#এক_টুকরো_সুখ
#পর্ব_৪
#লেখনীতে_শুভ্রতা_প্রাণ
“না না আঙ্কেল কোথাও যাইনি আমি। আমি তো ভাইকে খুঁজতে খুঁজতেই পুকুর পাড়ে গেছিলাম। একটা কল আসলো তারপর আমি কথা বলতে বলতেই আকাশ ভাই চলে আসলো। কি ভাই বলো আমি কথা বলছিলাম ফোনে।”
কথাটা বলে দুলাভাইকে কনুই দিতে খোঁচা মারে লোকটা। আড় চোখে তা দেখে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে ফেললাম আমি। অদ্ভুত তো। এখানে খোঁচা মারার কি হলো? উনি তো পুকুর পাড়েই ছিলেন। দুলাভাইকে কিছু বলতে না দিয়েই তার হাতে ধরে টেনে ঘরের দিকে নিয়ে গেলো ছেলেটা। তার পরপরই আপা আর আপার শাশুড়ি বের হয়ে এলো। হয়তো ওনারা গেছে বলেই এত জলদি এলো। নইলে আরো কুটকাচালি করার ছিলো বোধহয়। কথা গুলো ভেবে মনে মনেই হেসে উঠলাম।
আম্মার রান্না শেষ। সবাইকে খেতে বসার জন্য বলে আমাকে বললেন দুলাভাই আর ওই ছেলেটাকে ডেকে আনতে। আমিও বাধ্য মেয়ের মতো ঘরের দিকে এগোতে থাকলাম তাঁদের ডাকার জন্য। আব্বা আম্মার ঘরের সামনে যেতেই দেখা পেলাম দুলাভাই এর। আমার দিকেই আসছেন।
“আপনাকে আর আপনার ওই ভাইকে আম্মা খাওয়ার জন্য ডাকছে।”
আমার কথা শুনেও দুলাভাই আমাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। কিছুটা গিয়ে বললেন
“দুপুর তোমার আপার ঘরে শুয়ে আছে। গিয়ে বলো তাকে তার খালামনি ডাকছে খাওয়ার জন্য। আমি বললে আসবে না সে। আমি আম্মাকে গিয়ে বলছি তুমি ওকে নিয়ে আসো।”
আর কি করার। দুলাভাই এর কথা মতো গেলাম আপার ঘরের সামনে। একা একটা ছেলে শুয়ে আছে, ভেতরে যাওয়া কি ঠিক হবে? না আমি বরং এখানে দাঁড়িয়েই ডাকি।
“রাতের বাপ কাকু ও রাতের বাপ কাকু। তাড়াতাড়ি আসুন। আপনি না আসলে নাকি মা খেতে দেবে না। আরে ও রাতের বাপ কাকু….”
আরো কিছু বলার আগেই হুট্ করে রাতের বাপ ইয়ে মানে ওই দুপুর আরকি আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। একটু খানি চমকালেও নিজেকে সামলে নিলাম।
“কি তখন থেকে রাতের বাপ রাতের বাপ করছো সুন্দরী? কেমন যেন লাগে শুনতে। কল মি প্রাণনাথ! যাতে মন প্রাণ জুড়িয়ে যায় একেবারে।”
আমি ভেংচি দিয়ে বললাম
“এহ কল মি প্রাণনাথ! বলি আপনি আপনার কোন জন্মের প্রাণনাথ হন হু? আমি কোন সুখে আপনাকে প্রাণনাথ ডাকবো?”
ঠোঁট বাকিয়ে হাসতে হাসতে উনি বললো
“কেনো? জামাই পাওয়ার সুখে! আমার মতো এমন ভদ্র, সভ্য, সুদর্শন, কিউটি পিউটি, ভোলাভালা, বাচ্চা ছেলে তুমি আর কোথায় পাবে বিয়ে করার জন্য?”
বাচ্চা? ইনি বাচ্চা? আসলেই? তাহলে আমি কি এখনো জন্ম নেয়নি?
“আপনার কথা অনুযায়ী আপনি যদি বাচ্চাই হন তবে তো আমি এখনো ভ্রূণ!”
“আরে আরে সুন্দরী তুমি ভ্রূণ হবে কেনো? ভ্রূণ তো তোমার হবে।”
“ছি ছি কি নির্লজ্জ আপনি। ধুর আপনি আসলে আসবেন না আসলে না আসবেন। আমি চলে যাচ্ছি। অযথা সময় নেই আমার কাছে। অনেক কাজ।”
কথা গুলো বলে আমি হনহন করে হেঁটে চলে যেতে শুধু করলে সকাল না দুপুর সেও পেছনে আসতে থাকে। সেই তো এলো তাহলে এত কথার কি দরকার ছিলো?
“আরে আয়না সুন্দরী রাগ করছো কেনো? আমি তো শুধু ইয়ার্কি করছিলাম। রাগ করো না কেমন?”
সব শুনলেও কিছু বললাম না। আপাতত কথা বাড়ানোর কোনো ইচ্ছে নেই আমার। প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে তারউপর আবার এই রাতের বাপের বকবক। একটা ছেলে কীভাবে এত কথা বলতে পারে? বিরক্তও লাগে আবার কিছু বলাও যায় না। আচ্ছা আমরা যদ্দুর জানি তাতে আকাশ ভাইয়ের শুধু একটা বোন আছে। তাহলে ইনি তাকে ভাইয়া বললো কেনো? কেমন ভাই হয় তার?
সবাইকে একসাথে খাবার দিলেন আম্মা। আমার দায়িত্ব পড়লো কলপাড় থেকে পানি এনে তারপর বসার। গেলাম পানি আনতে। পানি নিয়ে আসার সময় শুনতে পেলাম আব্বার কথা।
“তাহলে বেয়াইন আপনারা খাওয়া দাওয়া শেষ করেই চলুন আমার সাথে বাজারে। আপনারা আমাদের বাড়িতে ঈদ কাটাতে এসেছেন এটা তো আমাদের দায়িত্ব।”
আব্বার জন্য খারাপ লাগছে ভীষণ। বেচারা এমনিতেই কত ঋণ শোধ করতে পারেনি। তারপরে আবার এই আপদ জুটেছে কপালে। আর আমার আপা কি সুন্দর কিছু বলছেও না। তার বাবার কি অবস্থা তা তো সে জানে। পারতো না শাশুড়িকে বলতে?
“আরে আরে না ভাই সাহেব এগুলো কি বলেন। এখানে তো আরো আমাদের উচিত আপনাদের কিছু দেওয়া।”
আপার শশুরের কথা শুনে আপা শাশুড়ি যেন বিপাকে পড়ে গেলেন। হুড়মুড়িয়ে বললেন
“কি বলছো আকাশের বাবা? ভাই সাহেব যখন এত করে বলছেন তাহলে আপত্তি করছো কেনো? আপনি চিন্তা করবেন না ভাই সাহেব। আমরা যাবো আপনার সাথে।”
এই মহিলা তো ভারী বজ্জাত। চিন্তা করা যায় কি পরিমাণ নির্লজ্জ ইনি?
“দেখো আকাশের মা আমি না আসলে একা চলে আসবে বলেই আমি তোমার সাথে এখানে আসতে রাজি হয়েছিলাম। তারপর আবার রাস্তায় দুপুরকে ডাকলে। তুমি কি বুঝতে পারছো না কতটা ছোটোলোকের মতো কাজ করছো তুমি?”
তেতে উঠলেন আপার শাশুড়ি। দুলাভাই আর তার ভাই একমনে খাচ্ছে। আপা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কথা গিলছে। আম্মা এখনো খাওয়া শুধু করেনি আমার মতো। আর আব্বা এনাদের ঝগড়া থামাতে চাইছেন কিন্তু আপার শাশুড়ির জন্য পারছেন না।
“তুমি কি ছেলের শশুর বাড়ির লোকজনের সামনে, আমার বোনের ছেলের সামনে আমাকে অপমান করতে চাইছো আকাশের বাবা?”
বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে দেখে আব্বা বলে উঠলেন
“আরে ভাই সাহেব এরকম করে আমাদের ছোট করবেন না। বেয়াইনের ইচ্ছে হয়েছে আমাদের সাথে ঈদ করতে তিনি এসেছেন। আমরা কিছু মনে করিনি।”
সুযোগ পেয়ে আমিও খোঁচা মেরে বসলাম।
“হ্যাঁ কাকু আমরা কিছু মনে করিনি। আসলে কি বলুন তো সবার মন কি আপনার আমার মতো ভালো নাকি হু?”
আপার শাশুড়ি চোখ মুখ শক্ত করে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। আপার শশুর আমার কথায় হেসে ফেললেন।
“আসলেও তুই সত্যি কথা বলেছিস আয়না। সবার মন আমাদের মতো ভালো না। আচ্ছা আয় খেতে বস। সবার খাওয়া তো শেষের পথে। বেয়াইন আপনিও বসুন।”
আমি আর আম্মাও খাওয়া শুরু করলাম। ততক্ষণে দুলাভাই আর দুপুর উঠে গেছে। উঠোনে চেয়ার পেতে বসে আছেন তারা। আমি খাওয়া শেষে আম্মার হাতে হাতে সব গুছিয়ে দিচ্ছিলাম। হঠাৎ দুপুর বলে উঠলো সে নাকি কিছু বলতে চায়। সবাই অনুমতি দিলে বলতে শুরু করলো আব্বার দিকে চেয়ে
“আসলে আঙ্কেল আমি ঢাকা থেকে আসার আগে বাবা মায়ের জন্য মার্কেট করে নিয়ে আসি। এবার মার্কেট যাওয়ার আগে মা কল করে বললেন খালামনির সাথে এখানে আসতে হবে। তাই আমি খালামনি আর আঙ্কেলের সাথে সাথে আপনার আর আন্টির জন্যও সামান্য কিছু জিনিস কিনে এনেছি। যদি আপনারা কিছু মনে না করেন তাহলে দিতে পারি।”
বাকিরা কিছু না বললেও আব্বা বেঁকে বসলেন।
“না না বাবা। এটা কীভাবে হয়? তুমি আমাদের অতিথি হয়ে আমাদের উপহার দেবে আর আমরা কিছু দেবো না এটা খুব খারাপ দেখায়।”
দুপুর আব্বাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন
“দিচ্ছেন না কে বললো? আপনাদের মতো একটা হাসিখুশি পরিবারের সাথে ঈদের সময় আনন্দ করতে পারবো এটা কি কম কিছু? আমার বাড়িতে তো মা আর বাবা ছাড়া কেউ নেই। আর না করবেন না আঙ্কেল।”
অগত্যা সবাইকে দুপুরের দেওয়া জিনিস নিতে হলো। আম্মা, আপা আর আপার শাশুড়ির জন্য শাড়ি, আব্বা, দুলাভাই আর কাকুর জন্য লুঙ্গি পাঞ্জাবী এনেছেন দুপুর। জিনিস গুলো বেশ সুন্দর। পছন্দ আছে ছেলেটার। আমি যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটা খারাপ নয়। এসব ভাবছিলাম বসে। বাকিরা দুপুরের নিয়ে আসা জিনিস পত্র দেখতে ব্যাস্ত। এরমধ্যে কোত্থেকে মুহিন চলে এলো।
“আমাকে কিছু কিনে দিবা না আব্বা?”
আব্বার চোখ মুখ দেখে বুঝলাম তিনি বেশ ইতস্তত বোধ করছেন। পরিস্থিতি সামলাতে বললাম
“তোকে নিয়ে বিকেলের দিকে আব্বার সাথে যাবো। আব্বা রাতে বলেছেন তোর জন্য আমাকে সব পছন্দ করে দিতে। আমি তোকেও নিচ্ছি। কোনো বাহানা করবি না কিন্তু।”
“এখন গেলে কি হবে? আব্বা তো এখনও বাইরে যাবে বললো ছোট আপা!”
“এখন আমার অনেক কাজ। যা খেলতে যা।”
আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হঠাৎ দুপুর আবার বলে বসলো
“আমি কখনো ছোটদের কাপড় বা মেয়েদের কিছু কিনিনি। তাই আয়না আর মুহিনের জন্য কিছু আনতে পারিনি। আঙ্কেল কিছু মনে না করলে বিকেলে আমিও যাই আপনাদের সাথে?”
আব্বা অনিচ্ছা শর্তেও না করতে পারলেন না।
“আচ্ছা বাবা যেও।”
আব্বা ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন আপার শশুর, শাশুড়ির সাথে গল্প করতে। আপা সেখানে বসে বসে কথা গিলে যাচ্ছে। মুহিন দুলাভাই আর দুপুরকে নিয়ে কোথায় যেন গেলো। আম্মা আর আমি সব কাজ করছি। এভাবেই দুপুর হয়ে এলো। দুপুরের আর সকালের খাবার একসাথে রান্না করায় রান্নার চিন্তা নেই। বাকি কাজও প্রায় হয়ে এসেছে। অল্প কিছু বাকি। তা দেখে আমি আম্মাকে বললাম গোসল সেরে নিতে। আম্মা সবাইকে নিয়ে পুকুরে গেলেন গোসল করতে।
রান্না ঘরে আমাদের মাটির চুলো। তাতে মাটি লাগাতে গিয়েই হয়তো কোনোভাবে মুখে মাটি লেগে গেছে। আপার ঘর পরিষ্কার করে ভাইয়ের ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। এমন সময় কানে এলো কারো হাসির শব্দ।
চলবে…?