#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_৯
ঠেলাগাড়ি যেমন ঠেলে ঠেলে দূর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। ঠিক এমন করেই ফাইজা দিন পার করলো তিনদিন। সাদের সাথে নিয়ম করে রোদ হারিয়ে যাওয়ার কালে যাওয়া হয় পাহাড় দেখতে। বাড়ি থেকে একটু দূরে হেঁটে গেলেই সবুজ ঘাসে বিছানো মাঠের দেখা পাওয়া যায়। তার থেকে বেশ দূরে, খানিকটা জঙ্গলে ঘেড়া উঁচু উঁচু পাহাড় দাড়িয়ে থাকে। ফাইজার কোলে বসে থাকে ছোট ফারিহা। সাদ তার শখের ছাগলের জন্য ঘস কেটে মুঠ পাকিয়ে বোঝা তৈরি করে। প্রথমবার যখন ভাইয়ের এহেন কান্ড দেখে, ফাইজা ছলছল নয়নে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। বাবার তো এতোটা করুণ অবস্থা নয়? সাদও বাবার অবহেলার ছেলে নয়। বরং অধিক আদরের। একজন স্কুল শিক্ষকের ছেলে মাঠে এসে ছাগল চড়ায়, আবার কোমরে গামছা বেঁধে খাটি কিশোর কৃষকের বেশে ঘাস কাটে! ব্যাপারটায় বাবার কিছু যায় আসে না? ফাইজা প্রশ্ন করে সাদকে। সে সাবলীল ভাবে উত্তর দেয়
” আমি টাকা জমাচ্ছি। ”
ফাইজা অবাক হয়। কৌতুহলী হয়ে শুনতে চায়
” টাকা মানে? তুই এই বয়সে টাকা দিয়ে কি করবি?”
” একবছর পর তো কলেজে যাবো। আমি বাইরে পড়তে চাই। ভালো কলেজে ঢাকার মধ্যে। মায়ের ভাইয়ের ছেলে যেখান থেকে পড়েছে ওখানে। মা যে শহরে বড় হয়েছে ওই শহর দেখতে চাই। ”
” তা না হয় পড়বি। কিন্তু একজ্য ছাগল পালতে হবে তোর? বাবা তোকে টাকা দেয় না?”
” দেয়, কিন্তু উনি অশান্তি করে।”
ফাইজা দমে গিয়েছিল। জীবন…! শুধুই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ফাইজার ভেতর হতে। কি পাগল বুদ্ধি তার ভাইয়ের!
” বাবা কিছু বলেনি তোর এমন পাগলামি দেখে?”
” রেগে কথা বলেনি তিনদিন। আমারও কিছু যায় আসেনি।”
ফাইজা এরপর আর সেদিন কথা বাড়ায়নি। সাদের কান্ডে তার হাসি পায় আবার যেন বুক কষ্টে ভারি হয়ে ওঠে। এমনটা কি হবার কথা ছিলো? মা আজ পাশে থাকলে ফাইজার ভাইয়ের জীবনটা অন্যরকম হতো। ফাইজারও হয়তো যেতে হতো না এতো দ্রুত শশুর বাড়ি। তাসরিফ নামের কেউ আজ নিশ্বাসে-বিশ্বাসে রাজত্ব করতে পারতো না।
আজ ফাইজার মনের এক আনা পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। গত তিনদিন যাবত ষোলা আনা মনখারাপ তাকে ধাওয়া করে বেড়িয়েছে। আজ তাদের এক আনা অনুপস্থিত। মানুষের চোরা চিত্ত তো এমনই। কতদিনই বা চোখ পারে অহর্নিশি অশ্রুর ঝড়না বহমান রাখতে। কতদিন মন মস্তিষ্ক চায় প্রতিনিয়ত কষ্ট গুলো জাগ্রত রেখে আহত হতে! ছেড়ে যাক দুঃখ, একটু স্বস্তি একটু শান্তি ডানা মেলে ফাইজার কোল জুড়ে বসুক। এমনই ভাবনা ফাইজা ভেবে নিয়েছে। বাহাত্তর ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে, ফাইজা গভীর হিসেব করে দেখেছে চার হাজার তিনশো বিশ মিনিট ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে। তাসরিফের কি মনে পরেনি ফাইজার কথা? ভাবতে গেলে হুহু করে ওঠে বুকের ভেতরটা। হয়তো পরেনি মনে, হয়তো তাসরিফের কল্পনা জুড়ে ফাইজা আর নেই। হয়তো একবারও তাসরিফের ইচ্ছে হয়নি ফাইজাকে একটা ফোন করার।
— আপু, চলো।
ভাবনার ঘোর উড়ে গেলো। ফাইজা পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইলো সম্মুখে সাদের পানে। ফারিহা ছোট হাত ভর্তি করে দু একটা লম্বা ঘাস নিয়েছে। সাদের পাশে দাড়িয়ে সেও প্রস্তুত বাড়ির পথে হাঁটার জন্য। কেবল যেন ফাইজাই বসে ছিলো। এলোমেলো, ছন্দহীন হাওয়ার মাঝে ফাইজা ঠোঁটে এক চিলতে হাসি জুড়ে দিয়ে উঠে দাড়ালো। ফারিহার ছোট হাতটা ধরলো। অপর হাতে ধরলো সাদের শখের ছাগলের রশি। নগ্ন পায়ে তারা তিন ভাই-বোন পাশা পাশি হেঁটে বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। সাদের এলোমেলো ঘাসের বোঝা থেকে ঘাাস পরছে যেখানে সেখানে। মাথায় রাখতে পারেনি বোঝা, আবার হাতেও ধরতে পারেনি সে। ফাইজা ভাইয়ের মাথায় একটা গাট্টা মেরে নাক মুখ সিটকে তোলার ভঙ্গি করে বলল
— এই ছাগলামি কিভাবে করলি তুই বুঝলাম না। ঘাস কাটোতে জানিস না, বোঝা বাঁধতে জানিস না, তারপরও সাহস করিস ছাগল পালার? ঢাক নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার!
কথার মাঝে ফাইজা সাদের হাত থেকে ঘাসের বোঝা নিলো। ছাগলের দড়ি দিলো সাদকে। সাদ মাথায় হাত রেখে নিজের বোকামির জন্য একটু মুষড়ে পরলো। সত্যই কি সে তথাকথিত ‘ছাগলামি’ বিষয়টা করে ফেলেছে? বেঝা যাচ্ছে না!
.
.
.
ফাইজার দিন এমন করেই ভাই আর বোনের সাথে কেটে। রাত কাটে তাসরিফের কথা স্মরণ করে। আজ সাত দিন হতে যাচ্ছে ফাইজা বাবার বাড়িতে।
গোধূলির শেষ প্রহর। আকাশ রক্তিম। রাত নামার তাড়া। ফাইজা হাতে হাতে সাহায্য করছিলো আসমার রান্নার কাজে। পাশের বাড়ির এক চাচি বসে আছে উঠোনে। আসমা তারই নিকটে আলু, পটোল কাটছে। দুজনে গল্পে মত্ত। ফাইজা মন দিয়ে কখনো তাদের খোশগল্প শুনছিলো আবার কখনো মাটির চিলোয় ঠেলে দিচ্ছিলো শুকনো পাতা। এমন অবস্থায় হঠাৎ উঠোনে বসা চাচি ফাইজার উদ্দেশ্যে কথা ছুড়ে দিলেন। বলে উঠলেন মুখভঙ্গি একটু বিকৃত করে
— ফাইজার মনে হয় শশুর বাড়ি যাওয়ার সময় হয়াই আইলো।
ফাইজা চমকে উঠলো। জেল পলাতক আসামির মতো দাপিয়ে উঠলো তার আত্মা। উঠোনে বসা মহিলার চোখ জোরা ছোট। দৃষ্টিতে আস্ত গোয়েন্দা সংস্থা স্থাপন করে রাখা যেন। ফাইজা দ্রুত ডিঙ্গাতে চাইলো দুশ্চিন্তা। সরাতে চাইলো মুখের অভিব্যাক্তি। সহজ ভাবে বলতে চাইলো
— হ্যা।
পাশের বাসার চাচি বোধ হয় একথা বিশ্বাস করলেন না। ফাইজাকে প্যাচে ফেলার ভাবনায় পুনরায় প্রশ্ন করলো
— জামাই খোঁজ নেয় না? কোনোবার এতো এতোবেশি থাকিস না। এইবার কি হইছে? সমস্যা? ওই ফাইজা…… তোর বাচ্চা হইবো না দেইখা কি ঝামেলা বাজছে?
ফাইজা মুহূর্তের মাঝে তরতর করে ঘেমে সিক্ত হয়ে উঠলো। চোখের নিচে জমলো ঘাম জল। চিবুক বেয়ে আসলো ফোঁটা ফোঁটা পানি। মাথা ফাঁকা হতে শুরু করলো। কি উত্তর দেওয়া যায়? আজ যাচ্ছেতাই বলে পার হয়ে গেলেও এই কথা চক্রর মতো ঘুরে আবারও সামনে দাড়াবে তার। জীবন পথ যেন বৃত্ত হয়ে গেলো ফাইজার। এতোদিন দুঃখ কষ্ট, তাসরিফ, ফাইজা একটা বৃত্ত পথে চলছিলো। আজ যেন যুক্ত হলো আরো একটা উপাদান। প্রশ্ন নামক উপাদান। না উপাদান নয় স্থানাঙ্ক। এতো এতো স্থানাঙ্ক কে ঘিরে তৈরি হওয়া সমীকরণ গুলো ফাইজা কিভাবে সমাধান করবে? সকলের অগোচরে ফাইজা হাশফাশ করে উঠলো। হঠাৎই জলন্ত চুলার মুখ হতে উঠে দাড়িয়ে বলল সে
— আমার ফোন বাজছে। আমি কথা বলে আসি।
ফাইজা এলোমেলো পায়ে ছুটলো ঘরের পানে। উঠোনে বসা মহিলাটা পলকহীন তাকিয়ে দেখলেন ফাইজার চলে যাওয়া। যেন গভীর ধ্যানে অবলোকন করলেন ব্যাপারখানা। আসমার নিকট বললেন
— মাইয়ারে কি বাড়ি থেকে বাইর কইরাই দিছেনি। আগে তো থাকতে কইলেই কইতো, শশুর, শাশুড়ী, জামাই তিনদিনের বেশি থাকতে মানা কইরা দিছে।
আসমার চোখ জোরা বড় হয়ে গেলো। যেন নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারলো তার মস্তিষ্ক। বুকের মাঝে শুরু হলো ধুকপুক ধুকপুক। তবে কি বুলবুলি ভাবির কথা ঠিক? আসমার পাঁচ মনের চার মনই সাই জানালো এ প্রশ্নে। তার বুলবুলি ভাবি অতীত বার্তা পেশ করে মাথা খাঁটিয়ে আরো একটু আগাম বার্তা তৈরি করে বললেন
— দেহো ফাইজার মা কি হয় না হয়। আবার গাঁয়ের মানুষের কথায় কিন্তু থাকা যাইবো না। ঘাট পাড়ে গেলেই সবাই জিগাইবো, ফাইজা রে কি ছাইড়া দিছে?
আসমা কথাগুলো শ্রবণ করে কাল পরিস্থিতি ভুলে ঠাঁই বসে রইলো। হাতে তার আধ কাটা আলু। বুলবুলি চলে গেলেন। আসমার ধাতস্থ হতে সময় লাগলো। ক্ষুব্ধ মনে, চিন্তার সাগরে পরে গিয়ে তিনি রান্না শেষ করলেন দ্রুত। ফাইজা আর এমুখো হলো না। হতে পারলো না। যদি সৎ মা এ প্রশ্ন করে বসে তখন সে কি জবাব দেবে? বড্ড কঠিন প্রশ্ন এটা। হাজার টন ভারি এই প্রশ্নের ওজন। বহন করা যায় না।
চলবে….