পাত্রপক্ষের সামনে বসেও যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না ঐশী,শুধুমাত্র দুইটা ছেলে বন্ধুসহ বান্ধবীদের সাথে রাত অবধি ঘোরাঘুরি করেছিলো বলে বিয়ের বন্দোবস্ত করবে তার বাবা।তাও আবার এক অসুন্দর,বুড়ো লোকের সাথে।হ্যাঁ, একটু আগে এখানে আসার পূর্বে তার একমাত্র ভাবি এটাই বলেছে তাকে।রাগে, দুঃখে কান্না পাচ্ছে ঐশীর।বন্ধুদের সাথে ঘোরার শাস্তি এতো ভয়াবহ জানলে কখনোই সে ঘুরতে যেত না।কিন্তু তারই বা দোষ কিসে!সে কি আর জানতো এতো রাত হবে।আড্ডায় আড্ডায় কখন বেলা গড়িয়ে রাত নেমেছিলো খেয়ালই হয় নি সেদিন।বাবার কথা মাথায় চাপতেই তো তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফিরল।কিন্তু রক্ষে আর হলো না।বাবা ডিক্লেয়ার করলেন এমন বাঁদর মেয়ে অবিবাহিত অবস্থায় ঘরে রাখবেন না।একে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হবেন তিনি।তাছাড়া মুখে চুনকালি লেপ্টে দিতে একটুও ভাববে না ঐশী।যেই ভাবা সেই কাজ।লেগে পড়লেন পাত্রের খোঁজে।ঘটক লাগিয়ে দিলেন শহর জুড়ে।
একের পর এক পাত্রের মাঝে প্রথম চয়েজ করা হলো এক পুলিশকে।ঐশীকে জানানো হলে, সে বললো,
“আব্বু পুলিশ পাত্র আমার পছন্দ নয়।বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ দ্বায়িত্ব কাধে পড়ে ওদের।যদি ফট করে ম’রে যায়।তখন আমার কি হবে?”
কন্যার এহেন যুক্তিতে চটে ওঠেন রাহেলা বানু।
“এক থা’প্পড় খাবি।পাত্র পুলিশ হলেই ম’রে যাবে এ কথা তোকে কে বলেছে?তুইও তো ফ’ট করে ম’রে যেতে পারিস।”
কিন্তু থামিয়ে দেন আনোয়ার খাঁন।যতই হোক,মেয়ের অপছন্দনীয় পেশার ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন না তিনি।পরের বার পাত্র আনা হলো ডাক্তার।তখনও বেঁকে বসল ঐশী।মুখ শুকনো করে বললো,
“ডাক্তার ছেলে পড়তে পড়তে বেরসিক হয়ে যায়।তাছাড়া আমাকে একটু সময়ও দিবে না।এমন ছেলেকে আমার বর হিসেবে চাই না আব্বু।”
আনোয়ার খাঁ মেনে নিলেন।এরপরে আনা হলো উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা।তখনও সে বললো,
“অবশেষে ঘুষখোর পোলা!”
হাল ছাড়লেন না আনোয়ার খাঁ।আরও পাত্র আনলেন।কিন্তু প্রত্যেকবার যখন নিজ কন্যা একটা না একটা বাহানা দিতে লাগলো তখন বুঝলেন মেয়ের মতলব কি।চটে গেলেন তিনি।রুষ্ঠ হয়ে বললেন এরপর যেমন ঘরের সম্বন্ধ আসুক না কেন চোখ বন্ধ করে তার সাথেই মেয়ের বিয়ে দিবেন।ওনার কথা পাঁকা।একবার মুখে যা উচ্চারণ করেন,তা ফেরানো দায়।কোনো দ্বিধা ছাড়াই পাত্রপক্ষকে নিয়ে আসা হলো বাড়িতে।ভাগ্যও ভালো বটে।এস্ট্যাবল পাত্র পাওয়া গেলো,ভার্সিটির লেকচারার।
পাত্রপক্ষের সামনে বসে নতমুখে এসবই ভাবছিলো ঐশী।নিজের প্রতি নিজেরই রাগ হচ্ছিল।কে বলেছিলো এতো বাহানা করতে।এর চেয়ে সে আগের গুলোর থেকে কোনো সুদর্শন পাত্র বিয়ে করতো!নিজের পাকনামোর জন্য নিজেকেই বাঁশ খেতে হচ্ছে তার।লম্বা একটা শ্বাস নেয় সে।মনে মনে স্থির করে এলোমেলো উত্তর দিয়ে পাত্রপক্ষকে ভাগিয়ে দিবে।কিন্তু, প্রায় দশ মিনিট বসে থাকলেও কেও কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করে না।বরং দশ মিনিট নিরবতার পর পাত্রের মা বলেন,
“মাশআল্লাহ!মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে।আপনাদের আপত্তি না থাকলে আজই সম্পর্কের কথা পাকা করতে চাই।”
“আলহামদুলিল্লাহ!আমাদের আর আপত্তি কিসে?এ তো চরম খুশির সংবাদ।”
গদগদ ভাষ্যে বলেন আনোয়ার খাঁন।মুরুব্বিদের বৈঠক বসে বিয়ের দিন তারিখ সহ সব কিছু পাকা পোক্ত করার কাজে।ঐশীকে ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।এসবের মাঝে পাত্র এক বারের জন্যও কোনো শব্দ উচ্চারণ করে না।এসব দেখে বেশ অবাক হয় ঐশী।ফিরতি পথে আড়চোখে একবার পাত্রের দিকে তাকায়।মুখখানা নিচু করে রাখা।হয়তো ঐশীকে একবারের জন্যও দেখেনি সে।আর একটু ভালোভবে ছেলের মুখটা দেখতেই চোখ চড়কগাছ ঐশীর।এ যে সাদাত স্যার!তারই ডিপার্টমেন্টের তরুন লেকচারার।
হতভম্ব হয়ে যায় মেয়েটি।যদি সত্যি সত্যি বিয়েটা হয় তবে তার কি হবে?লোকটা কি একটুও হজম করতে পারবে তাকে?আজ সকালে প্রথম দেখায়ই সে যা করলো স্যারের সাথে তা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে।সকালে দুষ্টুমি করে প্রথম বারের মতো র্যাগ দিয়েছিলো সে।ভুল করে সেটা সাদাতকেই দিয়ে বসে।জোর গলায় সাদাতের উদ্দেশ্যে হাঁকে,
“হেই মিস্টার হোয়াইট কিং,কাম হেয়ার অ্যান্ড শো দিস ক্রাউডেড ক্যামপাস অ্যা ডান্স।”
কলেজে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে এহেন হেলাফেলা মিশ্রিত কন্ঠ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সাদাত।দু’জন অল্প বয়সী শিক্ষার্থীকে দেখে ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করে সে।এরা যে ভুল করে তাকে স্টুডেন্ট ভেবে র্যাগ দিতে ডাকছে সে উদ্দেশ্য স্পষ্ট।বিরক্তি ছড়িয়ে যায় সাদাতের কপালজুড়ে।সামনে তাকিয়ে নিজের গন্তব্যে পা বাড়াতেই ঐশী আবারও ডেকে ওঠে,
“কি রে বেডা কথা না শুনে কই যাস?ইংরেজি বুঝিস না!এদিকে আয়।নাচতে বলছি তোকে।”
ঐশীর এমন আচরণে রাগে সারা শরীর জ্বলে ওঠে সাদাতের।বেয়াদবি সে একদম সহ্য করতে পারে না।চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তার।দুই হাত মুষ্টি বদ্ধ করে নিজেকে সংযত করে সে।অতপর কি একটা ভেবে এগিয়ে যায় দুই কদম।চোখদুটোতে অগ্নিবর্ষন করে তাকায় ঐশীদের পানে।বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে ঐশী ও জেবার মুখশ্রীতে।সাদাতের উদ্দেশ্যে আবারও হাঁকে,
“তুই বলেছি বলে রাগ করেছো ডেয়ার?আচ্ছা যাও,আর তুই তুকারি করব না।মনটা আজকে ভীষণ খারাপ।সুন্দর একটা নাচ দেখিয়ে মন ভালো করে দাও তো!এমনিতেই তোমার সুদর্শন চেহারা দেখে মন হালকা হয়ে গেছে।”
“আসলেই!ইউ আর সো হট গাইস।সাদা শার্টে আরও হট লাগছে।হট একটা পারফরম্যান্স আশা করছি।”
পাশ থেকে বলল জেবা।অট্টহাসিতে মেতে উঠল দু’জন।সাদাতের ইচ্ছে হল ঠাটিয়ে দুটি চ’ড় মে’রে দুইজনের গাল লাল করে দেয়।কিন্তু এতো বড় শিক্ষার্থী, উপরন্তু মেয়ে বলে নিজের ইচ্ছাকে দমন করে সে।দাঁতে দাঁত চেপে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“চিন্তা করবেন না,আমি নাচ না দেখালেও কিভাবে নাচাতে হয় সেটা দেখিয়ে দিব আপনাদের।পাশাপাশি সারা জীবনের নাচ দেখার ইচ্ছেটাও মিটিয়ে দিব।জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড সি।”
সাদাতের উক্তিতে হো হো করে হেসে উঠল দুটি প্রান।হাসির মাত্রা কমিয়ে কিছু একটা বলতে অধর ফাঁকা করতেই একহাতের তালু দিয়ে তা আটকে ধরে সাবিহা।মাত্রই ওদের কাছে এগিয়ে এসেছে সে।আর এসে এই অবস্থা দেখে ভয়ে জমে যায়।ঐশীর পরবর্তী পদক্ষেপের চিন্তা মাথায় আসতেই কন্ঠ রোধ করে ওর।অপরাধী গলায় আওয়াজ তোলে সাদাতের উদ্দেশ্যে,
“সরি স্যার।ওরা আসলে আপনাকে চিনতে পারে নি।ওদের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি।ভবিষ্যতে আর এমন হবে না।আপনি দয়া করে বিষয়টা সিরিয়াসলি নিবেন না।”
সাবিহার কথা শুনে ভড়কে গেল দু’জনে।এই ব্যক্তিকে সাবিহা স্যার সম্বোধন করছে কেন?তারমানে কলেজে কয়েকদিন আগে নতুন লেকচারার হিসেবে সামনের ব্যক্তিটি জয়েন করেছে?প্রশ্নরা হামাগুড়ি খেতেই চট করে উত্তর মিলে যায়।অপরাধী নয়নে তাকায় সাদাতের দিকে।যে অগ্নিমুর্তি ধারন করে আছে,আদোও কি এ অপরাধের ক্ষমা তারা পাবে?মিন মিন স্বরে দুজনেই আওয়াজ তুলে বলল,
“সরি স্যার।আমরা আসলে চিনতে পারি নি।”
সাদাতের অভিব্যক্তি পরিবর্তন হল না।জুতা মেরে গরুদান করলেই কি আর অপরাধ ঘুচে যায় নাকি?অপরাধ অপরাধই,এর সাজা হওয়া আবশ্যক।এর জন্য তাদের কঠিন শাস্তি দিবে সে,মনে মনে ভেবে নিল একবার।এক পলক ঐশী ও জেবার দিকে তাকিয়ে কয়েকটা কটু কথা শুনিয়ে দিল।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“চিন্তা করবেন না।এমন ব্যবস্থা করবো এই ভার্সিটির সাধারণ একটা কাকও আমাকে চিনতে পারবে।আর আপনারা তো মানুষ।সরি একটু কারেকশন দরকার,মনুষ্যত্বহীন মানুষ।”
লজ্জায় অপমানে মাথা নুইয়ে ফেলে ওরা।নিজের রাগ সম্পূর্ন ঢেলে দিয়ে গট গট আওয়াজ তুলে প্রস্থান করে সাদাত।ভয়ে আর ক্লাস করার সাহস হয় নি তাদের।ক্লাস বাঙ্ক মেরে সারাদিন ঘুরেছে তিনজন।আর রাতে কি না তার সাথেই বিয়ের কথা চলছে?
এ কেমন গ্যাড়াকলে পড়লো ঐশী!চিন্তায় পায়তারা শুরু করে সে।হটাৎ শাড়ী গহনা নিয়ে রুমে তার ভাবি প্রবেশ করে।মিটমিট হেসে বলে,
“কি রুপ দেখাইলা ননদী।ওরা তো তোমাকে রেখে যেতেই চাচ্ছে না।এখন এসব পড়ে রেডি হয়ে নেও।আর তখন মজা করে জামাই বুড়া বলেছি বলে মন খারাপ করো না।সত্যিটা বললে তো আমার নজরে দোষ দিতে।এত্তো সুদর্শন ব্যক্তি হাজারে একটা।”
ঘাম ছুটে ঐশীর।ওরা রেখে যেতে চাচ্ছে না মানে!তবে কি কপালে এটাই ছিলো?
চলবে
#শতদলের_ভীরে
#সুচনা_পর্ব
#মুসফিরাত_জান্নাত