#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_২০
অবাকের আস্ত একটা পাহাড়, দুশ্চিন্তার নদী আর কেমনতর এক অনুভূতি আমার হাতে তুলে দিয়ে স্মরণ চলে গেলো। চাচি আম্মা ব্যাস্ত পায়ে হেঁটে এসে আবারও জবাব চাইলেন
— তুই কেন জামাইকে ফোন দিয়েছিস?
আমি দিশে হারা দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। সত্যিটা হলো আমার কাছে আছে একটা ছোট মুঠোফোন। তাতে স্মরণের নাম্বারের অস্তিত্বও নেই। সে যে দামি এক ফোন আমাকে জাহিনের মাধ্যমে দিয়েছে তা এখনো ইনটেক করাই আছে। তাকে আমার ফোন দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।
— আমি ফোন করিনি আম্মা।
চাচি আম্মা মানতে নারাজ। সে চাপা গলায় শুরু করলেন তর্জন গর্জন। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে তাকে দেখে গেলাম। এখনো তিনি আগেরই মতো স্বার্থপর। আজও সে আমার প্রতি অন্যায় করে নিজেকে পার করতে চাইছে স্বচ্ছ স্থানে।
.
মাগরিবের নামাজ আদায়ের পর প্রতীক্ষা, ভাবনা। চাচি আম্মা আমাকে এভাবে ডেকে এনে ফেঁসে দিলো? আমি কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই। কম্পমান হৃদয় নিয়ে স্থির বসে রইলাম। লজ্জার সাগরে ডুবে গেছি অনেক আগে। আমার কাছে অঙ্কন কিংবা স্মরণ দুজনের উপস্থিতই দূরকল্পনার।
অপেক্ষার গন্ডি হলো দশ মিনিটের পথে। আমাকে ডাকা হলো। ছোট চড়ুয়ের মতো আমার ইচ্ছে হলো জানালা দিয়ে সব এড়িয়ে উড়ে যাই দূরে কোথাও। চাচি আম্মা স্থির বসে রইলেন। আমার কেন জানি না চোখে জল নেমে এলো। এক বিন্দু স্বস্তি মনে অবশিষ্ট নেই এসবের কবলে পরে। স্মরণকে মনে মনে দোষারোপ করে গেলাম। আমার করা অভিযোগের পাল্লাটা ক্রমেই ভারি হচ্ছিলো যখন। ঠিক তখনই হঠাৎ অনুভব করলাম কেউ এলো পাশে। আমার হাতটা ধরলো খুব শক্ত করে অতঃপর যথাসম্ভব দ্রুত বেগে হাঁটা দিলো। কিছুটা চমকে তাকালাম পাশের মানুষটার দিকে। চোখে পরলো অফ হোয়াইট রঙের পাঞ্জাবিওয়ালাকে। কানে বাজলো
— বিয়ে করার ইচ্ছে আছে নাকি? হাঁটতে এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? কি মনে হয় তোমার? দাড়িয়ে দাড়িয়ে বউয়ের বিয়ে দেখবো? তারপর প্যানিক অ্যাটাক করে বাসায় যাবো? নেভার ইভার। যেটা আমার ওটা আমারই।
তার কথাগুলো শুনে আমি চলতি পথে হতভম্ব হয়ে গেলাম। সে একপ্রকার টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। ড্রয়িং রুমে পৌঁছেই সে স্থির হলো। তখন আমি এক পলক সকলের মুখ দর্শন করে নিয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলাম। কয়েক জোড়া উৎসুক চোখ তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। আচমকাই আমার মনে হলো স্মরণ ঘামছে। অপ্রস্তুত সে। আমি ঝট করে তার পানে তাকালাম। উপলব্ধিটা মিথ্যা ছিলো না। তার বুকের কম্পিউটার যেন আমি পাশে দাড়িয়ে শুনছিলাম। সে বেজায় অপ্রস্তুত ভাব ঠেলেঠুলে সরিয়ে দিয়ে বলল
— অঙ্কন, খেয়া আমার বউ।
এটুকু বলেই স্মরণ থামলো। আমি চোখ তুলে তাকালোর সাহস করলাম না অঙ্কনের পনে বা উপস্থিত অন্য কারো দিকে। শুরু বুকে দূর্বল একটা জোর নিয়ে হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম স্মরণের পানে। নজর কাড়া সৌন্দর্যের, গম্ভীর স্বভাবের, আমার সাথে অল্প সল্পতেই রাগ দেখানো লোকটা আজ আমার মনের অবস্থা বড্ড দুরূহ করে দিচ্ছে। নতুন নতুন কাজে কথায় চমকে দিচ্ছে আমাকে।
— আমাদের বিয়ের সময় তুই আন্টি আঙ্কেলের কাছে ছিলি। কানাডাতে। আমাদের বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে হয়নি। তাই কাউকে জানানোর কথা ভাবিনি। বাবার জোরাজোরিতে বিয়ে করা। কিন্তু এখন সি মিনস অ্যা লট টু মি।
আমি চোখের পলক না ফেলে এখনও তাকিয়ে রইলাম স্মরণের দিকে। উপস্থিত সকলে বিষ্ময়কর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। অঙ্কনই যেন কেবল স্থির, নিষ্প্রাণ হয়ে তাকিয়ে রইলো।
.
যথারীতি একটা ভুল বোঝাবুঝির ইতি হলো। তবে অঙ্কনের মা খালি হাতে ফিরতে বেজায় নারাজ ছিলেন। হুট করে তিনি সকলকে অবাক করে দিয়ে প্রস্তাব করে বসলেন, তার একটা মেয়ে চাই। আজই চাই। যে উদ্দেশ্যে আসা হয়েছে সে উদ্দেশ্য পূরণ করা চাই৷ আর এতোসব ‘চাই’ পূর্ণতা পাবে যদি প্রিয়াকে পাওয়া যায়। প্রিয়া লাফিয়ে উঠলো এ প্রস্তাব শুনে। ভীষণ আপত্তি তার। অঙ্কনের সম্মুখে আপত্তি লুকাতে না পেরে সে বলেই উঠলো
— অসম্ভব, আমি কোনো ছ্যাকা খাওয়া ব্যাক্তিকে বিয়ে করবো না। নেভার।
অঙ্কন প্রতিবাদ করতে ভোলেনি। ধমকে ওঠে। মুহূর্তেই তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যায় দুজনার। সকলেই শুধু বিনাবাক্যে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। কেউ বাঁধা বা নিষেধ করতে গেলো না। একটু টক, একটু ঝাল, একটু মিষ্টি কথা দিয়ে তারা যেভাবে ঝগড়া করছিলো তাতে আমার মনে হলো, ওদের সন্ধিটা খারাপ হবে না। সংসারটা জমবে। জানি না আমার প্রতি অঙ্কনের ভালোলাগা আছে নাকি ভালোবাসা। তবে যাই থাকুক। আমি বলবো সব উবে যাক।
.
স্মরণ উৎসাহ নিয়ে ক্ষণিকের মাঝেই ফোন করে কথা বলে নিয়েছে প্রিয়ার মা-বাবার সাথে। খচ্চর মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য বেশ কিছুদিন হলো আঙ্কেলের প্রচেষ্টা ছিলো। ঠিকঠাক ছেলে মিলছিলো না যেন। আজ প্রস্তাব পেয়ে তিনি আসছেন এবাড়িতে। সব দেখে মুখটা শুকিয়ে গেলো চাচি আম্মার। ওয়ারেসিয়াকে নিয়ে চিন্তিত থাকলেও মুখে কিছু বলার সাহস যেন করে উঠতে পারলেন না স্মরণের কারণে। তবে তাকেও অবাক করে দিলো স্মরণ। প্রিয়ার মা বাবার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে নিজে হঠাৎ লাপাত্তা ছিলো মিনিট বিশের মতো। এক যোগে সবার যখন আগমন ঘটলো তখন সাথে ছিলো ওয়ারেসিয়ার প্রিয় মানুষটাও। ছেলের মা বাবা বাকি ছিলো না। চাচি আম্মা ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু বলার পূর্বেই স্মরণের উক্তি হলো
— ছোট মানুষ দু’জনেই। বাদ দিন। ওদের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। আপাতত শুধু ওদের বিয়েটা না হয় আমরা দিয়ে রাখি। তারপর যোগ্য হলে ওরা সংসার করবে না হয়৷
চাচি আম্মা আপত্তি জানানোর কথা ভুলে গেলেন। কেন যেন মেনে নিলেন স্মারণের কথা। ছোট আব্বুকে ফেন করা হলো। মুহূর্তেই বাড়িতে উৎসব আমেজ ভর করলো। রোজার দিনে বিয়ে হচ্ছে। যুগের দুষ্কর, গণ্যমান্য ব্যাপার। আমি দেখে যাচ্ছি ব্যাপার গুলো। কিছু বলার ছিলো না আমার। সকলের বাড়িতে এসে জমতে জমতে রাত দশটা পেরিয়ে গেলো। সকলে ভীষণ ব্যাস্ত আলোচনা নিয়ে। গুরুজনদেের ভাবনা। প্রিয়া এরমাঝে আমার নিকট দৌড়ে এসে বলে গেলো
— দোস্ত আমি বলেছিলাম এই ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হওয়া বেডারে বিয়ে করবো না। কিন্তু তোর বুইড়া জামাই আব্বুকে নিয়ে এলো। আমার মা তো ডাক্তার বলতে পাগল। আরো ভয়াবহ কথা হলো আম্মু নাকি এই হৃদয় পোড়া ডাক্তারের পেশেন্ট। আমাকে তো বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। নিলীমা, শান্ত, সজিবকে কি ফোন করা উচিত দোস্ত? যদি বিয়েটা সত্যিই হয়ে যায়? আমারও কেন জানি মনে হচ্ছে দশ মিনিটের ঝগড়ার মাঝে আমি আমার বিশ বছরের হৃদয়টা হারিয়ে ফেলেছি।
চঞ্চলতায় যেন প্রিয়া দিশেহারা। আমি কিছুটা বিরক্ত ওর কিছু শব্দে। সোজা কানে আঙুল ঢুকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম অন্যদিকে। সময় ফুরিয়ে রাত বারোটায় ঘড়ির কাটা। সকলের সিদ্ধান্ত স্থির হলো আজ বিয়ে পরিয়ে রাখা হবে। কাজি হাজির করা হলো। প্রিয়া আর ওয়ারেসিয়াকে সাজিয়ে গুছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পরলো আমার ওপর। হালকা সাজ। শুধু শাড়ি পরাতেই সমাপ্ত। ছেলেদের কবুল বলার পালা শেষে এঘরে কাজি এলো মেয়েদের মতামত নিতে। আমি দাড়িয়ে ছিলাম প্রিয়া আর ওয়ারেসিয়ার নিকট। বেশ স্বাভাবিক ছিলাম। আমার স্বাভাবিক ভাবটা হত্যা করা হলো। স্মরণ আচমকা আমার পাশ ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়ে গাল পরিষ্কার কারার ভঙ্গি করে চাপা কন্ঠে বলল
— তোমার কি বিয়ে বিয়ে ফিলিংস হচ্ছে? আমার কেন জানি বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে। তোমাকে আবার বিয়ে করে শক্ত করে বাঁধন দিতে মন চাইছে।
আমি যেন ঠাস করে চমকে উঠলাম। দ্রুত গতিতে মাথা তার দিকে ফেরাতে চাইলাম। সেখানে ঘটলো বিপত্তি। ঘুরতে গিয়ে সংঘর্ষ হলো তার থুতনির সাথে। সে এক ঝাঁক বিরক্তি আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল
— হোয়াট রাবিশ খেয়া? বিয়ের জন্য কেউ এতো পাগল হয়? আমি জাস্ট মজা করছিলাম। কাজি সাহেব বউ ক্ষেপে গেছে। সবার বিয়ে দেখে তারও নাকি বিয়ে করার ইচ্ছে হয়েছে। আমাদের বিয়েটাও পরিয়ে দিন।
স্মরণের কথা শুনে যেন আমি সপ্তম আকাশ থেকে ছিটকে পরলাম। চোখ চরক গাছ হয়ে গেলো। এতো রীতিমতো কৌশল করে ফাঁসানো হচ্ছে আমাকে!
চলবে…..