#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৪
মোহের হাসি পেল। কিন্তু হাসতে চাইল না। লুকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। মৃদু হেসে ফেলল রাস্তার পানে তাকিয়ে। কেননা, তার দৃঢ় বিশ্বাস সেই একবচন মানুষটি সে নিজেই। পরক্ষণেই মুখ মলিন হয়ে গেল মোহের। দ্রুত নিজের হাতে থাকা ইয়াকীনের ফোনটি নিয়ে ডায়াল করে নিজের বাবার নম্বর। স্বচ্ছ মোহের হাতের ফোন দেখে বলল,
“ফোন তোমার কাছে ছিল? জানাতে পারতে তো তাহলে সবাইকে তুমি কী অবস্থায় ছিলে।”
“আমাকে কি দেখতে বোকা মনে হয় আমার?”
পাল্টা প্রশ্নে স্বচ্ছ সোজা উত্তর করল,
“না, একদম না। মাঝে মাঝে দেশী মরিচ, মাঝে মাঝে মঞ্জুলিকা মনে হয়।”
মোহের রাগ হলেও সেসব নিয়ে তর্ক না করে বলল,
“যে আমায় কিড/ন্যাপ করেছিল তার ফোন নিয়ে এসেছি।”
স্বচ্ছ দ্রুত গাড়ির ব্রেক কষে। মোহের দিকে সন্দিহান হয়ে তাকায়। দ্রুত নিজের ফোনটা বের করে নেয়। একটা ছবি বের করে বলে,
“এই সেই লোক যে তোমায় কিড/ন্যাপ করেছিল?”
মোহ একপলক তাকিয়েই ফট করে বলে ফেলে,
“হ্যাঁ সেই লোকটাই তো। যে আমায় ব/ন্দি করে রেখেছিল।”
স্বচ্ছ ফোনের বাটন জোরে চাপ দিয়ে অফ করল। একটু একটু করে স্বচ্ছের মন থেকে যেন অনেক হাত নিচে নেমে গেল সরোয়ার সাহেবের প্রতি সম্মান। বিষিয়ে উঠল অন্তর। নিজের বাবার প্রতি তিক্ততা হয়ে উঠল প্রগাঢ়। ক্রোধের আগুনে ধ্বংস করতে ইচ্ছে জাগল আশপাশ। কিন্তু সে চুপ রইল। মোহ আকুতি করে বলল,
“একটু দ্রুত চলুন প্লিজ। বাড়ির সবাই অনেক চিন্তা করছে। আর ইথান নিশ্চয় কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে পড়েছে। আমি ছাড়া ও একটা কাজও করেনা।”
স্বচ্ছ বড়ো বড়ো শ্বাস নিলো কয়েকটা। সম্মতি জানিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে শুধাল,
“ইথানকে অনেক ভালোবাসো তাই না?”
মোহ মলিন হাসে। বলে,
“ওকে ভালোবাসি বলেই ওর জন্য আমার পুরো গ্রামের সাথে মনমালিন্য তৈরি হয়েছে। সকলে আমায় লাঞ্ছিত করেছে। আমি দমে যাইনি শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। আমি আর আমার পরিবার বাধ্য হয়ে গ্রাম ছেড়ে এসেছি। শুধু ইথানের মুখে দিকে চেয়ে। এখনো যখন তখন লোকজনের তিক্ত কথা শুনতে হয়। তবুও ওর প্রতি কখনো বিরক্ত হইনি। একটা সন্তানের প্রতি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা তার মায়েরই বোধহয় থাকে। সেটা যেই মা-ই হোক।”
শেষ কথাটি বেশ ধোঁয়াশা লাগল স্বচ্ছের। কৌতূহলী চোখে একবার চেয়ে জানতে চাইল,
“মানে?”
“মানে আবার কী? আমি বিশ্বাস করি মা তো মা-ই হয়। সেটাই বলতে চাইছি।”
স্বচ্ছ আরো কথা বাড়ানোর আগে মোহ কল করল তার বাবা আজহার সাহেবকে।
ইথানের কান্নাকাটি থামানোর প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন আজহার সাহেব। কোলে করে তুলে পিঠে হাত বুলিয়ে থামানোর চেষ্টা করলেও ইথান ক্ষণে ক্ষণে ফুঁপিয়ে উঠে বলছে,
“মায়ের কাছে যাব। মাম্মা কোথায়? আসছে না কেন?”
আজহার সাহেব বারংবার একই শান্তনা দিয়ে যাচ্ছেন,
“এসে যাবে সোনা। রাস্তায় আছে তোমার মাম্মা।”
তবুও ইথান থামার নয়। এমতাবস্থায় আজহার সাহেবের ফোনে কল এলে তিনি পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখেন অচেনা নম্বর থেকে কল এসেছে। প্রচণ্ড উত্তেজনায় আগপাছ না ভেবে কল রিসিভ করেন উনি। মোহ অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“বাবা!”
আজহার সাহেবের চক্ষুদ্বয় আকারে বড়ো হয়। কলিজায় যেন পানি আসে এত সময় পর মেয়ের মুখে বাবা ডাক শুনে। বিচলিত হয়ে জানতে চান,
“মোহ মা! কোথায় আছো? কী অবস্থায় আছো? ভালো আছো তো? কোথায় গিয়েছ তুমি মা?”
“বাবা আমি এখন ঠিক আছি। তুমি চিন্তা করো না। আমি বাসায় আসছি। গিয়ে সব বলব তোমাদেরকে। মা কেমন আছে? চিন্তায় কি কান্নাকাটি করছে?”
“সেটা করা তো স্বাভাবিক। আমারই তো চোখ ভিজে আসছিল তোমায় চিন্তায়৷ তোমার মা অস্থির হয়ে উঠেছে।”
মোহ আশ্বস্ত করে বলল,
“মাকে চিন্তা করতে মানা করো। আমি ফিরছি বাড়ি।”
“বাড়িতে তো আমরা কেউ নেই। গ্রামে এসেছিলাম তোমার খোঁজে।”
তৎক্ষনাৎ ইথানের কাঁদার আওয়াজ শুনতে পায় মোহ।
“বাবা! ইথান কাঁদছে? ওকে একটু ফোনটা দাও।”
আজহার সাহেব ইথানের দিকে চেয়ে বললেন,
“ইথান! এইযে তোমার মায়ের ফোন এসেছে। কথা বলো নাও।”
ইথান কানে ফোন ধরে আরো কান্না বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“মাম্মা! তুমি কোথায়?”
মোহ চটপটে কণ্ঠে বলল,
“আমি রাস্তায় ইথান। কিন্তু আমি তো এই বাসায় যাচ্ছি। এখন গ্রামের বাসায় যেতে পারব না তো। আজকের রাতটা তুমি দাদুভাইয়ের কাছে থাকো। কাল সকাল সকাল এখানে চলে এসো দাদুভাইয়ের সাথে। আজকে একটু লক্ষী ছেলের মতো থাকো। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”
ইথান বিষণ্ণ হয়ে বলল,
“তুমি আমায় ছেড়ে বাসায় চলে গেছো?”
“আমার কাজ পড়ে গিয়েছিল যে। এই কাজে বাচ্চাদের আনা যায় না। আজকের রাতটা থাকো ওখানে। ঠিক আছে?”
“আচ্ছা।”
ইথানের থেকে ফোনটা নিয়ে আজহার সাহেব বলেন,
“বাড়ির এক্সট্রা চাবি বাড়িওয়ালার কাছে জমা দিয়ে এসেছি। সাবধানে থেকো। বুঝতে পেরেছ?”
মোহ সায় জানিয়ে আরো কিছু কথা বলে কেটে দিলো ফোন। স্বচ্ছ প্রশ্ন করল,
“ইথান কাঁদছে?”
“হুঁ। আমার কাছে আসার জন্য বায়না করছে শুধু।”
“তুমি কি গ্রামে যেতে চাও? তুমি বললে গ্রামে পৌঁছে দিই তোমায়?”
“না তার কোনো দরকার নেই। অনেক রাস্তা এখান থেকে গ্রামে। আপনাকে এত কষ্ট করার প্রয়োজন নেই। আমাকে বাড়ি অবধি দিয়ে আসুন। আপনার শরীরও ভালো নয় এখনো।”
স্বচ্ছ প্রতিত্তোরে আর কিছু বলল না। মোহের চোখ লেগে আসছে। ক্লান্তিতে ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। চারিপাশ ঝাপসা লাগছে তার। হঠাৎ বলল,
“আমি একটু ঘুমোতে চাই। আমার বাড়ি অবধি পৌঁছে গেলে একটু ডেকে দেবেন?”
“ঘুমাবে এখন তুমি?”
মোহ কপাল কুঁচকে বলে,
“হুঁ। কোনো সমস্যা?”
“আমার তো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি ঘুমালে তোমার সমস্যা হবে না তো?”
স্বচ্ছের ভনিতা দেখে আঁড়চোখে তাকায় মোহ। বলে,
“কী সমস্যা?”
“তুমি ঘুমিয়ে পড়লে যদি তোমায় বাড়িতে না গিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে চলে যাই? আমাকে বিশ্বাস করে আমার গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়া কি ঠিক হবে?”
“তা আমায় কোথায় নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে?”
স্বচ্ছ চোখজোড়া সরু করে। সামনের দিকে মনোযোগ দিয়ে বলে,
“যে কোথাও! ধরো, যদি নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রেখে দিই?”
মোহ অন্যদিকে ফিরে চোখ বুঁজে নেয়। নির্লিপ্তে বলে,
“তাহলে আপনাকেও ওই কিড/ন্যাপারের মতোই উল্টো ব;ন্দী করে চলে আসব। সিম্পল!”
স্বচ্ছ চকিতে তাকায়। অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়,
“কী করেছ তার সাথে তুমি? বলো!”
মোহ আর উত্তরে কিছু বলে না। বলতে চায় না। স্বচ্ছ ফের জিজ্ঞাসা করে,
“এই বলো! কী করেছ ইয়াকীনের সাথে।”
মোহের নীরবতায় থামে স্বচ্ছ। হয়ত ঘুমাচ্ছে সে। আর বিরক্ত করে না সে। মনোযোগ দেয় নিজ
কাজে।
মোহের বাড়ি যাওয়ার গলির সামনে গাড়ি থামায় স্বচ্ছ। মোহ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। দিনভর ক্লান্তির ফলে আশপাশটা খেয়াল নেই মেয়েটির। স্বচ্ছ তাকে জাগায় না। নিজের ফোনটা বের করে কল করে সৌমিত্রকে।
বাহিরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ব্যস্ত সৌমিত্র। আড্ডার মাঝে ক্যারাম খেলা চলছে। নিজের ফোনটা বেজে ওঠায় একটু দূরে সরে গিয়ে কল রিসিভ করে সে। স্বচ্ছ ভালোমন্দ জিজ্ঞেস না করে সরাসরি বলে দেয়,
“কোথায় আছিস তুই?”
সৌমিত্র আমতা আমতা করে। পরক্ষণেই ফট করে বলে,
‘তোমার মোহের চিন্তায় ভীষণ চিন্তিত ছিলাম ভাই। তাই ভাবলাম বন্ধুদের সাথে কথাবার্তা বলে নিজের চিন্তা দূর করি।”
স্বচ্ছ ধমকে বলে ওঠে,
“নিজের চাপার জোর কমাবি নাকি কানের নিচে খাবি আজকে? কত চিন্তা তোর আমার জানা আছে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিস তাই তো? তাহলে ওদের সাথে মিলে আমার একটা কাজ করে দে।”
“কী কাজ?”
“ইয়াকীনের ডেরায় গিয়ে দেখ। ও আছে কিনা খোঁজ কর। ওকে পেলে ওরে নিয়ে সোজা ক্লাবে নিয়ে আসবি। ওকে রেখে দিবি। তারপর আমি আসছি।”
সৌমিত্র বাধ্য ছেলের ন্যায় বলে,
“আচ্ছা ঠিক আছে। মিস. মোহকে পেয়েছ তুমি?”
“হুঁ। আমার সাথেই আছে।”
খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,
“হাউ রোমান্টিক! রাতের বেলা, ঠাণ্ডা হাওয়া, একই গাড়িতে তুমি আর তোমার পছন্দের নারী…”
স্বচ্ছ দ্রুত কল কাটে। রাগে বিড়বিড়িয়ে মোহের মুখের পানে তাকায়। অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না তাকে। তবে তার অবয়ব তার চোখ, নাক, মুখ সবটাই তুলে ধরেছে যেন। এই ঘুমন্ত নারীকে জাগিয়ে বিরক্ত করা কি উচিত হবে?
মোহ জাগল প্রায় আধঘন্টা পর। আস্তে করে দুর্বল চোখ দুটো খুলতেই বুঝতে পারল মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। মাথায় একহাত রাখল। পাশে তাকিয়ে দেখল স্বচ্ছ নিজের ফোন ধরে কী যেন করছে। মোহ আশেপাশে তাকাল। এটা তার চেনা রাস্তা। তারই বাড়ির সামনের গলিটা। গলা খাঁকারি দিয়ে মোহ প্রশ্ন করল,
“বাড়ির সামনে এসে পড়লে ডাকতে বলেছিলাম তো। তা না করে কী করছেন আপনি?”
স্বচ্ছ হালকা কেশে নিজের কণ্ঠস্বরে খামখেয়ালি ভাব আনার চেষ্টা করে বলল,
“ওহ! আমি একটু গেম খেলছিলাম।”
মোহ ফোনের দিকে চাইল। ব্যঙ্গ করে বলল,
“আজকাল বুঝি ফোন উল্টো করে গেম খেলে? এটা কি ফোনের নতুন সিস্টেম? আমি বোধহয় বেশি ব্যাকডেটেড হয়ে গেছি। তাই বিষয়টা সম্পর্কে জানিনা।”
স্বচ্ছ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে মোহের তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ হজম করে নিলো। তার চালাকি কখনোই মোহ নামক মেয়েটির সামনে ফলে না। বোকা বনে যায় মাত্র এবং মাত্র মোহের সামনেই। মোহ কি বুঝে ফেলল, এতক্ষণ ধরে সে মোহকে বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল? এইসব ভেবে ঘামতে শুরু করল স্বচ্ছ। কান গরম হয়ে এলো ভাবনার মাঝে। মোহ মুচকি হেসে গাড়ির দরজা খুলে নেমে গেল। গাড়ির জানালায় উঁকি দিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ আপনাকে। আমার উপকার করার পাল্লা বেশি ভারী হয়ে গেল। যদি কখনো সুযোগ আসে আমি শোধ করার চেষ্টা করব।”
স্বচ্ছের চেহারা মলিন হলো। বলল,
“আমায় সবসময় এত ছোটো করো কেন তুমি মোহ? কী মজা পাও?”
“ছোটো করব কেন? কৃতজ্ঞতা জানাব না আপনাকে?”
“এটা তোমার কাছে কৃতজ্ঞতা মনে হলো? তাহলে এই কৃতজ্ঞতা আমার শত্রুরও কপালেও না থাকুক।”
মোহ নির্বিকার ভাবে বলল,
“শক্রর কপালে জুটতে হবে না। আপনার কপালে জুটলেই চলবে। তাহলে আমি এখন আসি।”
মোহ গলির সম্মুখে দাঁড়ায়। স্বচ্ছ তড়িঘড়ি করে জানালা দিয়ে নিজের মাথা বের করে দিয়ে মোহকে ডাকে।
“মোহ!”
মোহ পিছু ফিরে তাকায়। ইশারায় জানতে চায়, কী হয়েছে? স্বচ্ছ অনুতপ্ত হয়ে বলে,
“সরি। আই এম সরি।”
মোহ ভ্রু কুঁচকায়। হঠাৎ ক্ষমা চাওয়ার কারণ বুঝতে পারে না। গাড়ির সন্নিকটে আসে ফের।
“সরি কেন?”
“আমি সব জানি। আমার বাবার কৃতকর্ম। সব জানতে পেরেছি। তার জন্য তোমার জীবনে এত সমস্যা। সেও আমার জন্যই এই সমস্যা তৈরি করছে। আমায় ক্ষমা করো। যদি তাও না করতে চাও তাহলে শা/স্তি দাও। আমার বুক ভার হয়ে আছে আমার নিজে বাবার অ;পরাধের কারণে। সেই ভার আমি কমাতে চাই।”
“সেই ভার কমবে তখনি যখন আপনার বাবাকে আপনি সামলাতে পারবেন। আপনার বাবার নিজের ক্ষমতার ভুল ব্যবহারকে শুধরে যদি দিতে পারেন তবেই সেই ভার কমবে। সরি বলে বা পানিশমেন্ট চেয়ে লাভ হবে না। কারণ তিনি আবারও সমস্যা তৈরির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকবেন। আপনার বাবার অহংকার আপনাকেই চূর্ণ করতে হবে। নয়ত হয়তবা খুব বাজেভাবে তিনি নিজেই একদিন চূর্ণ হবেন।”
মোহের শেষ কথাগুলো বেশ ধারালো। তবে প্রতিত্তোরে কিছু বলার সুযোগ দিলো না সে। চলে গেল গলির ভেতরে।
স্বচ্ছ বাড়ি ফিরতেই দরজা খুলে দিলেন মিসেস জেবা। প্রথমেই স্বচ্ছকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন তিনি।
“এতক্ষণ কই ছিলে? দুই ভাই সারাদিন কোথায় না কোথায় ঘুরতে থাকে ঠিক নেই। একবার মাকে বলারও প্রয়োজনবোধ করে না। ছোটোটা একটু আগেই বাড়ি ফিরল। আর তুমি মাত্র ফিরলে।”
স্বচ্ছ মিসেস জেবাকে পাশ কাটিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে বলল,
“জানি আমি। ওকে আমিই কাজে পাঠিয়েছিলাম।”
“সারাদিন এত কী কাজ থাকে তোমাদের? আমায় বলতে পারো?”
“একটু পরেই জানতে পারবে। তা মন্ত্রী সাহেব বাড়িতে ফিরেছে?”
স্বচ্ছের কথায় মিসেস জেবা হেসে ছেলের হাতে চা/পড় দিলেন। ভাবলেন ছেলে হয়ত মজার ছলে বাবাকে এমন ডাকছে।
“কী বলো নিজের বাবাকে?”
“বাবা বলে ডাকতে অসহ্য লাগছে এখন মা।”
স্বচ্ছ আরো এগিয়ে এলো বসার বড়ো ঘরে। শুনতে পেল সেই কণ্ঠ। সরোয়ার সাহেব চা খাচ্ছিলেন বসে বসে। ছেলেকে দেখেই বললেন,
“আজকাল বাহিরেই ঘোরাফেরা করা হয় বেশি। বাহিরই হয়ে গিয়েছে বাড়ি আর বাড়িই হয়ে গিয়েছে বাহির তাই না?”
স্বচ্ছ সরোয়ার সাহেবের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। তাচ্ছিল্যের সহিত বলল,
“তোমার জন্যই কত যে ধকল সইতে হয় তার ঠিক আছে?”
সরোয়ার সাহেব চায়ের কাপটা রাখলেন টেবিলে। ইতিমধ্যে কপালে পড়েছে ভাঁজ। সন্দিহার হয়ে বলে উঠলেন,
“আমার জন্য ধকল সইতে হচ্ছে? কীসের ধকল?”
“কেন তুমি জানো না? তোমার তো ভালো করে জানার কথা।”
“কী জানার কথা বলছ?”
স্বচ্ছ এবার গর্জে উঠল যেন। মনের ভেতর জমা থাকা সমস্ত রাগ দা/বানলে রূপান্তর হলো।
“মনে আছে? ওইদিন হসপিটালে আমাকে প্রমিস করেছিলে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার তুমি করবে না কখনো। সেই প্রমিস তুমি নিমিষেই ভাঙলে। এই মন্ত্রী সাহেবকে আমি কখনোই চিনি না বাবা। একটা কাপুরুষের মতো অন্যকে দিয়ে একটা সাধারণ মেয়েকে তোমায় কিড/ন্যাপ করাতে হচ্ছে। কেন?”
সরোয়ার সাহেব ‘কাপুরুষ শব্দটি শুনেই উঠে দাঁড়ালেন। উপস্থিত হলো মিসেস জেবা আর নিচের ঘর থেকে ছুটে এলো ফারাহ। সরোয়ার সাহেব ধমকে বলে উঠলেন,
এই ছেলে, কাপুরুষ কাকে বলো তুমি? তুমি কার সামনে দাঁড়িয়ে কী বলছ তোমার হুঁশ আছে?”
“আছে হুঁশ। সব জ্ঞান আছে। এতদিন হয়ত সেই জ্ঞান ছিল না। সেই কারণে বুঝতেও পারিনি আমি যাকে নিজের আদর্শ মানি সেই মানুষটাই ভুল।”
বাবা-ছেলের দ্বন্দ্ব দেখে ফারাহ নিজের ভাইকে ডেকে উঠল।
“ভাইয়া!”
ক্রোধান্বিত স্বচ্ছ ফারাহর দিকে আঙ্গুল তুলে বলল,
“আমার আর বাবার কথার মাঝে কেউ আসবে না। কেউ না।”
সরোয়ার সাহেব হেয় করে বললেন,
“কার জন্য এত বড়ো গলা বের করছ তুমি? একটা মেয়ের জন্য নিজের বাবাকে যা নয় তাই বলে যাচ্ছো? ভুলে যাচ্ছো তাই না? আমি তোমার বাবা?”
“ভুলিনি তো। তবে আফসোস হচ্ছে এই ভেবে কেন ভুলে গেলাম না। তুমি যা করো নি ঠিক করো নি। তুমি মোহের সাথে অ/ন্যায় করে চলেছ বাবা৷”
সরোয়ার সাহেব একগুঁয়ের ন্যায় বললেন,
“অ/ন্যায় নয়। যা করেছি সেটা ওর প্রাপ্য।”
“এটা করো না তুমি বাবা প্লিজ। অন্ধ হয়ে যাচ্ছো তুমি ক্ষমতার নেশায়। এটা করো না। নিজের ভুল স্বীকার করে নাও।”
স্বচ্ছ আবেগাপ্লুত হলো এবার। যতই হোক নিজের আদর্শ যেই মানুষকে মেনে এসেছে তার প্রতি কঠিন হওয়া যেন দুর্বিষহ ব্যাপার। তবে সরোয়ার সাহেব একইভাবে বললেন,
“আমি কোনো ভুল করিনি। যা করেছি ঠিক করেছি। স্বীকার করব না নিজের ভুল। কী করবে তুমি? পুলিশের কাছে যাবে?”
স্বচ্ছ নির্লিপ্তে বলল,
“আমি তো সেটাই চাই। আইন যখন বানানো হয়েছে সেটা সকলের জন্য সমান হোক। মোহের বাবাকে তুমি জেলে পাঠিয়েছিলে না? বিনা অপ/রাধে। আজ তোমার নিজের অপ/রাধ তোমায় কত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারে জানো?”
মিসেস জেবা এগিয়ে এলেন স্বচ্ছের দিকে। সৌমিত্র ঘুম থেকে উঠে টলতে টলতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। মিসেস জেবা ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন,
“চুপ করো স্বচ্ছ। বাবার সঙ্গে এভাবে কথা বলো না।”
সরোয়ার সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“জেবা! দেখো তোমার ছেলেকে। আমার দিকে আঙ্গুল তুলছে ও। অথচ ওর জন্যই আমি সব করেছি।”
স্বচ্ছ শব্দ করে হাতজোড় করে চোখ খিঁচে বলল,
“অনেক করেছ। প্লিজ আর কিছু করো না।”
সরোয়ার সাহেব এগিয়ে এলেন। স্বচ্ছের গাল দুটো আলতো চেপে ধরে বললেন,
“কীসের এত টান তোমার ওই মেয়েটার প্রতি? ওর জন্য নিজের বাবার বিরুদ্ধে যেয়ে কি ঠিক করছ? কেন বারবার ওর পিছু ছুটছ? কেন? ও শুধুমাত্র একটা মেয়ে! ভুলে যাও তাকে। ও তোমার প্রায়োরিটি ডিজার্ভ করেনা।”
স্বচ্ছ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। আস্তে করে নিজের গাল থেকে সরোয়ার সাহেবের হাত সরিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
ওকে আমি ভালোবাসি বাবা!”
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। চোখে সমস্যা হওয়ার কারণে বেশি দেরি করে ফেলেছি। দুঃখিত।]