#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_০৫
প্রশান্ত পরিবেশে বাতাসের গুণগুণ শব্দ। অদূর থেকে যানবাহনের চাপা কলধ্বনি পুরু কাচেঁর দেওয়াল ভেদ করে অস্পষ্ট শব্দে ভেসে আসছে।
আদুরে হাতে স্পর্শ করলো কালো রঙের আবরণে ঢেকে থাকা সুবলিষ্ঠ বাহু, তৎক্ষনাৎ ঘন পল্লববিশিষ্ট নেত্রদ্বর মেলে আড়চোখে তাকালো মেহরাজ। অতিমাত্রায় শান্ত চোখ জোড়ায় নিষ্প্রভ চাহনিতেও যেন অদ্ভুত এক ক্রোধ দেখতে পেল তিয়াসা।
ধূসর বর্ণা চোখে কাঠকাঠ ঔদ্ধত্য, ক্রুদ্ধতার ভাঁজ।
তড়াৎ নিজের হাত সড়িয়ে নিল। মেহরাজের এহেন দৃষ্টি প্রতিবার ওর রুহ্ কাঁপিয়ে দেয়, গুটিয়ে নিল নিজেকে খানিক। মেহরাজকে শুধু সে নয় বাড়ির সকলেই অনেক বেশিই মান্য করে। ছোট বেলা থেকে দেখছে ওকে কেমন একটা গাম্ভীর্য, নির্লিপ্ততা সবসময় একটা দৃঢ় আব্রুর মতো আবদ্ধ করে রাখে ওকে। যার কারণে ওকে কেও বুঝতে পারেনা। যান্ত্রিক সৃষ্ট হিম আনিলে ঠান্ডা হয়ে এলো তিয়াসার শরীর, তবুও মৃদু গলায় বলল
-কি এতো ভাবছো তুমি?
প্রত্যুত্তর করলো নাহ মেহরাজ। তিয়াসা বিব্রত হলো না, মেহরাজের এরূপ ব্যবহার নিতান্তই স্বাভাবিক। তিনটা কথা বললে কদাচিত একটার উত্তর পাওয়া যায় তার থেকে।
মোহনীয় নজরে তাকালো চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে থাকা সুপুরুষের পানে। ধবধবে শরীরে কালো রঙের শার্টটা যেন চিকচিক করে উঠছে। কালচে খয়েরী ঠোঁট খানিক বাদে বাদে কেঁপে উঠছে। ঘনঘন নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট কানে বাজছে তিয়াসার। নেশা ভরা কা’মুক দৃষ্টিতে তাকালো মেহরাজের দিকে। চোখে মুখে প্রচন্ড তৃষ্ণা হলো তার। প্রগাঢ় ইচ্ছে হলো এক্ষুনি ঝাপিয়ে পড়তে বলিষ্ঠ দেহের মাঝে, একমাত্র স্বপ্নের পুরুষের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। অপ্রাপ্তির যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠলো অন্তঃস্থল। প্রচন্ড ভয়কেও অগ্রাহ্য করে অবাধ ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে এক হাত এগিয়ে রাখলো টেবিলের উপরে রাখা মেহরাজের হাতের উপর,ঢলা গলায় বলল
-ওই মেয়েকে কবে ডিভোর্স দিচ্ছো রাজ, আমার আর সহ্য হচ্ছেনা। ওই মেয়েটা তোমার বউ এ কথা ভাবলেও আমার গা পিত্তি জ্বলে উঠে। ওকে যত দ্রুত সম্ভব দূর করো।
মেহরাজ নিজের হাত এক ঝটকায় সরিয়ে নিলো। তিয়াসার দিকে না তাকিয়েই রুক্ষ গলায় বলল
-কতবার বলেছি কিপ ডিসটেন্স ফ্রম মি, আই ডন্ট লাইক টাচ।
-কেন রাজ? সেদিন তো ওই মেয়েকে ঠিকই কোলে তুলে ঘরে নিয়ে গেলে আর আমি ধরলেই কি তোমার ফোস্কা পরে যাবে!
প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো তিয়াসা। মেহরাজের এই নির্লিপ্ততা তার বুকে ধরা আগুনে ঘি ঢালার কাজ করছে। তেঁতে উঠে আবারও বলল
-ডন্ট ফরগেট দ্যাট আ’ম ইউর ফিয়ন্সে। ওই মেয়েকে যত দ্রুত সম্ভব তুমিই দূর করো না তো আমি বাধ্য হবো মাথা ঘামাতে।
বলেই পাশের পেপারম্যাট টা তুলে সজোরে ফ্লোরে ছুড়ে মেরে হনহন করে বেড়িয়ে গেলো। কাচের সো-পিচের মতন চকচক করা জিনিসটা চুরমার হয়ে গেল, সূর্যের তীর্যক রোশনাই তাতে পড়ে একে অপরের মাঝে প্রতিফলিত হয়ে তীব্র আলোর সৃষ্টি করলো। সেই আলোর একাংশ এসে পরলো মেহরাজের ধূসর গভীর চোখজোড়াতে, অনিমেষ তাকিয়ে রইলো মেহরাজ সেদিকে ঠোঁটের কোণায় ক্রুর হাসির সহিত। যার দুর্ভেদ্য প্রাচীর বধ করার ক্ষমতা স্বয়ং মেহরাজ ছাড়া নেই কারো , ওর সুগভীর চোখ আর তাতে আঁকতে থাকা ছকের নীলনকশায় ডুব দেওয়ার সাধ্যি কারো নেই। তন্মধ্যে টেবিলের উপরে রাখা ফোনটা বিপবিপ শব্দ করে তীব্রভাবে কেঁপে উঠলো, ফোনটা কানে ধরতেই ওপাশ থেকে বলতে থাকা কয়েকটি বাক্য সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ফট করে দাঁড়িয়ে পড়লো মেহরাজ, ব্লেজার টা হতে নিয়ে বেরোতে বেরোতে বলল
-আমাকে আগে ইনফর্ম করোনি কেন ইডিয়ট!
…………………
রান্নাঘরে ঘন ধোঁয়ায় বাতাসে তিতকুটে ঘ্রাণ মিশে আছে। জ্বলন ধরা চোখ টা কোনো রকমে খুলে অস্পষ্ট নজরে চুলা বন্ধ করে দিল মোহর। চিনির কৌটো খুঁজতে কেবিনেটের দিকে গেছিল এর মাঝেই চুলাতে দেওয়া মাংসের তলা পুড়ে গন্ধে ভরে গেছে আশপাশ।
চুলা টা বন্ধ করে কাশতে কাশতে বেরিয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। প্রচন্ড কাশিতে দম বন্ধ হয়ে আসছে প্রায়। চোখ জ্বলে তাকাতে পারছে না ঠিকমতো, হুট করেই সামনে কেও পানির গ্লাস ধরলে হালকা ঝাপসা চোখ খুলে তাকালো, ধাতস্থ হতে বেশ সময় লেগে গেলেও চেহারার মালিককে চিনতে পারলো নাহ। বিভ্রান্তিকর চেহারায় তাকিয়ে থাকা মোহরের সামনে পানির গ্লাস ধরে আগন্তক বলল
-পানিটা খান ভাবি, কাশতে কাশতে তো চোখ লাল হয়ে গেছে আপনার
আগন্তুকের পরিচয়ে মাথা না দিয়ে হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে সাবাড় করে দিলো মোহর, হাফাতে হাফাতে সোফাতে বসলো। আগন্তুক এগিয়ে এসে দাঁড়ালো মোহরের সামনেই, লম্বা চওড়া শরীরের শ্যাম গড়নের মুখ খানায় ঝুলানো অকৃত্রিম হাসি। পরনে পোলোর একটা সবুজ টি-শার্ট সাথে সাদা প্যান্ট। চওড়া হাসিকে আরও প্রসারিত করে আগন্তুক এক হাত বাড়িয়ে দিলো মোহরের সামনে, প্রস্ফুটিত গলায় বলল
-হ্যালো ভাবি, আমি নোমান। আমাকে নিশ্চয়ই চিনতে পারেননি। অবশ্য না চেনাটায় স্বাভাবিক আপনার সাথে দেখাই তো হলো আজ।
বলে আপনা আপনিই হাহা করে হেসে উঠলো। মোহর এ হাসির মর্মার্থ বুঝতে পারলো নাহ। এই ছেলেটাকে এ বাড়িতে আজই প্রথম দেখলো। মোহরের সামনে বেশ অনেকক্ষণ হাত বাড়িয়ে রাখলেও হাত এগোলো না সে, উপায়ন্তর নিজের হাত গুটিয়ে নিয়ে নোমান নামের ছেলেটি নিজেই বলে উঠলো
-আমি মেহরাজ ভাইয়ের ফুফাতো ভাই। আজই এসেছি। শুনলাম ভাই নাকি বিয়ে করেছে তাও যাকে করার কথা ছিল তাকে না, রাতারাতি নতুন বউ পেয়েছে নাকি ভাই। তাই ভাবিকে দেখতে এলাম।
বলে আবারও হেসে উঠলো, এভাবে কথার মাঝে অহেতুক হাসি মোহরের বোধগম্য বা পছন্দ কোনোটাই হলো নাহ। ও প্রত্যুত্তরে শুধু অপ্রস্তুত হেসে উঠে দাঁড়ালো। এ বাড়িতে যেখানে ওকে কেও বউ মানেই না সেখানে হুট করে একটা ছেলের এসে ভাবি বলা পরিচিত হওয়া নেহাৎ আদিক্ষেতা মনে হলো। তবুও ভদ্রতাসূচক বলল
-ওহ, আচ্ছা আমাকে রান্নাঘরে যেতে হবে
বলে হাঁটা শুরু করলে ছেলেটাও ওর পিছু পিছু এলো। একা একাই বলল
-বাহ ভাবি এসেই দেখছি রান্নাঘরের দ্বায়িত্ব নিয়ে ফেলেছেন, গ্রেট!
উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে হলো না মোহরের। সকাল থেকে ঘরের ভেতরেই পরে ছিল, এ বাড়িতে কেও ওর ঘরে আসে না বা কথাও বলে নাহ। নিজেকে এক প্রকার কয়েদি মনে হয়। অবশেষে বিরক্ত হয়ে নিচে এসেছিল। রান্নাঘরে কাকলি একা একাই কিছু একটা করছিলো দেখে এগিয়ে এসে সাহায্য করার কথা বললে সে মুখ ভেংচে বলে
-তুমি আবার কি সাহায্য করবে, রান্না বান্না কি আদও জানা আছে?
-জ্বি
কিঞ্চিৎ ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দেয় মোহর। কাকলি খানিক চুপ করে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা ভেবে বলে
-বেশ তবে আজ দুপুরের রান্না টা তুমিই করো। এমনেও শুয়ে বসে শুধু খাওয়া আর ঘুম, শুধু শুধু অন্ন ধ্বংস না করে কাজে লাগলেও ভালো। এমনিতেও নাজমা তো মা ছাড়া অন্য কারো কাজ খুব একটা করে না, আর মালা আজ রান্নাঘরে আসতে পারবে না ওর কাজ আছে। তুমি বরং রান্নাটা করে ফেল
বলে একগাদা রান্নার পদের নাম বলে বেরিয়ে গেছে। সেই যে গেছে এই পর্যন্ত একটা পক্ষিও আসেনি রান্নাঘরে ঢু মারতে, আদও মোহর কাজ গুলো করতে পারছে কি না দেখতে। এ বাড়ির পুরুষেরা সকাল থেকে সন্ধ্যা অফিসেই থাকে, দুপুরে এতো রান্নার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয়না, শুধু মোহরকে খাটানোর জন্যেই যে এতগুলো রান্না চাপিয়ে দিয়েছে তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলো মোহর।
চাপা প্রশ্বাস ফেলে চুলার দিকে এগিয়ে গেল। সব রান্না প্রায় হয়েই গেছিলো একা হাতে এতটা সামলাতে না পেরে মাংসের তলার খানিকটা পুড়ে গেছে।
-উহু,, এই মেয়ে কি করেছো কি, সারা বাড়িতে ধোঁয়া আর পোড়া গন্ধে ভরে গেছে। নাক সিটকে গেল আমার।
বলতে বলতে রান্নাঘরে ঢুকে মাংসের পোড়া পাতিল দেখে কাকলি কটমট করে বলল
-একটু রাধতে কি দিয়েছি আর তুমি পু’ড়িয়ে ফেলেছ।ভারি শয়তান মেয়ে তো তুমি। বের হও এক্ষুনি এখান থেকে বের হও!
বলে গরম পাতিল তুলে মোহরের হাতে ধরিয়ে দিলো। হাতে লাগতেই চামড়া পু’ড়ে জ্বলে উঠলো মোহরের। কোনো রকমে পাতিল টা বেসিনে রেখেই হাত ধরে বেড়িয়ে এলো রান্নাঘর থেকে, তবে বেড়িয়ে আসার সময় যে নোমান নামের ছেলেটা ওখানে ছিল না ব্যাপার টা একেবারেই খেয়াল করেনি মোহর।
বাড়ির সদর দরজায় পা রাখতেই মোহরকে রান্নাঘর থেকে ছুটে বাইরে আসতে দেখে ভ্রুদ্বয় কুচকে নিল মেহরাজ। সামনাসামনি পরতেই দাঁড়িয়ে গেল, মেহরাজকে পাশ কাটিয়ে যেতে গেলে হাত ধরে থামিয়ে দিল মেহরাজ।
পু’ড়ে তৎক্ষনাৎ ফোস্কা পরে যাওয়া যায়গা টাতে হাতের চাপ পড়ায় সহ্যশক্তির কাছে হার মেনে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো মোহর।
মেহরাজ মোহরের হাত দুটো সামনে ধরে চরম কাঠিন্য ভরা চোখে তাকালো মোহরের দিকে। ঘামে জবজবে সারা শরীর, চোখ মুখ ফুলে লাল হয়ে গেছে, থেকে থেকে ফুঁপিয়ে উঠিছে। অবিলম্বেই চিৎকার করে উঠলো মেহরাজ। বজ্রকণ্ঠের হুংকারে কেঁপে উঠলো মোহর, হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও পারলো নাহ।
ততক্ষণে মেহরাজের সউচ্চ গলার হুংকারে সকলে বেড়িয়ে এসেছে ঘর থেকে
-বাবু, কি হয়েছে! এতো তাড়াতাড়ি ফিরলি যে কোনো সমস্যা হয়েছে?
কাকলি ও রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছে ততক্ষনে, মোহরের হাত ধরে মেহরাজকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হয়তো ব্যাপার টা আন্দাজ করতে পেরেছে,তবুও কৌতুহলী গলায় বলল
-মেহরাজ, কি হয়েছে?
আম্বি এগিয়ে এসে মেহরাজের গায়ে হাত দিতে গেলে ও হাত তুলে থামিয়ে দিলো। রাশভারি গলায় চাপা হুংকারা দিয়ে বলল
-এ বাড়িতে কি কাজের লোকের অভাব পড়েছে?
শাহারা বেগম নাজমার সাহায্যে খোরাতে খোরাতে এসে দাঁড়িয়েছে তন্মধ্যে, পৌঢ়া গলায় জিজ্ঞাসা করলো
-কাজের লোকের অভাব কেন হবে, কি হয়েছে, কোনো দরকার?
-তাহলে মোহরকে রান্নাঘরে কেনো পাঠানো হয়েছে, ওকে দিয়ে কাজ করানোর প্রয়োজন কেন হলো, আর কেনই বা এই অবস্থা হলো ওর
গগনচুম্বী উর্ধস্বরে কেঁপে উঠলো আব্রাহাম ম্যানসনের দেওয়াল গুলো। মোহর নির্বাক, নিশ্চুপ সিটিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো এক খানেই। নিরবতা ভেঙে বেশ জড়তা ভরা গলায় কাকলি বলে উঠলো
-কেন মেহরাজ, ওকে বিয়ে করে যখন এনেছো তাহলে এ বাড়ির প্রতি ওর ও তো দ্বায়িত্ব আছে। আর এক বেলা রান্না করলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
-এ বাড়ির কর্তি বলে তো অনেকেই দাম্ভিকতা দেখিয়ে থাকে, কই তাদের তো চুলা জ্বালাতে দেখলাম না কখনো
মেহরাজের কথাটা যে কাকলি কে উদ্দেশ্য করেই বলেছে তা উপস্থিত কারোই বুঝতে অসুবিধা হলো নাহ। এহেন কথায় অপমানিত বোধ করে ফুসে উঠলো কাকলি। ঝাঝালো গলায় বলল
-তুমি কিন্তু আমায় অপমান করছো, ভুলে যাবে না আমি তোমার চাচি
-মোহর এ বাড়ির বউ, মেহরাজ আব্রাহাম ওকে বিয়ে করে নিজে এনেছে এ বাড়িতে তাই ওর সাথে কোনো দুর্ব্যবহার করা মানে স্বয়ং মেহরাজকেই অপদস্ত করা, এ্যন্ড আই ওন্ট টলারেট দ্যাট!
চাপা স্বরে ধমকে উঠলো মেহরাজ। আম্বি মোহরকে নিয়ে নিজ ছেলের এহেন উৎকণ্ঠা দেখে জ্বলে উঠে বলল
-ওকে কে অপমান করতে যাবে। আর রান্না করার কথা ও নিজেই বলেছে কাকলিকে। যেটা পারে না ওটা আগ বারিয়ে করতে কে বলেছে ওকে?
-এমন কোনো আচরণ করো না যাতে নিজের সম্মান বা স্থানের নড়চড় হয়
শান্ত গলায় প্রতুত্তর করে মোহরের হাত ধরেই উপরে উঠে গেল মেহরাজ। আম্বি হতভম্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শেষে কি না এই দুদিনের মেয়ের জন্যে তার ছেলে তাকে শাসিয়ে গেল? মেহরাজ সরে যেতে কাকলি এসে আম্বির পাশে দাঁড়িয়ে বলল
-আমি আগেই বলেছিলাম, এই মেয়ে প্রচুর ধূর্ত, দেখেছ এসেই কেমন হাতিয়ে নিয়েছে তোমার ছেলেকে। নাহ তো দুদিন আগ পর্যন্ত যাকে চিনতো নাহ তার জন্যে কি না নিজের মাকে অপমান করলো
লোহা গরম থাকলে যেমন যেদিকে আ’ঘাত পরে সেদিকেই বেঁকে যায়, আম্বি খাতুনের ক্ষেত্রেও ঠিক এরূপ প্রভাব বিস্তার করলো কাকলির কথাগুলো। দুনিয়াতে ছেলের চেয়ে বেশি আদরের কিছুই না তার কাছে, তবে কি এই মেয়ে সত্যিই ছিনিয়ে নেবে তার ছেলেকে?!
•
ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে মোহরের সামনা-সামনি হাটু মুড়ে বসলো মেহরাজ। বক্স টা খুলে তুলার গুচ্ছ থেকে খানিক ছিড়ে স্যাভলন লাগাতে থাকলো। মোহর তখনও ফুঁপাচ্ছে, হৃদযন্ত্র প্রচন্ড বেগে দৌড়াচ্ছে। শরীরের রক্তবিন্দু শীতল।
মেহরাজ কেমিক্যাল মিশ্রিত তুলাটা চেপে ধরলো মোহরের আঙুলের ডগায়। প্রচন্ড জ্বলনে কেঁপে উঠলো মোহর। চোখ মুখ খিঁচিয়ে নিলো,
মেহরাজ মুখ তুলে তাকালো মোহরের অশ্রুসিক্ত ঘনপল্লব আঁখি জোরায়। পরক্ষণেই চোখ ফিরিয়ে ব্যান্ডেজে মনোযোগ দিল।
মোহর নিজেকে সামলে অ-ধাতস্ত নাজুক দৃষ্টিতে তাকালো প্রায় শরীর ছুঁইছুঁই দূরত্বে বসে থাকা লোকটির দিকে। হাতের জ্বলনের থেকেও শরীরে অসম্বাধ কাঁপুনি ধরেছে, কড়া একটা সুগন্ধি এসে লাগছে নাকে।
ফোস ফোস শব্দে নির্গত প্রশ্বাস আছড়ে পরছে হাতে। প্রচন্ড জড়তা নিয়েও অবিন্যস্ত নজরে তাকালো মেহরাজের দিকে। অকস্মাৎ থমকে গেল, অক্ষিকোটরের মার্বেলাকৃতির মণিজোড়া ধার্য স্বরুপ আটকে গেলো মেহরাজের আনন পানে। খুঁটে খুঁটে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো সমস্ত টুকু।
পুরুষালি চেহারার উচু চোয়াল, চোখা মুক, ধারালো নাক, বিদেশীদের মতো গায়ের রঙ। অত্যন্ত ফর্সা যাকে বলে। আর সবচেয়ে মারাত্মক হলো চোখ জোড়া,অদ্ভুত আকর্ষণীয়! এমন ধূসর বর্ণা চোখ মোহর আগে দেখেনি। খুব অদ্ভুত ভাবেই মোহর মেহরাজের সাথে তার বাবা-মা এমনকি পরিবারের কারো চেহারারই মিল পাইনি।
বয়স কত হবে লোকটার! চেহারা দেখে আন্দাজ করা অসম্ভব। এতদিনে এভাবে কখনো নীরিক্ষন করা হয়নি মেহরাজ কে। কেমন অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের মনে হয় মানুষটাকে। এত সুদর্শন যুবকের নিশ্চয় প্রেমিকা আছে? এক বা একাধিক? তিয়াসাও হয়তো তাদেরই একজন! জরুরি না চেহারা সুন্দর মানেই মানুষটার ভেতর টাও সুন্দর হবে। এমন নিখুঁত চেহারা যার, দোষ তো নিশ্চয় আছে। কারণ কলঙ্ক তো চাঁদের ও আছে!
আনমনা হয়ে বিভিন্ন ভাবনায় জর্জরিত মোহরের মেহরাজের সাথে দৃষ্টি মিলতেই চোখ সরিয়ে নিল।
মেহরাজ উঠে দাঁড়িয়ে দু পকেটে হাত গুঁজে স্থির নিমিত্তে তাকালো সামনে, গম্ভীর আওয়াজে বলল
-বাড়ির বউ হবার চেষ্টা করার কোনো দরকার নেই। এরপর থেকে কোনো কাজে হাত দিতে যেন না দেখি
মোহর এক পলক চাইলো মুখের দিকে। হঠাৎই কি একটা ভেবে বলে উঠলো
-আমি এভাবে সারাদিন বাড়িতে বসে থাকতে চাইনা। আমার পড়াশোনা, জীবন সবটাই আটকে আছে এই অনিশ্চিত নামহীন সম্পর্ক টার জন্য। আর বাড়ির লোকেরাও আমার উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ
-হ্যাঁ তো কি করতে চাচ্ছেন?
দু’হাত বুকে ভাঁজ করে রেখে বলল মেহরাজ। মোহর কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই বলল
-যেহেতু বাড়ির সবাই এ সম্পর্কে অসন্তুষ্ট, আর আমি বা আপনি কেও ই চাইনা একসাথে থাকতে চাই আমার মনে হয় ডিভো..
-আমি কি চাই তা আপনাকে কে বলল মিস. মোহর শিকদার।
বিব্রতবোধ জেঁকে ধরলো মোহরের কণ্ঠে, মেহরাজের শান্ত চোখে তাকিয়ে কোনো উত্তর করতে পারলো নাহ। তবুও ভাঙা ভাঙা শব্দে বলল
-না আমি আপনাকে চিনি না আপনি আমায়। এক প্রকার বাধ্য হয়ে বিয়েটা হয়েছে। আর আপনার একজন বাগদত্তাও আছে। এই একটা সম্পর্ক সবকিছুর প্রতিকূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই..
-তাই আপনার এ ব্যাপারে না ভাবলেও চলবে। কোথায় যেতে চান আপনি? নিজের ওই বাড়িতে! যেখান থেকে দুশ্চ’রিত্রা বলে সকলে বের করে দিয়েছে? নাকি অন্য কোথাও? জায়গা আছে কোনো? কেও আছে নিজের বলে? সেদিন রাতের কথা ভুলে গেলেন যার জন্য ঘটনা আজ এতদূর! আর আপনার বোন ও তো সেই দলেই যারা আপনাকে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ না দিয়েই মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছে, তার কাছে যাবেন? আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন, আত্মসম্মানকে ছাপিয়ে বাস্তবতার নজরে তাকান, আপাতত আমি ছাড়া কেও নেই। ইউর লিগ্যাল হাসব্যান্ড!
পূর্ন দৃষ্টি মেলে তাকালো মোহর। ততক্ষণে মেহরাজ বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। হৃদবক্ষে বিস্ফোরণ ঘটলো মেহরাজের কথার বানে। একটা কথাও ভুল বলেনি। কিন্তু কথার ভাঁজে সুক্ষ্ম একটা ইঙ্গিত ছিল যা চোখে আঙুল তুলে মোহরকে বুঝিয়ে দিল ওর অসহায়ত্ব।
মেহরাজ কোনো না কোনো ভাবে নিজের দুস্তোষ্য বাক্যে মোহরকে বুঝিয়ে দিল ওর কেও নেই! এই বিশালাকার দেওয়াল গুলোর মাঝে প্রতিনিয়ত অপমানিত হলেও এ বাদে কোনো ঠিকানা নেই ওর!
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
#Humu_❤️
#হীডিংঃ উপন্যাসের যেকোনো চরিত্র বা বাক্যালাপে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকাটা স্বাভাবিক, পটভূমি আর সময়য়ানুযায়ী সবটাই সুস্পষ্ট করব ইনশাআল্লাহ। ততদিনে পাঠকদের ধৈর্য, সাহারা,ভালোবাসা প্রত্যাশা করছি
হ্যাপি রিডিং ❤️