মুঠোভরা_চোরাবালি #আলিশা_আঞ্জুম #পর্ব_৮

0
744

#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_৮

ফাইজা আঁতকে ঘর ছাড়লো। টিনের চালে ভারি বর্ষার শব্দ। সাদ উচ্চ গলায় কথা বলে যাচ্ছিলো তাসরিফের সঙ্গে। ঝট করে একপ্রকার কেড়ে নেওয়ার ভঙ্গিতে ফোন নিজের হাতে নিলো ফাইজা। ভেবেই নিলো তাসরিফ কাঙ্ক্ষিত কিছু বলবে। হয়তো বলবে, তার ফাইজাকেই চাই। ফাইজা ছাড়া তার চলবে না। কিন্তু এমন কিছুই হলো না। তাসরিফ ওপাশ হতে বরাবরের মতোই শান্ত কন্ঠে শুধালো

— কাফনেরর কাপড় ছোঁয়া মানে?

ফাইজা আশাহত হয়ে থমকে গেলো। রাগ হলো। দুঃখ হলো তার। সন্তপর্ণে একবার সাদের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলল

— তুই ঘরে যা। ভেজা কাপড় পাল্টে আয়।

সাদ চলে গেলো। ঘুণাক্ষরেও সে বুঝলো না তার বোনের বুকের ভেতরে গড়ানো আছে আস্ত এক দুঃখের পাহাড়। ফাইজা ফোন হাতে চলে গেলো নিজের ঘরে। শক্ত কন্ঠে ভরা দুঃখ নিয়ে বলল

— ভয় পাচ্ছো? আবার আত্মহত্যা করি কিনা এটা নিয়ে?

তাসরিফ ফোনের ওপাশে নিশ্চুপ। ফাইজা নিঃশব্দে হাসলো। পুনরায় বলল

— নিজেকে নিজে হ*ত্যা করার মতো সাহস আমার নেই। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। এমনিতেই মা*রা গেলেও তোমার বাড়িতে পুলিশ যাবে না। তোমার বিয়েতে কোনো বাঁধা পরবে না।

তাসরিফ এবারেও নিশ্চুপ। ফাইজার বুক ভেঙে চুড়ে যাচ্ছে যেন।
তাসরিফের ওপাশ হতে কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। ফাইজা আবারও বলল

— ডিভোর্স চাইতে অস্বস্তি হচ্ছে? এতো ভেবো না। ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়ো।

এবারে তাসরিফের মুখে কথা ফুটলো। ছোট করে বলল

— আচ্ছা।

অতঃপর ভালো মন্দ কিছু না বলেই ফোন কেটে দিলো সেকেন্ডের মাঝে। ফাইজা হতভম্ব হয়ে গেলো। অপ্রত্যাশিত ছিলো এমনটা। চোখ এবারেও চিকচিক করে উঠলো। বুকের নিভু নিভু আশার প্রদীপ ফু দিয়ে যেন নিভিয়ে দিয়েছে তাসরিফ। ফাইজা তো ডিভোর্সের কথা রাগ থেকে বলেছে। তবে তাসরিফ যে এজন্যই ফোন করেছিলো তা ফাইজার কল্পনাতীত ছিলো।

.
রাতটা যেমন তেমন হয়ে কেটে সকাল হলো। স্বভাবের তাড়নায় ফাইজার ঘুম ছুটে গেলো ফজরের আজানের সুরে। প্রকৃতি তখন শান্ত। ঝড়-ঝাপটা লুকিয়ে পরেছে কোথাও। বিছানা ছেড়ে ফাইজা অযুর উদ্দেশ্যে কলপাড়ে গেলো। সেখানেই দেখা হলো আসমার সাথে। মানুষ হিসেবে গড়েনে পাতলা, ছিপছিপে স্যাম বর্নের নারী আসমা।

কোলে ছোট ফারিহা কেঁদে বেহুশ হওয়ার জোগাড়। ফাইজা কথা খুঁজে পেলো না। আসার পর প্রথম দেখা কি বলবে ভেবে পাওয়া বড় কঠিন বিষয় হয়ে গেলো। এক টুকরো অস্বস্তির দানা মনে রেখে ফাইজা বোনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল

— মা কে ওযু করতে দাও। আমার কাছে আসো।

ফারিহার কান্না হুট করে থেমে গেলো। তিন বছরের বাচ্চা মেয়ে চোখে গড়াগড়ি খাওয়া অশ্রু সমেত তাকিয়ে রইলো ফাইজার দিকে। আসমা বড্ড বিরক্ত। মেয়ের কান্নায় সাথে ফাইজার দর্শনে। সে কোলের ছোট মেয়ে বকলো খানিকটা। ফাইজা ফারিহার সামান্য অনিচ্ছাকে ইয়ত্তা না করে কোলে নিলো। আসমা খুশি হলো কিনা বোঝা দ্বায়। সে চটজলদি ওযু করায় মগ্ন হলো। ফাইজাও যে আগ বাড়িয়ে, অতি খাতিরে আসমার সাথে কথা বলতে গেলো এমনটা নয়। সে ফারিহাকে কোলে নিয়ে দু পা চার পা হেঁটে, দু একটা অকেজো কথা বলে ফারিহাকে স্বাভাবিক করলো। ততক্ষণে আসমার হাত মুখ ধোয়া ও ওযু করা শেষ। সে এসে ফারিহাকে নিজের কোলে নেওয়ার সময় প্রথম বাঁক ফুটালো

— কলের পাম চলে গেছে। পুকুরে যইয়া ওযু করে আইসো।

ফাইজা চমকানো গলায় বলল

— আসলেই?

— আমি মিথ্যা কমু কি জন্যে।

সুদ্ধ অশুদ্ধর সংমিশ্রণে রাগের বাণী। ফাইজা কথা বাড়ালো না। আসমাও বসে রইলো না আরো দু একটা কথা আদান প্রদানের আশায়। সে চলে গেলো ঘরে। বিপদে পরলো ফাইজা। সর্বশক্তি ছেড়ে দিয়ে একেবারে নিস্তেজ হয়ে পরা টিউবওয়েলের হাতল একবার চাপ দিয়েই ঠোঁট উল্টে তুলল ফাইজা। সত্যিই কল অকেজো হয়েছে। পানি উঠছে না। বাবা এসে পাশের বাড়ির শরিফুল চাচাকে ডেকে না আনা অব্দি এই কল এমনই অকেজো থাকবে। ফাইজা ভাবনার মাঝে একবার আকাশ পানে চাইলো, সামনের পথের আলো আঁধারের অনুপাত হিসেব করলো। ততটা আঁধার নয়। চেয়ারম্যানের পুকুরঘাটও নিকটেই। যাওয়াই যায়।

.
ঘাট পাড় নির্জন। জলে টইটম্বুর পুকুর। গত রাতের বর্ষায় তার রূূপ-যৌবন যেন বেড়ে গেছে অনেক ধাপ। ফাইজা ধীর পায়ে নামলো পুকুরে। পা টিপে টিপে, একে একে সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেলো নিচে। পরিষ্কার, টলটলে পানি দেখেই মনের দুঃখ যেন অনেকখানি তলিয়ে গেলো। সতেজ এক আস্তরণ পরলো কষ্টের ওপর। হাত বাড়িয়ে পানি ছুঁইয়ে প্রথমেই সে মুখ ভিজিয়ে নিলো। এই পুকুরে কত নামা হতো আগে! ডুবে ডুবে জল খেয়ে সাতার শিখেছিলো ফাইজা। বাবা শিখিয়েছিল। ফাইজার মা পানি দেখে ভয় পেতেন। তিনি সাঁতার জানতেন না। সামান্য টিউবওয়েলের হাতল চেপে পানি উঠাতে গেলেই তার হাত হতো রক্তবর্ণ। উজ্জ্বল স্যামলা হাতে কখনো কখনো দেখা দিতো ফোস্কা। ফাইজার মন ছটফটিয়ে উঠলো। মায়ের স্মৃতিচারণের মাঝে ভেসে উঠলো বাবার পুরোনো ভালোবাসা। অতঃপর ভেসে উঠলো তাসরিফের যত্নগুলো। কালেভদ্রে ব্যাতিত গোসলের পানি কখনোই ফাইজার মা কলের হাতল চেপে উঠাতো না। মিরাজ সাহেব উঠিয়ে দিতেন। ফাইজাও যেন ঐ বৈশাখ আর এই পৌষ এমন ব্যাবধানে হাতে কাপড় ধুতো। পানির সাথে তার দীর্ঘ ক্ষণের সন্ধি হতো। অন্যথায় তাসরিফ ভীষণ রেগে যেতো। কারণ পানির দরূণ ফাইজার জ্বর, ঠান্ডা, গলা ব্যাথা, এলার্জি জনিত সমস্যা হয়। আইসক্রিম ভীষণ পছন্দ হওয়া সত্বেও তাসরিফ ফাইজাকে এই বস্তু ছুঁতে দিতে নারাজ ছিলো। একবার হলো কি! ফাইজা চুপিসারে কলেজ থেকে ফেরার পথে আইসক্রিম কিনলো। দু একটা বান্ধবী জুটেছিল তখন। মোটে তারা তিনজন ছিলো। সকলেই সেদিন আইসক্রিম খেলো একে একে পাঁচটা। ফাইজা আরো শখে শখে খেয়ে নিলো সাতটা। ভেবেছিল তাসরিফ বুঝবে না। জানবেই না। কিন্তু ভাবনাটা বড় ভুল ছিলো। রাতে শ্বাসনালী বন্ধ হওয়ার জোগাড়, কন্ঠ নালী চেপে গেলো। কন্ঠ হয়ে গেলো ফিচেল। তাসরিফ যখন পড়তে বসালো। যুক্তিবিদ্যায় তাকে ধরলো আইনস্টাইনের নাম। সে বলতে গেলে শোনালো

” আমি খাই নাই”

কি এক ভয়ানক অবস্থা ছিলো তার। না পেরেছিল গলায় ওড়না পেচিয়ে রাখতে। না পেরেছিল তাসরিফের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক কাপ চা খেয়ে গলা পরিষ্কার করতে। অবশেষে তাসরিফ বউয়ের কন্ঠ শুনে বুঝেই গিয়েছিল কি হয়েছে তার অগোচরে। পুরোনো দিনের কথা ভাবতে গিয়ে ফাইজা ফিক করে হেসে উঠলো। ঠিক এই হাসিতেই নিষিদ্ধ মায়া নগরীর পথে পা বাড়ালো পাড়ে দাড়িয়ে থাকা আরেকটা যুবক। বুকের ভেতর শুরু হলো চিনচিন ব্যাথা। তবে সে ব্যাথা তার কাছে পাত্তা পেলো না। আবার যেন পেলো। একটু খানি গুরুত্ব পেয়ে জলে ভেজানো হাতটা বন্দি হলো যুবকের হাতের ক্যামেরায়। ফাইজা এবিষয়ে রইলো অজ্ঞ।

ফজরের পরপরই বেরিয়ে পরা কাব্যর। চেয়ারম্যানের বাড়িতে দিন কয়েকের অতিথি হিসেবে উঠেছে। শখের ফটোগ্রাফি সিলেটে এসে শুরু হলো ফাইজার জলে সিক্ত হাতের ছবি থেকে। কাব্য অনিমেষ তাকিয়ে দেখলো এই ফটো। আবার চাইলো ফাইজার পানে। ফাইজা ওযু শেষে চলে যাচ্ছে বাড়ির দিকে। কাব্য বেশ খানিকটা চমকে গেছে, অনেকটা অবাক হয়েছে। ট্রেনের সেই মেয়েটা? এই গ্রামের? ভাবনার মাঝে বড়সড় এক দম শ্বাস ফেলল কাব্য। অনুমতি বিহীন ছবি তুলতে গিয়ে যে ধরা খেলো না সে এটা তার সাত কপালের ভাগ্য। মেয়েটা দেখে নিলেই হয়তো আবারও কুটিল চোখে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ কন্ঠে ঝাড়ি মেরে বলতো

” অনুমতি ছাড়া আমার ছবি কেন তুললেন?”

মমে মনে ফাইজাকে নকল করে এক চিলতে হাসিতে মেতে উঠলো কাব্য। অতঃপর পা বাড়ালো অন্য পথে। ভোরের কিছু ফটো সংগ্রহ করা বাকি আছে। আরও বাকি আছে বৃষ্টি ভেজা স্নিগ্ধ প্রকৃতির সাথে সাক্ষাৎ করা।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here