মুঠোভরা_চোরাবালি #আলিশা_আঞ্জুম #পর্ব_৪

0
639

#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_৪

ফাইজার দুঃখ গুলো যখন উচাটন করে বক্ষপিঞ্জরে তখন তাসরিফ তার থেকে বহু হাত দূরে। এমন কি সে বন্দবস্ত করতে বড্ড ব্যাস্ত। সে কি তোরজোর তার। বাহিরে ফকফকা আকাশ। মৃদু শীতল হাওয়া। মা ছেলে ফ্লাট ছেড়ে হাঁটতে বেড়িয়েছিল বাইরে। ছাদ ঘুরে মায়ের সাথে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ পথে তার মুখে উপচে পরা হাসি। ফাইজার কান অব্দি এলো সেই হাসির আওয়াজ। অদ্ভুত! এতোটাই খুশি সে আজ? এমন ঘর কাপিয়ে হাসি দেওয়ার স্বভাব খুবই দূর্বল তাসরিফের ক্ষেত্রে। ফাইজার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। বেলকনির মেঝেতে ঢলে পারে কান্না করলেও এখন উঠে দাড়ালো কৌতুহল নিয়ে। কোমল পায়ে হেঁটে দুঃখী চেহারায় দরজার নিকট এগিয়ে গেলো। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাসরিফের হাসিমাখা মুখটা। তার চাইতেও দ্বিগুণ হাসিখুশি তাসলিমা খাতুন। ফাইজা অবাক হলো। আশ্চর্য আর আফসোসে বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো। মানুষটা এতো পাল্টে গেলো? এতো? যে ফাইজার চোখের কোণে একটুখানি জলের দেখা পেলে জাপ্টে ধরে বুকের মাঝে আড়াল করে নিতো। বলতো,

” এই চোখের জল আমি দেখতে চাই না”

আজ সে স্বইচ্ছায় কাঁদিয়ে নিজে হেসে বেড়াচ্ছে। দৃশ্য খানা বুকে এক আকাশ কষ্ট চাপিয়ে দিলো ফাইজার। অদূর হতে হঠাৎ ভেসে এলো মাগরিবের আজানের ধ্বনি। মা ছেলের কথার ইতি হলো। তাসরিফ পা বাড়ালো নিজের রুমের দিকে। ফাইজা দরজা ছেড়ে সরে দাড়ালো। নিষ্ঠুর, পাষাণ হয়ে যাওয়া ফাইজার আবেগের তাসরিফ একবারের জন্যও তাকালো না ফাইজার পানে। যেন ইচ্ছে করেই না। যেন সে দেখতে চায় না ফাইজাকে। বাক বন্দী করে ফাইজা দাড়িয়ে দেখে গেলো সবটা। তাসরিফ ওয়াশরুম হতে ওজু করলো। ড্রেসিং টেবিল হতে টুপি তুলে মাথায় দিয়ে চলে গেলো মসজিদের উদ্দেশ্যে। একটা কথাও সে বরাদ্দ রাখেলো না ফাইজার জন্য। বুকের জখম চোখে ফুটে উঠলো ফাইজার।

.
দিনটা দূর্বিষহ লাগছে। এমন করে কেন অবহেলা করছে তাসরিফ? সে কি জানে না তার একটা উচ্চবাচ্য ফাইজার চোখে জল নামায়। সেখানে এতো বড় অবহেলার আঘাতে তো ফাইজা ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। তীব্র মন খারাপ নিয়ে ফাইজা এমন কথা ভেবে ভেবেই আলো শূন্য ঘরে বসে পরখ করছে ভেঙে যাওয়া মনের দশা। অনেকটা সময় ফুরিয়ে গেলো। রাত ন’টা বাজতে চলল। তার খেই নেই। চৈতন্য হলো তখন যখন আচমকা ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিলো কেউ। এসি অন করে বিছানায় বসলো কেউ। ফোনটা ফাইজার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল

— সাদ ফোন করেছিল। কথা বলবে৷

ফাইজা পাশ ফিরে চাইলো। তাসরিফ এক হাতে ফোন রেখে অন্য হাতে পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে ব্যাস্ত। ফাইজা সব ভাবনা অতলে ডুবিয়ে নিজের ফোনের সন্ধান শুরু করলো হুড়মুড় করে। ভ্রু জোরা কুঞ্চিত করে তাসরিফ বলে উঠলো

— আমি তো ফোন দিচ্ছি নাকি?

— আমার ফোনটা কোথায়?

— এই যে।

পকেট হতে ফাইজার ফোন বের করে বিছানায় রেখে বলল তাসরিফ। ফাইজা ততক্ষণে মেঝেতে ভর করে দাড়ানো। কিছুটা অবাক হয়ে তাসরিফের দিকে প্রশ্ন ছুড়লো ফাইজা

— তোমার কাছে? আমি কি আজকেও ভুলে কিচেনে রেখে এসেছিলাম?

— হুম।

ছোট করে জবাব দিলো তাসরিফ। অতঃপর ফোন করলো ফাইজার ছোট ভাইয়ের কাছে। ফাইজার হাতে ধরিয়ে দিতে গেলে ফাইলা অভিমান বা ক্ষোভে তাসরিফের ফোন হাতে নিলো না। পুনরায় নিজের ফোন ঘেঁটে ফোন করলো ভাইয়ের কাছে। সাতটা মিস কল ফোনের স্ক্রিনে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলো। কিছুটা ভয় হাতের মুঠোয় রেখে যেন ফাইজা ফোন করলো সাদের নিকট। বয়সে ভাইটা ছোট। তবে ঝাঁঝ, মেজাজ আর বুদ্ধি সবটাতেই বড় ফাইজার চাইতে। ফোন রিসিভ হলো আধা মিনিটের মাথাতেই। ওপাশ হতে ফেটে পরা রাগ নিয়ে বলা হচ্ছে

— তুমি কি মানুষ হবে না আপু? কই থাকো তুমি? ভাইয়া কি তোমাকে দিয়ে শুধু সারাদিন কাজ করায়? বিজনেস তুমি করো নাকি ভাইয়া করে বুঝি না আমি। যাও ফোন রাখো তুমি। কথা নাই তোমার সাথে।

ফাইজা জলে টলমল করা আঁখি নিয়ে ফোনের এপাশে একগাল হাসলো। তোষামোদ করতে আরম্ভ করলো। সাদের অভিমান গলে যাবে এক্ষুনি। এই তো দু মিনিট খোশামুদি করা শেষ। আর তিন মিনিট করলেই ছেলেটার অভিমান উবে যাবে। অতঃপর শুরু হবে তার কতো কথা! জমিয়ে রাখা শতবাক্য। ফাইজা কানে ফোন চাপিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো বেলকনির দিকে। টুপ করে ঝাড়ে গেলো তার চোখের কর্ণিশ বেয়ে এক ফোঁটা জল। সাদের কথাগুলো কানে ধারণ হলেও মস্তিষ্কে ধারণ হচ্ছে না। আপন মানুষ পেয়ে ফাইজার বুকের দুঃখ গুলো তড়পাচ্ছে বাজে ভাবে।

.
অতীতে কে যেন বলেছিল সবার কপাালে সুখ সহে না। কথাটা ফলনা ছিলো না মোটেও। সুখ জিনিসটা মুক্ত। সুখ আপেক্ষিক। সুখকে ধরে বেঁধে রাখা যায় না। ফাইজাও হয়তো পারবে না সুখকে জোর করে তার ঘরে বন্দী করে রাখতে। দিন গেলো দু’টো। ইতিমধ্যে ফাইজা তাসরিফের সম্পর্ক হয়ে গেছে নিরপেক্ষ। কর্মে দীনতা না আসা অব্দি কেউ কারো ধার ধারছে না। মাথায় মাথা রেখে সন্ধি করে নিদ্রায় যাওয়ার আয়োজন ভেঙে চুড়ে হয়ে গেছে এখন নিঃশেষ। দু’দিকে থাকে তাদের মুখ, মন্ডু। কেউ আপন করে পশ্চিম দিককে। কেউ আপন করে পূর্ব দিককে। এখন শুধু বাকি আছে দু’জনের পথটা দু’টো হওয়ার। সে দিনও বেশি দূরে নয়। একথা যেন ফাইজার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো ফাইজার শাশুড়ি। ফাইজা ছিলো রান্নাঘরে। তাসরিফ ড্রয়িং রুমে টিভির সম্মুখে। তাসরিফের বাবা ছেলের মুখোমুখি সোফায় বসে খবরের কাগজে চোখ বুলাছিলেন। এমন সময় তাসলিমা বেগম স্বামীর পাশে বসে টিভিতে চলমান ক্রিকেট খেলার দিকে অমনোযোগী দৃষ্টি রেখে বললেন

— একটা মেয়ে… তাসরিফ তোমার মনে আছে? আমাদের এই শহরেরই একটা মেয়ে। নাম স্নেহা। তোমার বিয়ের পর ভুলে তোমার জন্য সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিল। ভেবেছিলো আমাদের ঘরে বউমা আসেনি এখনো।

তাসরিফের অভিব্যাক্তির একচুল পরিবর্তন হলো না। তবে মনোযোগ বিনষ্ট হলো পুরোটাই। শুঁকবো মুখে শুষ্ক গলায় বলল

— হ্যা মনে আছে।

কথাগুলো ফাইজার কান অব্দি যাচ্ছিলো। খুব বেশি তফাতে নয় কিচেন। ফাইজা রান্না ছেড়ে দুরুদুরু বুক নিয়ে দু কদম এগোলো পূর্বের অবস্থানের চাইতে। তাসলিমা বেগম বলছেন

— বাপ আমাদের বংশের বাতি তো নিভে যাবে। একটু বোঝার চেষ্টা কর। ছোট বেলা থেকে তোর কোনো আবদার অপূর্ণ রেখেছি? মেয়েটার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। আমার বুকে ছুড়ি মেরে ও চলে গেছে। তুই কি এমন করবি?

করুন কন্ঠের বাণী। তসরিফ টিভির পর্দা থেকে দৃষ্টি সরালো না। তাসলিমা বেগম পুনরায় বললেন

— আমি মেয়ে দেখছি। ফাইজা থাকতে চাই…….

— আচ্ছা মেয়ে দেখো তুমি।

সকলকে আশ্চর্য করে দিয়ে তাসরিফ সেকেন্ডের মাঝে বলে ফেলল কথাটা। ফাইজা চমকে উঠলো। কেঁপে উঠলো তার সর্বাঙ্গ। তাসলিমা বেগমও যেন সেকেন্ড কয়েকের জন্য থমকে গেলেন। পরক্ষণেই মুচকি হাসলেন এক বুক আশা নিয়ে। অপ্রত্যাশিত শুভ সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দিয়েছে তাসরিফ।

— কাল তাহলে আমরা স্নিগ্ধাদের বাসায় যাই ? তুমি আর অফিস যেও না কালকে। তোমার বাবাই সামলে নেমে।

তাসরিফ এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। উঠে দাড়িয়ে পা বাড়ালো চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ফাইজা ততক্ষণাৎ একটা শব্দও করলো না। বক্ষে আস্ত দাবানল চাপিয়ে রেখে খুব যত্নে নেভালো গ্যাসের চুলা। হাত মুছলো শাড়ির আচলে। ভেজা গলায় শাড়ির আচল চাপিয়ে সে চলে গেলো রুমে। তাসরিফ ইতিমধ্যে কোলে ল্যাবটপ চাপিয়ে বসেছে। ফাইজা তাসরিফ হতে দু-হাত দূরত্বে দাড়িয়ে বেশ শান্ত কন্ঠে বলতে চাইলো

— বিয়ে পাকা হলো?

তাসরিফ এক নজরে পরখ করলো ফাইজাকে। অতঃপর চিরাচরিত স্বভাবেই সাবলীল ভাবে জবাব দিলো

— না।

ফাইজা ছলছল আঁখি নিয়ে ঠেলতে চাইলো কথোপকথন। বলল

— ওহ হ্যা। কাল তো যাবে তাই না? মা কে বললে না কেন? মা যে প্রশ্ন করলো উত্তর কেন দিলে না?

তাসরিফ ব্যাস্ততা দেখাচ্ছে। ভান করছে এমন যেন তার ফাইজার বলা কোনো কথাই কর্ণপাত হয়নি। ফাইজা এবার চেচিয়ে উঠলো। তাসরিফের মুখপানে দৃষ্টি স্থির রেখে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো

— মা আপনার ছেলে কাল ন’টায় তৈরি থাকতে বলছে। স্নেহাদের বাসায় যাবে।

তাসরিফের নজর ঘুরলো তড়িৎ গতিতে। ফাইজার দিকে চোখ ভরা রাগ নিয়ে আবার নিজে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল

— আমার ন’টায় একবার অফিসে যেতে হবে। এগারোটার দিকে ফিরবো। কোথাও গেলে যোহরের পর।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here