#মিতা
৩য় পর্ব
লাবণ্য কি তবে আমার আবীরকে ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছে! কেন, আবীরের দিকেই কেন তোর চোখ পড়লো! আরোও তো অনেকেই ছিল । তুই হঠাৎ এতোটা হিংসুটে হলি কি করে লাবণ্য !
জান্নাত তার বড় বোনের সাথে একদিন মার্কেটে যাবার সময় ওর প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে তার প্রেমিক আবীরের সাথে রাস্তায় খুব হাসাহাসি করতে দেখে। এবং সেই সাথে আবীরের হাতে একটা কাগজও গুঁজে দিতে দেখে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিল না জান্নাত। কেন লাবণ্য আবীর সম্পর্কে সেদিন এতো উল্টাপাল্টা কথা বলছিল বুঝতে তার আর বাকী রইলো না ওর। লাবণ্য আবীরকে পছন্দ করে জান্নাত বুঝতে পারতো কিন্তু এভাবে লিমিট ক্রস করবে ভাবতেও পারেনি। এতো কষ্ট ও’ কোনো দিনও পায়নি। একটু কাঁদলে স্বস্তি পেতো কিন্তু বাসায় তা সম্ভব না। তাহলে ধরা পড়ে যেতে পারে। অন্য কোনো বিষয় হলে সে তার বান্ধবীর কাঁধে মাথা রেখে সব ভুলে যেতে পারতো কিন্তু আজ সে ভরসার কাঁধটাও আর নেই।
জান্নাত, লাবণ্যকে যতটা চেনে এসব প্রেমভালবাসায় তার আকর্ষণ নেই। ওর একমাত্র ইচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার তা যে কোনো বিষয় হলেই হলো। আর গোপন একটা শখ, মিডিয়ায় কাজ করার। হঠাৎ আবীরকে দেখে সেই মানুষটা চেঞ্জ হয়ে গেল! নাকি হিংসা, ঈর্ষা! কিছুটা রাগ,ক্ষোভ নিয়েই জান্নাত স্কুলে গেল কিন্তু লাবণ্যর পাশে আর বসা হলো না। অনেক কথা ঠোঁট পর্যন্ত উঠে আসছে বলার জন্য। তবুও ওর প্রিয় বান্ধবীকে কিছুই বলতে পারলো না জান্নাত । শুধু বাথরুমে গিয়ে কেঁদেটেদে চোখ ফুলিয়ে এলো।
লাবণ্যও হতভম্ব হয়ে গেল ওর আচরণে। কিছুই বুঝতে পারলো না। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় লাবণ্যর পাড়ারই একটা নতুন মেয়ে ওদের ক্লাসে ভর্তি হলে কয়েকটা দিন তাকে নিয়েই আসাযাওয়া করতো লাবণ্য । পাশাপাশি বসতো। সেদিনের কষ্টটাই যেন আজ জান্নাত তার বান্ধবী লাবণ্যকে ফেরত দিলো। চাপা অভিমানে লাবণ্যও আর জান্নাতকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না।
দুটো প্রিয় মানুষ এখন যেন দুজনার সবচেয়ে বড় শত্রু।একটা ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে ওদের।
ক্লাসের সব মেয়েরা ব্যাপারটা খেয়াল করলো। বহুদিন ধরেই ওদের দুজনকে তৃতীয় স্থানে থাকা মেয়েটি টপকাতে পারছিল না। সে এই সুযোগ কাজে লাগালো। আমরা সবাই জানি, শত্রুর শত্রু কিন্তু মিত্র হয়। কিছুকিছু মানুষ থাকে অকারণেই প্রিয় দুটো মানুষের মাঝে ঢুকে পড়ে তাদের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করে। এবং একজনকে ছিনিয়ে নিতে পারলেই তাদের যেন সকল সুখ। এ মেয়েটি তেমনই,জান্নাতের সাথে ভাব করে ফেললো তাড়াতাড়ি । এ’ও বললো প্রায়ই আবীরের সাথে তার বান্ধবীকে দেখা যায়। খুব দ্রুতই জান্নাতের সাথে ক্লাসের ব্যাক বেঞ্চারদের সখ্যতা গড়ে উঠলো। যাদের গল্পগুলো থাকতো সব ছেলেদের ঘিরে, রসালো গল্প । সেসব মেয়েদের সাথে স্কুল ব্যাগে সিভিল ড্রেস নিয়ে তা পরে দেয়াল টপকে আবীরের সাথে দেখা করতো জান্নাত। জান্নাত আর আবীর সুরভী উদ্যানে ঘুরে এসেছে…. লাবণ্য জানাতেও পারলো না। শোনার পর কষ্ট পেলো, যেখানে ওরা দুজন সবসময় একসঙ্গেই বেড়াতো। দুষ্টুমি করে টিফিন পিরিয়ডে গিয়ে মিতালি রেস্টুরেন্ট,নুরানি হোটেলেও খেয়ে আসতো। রেল লাইন ধরে হাটতে গেলেও পড়ে যাবার ভয়ে লাবণ্যর হাত ধরে থাকতো আর আজ ওকে ছাড়াই সব চিনে ফেলেছে জান্নাত . …….
লাবণ্য এতো কষ্ট পেলো যে স্কুলে তার অনুপস্থিতি বাড়তে লাগলো। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে রাজশাহী বিভাগে নাচে প্রথম হওয়া লাবণ্য সে-বছর কোনো ক্যাটাগরিতেই অংশ নিলো না। একই জেদে আবৃত্তি বা রচনা প্রতিযোগিতাতে জান্নাতও পার্টিসিপেট করলো না। ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় সাময়িকীতে লাবণ্য প্রথম স্থান থেকে ধপাস করে সপ্তমে নেমে এলো। আর জান্নাত চার সাবজেক্টে পাশই করতে পারলো না।ফার্স্ট হলো তিন রোল ধারী। কথায় বলে,
সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস
অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।
জান্নাতের বাবা প্রথমবারের মতো ওর গায়ে হাত তুললেন। মা’কেও বকাঝকা করলেন। তিনি অন্য রকম ইঙ্গিত দিলেন মেয়ের সম্পর্কে(প্রেম ঘটিত সমস্যা) । তা না হলে এতো খারাপ রেজাল্ট হতেই পারে না। এ সময় একটু আধটু অনেকেরই এমন হয়। বয়সটা যে ভুল করার সময়। ঘরে বসেবসে এতটুকু ব্যাপারও খেয়ালও রাখতে পারো না! কিন্তু ওর মা কিছুতেই এ ব্যাপারটা স্বীকার করলেন না। বলেন, আমার মেয়ে কখনোই এমন কাজ করতে পারে না। সবার আদরে হয়তো একটু দুষ্টু হয়েছে কিন্তু অসভ্য মেয়ে নয়। জান্নাতের বড় বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী,একমাত্র ভাই এবছর ফ্লাইট অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছে। কতো আশা তার ছোট মেয়েটি ডাক্তার হবে। আর ক’টা দিন পরেই প্রিটেস্ট। আর মেয়েটা কিনা……………
এসময় মাইক্রোবাসের ঝাঁকুনিতে জান্নাত বাস্তবে ফিরে আসে। শুভ্র বলে গাড়ি আর যাবে না আন্টি। রিক্সায় যেতে হবে। নীলফামারীর সদর হাসপাতালের পাশ দিয়ে সরু গলি দিয়ে ইট বিছানো রাস্তায় রিক্সায় যেতে যেতে জান্নাত আশপাশটা ভালো করে দেখছিল। কিছু কাঁচাপাকা দোকান, ময়লার স্তুপ, টিন শেড বাড়ি। অথচ লাবণ্যদের প্রাচীর ঘেরা দোতলা বাড়ি রংপুরের অভিজাত এলাকায় ছিল। ওর মায়ের সখের বাগান ছিল। ফুল এবং ফলের।
জান্নাত তাদের সরকারি কোয়ার্টারের থেকে লাবণ্যদের বাসা বেশি পছন্দ করতো। তার সেই মিতার বাসাতেও যাওয়া বন্ধ করে দিল জান্নাতের বাবা । টিভি বন্ধ। শুধু পড়া আর পড়া। কেবল হুমায়ুন আহমেদের “আজ রবিবার ” নাটক দেখা যাবে।
এই নাটকে তিতলি কঙ্কা দু’বোন একই ছেলেকে ভালোবাসে। কিন্তু কঙ্কা তার বোনের জন্য নিজের ভালোবাসাকে উৎসর্গ করে। অথচ ওর লাবণ্যটা এতো স্বার্থপর হলো কি করে! হবেই তো,সে তো আর নিজের বোন নয়! কিশেরী মন, অসহায়ের মতো কতো কি যে ভাবছে জান্নাত।
তখন হঠাৎ জান্নাতের বাবার পোস্টিং হয়ে যায়। ওর বাবা ঠিক করেন উনি চলে যাবেন ফ্যামিলি রেখে। জান্নাতের এসএসসির পরে সবাইকে নিয়ে শিফট করবেন । কিন্তু আবীর তা বিশ্বাস করে না। ও বলে, উনি কাছে না থাকলে তোমার রেজাল্ট আরও খারাপ হবে। দেখো,তিনি তোমাদের সবাইকে নিয়েই যাবেন। আবীর অস্থির হয়ে ওঠে জান্নাতকে হারিয়ে ফেলছে ভেবে। উপায় না পেয়ে বিয়ের কথা বলে জান্নাতকে। ও জানায়,বাবা কুটিকুটি করে কেটে ফেলবে। বাবা কিছুতেই এ বিয়ে মানবে না। বুদ্ধিমান আবীর হাল ছাড়ে না। তার ধারণা যে করেই হোক একবার বিয়েটা হয়ে গেলেই ওনারা না মেনে পারবেন না।
এবার জান্নাতের তার মিতাকে ভীষণ দরকার। স্কুলে গিয়ে ওদের প্ল্যানের কথা লাবণ্যকে জানায়। বলে কথা বলিস আর না বলিস তোকেই হেল্প করতে হবে। তুই মা’কে বলবি আমি তোদের বাসায় থাকবো। লাবণ্য বিস্ময়ে হতবাক হয় যায়। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে: তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! তুই অনেক ছোট। তোর ফ্যামিলি স্ট্যাটাস আর আবীর……. মিলছে না কিছু । আমি কিছুই করতে পারবো না।
ঠাণ্ডা মাথায় ভাব একবার। আঙ্কেল শুনলে হার্ট অ্যাটাক করবে। সামনে এসএসসি। পড়াশোনায় মন দে,দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।
: আমি জানতাম তুই হেল্প করবি না। করার কথাও না। তাহলে তো তোর সুবিধাই হয়, তাই না!
চিৎকার করে ওঠে জান্নাত ।
চলবে…..
৪র্থ এবং শেষ পর্বের লিঙ্ক
https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1692200801294940/?mibextid=Nif5oz