#এক_টুকরো_সুখ
#পর্ব_৬
#লেখনীতে_শুভ্রতা_প্রাণ
“আরে আমাকে চিনতে পারছো না? আমি রাফিদ। ঐযে সেদিনের কম্পিটিশন, প্রাইজ! মনে নেই?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে। কেমন আছেন ভাইয়া? দিন কাল কেমন যাচ্ছে আপনার?”
ছেলেটা হেসে বললো
“ওই আগেই মতোই সবকিছু। তোমার কি খবর? আগেই মতোই ঝগড়া টগড়া করো প্রাইজ নিয়ে?”
খানিকটা লজ্জা পেলাম আমি। রাফিদ ভাইয়া আমাদের দুই বছরের সিনিয়র। ভাইয়া যখন এসএসসি পরীক্ষার্থী তখন একটা কুইজ প্রতিযোগিতায় দুইজনের ড্র হয়ে গেছিলো। বিচারকরা সব দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলো। পদুইটা কারণ তার। এক রাফিদ ভাইয়া এইবারই লাস্ট অংশগ্রহণ করেছে আর দুই ভাইয়ার আগে স্কোর আমার হয়েছে। ভাইয়া পরে সমান করেছে। সেই অনুযায়ী কাউকেই বাদ দেওয়া যায় না। এক টিচার যখনই মুখ ফসকে রাফিদ ভাইয়াকে প্রাইজ দিয়ে দেওয়ার কথা বলেন অমনি আমি ক্ষেপে উঠি। দোষ তো আমার নেই তবে আমি পাবো না কেনো? তাঁদের এত দরদ তো তাহলে দুইজনকেই দিয়ে দিক। এসব ভাবনার মাঝে রাফিদ ভাইয়া আবার কথা বলে উঠলেন।
“সরি সরি তোমাকে লজ্জা দিয়ে ফেললাম। কিছু মনে করো না আবার। তবে আয়না তোমার একটা কাজে কিন্তু আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। মানে যাকে বলে ভয়ংকর রকমের কষ্ট।”
অবাক হয়ে গেলাম। এনাকে কষ্ট দেওয়ার মতো কি করলাম আমি? মুহিন আর দুপুরও কেমন চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে। আমি বোকার মতো হেসে বললাম
“মানে ভাইয়া? আমি কি করেছি?”
“তুমি আমার সাথে যোগাযোগ রাখলে না। বর্তমানে যোগাযোগ করার কত কত মাধ্যম। ফেইসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটস অ্যাপ, ফোন কল কত কি! এত কিছু থাকতেও আমাদের মাঝে কোনো যোগাযোগই নেই।”
উফফফ। ভয় পেয়ে গেছিলাম। সবাই কি শুধু আমাকে ধাঁধায় ফেলতে ব্যাস্ত নাকি বুঝলাম না।
“আসলে ভাইয়া আমার কোনো ফোন নেই। বাড়িতে একটাই মোবাইল তা আব্বার কাছে থাকে।”
“ঠিক আছে কোনো সমস্যা না। তোমাকে আমিই খুঁজে নেবো। আজ ব্যাস্ত আছি একটু। এখন আসি কেমন?”
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলো। কেমন ছেলেরে বাবা। হুট্ করে এলো আবার হুট্ করে চলেও গেলো। আবার বলে কি না আমাকে খুঁজে নেবে! আহা কত দরদ, যেন উতলে পড়ে হুহ। এসব মনে মনে বলতে বলতে সামনে ঘুরতেই চমকে উঠি আমি। মুহিন, দুপুর বুকের ওপর হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করলাম।
“কি হয়েছে?”
“কিছু না।”
দুজনেই এক সঙ্গে গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলো। তারপর নিজেদের মতো কেনাকাটায় ব্যাস্ত। জাব্বাবা। এটা কি হলো? কি করেছি আমি? এরা তো এমন ভাব করছে যেন প্রেম করতে এসে ধরা খেয়েছি।
সবকিছু কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরতে আমাদের প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। আম্মা রাতের রান্নার জন্য জোগাড় করছেন। আব্বা আর দুলাভাই ফেরেনি এখনো। জিনিস পত্র মুহিনের হাতে দিয়েই আমি আম্মার সাথে কাজে লেগে পড়লাম। বাকি গুলো রইলো দুপুরের কাছে। ওরা সব নিয়ে ঘরে চলে গেলো। আম্মাকে একটু সাহায্য করে গেলাম নামাজ পড়তে। মাগরিব নামাজ শেষ করে আবার টুকিটাকি কাজ করতে থাকলাম। এশার নামাজ পড়ার পর দুলাভাই তারপর আব্বা এলেন। সবাইকে একসাথে রাতের খাবার দিলেন আম্মা। অবাক হলাম এটা দেখে যে আমার আপা বা তার শাশুড়ি কেউই কোনো বাহানা করলো না। চুপচাপ খেয়ে নিলো। আশ্চর্যের ব্যাপার বটে।
সারাদিন সবকিছু ঠিকঠাক গেলেও ঝামেলা বাঁধলো ঘুমানোর বেলায়। যেহেতু বাড়িতে ঘর তিনটা তাই কোথায় কাকে দেওয়া হবে তা নিয়ে এক বিরাট অস্বস্তি। আপা আর দুলাভাইকে তো আলাদা করা যাবে না। আবার দুপুর নতুন অতিথি তাকেও নিচে দেওয়া যায় না। অনেক ভাবনা চিন্তার পর আপা, দুলাভাইকে আমার ঘরে, বাকি পুরুষদের ভাইয়ের ঘরে আর আব্বা আম্মার ঘরে আমি, আম্মা আর আপার শাশুড়ি শুয়ে পড়লাম। সেখানেও কিছু খোঁচা মারা কথা বলতে ছাড়লেন না আমার আপার গুণবতী শাশুড়ি। কোত্থেকে যে এই মহিলা এসেছিলো আল্লাহ জানেন। বিরক্তিকর!
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গোসল করে আব্বা, মুহিন, দুলাভাই, দুপুর, আপার শশুর সবাই নামাজে চলে গেলেন। আমি আর আম্মা রান্নাবান্না নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। আপাকে বলা হলো তার শাশুড়িকে নিয়ে গোসল সেরে ফেলতে। আপাও তাই করলো। ফজরের নামাজ পড়েই রান্না বসানোর দরুন ছেলেরা নামাজ পড়ে আসতে আসতেই রান্না শেষ হয়ে গেলো। আম্মাও গোসল করে খাবার বাড়তে শুরু করেছেন। কেবল আমার গোসল বাকি।
গোসল করে এসে কালকে বিকেলের কেনা নতুন জামাটা পড়ে বাইরে এসে দেখি সবার খাওয়া শুরু প্রায় শেষ। শুধু দুপুর, আব্বা আর মুহিন খাচ্ছে। আম্মা এখনো শুরু করেননি। আমি আর আম্মা একসাথেই খাওয়া শুরু করলাম। যেহেতু আমাদের কুরবানী দিচ্ছে না সুতরাং খাওয়ার পরে আর কোনো কাজ নেই। উঠোনে চেয়ার পেতে বসেছি সেই সময় আপা আর তার শাশুড়ি বাইরে আসে।
“আমার দেবরকে বেশ ভালোই ভাঙিয়েছিস তবে?”
হঠাৎ আপার এমন কথায় ভড়কে গেলাম। কিছু বলার আগেই আপার শাশুড়ি শুরু করলেন।
“মন্দ বলোনি বউমা। বেশ সেয়ানা বটে তোমার বোন। আমার ভাগ্নেকে বোকা পেয়ে ভালো মতোই সব হাসিল করে নিয়েছে।”
এদের কথার কোনো মানেই আমি বুঝতে পারছি না। এসব কি বলছে!
“কি বলছেন এগুলো? আমি আপনার ভাগ্নেকে কীভাবে ভাঙালাম আন্টি?”
“হুহ এখন না বোঝার ভান করছো? কাল বিকেলে তো খুব দুপুরকে দিয়ে সব জিনিস কিনিয়ে নিলে। এখন নাটক করছো কেনো?”
“হ্যাঁ আয়না তুই এত বেহায়া হলি কবে থেকে রে? দুপুর ভাইকে তুই চিনিস ঠিকমতো যে ওনার থেকে অত গুলো জিনিস নিয়ে নিলি?,
নিজের আপন বড় বোনের মুখে এরকম কথা শুনলে কে ঠিক থাকতে পারে? কান্না চলে আসলো আমার। টলমলে চোখ নিয়ে কিছু বলবো তাও গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি। আব্বা আম্মা ছুটে এলেন।
“কি হয়েছে রে রুবি? আয়না কান্না করে কেন?”
আম্মার প্রশ্নে আপা ভেংচি কাটলো। আপার শাশুড়িও তাই। আব্বা আমার কান্না থামাতে তৎপর হয়ে উঠেছেন।
“আর কি হবে আন্টি! আপনার বড় মেয়ে আর আমার খালামনি আয়নাকে একেবারেই তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে একগাদা কথা শুনিয়েছে। এবং বিষয়টা এমন যেখানে আয়নার কোনো ভূমিকাই নেই।”
“একটু খুলে বলো বাবা কি হয়েছে। আমার আয়ু মা তো এমনি এমনি কখনো এভাবে কাঁদে না। যথেষ্ট শক্ত সে। কান্না যখন করছে মানে অবশ্যই বড় কোনো কারণ আছে।”
আব্বার কথা শুনে আরো জোরে কেঁদে ফেললাম। আপা কীভাবে আমাকে এগুলো বলতে পারলো?
“আসলে আঙ্কেল কালকে তো আমি আপনাকে কোনো জিনিসের দাম দিতে দিইনি। তারপর আপনি আসার পরে ভাবির জন্য আর আয়নার জন্য কিছু জিনিস কিনেছিলাম। বাড়িতে এসে ভাবিকে আর দেওয়া হয়নি। এখন খাওয়া দাওয়া শেষ করে যখন ভাবিকে সেগুলো দিলাম তখন স্বাভাবিক ভাবেই আয়নার গুলোও সে দেখেছে। আর তাতেই আমার খালামনি আর ভাবির এরকম আচরণ। আয়না নাকি আমাকে ভাঙিয়েছে।”
আব্বার চোখ মুখ লাল হয়ে এলো। কঠিন মুখে একবার আপার দিকে আর একবার আম্মার দিকে চেয়ে আমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। আম্মা কেমন মিয়িয়ে গেলেন আব্বার চাহুনিতে। আপার দিকে কেমন করে যেন চাইলেন। আর কিছু দেখার আগেই আব্বা আমাকে নিয়ে পুকুর পাড়ে চলে এলেন। আমাকে বসতে বলে নিজেও আমার পাশে বসলেন।
“শোনো আয়না আজ তোমাকে কিছু কথা বলবো। আমার কথা শেষ হওয়ার আগে কোনোরকম উত্তেজিত হবে না আর কিছু বলবেও না। ঠিক আছে?”
অবাক হলাম আমি। একটু আগে কি হয়েছে না হয়েছে সব বেমালুম ভুলে গেলাম। আব্বা আমাকে তুমি করে খুব কম বলেন। আর আয়না বলে ডাকেন না বললেই চলে। যেহেতু এখন বলছেন মানে অনেক বড় কোনো ব্যাপার আছে যা শুনে আমি হয়তো বা নিজেকে সামলাতে পারবো না বা হিমশিম খাবো। তাই আমাকে কঠিন করতে চাইছেন শুরু থেকেই। মাথা নেড়ে সায় দিলাম আমি।
“আমার সাথে বিয়ে হওয়ার আগেও তোমার আম্মার একজনের সাথে বিয়ে হয়েছিলো। রুবি তারই সন্তান। সেই লোকের ছিলো চুরির অভ্যাস। কোনো কাজকর্ম করতেন না। তাই তোমার আম্মা রুবিকে পেটে নিয়ে সেই বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন। রুবি পেটে থাকতেই তোমার আম্মার ওপর নজর পড়ে আমার মায়ের। সবকিছু জেনেও তিনি আমাকে বলেন রাবেয়া মানে তোমার আম্মাকে বিয়ে করার কথা।
ছোটবেলায় আব্বাকে হারিয়েছি আমি। তারপর থেকে আম্মাই সব ছিলেন। অনেক কষ্ট করে কিছু লেখাপড়াও শিখিয়েছেন। তাই তখন তার কথা ফেলতে পারিনি কিন্তু তোমার আম্মাকে শর্ত দিই যেন তার সন্তানের জন্য আমার সন্তানের কোনো অযত্ন না হয়। রাবেয়া মেনে নেয়। এরপরে একে একে রুবি, তোমার আর মুহিনের জন্ম। তোমার আম্মা আমার সামনে অন্তত কখনো তোমাদের অযত্ন করেনি। কিন্তু আজ তার মেয়ে যা করলো তা আমি কিছুতেই মেনে নেবো না। আমি আগেও খেয়াল করেছি রুবি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। এসব জানলে আরো করবে আর ওর শশুর বাড়িতে ঝামেলা হবে তাই সবার সামনে না বলে তোমাকে এখানে এনে বললাম।
এখন তোমাকে সবসময় মনে রাখতে হবে আম্মা কখনো তোমাকে রুবির থেকে বেশি গুরুত্ব দেবেন না কারণ রুবি তার বড় সন্তান। তোমাকেই তোমার সবকিছু গড়তে হবে। আব্বা আর মুহিন ছাড়া কেউ নেই তোমার। এরকম দু চার কথায় কেঁদে ভাসালে চলবে না। আরো শক্ত হতে হবে। কেউ অকারণে দোষারোপ করলে তাকে জবাব দিতে হবে। বুঝতে পারছো?”
আব্বার কথায় উত্তর কি দেবো আমি তো ঘোরের মধ্যে থেকেই বের হতে পারছি না। কি বললেন আব্বা এগুলো এতক্ষণ। আপা আমার আপন বোন না? এক রক্ত না বলেই বোধহয় আমার সাথে এরকম ব্যবহার করতে পারলো।
“আয়ু আমি জানি আমার কথা গুলো মেনে নিতে তোর সময় লাগবে কিন্তু কিছু করার নেই মা। সত্যিটা তো একদিন না একদিন তোকে জানতেই হতো।”
হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে ফেললাম আমি। না আর কাঁদবো না। চোখের পানির অনেক মূল্য। যার তার জন্য ফেলা উচিত না। একেবারেই অনুচিত।
“তুমি চিন্তা করো না আব্বা। তোমার আয়ু এখন থেকে আর কাঁদবে না। সবসময় নিজেকে নিয়ে ভাববে। যারা আমার জন্য ভাবে না আমিও তাঁদের জন্য ভাববো না। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোমার নাম উজ্জ্বল করবো আর তাঁদের দেখিয়ে দেবো যারা এখন কথা শোনাচ্ছে।”
আব্বা আমার মাথায় হাত রাখলেন। এখন বুঝতে পারছি কেন আম্মা সেদিন বিনা কারণে আমাকে মারলো আপার জন্য। আগের কথা ভাবছিলাম সেই মুহূর্তে পেছন থেকে কেউ বলে ওঠে
“তারমানে রুবি আপনার নিজের মেয়ে না?”
আমি আর আব্বা দুজনেই চমকে উঠি। এবার কি হবে?
চলবে…?