মিতা। পর্ব শেষ

0
185

মিতা

জান্নাতের বদ্ধমূল ধারণা লাবণ্য ওর আবীরের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। এ মিথ্যে অপবাদ থেকে নিজেকে বাঁচাতে জান্নাতকে সাহায্য করতে রাজি হয়ে যায় লাবণ্য। ।

আজ জান্নাতের বিয়ে । লাল টুকটুকে শাড়িতে জান্নাতকে একদম একটা পুতুলের মতো লাগছে। লাবণ্য হতাশ হয়ে দেখছে ওকে। এতো ব্রিলিয়ান্ট একটা মেয়ে যার জন্য আলোকিত এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে সে এটা কি করছে! কত স্বপ্ন ছিল ওদের, ওরা একই কলেজে পড়বে। ঢাকায় পড়বে,ছেলেদের জ্বালাবে, আরো আরো অনেক কিছু……..
কিন্তু এ কোন খেয়ালিতে পেয়ে বসেছে আজ তাকে! অনেকদিন জান্নাত ঘর থেকে বের হয় না। বোর হয়ে যাচ্ছিল। লাবণ্য,আন্টিকে অনেক বলেকয়ে রাজি করিয়েছে ওদের বাসায় যেন জান্নাতকে আজ রাতটা থাকতে দেয়। রিফ্রেশমেন্টের জন্য আরো কয়েকজন বান্ধবীও থাকবে। খুব সহজেই জান্নাতকে বাইরে নিয়ে আসতে পেরেছে লাবণ্য । ওর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে সত্যিটা আন্টি জেনে গেলে কি হবে! ওর উপর বিশ্বাস করে মেয়েকে পাঠালো আর ও’কিনা….

আবীরের এক বন্ধুর বাড়িতে বিয়ে পড়ানোর জন্য মৌলভিও চলে এসেছে। লাজুক চোখে বৌ বৌ ভাব নিয়ে জান্নাত একটা খাটে বসে আছে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে লাবণ্যর…..ঢং দ্যাখো।
বাসায় জানাজানি হলে কি হবে!
কারো কারো দৃষ্টিতে ঢং মনে হলেও এটাতো সত্যি যে জান্নাত তার ভালোবাসাকে কাছে পেতে যাচ্ছে,এই মুহূর্তে সে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ভাবছে।
ভালোবাসা আসলে একটা অনিয়ন্ত্রিত আবেগ যা কোনো রকম যুক্তি মানে না, কিচ্ছু মানে না, শুধু স্বপ্নে ভাসায়। জান্নাতও এখন নিজেকে ছাড়া অন্য কারো কথাই ভাবার মতো অবস্থায় নেই। লাবণ্যর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল,ও দ্রুত ঘর থেকে বাইরে চল আসে।
চোখেমুখে উৎকণ্ঠা নিয়ে পায়চারি করতে লাগলো। গলা শুকিয়ে আসছে। কত গ্লাস যে পানি খেলো তবুও যেন তৃষ্ণা মিটছে না।
হঠাৎ কোত্থেকে জান্নাতের বড় বোন এসে ওর দু’বাহু ধরে জোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, কি হচ্ছে এসব! পরক্ষণেই নিজেকে সামলিয়ে বুদ্ধিমতী বোন তার গলাটা আরো একধাপ নীচে নামিয়ে কোমল স্বরে বলে,আমাকে বললে না কেন কিছু আপু?
এখন কি বিয়ের সময়! আগে পড়াশোনা শেষ করো,বড় হও। কথা দিচ্ছি, বাকীটা আমি দেখবো। লাবণ্যর দিকে আঙ্গুল তুলে বলে ,ও না বললে তো জানতেও পারতাম না কোন সর্বনাশ ডেকে আনতে যাচ্ছো।

কোনো উপায়ন্তর না দেখে লাবণ্য একদিন জান্নাতের বড় বোনকে ফোনে জানায় সব। উনি পরীক্ষা বাদ দিয়ে ঝড়ের গতিতে ঢাকা থেকে চলে আসে । তখনও যমুনা সেতু হয়নি। আরিচা নগরবাড়ি ফেরিতে তখন পাঁচ ‘ছ ঘণ্টা লেগে যেতো। উনি লাবণ্যকে অনুরোধ করেছিল, বাবা-মা যেন কোনোভাবেই কিছু না জানে। আমি এসে সবটা ম্যানেজ করবো। আবীর তার বন্ধুদের নিয়ে পালিয়ে যায়। জান্নাত তার প্রথম প্রেম, প্রতিদিন একটু একটু করে বোনা স্বপ্ন ভাঙার জন্য লাবণ্যর ডালিমরাঙা গালে সর্বশক্তি দিয়ে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ বসিয়ে চড় মেরে বলেছিল, তুই কোনোদিন আমার সামনে আসবি না। বন্ধু নামের কলঙ্ক তুই। তুই কখনোই আমার আসল বন্ধু ছিলি না।
সবসময় এতো ভালো বন্ধু হওয়ার কি দরকার আছে! মাঝেমধ্যে বন্ধুত্বে না হয় থাকলো কিছু কলঙ্কের দাগ যদি তাতে কারো মঙ্গল হয়।
সেটাই ওদের দু’বান্ধবীর শেষ দেখা। এরপরই জান্নাতরা সপরিবারে রংপুর ছেড়ে চলে যায়।

ইন্টারমিডিয়েট সেকেণ্ড ইয়ারে থাকতেই জান্নাতের বাবা বড় মেয়ের বিয়ে দেবার সাথে সাথে ওর’ও বিয়ে দিয়ে দেন।

শুভ্র বলে এখানে বসুন আন্টি।
আমি মা’কে ডেকে আনছি। এতোক্ষণে জান্নাত লক্ষ্য করে দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়া খুব নোংরা আর অগোছালো একটি ঘরে দাঁড়িয়ে আছে সে । বেতের ঝলসানো নেতানো সোফা প্রাচীন যুগের সাক্ষ্য বহন করছে। জান্নাতের বসার ইচ্ছেটাই উবে গেল। কিছুক্ষণ পর নেপথলিনের গন্ধ ছড়ানো একটা সুতি শাড়ি পরে অতি দীর্ঘকায় এক মহিলা এলো। চেহারায় সংসারের টানাপোড়েনের স্পষ্ট ছাপ। গায়ের রঙ মাজা,মুখে মেছতার দাগ, ফাঁকা দাঁতে পানের পিচকি। লাবণ্য ! কোথায় তার সেই চিরচেনা বন্ধু যাকে প্রথম দেখায় দেবী মনে করে ভুল করেছিল। তবে চুলগুলো এখনও আগের মতোই আছে। ঘোমটার পেছনে বড় একটা খোপা তার জানান দিচ্ছে। জান্নাতের দিকে তাকিয়ে চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে মহিলাটিও । ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওর হাতগুলো ধরতে যেয়ে চাপা কালির মতো আঙ্গুলের জায়গায় ক্ষয়ে যাওয়া নখ দেখে জান্নাতের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। মনে পড়ে, একদিন আন্টি লাবণ্যকে সালাদ বানাতে বললে লাবণ্য আঙুলে পাতলা কাপড় পেচিয়ে সাবধানে কাটাকাটি করেছিল যেন কোনো দাগ না পড়ে । ছুরি দিয়ে ও’তখনও কাটা শেখেনি। খুব যত্ন নিতো নিজের। আর আজ……….. ।
হাত সরিয়ে নিয়ে গাল দুটো ধরে ছলছল চোখে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে,খুব লেগেছিল মিতা! আমায় তুই মাফ করে দে। আমি আজ শুধুই ক্ষমা চাইতে এসেছি তোর কাছে।

ওর মিতাও আড়ষ্টতা কাটিয়ে জান্নাতের হাত চেপে গলা জড়িয়ে ধরে ডুকরে ওঠে, তুই! তোর অপেক্ষাতেই ছিলাম। মন বলছিল আমাদের ঠিক একদিন দেখা হবে। আমাকে তুই ক্ষমা কর। তোর ভালোবাসা কাড়তে চেয়ে আমারও যে কিছু পাওয়া হলো না। কাওকে অসুখী করে সুখ পাওয়া যায় না মিতা। তোর কোনো রাগ নেই তো আমার উপর!

জান্নাত কিছু বুঝতে পারে না । বলতে থাকে, কিসের রাগ?তুই তো আমার উপকার করেছিলি। অল্প বয়স ছিল, একটা মোহের পেছনে ছুটেছিলাম। ভুল করতে গিয়েছিলাম। প্রকৃত বন্ধু হয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিলি। দু’বছর পর পত্রিকা মারফত জানতে পারি ,হেরোইন সাপ্লাইয়ের জন্য আবীর গ্রেপ্তার। নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে সুন্দর মুখশ্রীর আড়ালে মিথ্যে পরিচয়ে মেয়েদের টোপ ফেলানো ছিল ওর পেশা। নতুন করে শিখলাম, don’t judge a book by its cover.
সেইদিন থেকে তোকে পাগলের মতো খুঁজছি আমি। তোর খবর নেবার জন্য একবার দুঃসম্পর্কের এক ভাইকে তোদের বাসায় পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারলো না। তোরা তো ওখানকার স্থানীয় ছিলি তাই না? জানিস, কতো ভালো ঘর পেয়েছি। বর পেয়েছি। ডাক্তার হতে পরিনি তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছি। সবই তোর জন্য। আমি তোর কাছে কৃতজ্ঞ। তুই সেদিন বাঁধা হয়ে না দাঁড়ালে হয়তো কবেই অন্ধকারে তলিয়ে যেতাম।
তোর মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ভুল পথ থেকে সঠিক রাস্তা চিনিয়েছিস। তুইই সত্যিকারের বন্ধু, মিতা।

লাবণ্যর চোখ ঝলমল করে ওঠে। বলে,আবীর সম্পর্কে আমি কিছুটা জানতাম। একদিন আমার ব্যাগে একটা চিঠি দেখে আবীরকে ফেরত দিতে গিয়ে বললাম, হয়তো নামের বিভ্রাটে ভুল করে দিয়েছেন ভাইয়া।
নির্লজ্জের মতো ও বললো, সে নাকি ইচ্ছে করেই আমাকে লিখেছে। কিন্তু তুই তো একথা বিশ্বাস করতি না। বলতে চেয়েও পারিনি।

: অথচ আমি কিসব আজেবাজে চিন্তা করছিলাম। কেন যে আমরা কথা বললাম না! যদি মন খুলে ঝগড়াটাও করতাম তবে হয়তো সবকিছু অন্যরকম হতে পারতো।

লাবণ্য অভিমানী কণ্ঠে বলে, তুইই তো কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলি। তবে আবীর যেমনই হোক তোর তো ভালোবাসা ছিল। আমি তোর মন ভেঙেছি। জানিস তো মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা সমান। তাই আল্লাহ আমার ভালোবাসাও কেড়ে নিয়ে আমাকে শাস্তি দিয়েছে ।
তোরা চলে যাবার পর হঠাৎ রোড অ্যাকসিডেন্টে মা মারা গেল। বাবা আবার বিয়ে করলো। কি যে কষ্ট হয়েছিল। তোকে কতো খুঁজেছিরে মিতা। আমার কোনো ভাইবোনও ছিল না যে শেয়ার করবো। সৎ মায়ের গঞ্জনা সইতে না পেরে বাইরে বাইরেই থাকতাম বেশি। কেউ দুটো ভালো কথা বললে তাকে আঁকড়ে ধরতাম। আমিও প্রেমে পড়লাম। পালিয়ে বিয়ে করায় বাবা ত্যাজ্য করলো। যে সম্পদের লোভে লোকটা আমায় বিয়ে করেছিল সেটা পাওয়ার সম্ভাবনা না পেয়ে আমাকে ডিভোর্স দিল দুটো বাচ্চাসহ। পড়াশোনাও হলো না। কি ছিলাম,কিভাবে আছি দ্যাখ। হাউমাউ করে কাঁদছে লাবণ্য ।
জান্নাতের ভেতরটা কেঁপে ওঠে । ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে, শাস্তি নয় এটা নিয়তি।
কাঁদুক যতো ইচ্ছে। এটাই যেন ওর শেষ কান্না হয়।

পাশে ওর ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে। শুভ্র আবার তার জন্য রেস্টুরেন্ট থেকে কি কি সব খাবার নিয়ে এসেছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভালো মানের আর দামও নিয়েছে বেশ। জান্নাত বললো,উঁহু এতে চলবে না। আজ আমি আমার মিতার হাতের রান্না খেয়ে যাবো। আসলে ওদের আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে খাবারগুলো জান্নাতের গলা দিয়ে নামছিল না। শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে,এই স্মার্ট এবং বুদ্ধিমান ছেলেটির কি শুভ্র নামটা পছন্দ নয়! “মায়ের লুতুপুতু ছেলে ” কোনো পরিচয় হলো! শুভ্র লজ্জা পেয়ে যায়।
শুভ্রর চোখে ওর মা গভীর মনোযোগে কি যেন দেখে। সস্নেহে তার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে প্রশ্রয়ের হাসি হাসে, হুম বুদ্ধিমান ছেলে বলেই মা’কে তুলে রাখা শাড়ি পরিয়েছে। এবার আমি সব বুঝতে পারছি। কিন্তু আমাকে আগে বললে আমি ঘরবাড়ি গুছিয়ে একটু সেজেগুজে থাকতে পারতাম । আমার মিতা আমাকে এ অবস্থায় দেখে কতটা কষ্ট পেয়েছে তুই জানিস!

জান্নাত ওর মেয়েটাকে কাছে টেনে নেয়,অবিকল আমার সেই মিতা। উথলী তো!
মেয়েটা মাথা উপর নিচ করে বলে এবার এইচএসসি দেবো।
জান্নাত তার মিতাকে কথা দেয়,তুই পারিসনি। তোর মেয়ে ইনশাআল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। আমার অভ্র জানবে শুভ্র নামে ওর আর একটা ভাই আছে। তুই আমার জন্য অনেক করেছিস। অনেক ঋণ আমার। আমি জানি ঋণ কখনো পরিশোধ করা যায় না । এবার অন্তত কিছুটা আমায় ফেরত দিতে দে। কি দিবি?

গল্প করতে করতে সন্ধ্যা পেরিয়ে মায়াবী চাঁদের আলো নিয়ে রাত আসে। দু’বান্ধবী সেই আলো গায়ে মেখে উঠোনে বসে ছোট্ট কিশোরীর মতো হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ের উপর ঢ’লে পড়ে আবার কাঁদে। ছেলেমেয়ে দুটো অবাক হয়ে যায়, তাদের মা এত্তো কথা বলতে পারে!
আজ এতো সুন্দর লাগছে কেন মা’কে!
প্রায় দুই যুগ পর দুই মিতার চোখের জলে জমানো সব ভুলভ্রান্তি, দুঃখ,কষ্ট, মান অপমান ,অভিমানের অবসান ঘটে।

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here