#এক_টুকরো_সুখ
#পর্ব_৮
#লেখনীতে_শুভ্রতা_প্রাণ
“বোকার মতো কথাবার্তা বলিস না রুবি। এ মাসের মাঝেই ডেলিভারি তোর। হাসপাতালে নিলেই একগাদা পয়সা লাগবে। তোর কি মনে হয় সেগুলো দেবে তোর শাশুড়ি? আর যদিও দেয়, পরে তোকে ছেড়ে কথা বলবে? আয়নার আব্বার থেকেই এসব টাকা আদায় করতে হবে। তার আদুরে মেয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করলে সে তোকে আর আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতেও দুবার ভাববে না। সে পাশের ঘরে থাকাকালীন তুই কীভাবে আয়নার সাথে ঐভাবে কথা বলিস? মাথার মধ্যে কি গোবর পুড়েছিস শশুর বাড়ি গিয়ে?”
রুবি অবাক হয়ে নিজের মায়ের কথা শোনে। সত্যিই তো। সে কি করে এরকম বোকামি করতে পারলো? আয়না যে যার নিজের বোন না এ কথা সে বহু আগে থেকেই মায়ের দৌলতে জানে। তার ধারণা ওই জন্যই আব্বা আয়নাকে বেশি ভালোবাসে। তাই তো তার সহ্য হয় না ওই মেয়েকে। কিন্তু আয়নার প্রতি আব্বার যে দরদ তাতে সে কিছু বলবে আব্বা ছেড়ে দেবে না। সুতরাং সাবধানে কাজ করতে হবে। নিজের জন্য হলেও ভালো ব্যবহার করতে হবে আয়নার সাথে।
“হুম মা আমি বুঝতে পেরেছি কিন্তু তুমি আমাকে অত জোরে না মারলেও পারতে।”
“আয়নার আব্বা পাশের ঘর থেকে সব শুনছিলো। আমি যদি তোকে শাসন না করতাম তাহলে চোটে যেত বোকা।”
আপাও আম্মার কথায় সায় দিলো।
একটু আগে যখন আমার দিকে কড়া দৃষ্টি দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আপা আম্মার কাছে গিয়ে জানতে চাইলো যে আম্মা কেন তার সাথে এরকম ব্যাবহার করলো তখনই আম্মার সাথে তার এসব কথাবার্তা হলো। অথচ আমি ভেবে বসে আছি আম্মা আমার জন্য আপার গায়ে হাত তুলেছে। কত বোকা আমি! আমার অজানাই রয়ে গেলো আম্মার আসল রূপ।
এরপর থেকে আম্মা আর আপা দুইজনেই আমার অতিরিক্ত যত্ন করতে শুরু করলো। প্রথম প্রথম অবাক লাগলেও পরে ভেবে নিলাম হয়তো তাঁদের সুবুদ্ধি হয়েছে। আমার পরীক্ষা শুরু হলো। বেশ ভালো ভাবেই দিতে থাকলাম। আম্মা কোনো কাজের জন্য ডাকেন না। সবকিছু এগিয়ে দেন। আপাও খারাপ ব্যবহার করে না। সবকিছু ঠিকঠাক ছিলো। আপাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো। সিজার করা লাগলো না। ফলে খরচ কম হলো আর আপাও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে এলো। হাসপাতালে যে দুইদিন ছিলো তখন আম্মা শুধু সকালে রান্না করে রেখে যেতেন। আপার সাথে এলো দুলাভাই কিন্তু সে আবারও চলে গেলো। আপাকে নিতে নাকি ঘটা করে সবাই আসবে কিছু দিন বাদে।
পরীক্ষা, ব্যাবহারিক সব শেষ হলো। আবারও আম্মার সাথে কাজে সাহায্য করতে শুরু করলাম। যেহেতু আমার সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করছে না তাই আমারও সমস্যা নেই। আপার ছেলেকে কোলে নিচ্ছি, দুষ্টুমি করছি। মনে হলো যেন এই তো সুখ। কিন্তু আমার জানা ছিলো না আমার জন্য ঠিক কি অপেক্ষা করে আছে।
আমাদের গ্রামের মেম্বার নাজমুল চাচা। তার একমাত্র ছেলে নাঈম। লেখাপড়ায় বরাবরই গোল্লা। মেম্বারের ছেলে বলেই হয়তো এসএসসিতে এলাও হয়েছিলো। টেনেটুনে পাশ। তারপর আর এগোয়নি। সারাদিন বাজারের কাছে একটা মোড়ে বসে আড্ডা দেয়। শুনেছি মেয়েদের সাথে ফ্লার্টও করে। সেই ছেলের জন্য আমাকে দেখতে এসেছেন নাজমুল চাচার বউ। তার ছেলে নাকি আমাকে অনেক আগে থেকে পছন্দ করে। মেম্বারের বউকে পেয়ে আম্মা তো একেবারে আটখানা। পারলে এখনই বিয়ে দিয়ে দেন। সাথে আছে আমার আপা।
“তুমিই তো আয়না তাই না মা?”
“জী আমিই আয়না।”
” মেট্রিক দিয়েছো বলে শুনলাম। এবার তো মা সংসার সামলাতে হবে। লেখাপড়া অনেক হয়েছে। কি বলেন বেয়াইন।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ বেয়াইন আর পড়ে হবে কি! একেই মেয়ে মানুষ তারউপর আব্বা গরিব। দরকার নাই আর লেখাপড়া দিয়ে।”
হাহ এখনো বিয়ে ঠিক হয়ে পারলো না আগেই বেয়াইন। আম্মাও কেমন হাসি হাসি মুখে চেয়ে আছে।
“কেনো চাচি লেখাপড়ায় কি সমস্যা? আর গরিব মানুষ কি লেখাপড়া করে না আম্মা? কোথায় লেখা আছে এমন নিয়ম যে গরিবের মেয়ে হলেই মাধ্যমিক পাশ করে বিয়ে করে সংসার ঠেলতে হবে? আমি এখন কোনো বিয়ে টিয়ে করছি না। পাঁচ বছর আগে যেমন আব্বা কড়া ভাবে বারণ করেছিল আজ আবার তেমন করতে বলবো। আসুক আজ আব্বা বাড়িতে।”
মেম্বারের স্ত্রীর চোখ মুখ দেখে বুঝলাম আমার ব্যাবহারে সে বেজায় অখুশি। আম্মাও রাগী চোখে চেয়ে আছে। থাকুক গে তাতে আমার কিছু না। আমাকে নিজের আর আব্বার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।
“হ্যাঁরে আয়না অত পড়ে কি হবে তোর? কোন মহাভারত উদ্ধার করতে পারবি? সেই তো হাঁড়ি পাতিল ঘোষবি। এমন ভালো পরিবার থেকে আর কেউ আসবে তোর মতো গরিবের মেয়েকে ছেলের বউ করতে?”
আপার কথা গুলো শুনে গা জ্বলে উঠলো। আমি বুঝতে পারছি না এদের মানসিকতা এরকম কেনো! মানছি রান্না ঘর সামলানোর কাজ মেয়েদেরই সবসময় করতে হয়। আমিও করবো। না তো বলিনি। কিন্তু এখনই কেন? কি এমন বয়স হয়েছে আমার?
“তুই নিজেরটা ভাব আপা। আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না তোকে। কোনোকালে তো ভাবিসনি আমার কথা, এখনও ভাবতে হবে না। আমার জন্য আমি আর আব্বাই যথেষ্ট। তুই যা দেখ তোর ছেলে কাঁদছে।”
আমার এহেন কথায় আম্মা, নাজমুল চাচার স্ত্রী, আপা সবাই বেশ রেগে গেছে। আপা গজগজ করতে করতে নিজের বাচ্চার কাছে গেলো।
“রুবির সাথে যেন আর কখনো তোকে এভাবে কথা বলতে না দেখি আয়না। তবে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”
“মেয়েকে বোঝান। আজকাল এসব লেখাপড়া, তেজ দিয়ে পেট চলে না। সবাই টাকা দেখে টাকা। আমার ছেলেকে বিয়ে করে নিলে আরামে বাকি জীবন পার করে দিতে পারবে। সময় থাকতে রাজি হতে বলুন। ভবিষ্যতে পস্তাতে হবে। এই তেজ কোনো কাজে আসবে না।”
মুখ ভেংচি দিয়ে পান চিবুতে চিবুতে চলে গেলো চাচি। এরমধ্যে উঠোনে আব্বার দেখা পাওয়া গেলো। আমি মনে মনে স্বস্তির নিঃশাস ফেললাম। এখন আর কিছু খারাপ হবে না। আমার আব্বা এসে গেছে।
“আয়ু মা আয় এদিকে দেখ তোর জন্য কি এনেছি আব্বা। তাড়াতাড়ি আয় মা।”
আমি কারো দিকে না তাকিয়ে নেমে গেলাম বারান্দা থেকে।
“কই আব্বা দেখি কি এনেছো।”
আব্বা আমার হাতে একটা ব্যাগ দিলেন। তার মধ্যে একটা বক্স। খুলতেই সামনে এলো একটা নতুন স্মার্ট ফোন। অবাক হয়ে আব্বার দিকে তাকালাম আমি। আব্বা চোখের ইশারায় বললেন এটা আমার। সত্যি! এই ফোন আমার! আল্লাহ এত্ত খুশি আমি। এতদিন শুধু দেখেছি আমার বান্ধবী গুলো ফোন নিয়ে কত কি করে। এখন আমারও ফোন আছে।
“সত্যি আব্বা? এই ফোন তুমি আমার জন্য এনেছো? আমি অনেক খুশি হয়েছি আব্বা। সত্যি এত্ত গুলো খুশি যে বলে বোঝাতে পারবো না।”
“হ্যাঁ মা এটা তোর। কালকে রুবিকে নিতে ওর শশুর বাড়ির লোকজন আসবে। ওরা যাওয়ার পরেই তোকে তোর ফুপুর কাছে দিয়ে আসবো। কদিন থাকবি সেখানে। তৈরী হয়ে নিস্। তোর মিনা আপার কম্পিউটার আছে। ও তোকে শিখিয়ে দেবে বলেছে। আর ফুপুর থেকে জামা কাপড় বানানো শিখবি। নিজের কাজ নিজে করতে পারবি তাহলে। এরপরে আব্বা টাকা পয়সা হলে তোকেও একটা কম্পিউটার কিনে দেবো।”
আব্বার কথা শুনে আরো বেশি খুশি হয়ে গেলাম। মিনা আপা আমার একমাত্র ফুপুর একমাত্র মেয়ে। অনেক ভালোবাসে আমাকে। আর কম্পিউটার শেখা তো স্বপ্ন আমার। আমার খুশি যেন সহ্য হলো না আম্মার। তেড়ে এলো আম্মা।
“মেয়ে বড় হয়েছে সে খেয়াল কি আছে? বিয়ে দিতে হবে না তাকে? আজ মেম্বার ভাইয়ের বউ এসেছিলেন তার ছেলের জন্য আয়নাকে দেখতে। তাকে যা নয় তাই বলেছে তোমার মেয়ে। এখন কি আর এত ভালো সম্মন্ধ পাবো?”
আব্বার মুখ মলিন হয়ে এলো।
“নাজমুল মেম্বারের ছেলের সাথে আমি আয়ুর বিয়ে দেবো না। আপাতত আমি ওর বিয়ে নিয়ে ভাবছি না। আমার মা লেখাপড়া করবে। কালকে বিকেলে ওরা রুবিকে নিয়ে যাওয়ার পর আমি আয়ুকে আপার কাছে দিয়ে আসবো। এ নিয়ে আর কোনো কথা যেন না হয়।”
আব্বা ঘরে চলে গেলেন। আম্মার রাগের আগুনে যেন ঘি পড়লো। আপাকেও দেখলাম দরজায় দাঁড়িয়ে ফুসছে। এরা এরকম করছে কেনো কে জানে। আমার ভালো কি চায় না এরা? আমিও ঘরে চলে এলাম। আব্বা আমাকে নতুন মোবাইল দিয়েছে সেটা দেখতে হবে না? ওরা যা করে করুক। আমার আব্বা তো আছেই আমার সাথে। আম্মার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। বোধহয় বেশি রেগে গেছেন।
“মেয়েকে নাকি লেখাপড়া করাবে। ওই মেয়েই তোমার মুখে চুনকালি দেবে এই বলে দিলাম আমি। মিলিয়ে নিও আমার কথা। আমার কথা শুনলে না তো? মেয়ের বিয়ে দেবে না এখন! তোমার ওই আদুরীর কপালে ছেলে জুটলে হয় শেষে।”
আম্মার কথা গুলো মাথায় ঢুকলো না আমার। মোবাইল দেখতে ব্যাস্ত কি না। ঢুকলে হয়তো মনে প্রশ্ন আসতো, কোনো মা কি নিজের মেয়ের সম্পর্কে এভাবে বলতে পারে?
চলবে…?