টাকার কথা। আব্বাকে কিছু না বলেই দৌড় দিয়ে গেলাম ভাইয়ের ঘরে। ভাই ঘুমিয়ে পড়েছে তা দেখে তবেই ওর খাটের তলা থেকে নিজের লুকোনো জিনিস বের করলাম। টাকা গুলো নিয়ে আবারও ছুটে আব্বার কাছে গেলাম। আব্বার পাশে বসেই গুনতে শুরু করলাম। আব্বা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কিন্তু তা দেখার সময় নেই আমার। ভুল হতে পারে। আগে গণনা শেষ করতে হবে।
“এই আট হাজার ছ’শ টাকা। নাও আব্বা। এটা দিয়েই কোনোরকম কাজ চালাও। ভাইয়ের জন্য সাধারণ একটা কিছু কিনে বাকিটা ওনাদের কাপড় কিনে দিও। আমার কাছে আর নেই। থাকলে দিতাম।”
কথা গুলো বলে আব্বার দিকে তাকাতেই অবাক হলাম। আব্বা কাঁদছেন। পানি গুলো মুছে দিলাম সুন্দর করে।
“তোর কপাল এমন না হলেও পারতো রে আয়ু। কেন যে আমার ঘরে জন্মালি তুই!”
“এ ঘরে না জন্মালে তোমার মতো বাবা পেতাম না। এখন টাকা গুলো নিয়ে যাও তো ঘুমুতে যাও। সকালে উঠতে হবে তো। যাও যাও।”
রাতে আর কিছু বলতে না দিয়েই আব্বাকে ঘরে পাঠিয়ে নিজেও ঘুমুতে চলে গেছিলাম।
“এমন ধ্যান ধরে ঘষতে থাকলে পাতিল জীবনেও মাজা শেষ হবে না সুন্দরী।”
হঠাৎ কারো কথা কানে আসায় ভড়কে গিয়ে হাতে থাকা পাতিল ছেড়ে দিলাম। অমনি না পুকুরে গিয়ে পড়লো। তা দেখে পেছনের মানুষটা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন। তাকে তো পরে দেখে নেবো। এখন আগে আমাকে পাতিল তুলতে হবে। বেশ খানিকটা দূরে চলে গেছে ভাসতে ভাসতে। আর কিছু না ভেবেই দিলাম ঝাঁপ।
পাড় থেকে ভেসে এলো আবার সেই কণ্ঠস্বর
“ঝাঁপ দিও না গো সুন্দরী। ডুবে যাবে।”
চলবে…?