#মিতা
দ্বিতীয় পর্ব
প্রায় চব্বিশ বছর পর জান্নাতের তার বান্ধবীর সাথে দেখা হবে। তার চোখেমুখে যে আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশ পাচ্ছিল সেদিনকার ঘটনাটা চোখের সামনে আসতেই লজ্জা আর গ্লানিতে পরক্ষণেই মুখটা ম্লান হয়ে যাচ্ছিল। সেই চড়টা সেদিন যদিও জান্নাত, লাবণ্যকে মেরেছিল কিন্তু তার বান্ধবী জানে না রক্তাক্ত হয়েছিল ওর নিজের হৃদয়।
গত দুদিন ধরে জান্নাত খুশি যেন ধরে রাখতেই পারছে না।স্বামী ছেলে মেয়ে সবার সাথে ওদের দুজনার স্কুলের দুষ্টুমির গল্পগুলো শেয়ার করছিল। হাসতে হাসতে একেকজনের পেট ব্যথা। ওদের দুজনার দেখা হলে ঠিক কি হবে,কে আগে কথা বলবে! আচ্ছা লাবণ্যর কি সেই ছেলেটার সাথেই বিয়ে হয়েছে?সেই ছেলেটা! নাহ মনে হয়। কারণ দুবছর পরই তো ছেলেটার জেল হয়ে গেল।
ক’টা ছেলেমেয়ে হয়েছে ওর? ওরা তো ভবিষ্যতবাণী করেছিল, দু’বান্ধবীরই দুটো ছেলেমেয়ে হবে। নাকি ও একাই ফুটবল দল বানিয়ে ফেলেছে! আনমনে একা একা হাসতে দেখে মেয়ে বলে, মা তোমার মাথাটা একেবারেই গেছে! সত্যিই গেছে। কতটা দিন যে ও লাবণ্যকে খুঁজেছে! আবার ভাবে, লাবণ্য কি সব ভুলে ওকে ক্ষমা করতে পারবে! ও নিজে নিজেকেই সান্ত্বনা দেয়,ছেলের নাম যখন শুভ্র রেখেছে অবশ্যই ক্ষমা করবে। না হলে বন্ধু কিসের! সেই ছোট্টবেলার বন্ধু। জীবনে বহু বন্ধু আসাযাওয়া করে কিন্তু স্কুল জীবনেে বন্ধুদের কেউ কখনো ভুলতে পারে না। কি যে এক মায়া! ওটাই আসল বন্ধুত্ব। একবার লাবণ্যকে বুকে জড়িয়ে সরি বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।
জান্নাত বহুবার ফেসবুকে সার্চ দিয়েও তার মিতাকে পায়নি।একই নাম হাজারটা আসে কিন্তু প্রতিটা প্রোফাইলে গিয়ে গিয়ে দেখেছে, সে যাকে খুঁজছে এ সেই মিতা নয়। হয়তো মোটা হয়ে গেছে নাকি সংসারের চাপে সেই নিস্পাপ শিশু সুলভ মুখের দিপ্তী ধরে রাখতে পারেনি। সেজন্যই কি চিনতে পারছে না! নাহ,তেমন তো হবার কথা না। তার বেস্ট ফ্রেণ্ড। আজও লাবণ্যর চেহারাটা জ্বলজ্বল করে ভাসে ওর স্মৃতির মণিকোঠায়। জান্নাত তো আর জানতো না যে লাবণ্যর এফবি আইডি নেই। স্কুলের সেরা চৌকস মেয়েটি কি আজ এতোটাই আনস্মার্ট হয়ে গেল! এসব ভাবতে ভাবতেই জান্নাত দেখে ঢাকা থেকে ওদের প্লেন সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছে। জান্নাত চেক আউট হয়ে আগে থেকে মাইক্রোবাস নিয়ে অপেক্ষায় থাকা শুভ্রর (মায়ের লুতুপুতু ছেলে) সাথে নীলফামারীর পথে রওয়ানা দেয়। জান্নাত একদম একা এসেছে। ওর হাজব্যাণ্ড বলেছে,কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না। এবার তোমরা দুজন মন পেট সব ভরে গল্প করে নাও,আমরা না হয় অন্য কোনো সময় যাবো।
এই প্রথম জান্নাত নীলফামারি যাচ্ছে। সেটাও ওরই সুবাদে। রংপুর থাকতেও লাবণ্যর জন্যই কতো কি করেছে প্রথমবারের মতো, কতো কিছু দেখতে পেরেছে জান্নাত । ক্লাস ফোরে পড়ার সময় মে মাসে হঠাৎ কুমিল্লা থেকে টিসি নিয়ে এসে জান্নাত নতুন স্কুলে ভর্তি হয়। ওর রোল হয় তিপ্পান্ন। ক্লাসের লাস্ট রোল। জান্নাত সবসময় এক থেকে তিনের মধ্যেই থেকেছে এতোদিন। একে তো সবার শেষে রোল তারউপর পুরনো বন্ধুদের ফেলে নতুনদের সাথে এ্যাডজাস্ট করা………. সব মিলিয়ে মন বসাতে পারছিল না নতুন স্কুলে। এই স্কুলে পড়বে না বলে বলপেন পেন্সিল কিছুই ও নিয়ে আসতো না । লিখতো না একটা শব্দও। লাবণ্য রোজ এক্সট্রা বলপেন নিয়ে আসতো ওর জন্য। নিজের লেখা শেষ করে ওর খাতায় তুলে দিতো। প্রতি পিরিয়ডের ফাঁকে ফাঁকে পরবর্তী পিরিয়ডের হোম ওয়ার্ক করে দিতো। অল্পকিছুদিনের মধ্যেই দুজনার খুব ভাব হয়ে গেল। মেয়েটাকে জান্নাত যেদিন প্রথম দেখে সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার,স্কুলে সিভিল ড্রেস পরার নিয়ম। ওর পরনে ছিল সাদা ধবধবে ফ্রক। সামনে বেবি কাট দিয়ে ড্রেসের সাথে ম্যাচিং সাদা বো ক্লিপে পোনিটেল করে চুল বাঁধা। যেন এক দেবশিশু। মেয়েটির রোল এক।
নাম :মাহমুদা রহমান লাবণ্য।
আর ও নিজে জান্নাতুল ফেরদৌস লাবণ্য।
ক্লাসের সবাই ওদের লাবণ্য- ১ ( যার রোল এক ছিল) আর লাবন্য- ২ বলে ডাকতো। আর ওরা দুজন দুজনকে শুধুই “মিতা” বলে ডাকতো।
(পাঠকের সুবিধার্থে আমি মাহমুদা রহমান লাবণ্যকে “লাবণ্য ” এবং জান্নাতুল ফেরদৌস লাবণ্যকে “জান্নাত ” হিসেবে লিখছি)
লাবণ্যর সাহায্য সহযোগিতায় সেকেন্ড হয়ে ফাইভে উঠলো জান্নাত । গাড়িতে বসেবসে জান্নাত ভাবে লোকে ঠিকই বলে,একজন ভালো বন্ধু পাশে থাকলে কখনো পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না যদি না ভাগ্য খারাপ হয়। ওদের দু’পরিবারের মাঝেও বেশ সখ্যতা গড়ে উঠলো। জান্নাতের বাবা সরকারী কর্মকর্তা। আর লাবণ্যর বাবা ব্যাবসায়ী। সুপার মার্কেটে বড়বড় তিনটা কাপড়ের দোকান আছে। দারুণ রান্না করতো জান্নাতের মা। মজার মজার টিফিন বানিয়ে দিতো দুজনকে। দু’জনের বাসার ঠিক মিডলে ছিল স্কুল। তারপরও একজন স্কুল পেছনে ফেলে অন্যজনের বাড়ি গিয়ে তাকে সঙ্গে করে আবার স্কুলে আসতো। ওরা দুজন দুজনার সাথে এমনভাবে লেপ্টে থাকতো এযুগের বাচ্চারা হলে নির্ঘাত ওদের লেসবিয়ান নামে আখ্যা দিতো। ভাগ্যিস তখনও ওদের এই শব্দের সাথে পরিচয় ঘটেনি। ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন হঠাৎই স্কুলে জান্নাতের প্রথম পিরিয়ড হয়।ছোট্ট লাবণ্য নিজের স্কার্ফ খুলে জান্নাতের পেছনে বেঁধে বাসায় পৌঁছে দেয়। তখনকার সময়ে এসব নিয়ে খুব লুকোচুরি চলতো। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই ব্যাপারটা নিয়ে এখনকার মতো অতো খোলাখুলি আলোচনা হতো না বললেই চলে। ভয়ে জান্নাত কাঁদতে থাকে। তখন তার মেন্টাল সাপোর্ট প্রয়োজন ছিল যা লাবণ্যর কাছ থেকে পেয়েছিল। ক্লাসের অন্য মেয়েদের মতো ওকে তিরস্কার না করে পাশে থেকেছিল। তখন থেকে জান্নাত লাবণ্যর উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল ।
ওদের মা’য়েরা দুজনকে একইরকম ড্রেস কিনে দিতো ইদ বা জন্মদিনে। ফার্স্ট সেকেন্ড স্টুডেন্টদের মধ্যে সবসময় একে অপরকে টপকানোর একটা টেণ্ডেন্সি থাকে। কিন্তু ওদের তা ছিল না। বরং দুজন ইচ্ছে করেই যেন মাঝেমধ্যে নিজেদের অবস্থান একচেঞ্জ করে নিতো । একই স্কুল থেকে সেই প্রথম ওরা দুজন ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলো ক্লাস এইটে।
এরইমধ্যে ওরা সেবার বই ছেড়ে চুপিচুপি বাড়ির বড়দের অগোচরে রোমান্টিক বই পড়া শুরু করেছে। একজন পড়ে অন্যজনকে দেয়। কখনোবা স্কুলের ফাঁকে বেঞ্চের নীচে মাথা ঢুকিয়ে একসাথে পড়ে। ধরা পড়ার ভয়ে রুমের দরজায় সন্তর্পণে চোখ রেখে পড়ার বইয়ের ভাঁজের মধ্যে বই রেখে পড়তো। হুমায়ুন আহমেদ, সমরেশ মজুমদার,শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো বাঘা-বাঘা লেখকের বই টপাটপ গিলছে। দুজনার মধ্যে তা নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড়। দূরবীন বইটা পড়ে রেমী আর ধ্রুবর খুঁনসুটি জান্নাতের’র ভীষণ ভালো লেগে যায়। কিশোরী বয়স,ওদের রোমান্টিক মুহূর্ত ও’কে শিহরিত করে। বইয়ের ঐ পৃষ্ঠা থেকে আর বেরুতেই পারতো না। বারবার পড়তো। আর ন’হন্যতে মির্চার সাথে মৈত্রেয়ী দেবীর দেখা হবার মুহূর্ত ওকে যেন অন্য জগতে নিয়ে যায়। মনেমনে ধ্রুবকে চায়, চায় মির্চাকে।
বেশ কয়েকদিন লাবণ্যর স্কুলে অনুপস্থিত থাকার কারণে জান্নাত তাকে দেখতে গিয়ে জানতে পারে প্রিয় নায়ক সালমান শাহ’র মৃত্যতে ও নাকি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। লাবণ্যর বদমেজাজি বাবা ভীষণ বকাঝকা করেছে এই আদিখ্যেতার জন্য। তবে এটা সত্য, তখন এই হার্টথ্রব নায়কের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজন তরুণী আত্মাহুতি দিয়েছিল। লাবণ্য বাংলা হিন্দি সব ধরনের মুভি পছন্দ করতো। জান্নাত কখনো সিনেমা হলে যায়নি এবং চলচ্চিত্র নিয়ে কোনো আগ্রহও নেই। ওর বাবা পছন্দ করতেন না। রাত দশটার নিউজ দেখা বাধ্যতামূলক ছিল ওদের জন্য আর কেবল সাপ্তাহিক নাটক এবং ইংরেজি সিরিজ দেখতে পারতো। বান্ধবীর বেহাল অবস্থা দেখে তার অনুরোধে জীবনে প্রথম শাপলা হলে গিয়ে “সত্যের মৃত্যু নেই ” ছবিটা দেখে ভীষণ আবেগী হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসে জান্নাত ।
লাবণ্য ছিল বেশ লম্বা আর অসম্ভব সুন্দরী। কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রঙ আর কাটাকাটা চেহারা। ও নিজে ততটা ফর্সা না হলেও খুব মিষ্টি আর মায়াময় ছিল। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে বিপরীত লিঙ্গের চোখের সাথে চোখাচোখি হতো। জোর করে কেউ চিঠি ধরিয়ে দিতো। খুব ইনজয় করতো জান্নাত । লাবণ্য দুঃখ করতো, দ্যাখ আমি তোর চেয়ে সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও সব চিঠি ওরা তোকে দ্যায় কেন রে! জান্নাত দুষ্টু হাসি হেসে ও’কে সান্ত্বনা দিয়ে বলতো আমরা দুভাইকে বিয়ে করবো,বুঝলি মিতা। যারাই চিঠি দেয় লক্ষ্য করেছিস, সবগুলো বাবার একমাত্র ছেলে। তাই আমার প্রেমটাও হচ্ছে না। আর শোন, আমাদের একটা ছেলে একটা মেয়ে হবে। ওদের নামও আমিই রাখবো। তুই আবার কি সব বাংলা সিনেমার নায়ক ভিলেনমার্কা উদ্ভট নাম রাখবি! আমি সাহিত্যধর্মী সুন্দর সুন্দর নাম রাখবো। তোর ছেলেমেয়েদের নাম হবে, শুভ্র আর উথলী।আমার গুলোর নাম হবে অভ্র আর গোধূলি। লাবণ্য হাসতে হাসতে পেট চেপে বসে।
গাছে কাঁঠাল
গোঁফে তেল।
শখ কতো,আন্টি শুনলে তোকে আস্ত রাখবে! আগে ডাক্তার হ। আমিও ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হই। তারপর এসব নিয়ে ভাবা যাবে।
কিন্তু অতোদিন পর্যন্ত জান্নাত অপেক্ষা করতে পারলো না। হুট করেই প্রেমে পড়ে গেল আবীর নামের এক ছেলের। জান্নাত তার মধ্যে ধ্রুবকে আবিষ্কার করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ভালো ফুটবল খেলে। লাবণ্য ওদের দুজনকে শহর ছেড়ে অনেক দূরে চিকলীর বিল নিয়ে গেল।সারাদিন ঘুরলো ওরা। সেদিনটা ভুলবার নয়। সেটাও জান্নাতের বাবা-মা ছাড়া অতদূরে প্রথম বেরিয়ে আসা। লাবণ্য বলতো, একদম দিলওয়ালে দুলহানিয়ার শাহরুখের মতো তোর ইয়েটা…. । আমাকে দিয়ে দে না। আমাকে আজ পর্যন্ত কেউ একটা প্রপোজও করলো না…..গাল ফুলিয়ে বলে লাবণ্য। ।
জান্নাত জবাবে বলতো,বাঙালি মেয়েরা সব পারে, শুধু স্বামীর অধিকার কাওকে দিতে পারে না।
স্বামী!!!!
আবার হেসে কুটিকুটি দুজনে।
প্রেমে পড়ে জান্নাত দশম শ্রণীর প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় দুটো সাবজেক্টে ফেল করলো। লাবণ্য ওকে বুঝিয়ে বললো,এসব বাদ দিয়ে পড়। শুনেছি ছেলেটি বস্তিতে থাকে। ভালো না। শুনে জান্নাতের নৈতিকতা মানবিকতা জেগে উঠলো। প্রেম ধনী গরীব দেখে হয় না। শিক্ষা থাকলে একদিন গাড়ি বাড়ি সব হবে। ভালোও হবে। ও’ এখন কারো বুঝ নেবার মতো অবস্থানে নেই। একটা ঘোরের মধ্যে আছে। আর সেই টিন এইজ বয়সটাই এমন যা দেখে সবই মুগ্ধতা ছড়ায়। তাছাড়া এসব ব্যাপারে পরামর্শই বা নেবে কার কাছ থেকে? যার সাথে শেয়ার করছে সে’ও তো তারই সমবয়সী। সেজন্য ভালো প্যারেন্টিং ভীষণ জরুরি। এবং ভালো বন্ধু হয়ে মা-বাবার উচিৎ সন্তানকে সবকিছু বুঝিয়ে বলা।
ফেল করার জন্য জান্নাতের বাবা বাসায় টিচারের সংখ্যা বাড়িয়ে দিলো। কড়া নজর রাখা হলো তার ওপর। ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ।
বড় বোনের সাথে মার্কেটে যাবার সময় জান্নাত একদিন দেখে তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী আবীরের হাতে একটা চিঠি গুঁজে দিয়ে খুব হেসে হেসে কথা বলছে। জান্নাতের আর বুঝতে বাকি রইলো না কেন সেদিন আবীর সম্পর্কে উল্টাপাল্টা কথা বলছিল লাবণ্য ……
৩য় পর্বের লিন্ক
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1691888847992802/?mibextid=Nif5oz
চলবে…..