মুঠোভরা_চোরাবালি #আলিশা_আঞ্জুম #পর্ব_৫

0
700

#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_৫

তাসরিফ গলা উঁচিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে ওকথা বললেও ফাইজা একরত্তি প্রতিবাদও করলো না। জোর করা মানা। ভালোবাসা জোর জবর্দস্তি মানে না। ফাইজার মন প্রতীক্ষায় রইলো। তাসরিফ সত্যিই যায় কিনা পাত্রী দেখতে তা অবলোকন করতে চাইলো ফাইজা। পরদিন তাসরিফ অফিসে গেলো। ফিরেও এলো এগারোটার নাগাদ। এখনো ততটা পরিপক্ব নয় ফাইজা। বয়সটা সবে উনিশ। সে কথা বাকিই রাখা যাক। ফাইজার তো সবে উনিশ। স্বামী নামক মানুষটার ওপর কেবল ভিন্ন দৃষ্টি তাক করলেই উনচল্লিশ বয়সের এক নারীরও ক্ষেপে ওঠে। অন্তঃপুরে অগ্নির আগমন হয়। জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায় চোরা চিত্ত। তাসরিফের ভাবখানা বড্ড বাজে লাগা আরম্ভ করেছে। ফাইজার মনকে বোঝানো যাচ্ছে না তাসরিফ পাল্টে গেছে। আবার এ কথা মানতে চাওয়াও বড্ড বোকামি হচ্ছে। তাসরিফ যে শুধু ফাইজারই ছিলো, আছে, থাকবে।

— তুমি তাহলে যাবে?

— কোথায়?

ক্ষণিকের জন্য নির্বাক হয়ে গেলো ফাইজা। তাসরিফ এক ঘন্টা হবে অফিস থেকে ফিরেছে। ফিরে এসেই ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরেছে বিছানায়। তার শরীর বড্ড ক্লান্ত। এমন সময়ই ফাইজা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে তার দিকে।

— হেয়ালি করছো?

বন্ধ চোখ জোরা এক ঝাঁক রাগ সমেত মেলল তাসরিফ। শোয়া থেকে উঠে বসে বলল

— আজব! হেয়ালি কেন করতে যাবো আমি?

— বিয়ে করার জন্য। তুমি তো বিয়ের জন্য মরিয়া। তোমার আর তোমার মা র তো বাচ্চা ছাড়া চলছেই না।

তাসরিফ রেগে গেলো ভীষণ। ফাইজার দিকে ক্ষুব্ধ চাহনি নিয়ে বলল

— ফাইজা ভালো ভাবে কথা বলো। আমার মাথা গরম কোরো না।

ফাইজা শুনলো না। সে বলেই যাচ্ছে

— আজ এগারোটাতেই অফিস থেকে ফিরলে। বিয়ে করার খুব তাড়া তাইনা? তোমরা সব পুরুষই এমন। এতোদিন বাবাকে ভুল বুঝেছি। কিন্তু তোমার চাইতে উনি অনেক ভালো। আমার মা মারা যাওয়ার কারণে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। আর তুমি? বউ বাসায় রেখে, তার কলিজায় পাড়া দিয়ে বিয়ের পিড়িতে বসতে চাইছো। লজ্জা লাগছে না? কতটা নির্লজ্জ তুমি?

— এই চুপ করো তো। তুমি নিজেই তো বড় সেমলেস। তুমি নারী হিসেবে অক্ষম তারপরও পরে আছো আমার কাছে। মুখের কথা কখনো বলেছো যে তুমি বিয়ে করো? আমার কি বাবা ডাক শোনার ইচ্ছে নেই? আমার ইচ্ছে হয় না একটা সন্তানের মুখ দেখার?

তাসরিফের তীব্র বিরক্তির বাক। শুধু যে বিরক্তির তা নয়। যেন বহু দিনের চেপে রাখা রাগও প্রকাশ পেলো তার কথায়। ফাইজা চমকে উঠলো। কথাগুলো যেন সূঁচালো, ধারালো ছুরি হয়ে এসে বিধলো হৃদপিণ্ডে। নিমিষেই উধাও হলো রাগ, তেজ, বিদ্বেষ। অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখলো তাসরিফ কে। তাসরিফের চোখ মুখ শক্ত, নিষ্ঠুর, পাষণ্ডে ভরপুর। অকপটে তাসরিফ কোবরা অহির মতো ফাইজার হৃদয়ে দংশন করে প্রস্থান করলো।ধপ করে তখনই মেঝেতে বসে পরলো ফাইজা। সিক্ত চোখের অশ্রু গড়াগড়ি খেতে নেমে পরেছে গালে। শ্বাস রোধ হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। মনে হচ্ছে তাসরিফের মুখে নিজের অক্ষমতার কথা শোনার চাইতে ঢের ভালো হতো যদি সে মা*রা যেতো।

.
এক নিদারুণ কঠিন ক্ষেত্রে বন্দি হয়ে গেছে ফাইজা। নারীর জীবনের সব চাইতে অভিশপ্ত অধ্যায়ে আজ তারও নাম লেখা হয়ে যাচ্ছে। কিছু অপরাধ না করেও তাকে মাথা পেতে নিতে হচ্ছে অপবাদ। দেখতে হচ্ছে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের জন্য উতলা হওয়া মন। ছিহ! একবুক ঘৃণা এসে হুট করেই জমা হয়েছে তাসরিফের নামে। কিভাবে পারলো তাসরিফ যোহরের পর মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে যেতে? তাসরিফের বাবাও কেমন নির্লিপ্ত। চুপচাপ। সকলে এক মুখো হয়ে গেছে। ফাইজা ঘরের দরজা বন্ধ করে ডুকরে আসা কান্না থামাতে চাইছে। পারলো না সে তাসরিফ কে আটকাতে। তার মায়াবদ্ধ চেহারার মায়া ফিকে করে দিয়ে তাসরিফ চলে গেছে। ফাইজা আঁচলে মুখ চেপে ধরলো। ভেতর হতে বেরিয়ে আসতে চায় উগ্র কান্না। ছলছল চোখ উপচে দেওয়া জল নিয়ে ফাইজা ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। এক শাড়িতে বেরিয়ে পরলো দরজা ছেড়ে, চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে। অবাধ্য ইচ্ছে নাড়া দিলো, পিছু টান জেরালো হয়ে ছুয়ে যাচ্ছে তাকে। তবে তার একটাই ভাবনা। বন্ধ চোখে বিরবির করে বলা

” পিছু ফিরে তাকাবো না আমি। তাকালেই এখানেই মা*রা যাবো। এই ঘর, এই ঘরের মানুষের স্মৃতি গেঁথে যাবে আজন্মের জন্য বুকের দেয়ালে। ”

কথা গুলো মুখ থেকে ছুটে আসার কালে ছুটে এলো চোখ থেকে জলও। আটকানো যায় না এই জল। সহ্য হয়না এই দহন। ফাইজার শরীর যেন শতগুণ ভারি হয়ে এলো। পা ওঠাতে চাইলে তীব্র প্রতিবাদ আসে। যেতে চাইলে মনের এক কোণ হতে আওয়াজ আসে, তাকে ছাড়া থাকতে বড্ড কষ্ট হবে। ফাইজা মন শক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালালো। এক দৌড়ে বেরিয়ে এলো সে ফ্ল্যাট ছেড়ে। অতঃপর হুড়মুড় করে নামতে আরম্ভ করলো সিঁড়ি বেয়ে। তিন তলা হতে একেবারে নিচ তলায় এসে থামলো। দারোয়ান গেটে দাড়িয়ে ফাইজার এরূপ দৃশ্য দেখে ছুটে এলো।ব্যাস্ত গলায় শুধালো ফাইজাকে

— আম্মা আপনার কিছু হইছে?

ফাইজা চেপে গেলো কান্না ও বিষয়। রক্তিম চোখ মুখ নিয়ে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল

— না চাচা। আমি একটু বাড়িতে যাচ্ছি। আপনি গেটটা খুলে দিন।

— কিন্তু আম্মা, এই ভর দুপুরে। এইরকম রোদের মধ্যে।

ফাইজা কথা বাড়াতে চাইলো না। এতো সুন্দর করে এই বরকত চাচা আম্মা ডাকে যে তার মায়া হয়। এ বাড়িতে বউ হিসেবে পদার্পণ করার সাত দিনের মাথাতেই একবার হারিয়ে গিয়েছিল ফাইজা। গ্রাম থেকে এসে শহরের অলিগলির ভীরে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিল। তারই বোকামির দরুন। একদিন ভরা সাঝে তার ইচ্ছে হয়েছিল এবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার। খালা শাশুড়ি কড়া করে অপমান করেছিল গ্রামের মেয়ে বলে। সহ্য হয়নি ফাইজার। ছোট বউ মনে করে নিয়েছিল এই বাড়িটা তিক্ত। এই বাড়ির শাশুড়িটাও শুকনো পাতার মতো। শশুর কথা বলতে জানে না। তার হেলদোল নেই সংসারের কোনো অহেতুক ব্যাপারে। সে কেবল চেনে ব্যাবসা। আর এই বাড়ির ছেলেটা? সে ভিন গ্রহের প্রাণী। তার কাছে ফাইজা নামক কেউ অদৃশ্য। একে চোখে দেখা যায় না। আর বিয়ের পর তো বাবা বলেই দিয়েছিল, ‘যখন মন চাইবে চলে আসবি।’ ব্যাপারই না এই বাড়ির গেট পেরিয়ে একটা গাড়িতে ওঠা। তারপর একদম ফাইজা ঘরের দরজায় নেমে বাবাকে ডেকে এনে টাকা দিয়ে দেবে গাড়ি চালককে। কী ভয়ঙ্কর চিন্তা ছিলো তার! ফাইজা তাচ্ছিল্য ভরা হাসি হাসলো। সেদিন ভবনাটা সহজ হলেও বাস্তবটা বড্ড কঠিন ছিলো। গেটে এসেই বরকত চাচার কাছে শুনলো এভাবে দূরের পথ পারি দেওয়া যায় না। টিকিট কাটা বাঞ্ছনীয়। ফাইজা তখন বরকত চাচাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বলে টিকিটের ব্যাবস্থা করে নিয়েছিল। কিন্তু যাওয়া হয়নি। ফোন করে বসে তাসরিফ। তার বাচ্চা দেখতে একটা বউ নাকি হারিয়ে গিয়েছে। গেট থেকে বেরোতে দেখেছে কিনা বরকত চাচা এমন প্রশ্ন করে। তারপর ফাইজার ফিরে যেতে হয় ঘরে । বরকত চাচা পূর্বে না চিনলেও তাসরিফের বর্ণনায় তখন চিনে গিয়েছিল ফাইজাকে।

— চাচা আজকে আমি হারিয়ে যাবো না। আপনি যে কাউন্টারে নিয়ে গিয়েছিলেন ওখান থেকে আগে টিকিট কাটবো। তারপর বাড়িতে যাবো। চিন্তা করবেন না।

— কিন্তু আম্মা পারবেন আপনি? সবসময় তো তাসরিফ বাবাই নিয়ে যায় আপনাকে। একা তো কখনো যেতে দেখি নাই।

ফাইজা হাসলো। নরম সুরে বলল

— পারতে হবে। অন্যের ওপর আর কতদিন নির্ভর করে চলা যায় বলুন?

বরকত চাচা ফাইজার কথার মর্মার্থ বুঝলেন না। তিনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন এই মেয়েটার দিকে। চোখ মুখ প্রমাণ দেয় মেয়েটা বাঁধ ভাঙা কান্নায় জড়িয়ে ছিলো একটু আগে। ফাইজা এড়িয়ে গেলো বরকত চাচার চাহনি। দ্রুত সে পা বাড়ালো গেইটের দিকে। এখন না গেলে আর যাওয়া হবে না। বেশ কসরত হবে বাড়ি ছাড়তে। না বরকত চাচা যেতে দেবেন, আর না তাসরিফের মা। হয়তো আবারও জোরাজুরি করবে ডিভোর্স পেপারে সই করার জন্য। তবে কিভাবে? কিভাবে সম্ভব ঐ পেপারে সাইন করা? হাত কাপে ফাইজার। সে তাসরিফ কে কথা দিয়ে এসেছে। ফিরে আসবে না সে। ঝঞ্জাট হবে না তার নতুন সংসারে। ফাইজা ভাবনার মাঝে ডেকে নিলো একটা রিক্সা। উঠে বসলো তাতে। হাতের পার্সে দৃষ্টি রাখলো। কিছু টাকা একমাস পূর্বেই তাসরিফ তাকে দিয়েছিল। মাঝে মাঝে এমন করেই হাজার দশেক টাকা ফাইজার হাতে ধরিয়ে দিতো সে। ফাইজা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। চলন্ত রিকশায় বসে দৃষ্টি ফেলে রাখলো অজানায়। ঘর থেকে ব্যাগ গুছিয়ে চলে আসার পূর্বে একটা চিরকুট লিখে ফাইজা রেখে এসেছে টেবিল ল্যাম্পের ওপর। চিরকুটের কথা ভাবতে গিয়েই চোখ সিক্ত হলো পুনরায়। ফাইজার চোখে ভেসে উঠলো চিরকুটটা। কতো যেত্নেই না সে লিখে এসেছে

” ডাক্তার যদি নিজেই চায় রোগীকে মেরে ফেলতে তবে রোগীর বেঁচে থাকার শখটা হয়ে ওঠে তখন বিলাসীতা। তুমি আমার মানুষিক ডাক্তার ছিলে। তোমার কথায় আমি হাসতে বাধ্য হই। তোমার কথায় আমি কাঁদতেও বাধ্য হই। আমি এমন এক রোগী, যে জেনে গেছি আমার ডাক্তার আমাকে মেরে ফেলতে চায়। তবুও পান করে গেলাম চুপচাপ কিছুদিন তার দেওয়া ওষুধ রূপের অবহেলা। শেষ মুহূর্তে এসে আমি সত্যিই মৃ*ত ডাক্তার। ম*রে গেলাম। তুমি আমাকে মে*রে ফেললে। আমার আকাশসম বিশ্বাস এক পলকে ভেঙে দিয়ে পরপর দুবার বললে, ‘ চলে যাও ‘। আমি যাচ্ছি। আমি তো সন্তান দিতে পারবো না। আমি বরং চলেই যাই। তুমি সুখী হও, নতুন সংসার গড়ো। আমি ফিরে আসবো না। ভয় পাবে না মোটেও। শুধু আল্লাহর কাছে বলে দিও, তুমি বিয়ে করে অন্য নারীকে ছুঁয়ে দেখার পূর্বে যেন আমি কাফন ছুয়ে ফেলি।”

চলবে…..

( পরীক্ষার খাতাই রিভিশন দিতে আলসেমি লাগে। তাহলে বুঝে নিন আমি গল্প রিভিশন দেওয়ার কথা চিন্তা করা মানে বিলাসিতা। ভুল অনেক হয়। ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন প্লিজ 🥲 আর রেসপন্স টা 🙂)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here