মুঠোভরা_চোরাবালি #আলিশা_আঞ্জুম #পর্ব_৭

0
750

#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_৭

রেল স্টেশনে পৌঁছেই ফাইজা খোঁজ করলো সাদের। রাত ন’টা বাজতে চলল। সাদ না এলে বড্ড মুশকিল হবে। পথ দু’একটা ল্যামপোস্টের কারণে আলো আঁধারে ছেয়ে আছে । এখানে স্টেশন বলে লোকের আনাগোনা একটু বেশি। অটো নিয়ে পনেরো মিনিটের পথ অতিক্রম করে নিজ গ্রামে পৌঁছালেই দেখা যাবে নির্জন পথঘাট। ফাইজা চিন্তিত হয়ে দাঁড়ালো হলুদ আভা বিচ্ছুরিত করা লাইটের নিকট। একচালা টিন তুলে এখানে তৈরি করা হয়েছে একটা অদৃঢ় ছাউনি। সেখানে অনাদরে পরে আছে একটা টেবিল। একটা ইটের চুলো। হয়তোবা খোলা চায়ের দোকান এটা। ফাইজা একবার চোখ বুলিয়ে নিলো দোকানময়৷ আবার দৃষ্টি রাখলো ছোট বাল্বের দিকে। সাদ যেন তাকে দ্রুত দেখে। চটজলদি যেন খুঁজে পায় তাকে তাই এমন করে লাইটের নিকট দাঁড়ানো তার।

একই স্টেশনে নেমেছে কাব্যও। একই ভাবে দাড়িয়ে ছিলো সে রাস্তার অপর পাশের অন্য এক দোকানে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মাঝে ছাতা বিহীন সে হাটা দেবে কিনা গন্তব্যে এনিয়ে তার বিড়াট ভাবনা। গতবছর বাসা থেকে পালিয়ে এসেও লাভ হয়নি। মুনাফা তো দূরের বিষয়। বৃষ্টি হলো, ঝড় হলো, কাব্য আয়েশ করে ভিজে জ্বর বাধিয়ে বাধ্য হয়ে ছুটলো আবার ঢাকার পথে। এবার যদি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে তবে আর রক্ষে নেই। তার মা গেইট থেকেই সালাম দিয়ে বিদায় জানাবে। কাব্য অনেক ভাবলো। আকাশ পাতাল ভাবলো। অতঃপর হুট করেই নেমে পরলো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মাঝে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পথ চলার পূর্বে অবশ্যই পকেটের ফোনটাকে মুড়িয়ে নিলো পলির মধ্যে। অতঃপর পুনরায় পকেটে রেখে পথ চলতে শুরু করলো। এবার তার দৃঢ় সংকল্প সিলেটের আনাচে কানাচে ঘুড়বে। সব সৌন্দর্য উপভোগ করে, অসাধারণ কিছু ছবি তুলে তবেই ফিরবে ঢাকায়। তার জননী বা বৃষ্টি কেউই এযাত্রায় তাকে আটকাতে পারবে না।

.
ফাইজাকে খুঁজে পেতে একটুখানি কষ্ট হলো সাদের। ছোট এক চায়ের দোকানে তার বোন জড়সড় হয়ে দাড়ানো। সাদ এগিয়ে গেলো উৎফুল্ল মনে। ফাইজা ভাইকে দেখে প্রাণ ফিরে পায় যেন। হাসি ফুটলো তার ঠোঁটে। সাদ প্রথমেই ফাইজার হাতে ধরিয়ে দেয় নিজের মাথার ছাতা। অভিযোগ তোলে আচমকা তাসরিফের নামে

— আপু? তুমি একা কেন? ভাইয়া আসে নি?

ফাইজার মুখমন্ডলের উজ্জ্বলতা হারিয়ে গেলো। ভাইকে দেখে দিনশেষে যে প্রভা মুখে উদয় হয়েছিল সে প্রভা হুট করেই অস্ত নিলো। ফাইজা তবুও চেপে গেলো মন খারাপ। স্বাভাবিক কন্ঠে বলতে চাইলো

— কাজে ব্যাস্ত তো তাই আসার সুযোগ হয়নি।

বোন জামাইয়ের এমন ধরণ সাদের একটুও পছন্দ হলো না। কাজ তো পরেও করা যায়! সে মনে একটুকরো ক্ষোভ রাখলো তাসরিফের প্রতি। অতঃপরও ফাইজার হাত থেকে নিজের হাতে ব্যাগ স্থানান্তর করে বলল

— চলো। তোমার আসতে সমস্যা হয়নি তো?

ফাইজা মাথা নাড়িয়ে ছোট করে বলল

— না।

সাদ আগে আগে হাঁটা শুরু করলো। বোনকে রাখলো পিছে। পা টিপে টিপে তার হাটা। মাঝে মধ্যে সর্তক বাণী ছুড়ে দেওয়া ফাইজার উদ্দেশ্যে। এখানে পা রাখো, কাঁদা আছে, আস্তে হাঁটো আরো কত কি! আবেগী ফাইজার চক্ষু ভিজে যাচ্ছে অনিচ্ছায়। এতো আদর, এতো ভালোবাসা! হঠাৎ ফাইজা দ্রুত হেঁটে ভাইয়ের পাশাপাশি চলে গেলো। নোনাজল আড়ালে মুছে নিয়ে সাদের মাথায় ছাতা ধরে বলল

— ভিজে যাচ্ছিস তো! দুটো ছাতা আনতি।

চলতি দশায় সাদ মাথা ঝাঁকিয়ে চুলের ছিটেফোঁটা পানি ঝেড়ে ফেলল। একটুকরো হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলল

— নাহ! ঠিক আছি আমি।

সাদের কথা গ্রহণযোগ্য মনে হলো না ফাইজার। নিজের মাথার ছাতা পুরোটাই উঁচু করে ধরলো সাদের মাথায়। এত্তোটাই লম্বা হয়েছে তার ভাই যে এক ছাতা উঁচু করে ধরায় ফাইজার আর ঠাঁই হচ্ছে না তাতে। বাদলের ধারাও অল্পে অল্পে বেগবান হচ্ছে। ফাইজা ঈষৎ বিরক্ত নিয়ে বলল

— এতো লম্বা হয়েছিস কেন?

সাদ হেঁসে ফেলল। একহাত দিয়ে ফাইজার থেকে ছাতা নিয়ে ফাইজার মাথায় ধরে বলল

— তোমার ওপরই থাক। আমার লাগবে না। বৃষ্টির সময় বোন পাশে থাকা অবস্থায় ভাইদের ছাতা লাগে না।

ফাইজা চমকে উঠলো সাদের কথায়। অবাক চোখে তাকালো। সাদ গভীর একটা কথা বলে দিয়েছে। বড় বড় কথা। তবে কি সাদ বাস্তবতা বুঝতে শিখেছে? বড় হয়ে গেলো তার ভাই? হয়তোবা! সত্যিই মা হারানো ছেলেটা বড় হয়ে গেছে। চৌদ্দ বছরের বালককে ফেলে বাধ্য হয়ে চোখে পানি দিয়ে শশুর বাড়ি গমন করা বোনকে ছাড়া দিনাতিপাত করতে শিখে গেছে। সে শিখে গেছে পৃথিবীতে মায়ের মতো কেউ হয় না। বোনের মতো আত্মা দিয়ে কেউ ভালোবাসে না। সৎ মায়ের সংসারে বসে সে অনেক জটিল অংকের মুখোমুখি হয়েছে। মুখস্থ, আত্মস্থ হয়ে গেছে সব সূত্র। ঘরে দু’টো কেন তিনটে সুন্দর, ভালো, মজবুত ছাতা আছে। যখন সাদ এই রাতে বোনকে স্টেশন থেকে বাড়ি নিয়ে যাবে বলে দু’টো ছাতা নিতে গেলো বাবার ঘরে। তখনই সাদের সৎ মায়ের সাত পাঁচ কথা। ফাইজা বাড়িতে ফিরছে কেন? ফাইজার ফেরা নিয়েই তার যতো পীড়া। অনেক কথা। হাজার অভিযোগ, একশো একটা অসুবিধা তার। সাদ রেগে যায়। ভীষণ ক্ষেপে একটা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে আসে। শাসিয়ে আসে সৎ মাকে

” আমার বোন আসছে তার সামনে কোনো নাটক করতে পারবেন না আপনি। যদি সে আপনার কোনো কথায় কষ্ট পায় আমি কিন্তু চুপ থাকবো না। আমার আপুর সাথে ভালো ব্যবহার করবেন। ”

সাদের সৎ মা ক্ষেপেছিল ভীষণ। তবে প্রকাশ করতে পারেননি পুরোটা। একটু আধটু ভয় হয় সাদকে দেখলে। স্যাম বর্ণের মায়া ভরা চোখ দু’টো অগ্নি রূপ ধারণ করলেই ভয় হয় আসমার। উপরন্তু মিরাজ সাহেবের শখের ছেলে সাদ।

.
বাড়ি পৌছাতে পৌছাতে রাত দশটা বেজে গেলো। বৃষ্টি মুখর রজনি। কাঁদা মাটিতে মাখামাখি ফাইজার শাড়ি। সাদ বৃষ্টির দরূন কাকভেজা। ফাইজার বাবা মিরাজ সাহেব সন্তানদের জন্য ঘরের সদর দরজা খুলে অপেক্ষায় ছিলেন। বারান্দায় টুকটাক কথার শব্দ কানে যেতেই তিনি ঘর থেকে ছুটে এলেন। ফাইজার বিষন্নতা তালাবদ্ধ করে রাখা বুকের মধ্যে। সে সাদকে হালকা বকার ওপর রেখেছে। কেন এমন করে ভিজলো। আসার পথে ফাইজা তার লম্বা শাড়ির আচলটা ভাইয়ের মাথায় দিয়েছিল কিন্তু লাভের হিসাবখানা শূন্য হয়েছে। বারান্দায় রাখা গামছা সাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ফাইজা ভীষণ বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে রেখেছে। মিরাজ সাহেব এমন সময় নিজের উপস্থিতি জানান দিলেন

— ফাইজা? এসেছিস?

বাবার কন্ঠে ফাইজা পাশ ফিরে চাইলো। বুকের এক স্থানে গাঢ় অভিমান, দৃঢ় অভিযোগ থাকলেও বাবা কে ভালোবাসে ফাইজা। মেয়েদের মন কলিজা হতে চারজন পুরুষ কে কখনো স্থানচ্যুত করতে পারে না। বাবা, ভাই, স্বামী আর ছেলে কে তারা কেবল ভালোবেসেই যায়। আকাশসম অপরাধ করে একটু খানি অণুতপ্ত হলেই মেয়ে জাতি ভুলে যায় সব কষ্ট, তাদের থেকে পাওয়া সব দুঃখ। ফাইজার বাবার লুকানো অনুতপ্ত ফাইজাকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া হতে বাঁধা দেয়। ভীষণ ভাবে বাবাকে এড়িয়ে যেতে চেয়েও থমকে যায় ফাইজা।

— হুম বাবা।

— জামাই আসে নাই? তুই একা?

খানিকটা ভীতু কন্ঠ মিরাজ সাহেবের। ফাইজা নুইয়ে পরলো। তবে হুট করেই আর কেঁদে উঠলো না। যেন ধাক্কা সহ্য করার মতো ক্ষমতা সে আজ অর্জন করে নিয়েছে। মনের দেয়ালে খোদাই করে লেখা হয়ে গেছে, ‘মনে এখন মেঘ জমলেও বৃষ্টি নামানো বারণ’।

বাবার কথার প্রত্যুত্তরে ফাইজা সাদকে দেওয়া উত্তরটাই আওড়াল। অতঃপর গম্ভীর মুখে খোঁজ করলো সৎ মায়ের। জানা গেলো সে ঘুমিয়ে গেছে। ফাইজা নিজ ঘরে চলে গেলো। সাদও বোনের ঘরে ব্যাগ রেখে চলে গেলো আপন ঘরে। ফাইজা ভেজা শাড়িতে বসে রইলো ক্ষণকাল। মনে একটা আশার প্রদীপ নিভু নিভু করে। তাসরিফ ফোন করেছে কি? এমন ভাবনা মনে নিয়ে সে পার্স থেকে বের করে ফোন। আশার প্রদীপ আরো একধাপ মলিন হয়। কোনো ফোন কল নেই। কোনো টেক্সট নেই। ফাইজা চাপা নিশ্বাস ছাড়লো। হঠাৎই বুকে যেন চেপে বসলো ভারি কোনো বস্তু। দৃষ্টি চলে গেলো তার ঘরের টেবিলে জ্বালিয়ে রাখা মোমবাতিতে। মাত্রই ফাইজা চলে যেতো ভাবনার জগতে। ঠিক তখনই আচমকা সাদের ডাক। ব্যাস্ত স্বরে সে খোলা দরজার ওপাশে দাড়িয়ে ডাকছে

— আপু, আপু… ভাইয়া ফোন করেছে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here