#আমার_ভাঙা_ক্যানভাসে (৫)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
– ‘ওয়াও রুহু কি সুন্দর এঁকেছিস।’
রুহি ক্যানভাস থেকে মাথা না তুলেই বলল,
– ‘এমন ভাবে বলছিস যেন আমার আঁকা এই প্রথম দেখলি।’
– ‘সে অনেকবারই দেখেছি। কিন্তু এত সুন্দর হতো না।’
সোহানের কথাতে রুহি পেছন ফিরে তাকাল। সোহান রুহির বড়ো ফুপির ছোট ছেলে সময়ে প্রায় সমবয়সীই কিন্তু বছর আলাদা হওয়াতে ক্লাসে সিনিয়র হয়ে গেছে।
– ‘আগেও এইরকমই আঁকতাম কিন্তু তুইই চোখে দেখিস নাই।’
– ‘এই রুহু আমি তোর থেকে বড়ো হয় তাই সম্মান দিয়ে কথা বল।’
– ‘বয়েই গেছে ওনার সাথে সম্মান দিয়ে কথা বলতে। যা ভাগ এখান থেকে।’ (ভেংচি কেটে)
– ‘এত বড়ো হয়ে গেলি এখনো সেই পুরানো অভ্যাস গেল না।’
– ‘আমার অভ্যাস আমি বদলে ফেলব না কি করবো সেটা আমার ইচ্ছা।’
– ‘হুমম। জানিস রুহু তোকে এই কয়েকবছরে খুব মিস করেছি। বিশেষ করে এই বাড়িতে আসলে, তোকে খুব মিস করতাম।’
– ‘আমিও তোদেরকে খুব মিস করতাম।’
– ‘তা আমার জানা আছে। তোকে না আমার অনেককিছু বলার আছে।’
– ‘কি বল।’
– ‘কথাটা জয়ের বিষয়ে।’
রুহির হাসিমুখটা নিমিষেই গম্ভীর হয়ে গেল। কাঠ কাঠ গলায় বলল,
– ‘জয়ের বিষয়ে কোনো কিছু শুনতে আমি আগ্রহী নয়। অন্যকিছু বলার থাকলে বলতে পারিস।’
– ‘একটাবার শোন।’
– ‘না প্লিজ।’
– ‘ওকে। তবে কথাগুলো তোর শোনা প্রয়োজন ছিল।’
– ‘কোনো প্রয়োজন নেই। যে মানুষটা দুইদিনের ভালোবাসার জন্য এতদিনের বন্ধুত্বকে অসম্মান করতে পারে তার বিষয়ে আমার কিছুই শোনার নেই। প্লিজ আমাকে পুরানো কথাগুলো মনে করিয়ে দিস না।’
সোহান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনেকগুলো সত্যি রুহির জানার দরকার ছিল কিন্তু মেয়েটা তো কিছুই শুনল না। রুহি, জয় আর সোহান একই কলেজে পড়ত, শুধু ক্লাস আলাদা। রুহির বাড়ির ছাড়ার আসল কারন যে জয় ছিল সেটা একমাত্র সোহান জানত। এই বাড়ির আর কেউই জানে না কেন রুহি হঠাৎ করেই পড়াশোনার বাহানায় মামার কাছে চলে গিয়েছিল আর না জানে বন্ধুত্বের ভাঙনের কথা। সকলে জানে এখনো রুহি আর জয় একে অপরের প্রা’নভোমড়া।
– ‘জানিস রুহু এখন মাও এই বাড়িতে আসতে চাই না। বলে পরিবারটা কিরকম একটা ভেঙে গেছে এখন আর ভালোই লাগে না। তুই এসেছিস শুনে মা তো কি খুশি নিজে আস্তে পারল না বলে আমাকে পাঠিয়ে দিলো তোকে ওই বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য।’
– ‘কেন বড়ো পিমনি আসলো না কেন?’
– ‘আর বলিস না। পুচকেটার পেছনে দৌড়াতে গিয়ে পা মুচকে গেছে ঠিক করে হাঁটা চলা করতে পারছে না।’
– ‘ইশ পুচকেটা কত বড়ো হয়ে গেছে, কতদিন দেখিনি।’
– ‘তা দেখবি কি করে। ওর বয়স তখন কিছু মাস তুই অন্যশহরে পাড়ি দিলি।’
– ‘মাঝেমধ্যে ভাবি জানিস হয়তো এই পরিবারটা আমার কারনেই ভে’ঙে গেছে। আমি এই শহর না ছাড়লে সবাই হয়তো একসাথেই থাকত।’
– ‘তুই নিজেকে দোষ দিচ্ছিস কেন? বড়ো মামু আর সেজমামুকে কি তুই বলেছিস চলে যেতে!’
– ‘না কিন্তু…
– ‘তাহলে চুপ থাক। ওনারা নিজের ইচ্ছায় এই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল এইখানে তো তোর কোনো দোষ নেই।’
– ‘সবকিছু কিরকম বদলে গেছে।’
– ‘হুমম বলতে গেছে। অনেককিছুই বদলে গেছে যেমনটা তোর আর জয়ের সম্পর্কটাও।’
– ‘আবার জয়!’ (বিরক্ত হয়ে)
সোহান এই টপিকটা বাদ দিয়ে আড্ডায় বসলো।
– ‘সোহান শোন না, সবাইকে কি একসাথে করা যায় না সেই আগের মতো।’
– ‘জানি না। তবে তুই চেষ্টা করলে সাকসেস হতেও পারিস।’
– ‘চেষ্টা তো করতেই হবে।’
রুহি ভেবে চলেছে কিভাবে কি করবে। হঠাৎ মাথাতে একটা কথা আসে,
– ‘এই সোহান তিথি আপার বিয়ে কবে রে?’
– ‘২মাস পর। কেন?’
– ‘প্ল্যান পেয়ে গেছি।’
– ‘কি প্ল্যান!’
– ‘সব বলছি শোন।’
**
পরেরদিন সকাল বেলা রুহি আর সোহান বেরিয়ে পড়েছে, কোথায় যাচ্ছে তার কিছুই বাড়িতে জানায় নি। বলেছে ঘুরতে বের হচ্ছে প্রিয়া যাবার বায়না ধরলেও রুহি নিতে রাজি হয়নি। একারাই বেরিয়ে গেছে।
রুহি মাথা নীচু করে বসে আছে, সামনে বসে আছে হামিদ চৌধুরী। মুখটা দেখে বোঝা যাচ্ছে না ওনার মনের মাঝে কি চলছে আর সোহান পাশে দাঁড়িয়ে নখ খুঁটে চলেছে।
হামিদ চৌধুরী গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
– ‘তুমি এইখানে কেন?’
– ‘বড়ো আব্বু আসলে…
– ‘আমি কারোর বড়ো আব্বু নয়।’ (অভিমান করে)
রুহি গাল ফোলাল, রুহির বড়ো আব্বু হামিদ চৌধুরী পরিবারের সকলের বড়ো হওয়াতে একটু গম্ভীর স্বভাবের কিন্তু রুহিকে বড্ড স্মেহ করতেন। রুহিকে হঠাৎ করেই মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়াতে মেজ ভাইয়ের উপরে একটু রাগ দেখিয়েই ওই বাড়ি ছেড়ে ছিলেন।
– ‘বড়ো আব্বু এখনো কি রাগ করে থাকবে!’
– ‘আমি কারোর উপরে রাগ করে নেই।’
– ‘দ্যাখো আমি ফিরে এসেছি আর কোথাও যাবো না। প্লিজ তোমরা ফিরে চলো আমরা আবারো একসাথে আগের মতো থাকতে শুরু করি।’
– ‘সেটা সম্ভব না।’
– ‘ঠিকাছে কি আর করার তাহলে আমিও ফিরে যাবো।’
হামিদ চৌধুরী রাগী চোখে রুহির দিকে তাকাল, রুহি পাত্তা না দিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। মানুষটার সামনে এইভাবে কখনোই কথা বলেনি কিন্তু আজকে সাহস দেখিয়ে বলতে হচ্ছে, নাহলে ওনাদের এই বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।’
হুট করেই রুহির কানটা কেউ টেনে ধরল। রুহি আহ্ বলে তাকিয়ে দেখল ওর মা দাঁড়িয়ে আছে।
– ‘বড়ো মা।’ (খুশি হয়ে)
– ‘একটু আগে কি বলছিলিস আবার চলে যাবি? বলি এক পা আগিয়ে দেখ পা ভে’ঙে রেখে দেব। দরকার পড়লে তোকে আমাদের বাড়িতে রেখে দেব তবূও কোথাও যেতে দেব না।’
– ‘কি করে রাখবে, তোমার ছেলের তো বিয়ে হয়ে গেছে।’ (দাঁত বের করে)
বড়ো মা রুহির কানটা আর একটু শক্ত করে চেপে ধরল।
– ‘সেই আগের মতোই রয়ে গেলি।’
– ‘আহ লাগছে তো ছাড়ো না।’
– ‘নে ছাড়লাম। কেমন আছিস বল।’
– ‘আছি ভালোই তোমরা কেমন আছো। দাভাই, ভাবি সব কোথায়?’
– ‘ওরা একটু বেরিয়েছে। একটু পরেই চলে আসবে।’
– ‘ওহ।’
রুহি হামিদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
– ‘তোমাদের তো আমি ওই বাড়িতে ফিরিয়েই ছাড়ব হু।’
**
রুহি হামিদ চৌধুরীর পেছনে পড়েও ওনাকে ওই বাড়িতে ফিরে যাবার জন্য রাজি করাতে পারল না। হতাশ হয়ে ফিরে যাবে তখনি আদেশ হলো দুপুরের খাবার খেয়ে তবেই এই বাড়ির বাইরে পা রাখতে পারবে তার আগে নয়। অগত্যা এই বাড়িতে থাকতে হলো, রুহির বড্ড মনখারাপ ছিল কিন্তু মিলনের ছেলেটাকে পাবার পর থেকে তাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মিলন হামিদ চৌধুরীর ছেলে বিয়ে হয়েছে অনেক বছর আগেই দুটো বাচ্চার বাবাও হয়ে গেছে একজন একটু বড়ো আর ছোটটা এই ২বছরের।
সবাই একসাথে খেতে বসলো। মিলন রুহির সাথে টুকটাক কথা বলছে, বাড়ির বড়ো ছেলে হওয়াতে রুহিদের সাথে মিলনের বয়সের ডিফারেন্সটা অনেকটাই তাই সেইভাবে ওর সাথে কারোরই সখ্যতা গড়ে উঠেনি। বড়ো দাদা হিসাবে সকলেই মিলনকে খুব সম্মান করে।
– ‘আমার একটা কথা বলার ছিল।’
হামিদ চৌধুরীর গম্ভীর কন্ঠ শুনে সবাই নড়েচড়ে বসল।
– ‘কি বাবা বলো।’
– ‘……
#চলবে…
সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।