এবার ঈদে বড় আপা আর তার জামাইকে মার্কেট করে দিতে গিয়ে আমাদের জন্য কিছু কিনতে পারেননি আব্বা। আমাদের পরিবারের আহামরি টাকা পয়সা না থাকলেও বেশ স্বচ্ছল অবস্থা। ভালো ভাবেই দিন চলে যায় আমাদের। ঈদেও পরিবারের সবার জন্য কম বেশি কেনাকাটা প্রতিবারই আব্বা করে দেন। কিন্তু এবার আর তা সম্ভব হয়নি বড় আপার জন্য।
আমরা তিন ভাই বোন। আমি আয়না, বড় আপা রুবি আর ছোট ভাই মুহিন। বড় আপার বিয়ে হয়েছে কয়েক মাস আগেই। আমি দশম শ্রেণী আর ছোট ভাই তৃতীয় শ্রেণীতে আছি। আপার বিয়ের পর এটা প্রথম ঈদ। তাই ওর শাশুড়ি ওকে আর দুলাভাইকে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সাথে ফোন করে আব্বাকে বলেছেন তিনি যে ছেলের শশুর বাড়িতে কিছু দিচ্ছেন না এটা যেন আশেপাশে মানুষ না জানে। তাতে নাকি সবার ভালো হবে। তাই আব্বা আমাদের কাউকে কিছু না দিয়েই দুলাভাই আর আপাকে সবকিছু কিনে দিলেন। একই সাথে নিজের রোজগারের টাকায় বাজার করে এনে প্রতিবেশীদের কাছে বললেন আপার শশুর বাড়ি থেকে ঈদের বাজার দিয়েছে।
আপার শাশুড়ির শীতল হুমকির ফলে আব্বা বাড়ির কাউকে একটা সুতোও না দিয়ে যখন আপা আর তার জামাইকে দামি দামি কাপড় কিনে দিলেন, বাজার এনে তার শশুর বাড়ির নাম দিলেন তখন আমার আপা একটুও বারণ করলো না আবার নিজেও কি সুন্দর হেসে হেসে লোকজনের সামনে নিজের শশুর বাড়ির প্রশংসা করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। আমারই তখন লজ্জা লাগছিলো আপার ব্যবহার দেখে। নিজের জন্য খারাপ লাগছে না ঠিকই কিন্তু আমার ছোট ভাইটা! ও কি এত মার প্যাচ বুঝতে পারে? ওর তো খারাপ লাগবে ঈদের দিনে নতুন কাপড় না পেলে। বুঝতে পারছি না কিছুই যে কি করবো!
বাজার দেখে আশেপাশের মানুষ গুলো আপার শশুর বাড়ির সুনাম করে গেলো। আব্বা আম্মাও কেমন হাসি মুখে আছে। আর আমার আপার কথা কিই বা বলবো! এত নির্লজ্জ মানুষ কীভাবে হতে পারে?
লোকজনের জিনিসপত্র দেখে যেতে যেতে আর বাড়ি খালি হতে হতে দুপুর প্রায় গড়িয়ে গেলো। মা আর আমি সব কিছু গোছগাছ করছিলাম। এমন সময় আপার চিৎকার শুনে বাইরে বের হয়ে এলাম।
“তোমরা কি আমাকে শান্তিতে সংসার করতে দেবে না মা? কখন এসেছে তোমার জামাই তার কি লাগবে না লাগবে একটু খেয়াল যে করতে হয় সে হুশ কি তোমাদের নেই? আর এই যে আয়না! তোকেও তো বলিহারি রে। ধেই ধেই করে নাচার স্বভাব এখনো গেলো না? তোর দুলাভাই যে সেই কখন এসেছে আব্বার একটা লুঙ্গি এনে তাকে দিবি না? তার খাবারের ব্যবস্থা করবি না? নাকি না খাইয়ে মারতে এনেছিস আমাদের?”
আপার কথা শুনে আমি মা দুজনেই তাজ্জব বনে গেলাম। এগুলো কি বলছে ও? ও নিজেই তো পাশের বাড়ির কাকিদের সবকিছু বের করে দিলো দেখতে। পরে না গুছিয়ে রেখেই চলে গেলো। এগুলো না গুছিয়ে আমরা খেতে দেবো কোথায়?
“এগুলো তুই কি বলছিস আপা? তোর এলোমেলো করা জিনিসপত্রই তো আমি আর আম্মা গুছিয়ে রাখছি। এগুলো না সরিয়ে খেতে দেবো কোথায়? আর লুঙ্গি আমাকে কেনো দিতে হবে? তুই কি এই বাড়িতে নতুন নাকি? নিজেও তো দিতে পারিস!”
মুখের কথা শেষ হতে না হতেই সপাটে চড় পড়লো আমার গালে। গালে হাত দিয়ে পাশে চেয়ে দেখি চড়টা আমার আপা না মা মেরেছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
“তুমি আমাকে কেন মারলে মা? আমি কি করেছি?”
অমনি আপা তেড়ে এলো। আমার আরেক গালে চড় মেরে বললো
“আবার জিজ্ঞেস করছিস কেনো মারলো? তোর সাহস কি করে হয় আমার মুখে মুখে কথা বলার! একটা দিয়ে থামলে কেন মা? আরো দু চারটে লাগিয়ে দাও।”
“তুই চুপ কর রুবি। যা তোর ঘরে যা। আয়না লুঙ্গি আর সাবান নিয়ে যাচ্ছে। জামাইকে গোসল করে নিতে বলবি। তারপর খাবার দিচ্ছি আমি।”
আপা চলে গেলো। আমি এখনো যেন ঘোরের মধ্যে আছি। মা শুধু শুধু মারলো আমাকে, সাথে আপাও আর মা ওকে কিছু বললোও না।
“কিরে দাঁড়িয়ে আছিস যে বড়। কথা কানে যায়নি নাকি? যা লুঙ্গি, সাবান নিয়ে যা। দুলাভাই গোসল করতে করতে সব ঠিকঠাক করে গুছিয়ে ফেলবি। আমি খাবার আনতে যাচ্ছি।”
আমি আর মায়ের সাথে কথা বললাম না। চুপচাপ আব্বা মার ঘরে চলে গেলাম লুঙ্গি আনতে। লুঙ্গি আর সাবান নিয়ে আপাকে দিতে গেলে তা একপ্রকার ছো মেরে নিয়ে নিলো আপা। দুলাভাইকে দেখলাম খাটে শুয়ে আছে। কেমন কেমন করে এক নজর দেখলো আমাকে। ভালো ঠেকলো না আমার কাছে। তাই দ্রুত চলে এলাম। গোছাতে থাকলাম সব কিছু। নইলে পরে আপা আবার চিৎকার করবে।
দুলাভাই এর গোসল শেষে মা আপা, মুহিন আর দুলাভাইকে খেতে দিলেন। আমি এখনো গোসল করিনি তাই বোধহয় আমাকে ডাকলেন না। খাবার হিসেবে কঁচু শাক, ডাল, ডিম ভুনা আর ভাত। তা দেখে আরেক দফা রেগে গেলো আপা।
“এগুলো কি রান্না করেছো মা? তুমি জানো না আমরা কেমন খাবার খাই? তোমাকে প্রতিদিন ফোনে বলি না আমি? তারপরেও এগুলো কি আমাদের খেতে দেবে না বলে রেঁধেছো? নাকি অপমান করতে!”
মা কিছু বলবে তার আগেই দুলাভাই বলে উঠলেন
“আহ রুবি। হচ্ছে টা কি? এসে থেকে চিৎকার করেই যাচ্ছো। আর খাবারে খারাপ কি আছে? আম্মা কত যত্ন করে রান্না করেছেন। চুপচাপ খেয়ে নাও।”
আপা যেন আরো রেগে গেল।
“তুমি এত কথা কেনো বলো? আসার সময় আম্মু তোমাকে বেশি কথা বলতে বারণ করেছে না? আমার কি আম্মুকে ফোন করে বলতে হবে তোমার কথা?”
দুলাভাই চুপসে গেলেন। হয়তো নিজের মাকে ভয় পান বা ভালো করে চেনেন তাই। চুপি সারে আপাকে বললেন
“তুমি যদি না চাও আমি খাবার ছেড়ে উঠে যাই তবে চুপ করে খেয়ে নাও।”
দম নিলো আপা। দুলাভাই এর আচরণ যেন আম্মার অনেক পছন্দ হলো। অতিরপ্রাণ যত্ন করতে শুরু করলেন। ডিম একটার জায়গায় দুইটা তুলে দিলেন প্লেটে। এদের খাওয়া দেখে আমারও ক্ষিদে পেয়ে গেলো। সেই সকালে খেয়েছি, এখন প্রায় বিকেল। তাই বলেই ফেললাম আম্মাকে খাবার দেওয়ার কথা।
“মা আমাকেও খেতে দাও। গোসল পরে করে নেবো।”
“খবরদার মা তোমার এই মেয়েকে আমাদের সাথে খেতে দেবে না। তাহলে কিন্তু আমি উঠে চলে যাবো।”
“আরে রুবি…”
আম্মা আরো কিছু বলবেন তার আগেই ভেসে এলো আরেকটা কণ্ঠস্বর।
“আয়না নিজের ভাগের খাবার খাবে। তাতে তোমার উঠে যাওয়ার কারণ কি রুবি?”
উঠোনের দিকে সবাই তাকিয়ে পড়লাম। আব্বা দাঁড়িয়ে আছে নিজের কাজের ব্যাগ হাতে। ছুটে গিয়ে আব্বার হাত থেকে ব্যাগ নামিয়ে রেখে পানি এগিয়ে দিলাম। আব্বা আবারও প্রশ্ন করলেন
“কি ব্যাপার রুবি বললে না যে? আয়না খেলে তুমি খাবে না কেনো? আয়না কি তোমার প্লেটের খাবার কেড়ে খাবে?”
আপা আমতা আমতা করতে শুরু করলেন।
“আসলে আব্বা ও গোসল করেনি তাই আরকি বলেছিলাম। আম্মা ও যদি খেতে চায় গোসল না করে তো দিয়ে দাও।”
আপার কথা যেন কানে তুললেন না মা। নিজের মতো দুলাভাই এর প্লেটে খাবার দিতে থাকলেন। তা দেখে আব্বা বললেন
“খাবার দাও মুহিনের মা। আয়না তুই যা ব্যাগ রেখে আয়। আমার সাথে খাবি।
আম্মা ফোড়ন কাটলেন।
“অত বড় ধামরি মেয়েকে নিয়ে এত আদিক্ষেতা করার কি আছে? ও হাত দিয়ে খেয়ে নেবে। তুমি নিজে খাও।”
আব্বা শীতল কণ্ঠে বললেন
“আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছি মুহিনের মা, পরামর্শ না।”
আম্মা আর কথা না বাড়িয়ে খাবার দিলেন। আব্বা নিজে খাওয়ার সাথে সাথে আমাকেও খাইয়ে দিলেন। এই সময়টা আমার বড্ড ভাল্লাগে। যদি কেউ কখনো আমাকে জিজ্ঞেস করে তোমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত কোনটা! আমি অকপটে বলে দেবো, “যেই মুহূর্তে আমার আব্বা আমার মুখে খাবার তুলে দেয়।”
খাবার শেষে আপা আর দুলাভাই আপার ঘরে চলে গেছে ঘুমুতে। আম্মা সব গুছিয়ে রাখছে। মুহিন খেলতে চলে গেছে। আমি আব্বার পাশে বসে আছি। এমন সময়ে আব্বার ফোন এলো। ফোন রিসিভ করে কথা বলার পরে আব্বাকে কেমন মনমরা দেখালো। আমি জানতে চাইলাম কিন্তু কিছু বললো না। বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। আমার একটু খটকা লাগলো। কি এমন হলো যে আব্বা এত চুপ হয়ে গেলো?
চলবে…?
#এক_টুকরো_সুখ
#সূচনা_পর্ব
#লেখনীতে_শুভ্রতা_প্রাণ