আমার_ভাঙা_ক্যানভাসে (৭) #তানজিলা_খাতুন_তানু

0
398

#আমার_ভাঙা_ক্যানভাসে (৭)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

জয় খুড়িয়ে খুড়িয়ে আগিয়ে গিয়ে দিয়াকে দেখতে পাই, ওহ দাঁড়িয়ে রুহি আর একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। ছেলেটা কে পেছন থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু জয়ের মনে হচ্ছে ওর চেনা কেউ।

জয়কে দেখা মাত্র ওর বোন দিয়া বলল,
– ‘আরে দাভাই তোর পায়ে কি হয়েছে? খুড়িয়ে হাঁটছিস কেন?’
– ‘একটা মুটকি পায়ের উপরে প্যা’রা দিয়েছে।’ (করুন চোখে)

জয়ের কথা শুনে রুহি রাগী চোখে ওর দিকে তাকায়। কিন্তু জয় সেইদিকে পাত্তা দেয় না। জয়ের কথা শুনে ওদের সাথে থাকা ছেলেটা হাসতে হাসতে বলল,

– ‘প্যা’রা খেয়ে আবার মুটকির প্রেমে পড়ে গেলে নাকি?’
– ‘এই বেশি না বকে বাড়ি চল।’ (রুহি ধমক দিয়ে)
– ‘কেন রে দুজনে আবার ঝগড়া করেছিস নাকি?’

রুহি রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
– ‘রোহান চুপচাপ বাড়ি চল। এমনিতেই রোদে মেজাজ গরম আছে আর গরম করাস না।’
– ‘রোহান দিদির কথা শোনো নাহলে তোমাদের রাগটা ও আমার উপরে এসে পড়বে।’
– ‘আচ্ছা তাহলে আসছি জয়দা। আবার দেখা হবে, দিয়া আসছি রে।’

রোহান আর রুহি চলে যেতে জয় দিয়াকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলো।

– ‘রোহান।’
– ‘হ্যাঁ বল।’
– ‘তুই আর দিয়া একসাথে আসলি কি ব্যাপার?’
– ‘আমরা দুজন তো এক কলেজেই পড়ি। একজায়গাতেই বাড়ি তাই একসাথেই আসবো এইটা স্বাভাবিক।’

রুহি কিছু বলল না কিন্তু বিষয়টা ওর কাছে ঠিক ভালো লাগল না। একসময়ে ও আর জয়ও অনেক ভালো বন্ধু ছিল কিন্তু বর্তমানে সেই সুন্দর সম্পর্কটার মাঝেও বিচ্ছেদ ঘটেছে।

**

দুই বাড়িতেই তোড়জোড় চলছে বাড়ির ছেলে মেয়ের বাড়িতে ফিরছে এটা যে বাবা মায়ের কাছে এতটা আনন্দের দিন সেটা একমাত্র ওনারাই জানেন। দুইবাড়িতেই তাদের ছেলেমেয়েদের পছন্দের রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে।

রুহির মা কিছুটা খাবার তুলে রুহিকে বলল,
– ‘এই রুহি এই খাবারটা ওই বাড়িতে দিয়ে আয় তো।’
– ‘মা এইসব আমার একদম ভালো লাগছে না। ওদের বাড়িতেও আজকে অনেক রান্নাবান্না হচ্ছে কি দরকার দেবার।’ (বিরক্ত হয়ে)
– ‘কি দরকার মানে! আগে তো নিজেই দিয়ে আসতিস এখন কি হয়েছে?’

রুহির মা রাগ দেখিয়ে মেয়েকে কথাগুলো বললেন। রুহি কি উত্তর দেবে বুঝতে পারল না, বর্তমানে যে জয়ের সাথে সম্পর্কটাই ঠিক নেই সেটা মাকে কিভাবে বোঝাবে!

– ‘মা আমাকে দাও আমি দিয়ে আসছি।’

রোহান এসে বলল। রুহির মা রোহানকে খাবারগুলো দিয়ে ওদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন, রুহি বিরক্ত হয়ে নিজের রুমে ফিরে গেল।

**

– ‘আন্টি মা এইগুলো আপনাদের জন্য পাঠালো।’
– ‘আরে রোহান বাবা যে কেমন আছো।’ (জয়ের মা)
– ‘ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন আন্টি।’
– ‘আছি বেশ ভালোই। তুমি বসো,আমি তোমার জন্য কিছু আনি।’
– ‘না আন্টি এমনিতেই আসার পর থেকে খেয়েই চলেছি এখন আর নয় অন্য একদিন।’
– ‘আচ্ছা।’
– ‘আন্টি দিয়া কোথায়?’
– ‘দুই ভাইবোনে বসে আড্ডা দিচ্ছে। যাও না দেখা করে আসো।’
– ‘যাবো!’
– ‘হ্যাঁ যাও, জয়ের রুমেই আছে।’

রোহান জয়ের রুমের দিকে পা বাড়াল। দুটো বাড়ি পাশাপাশি হওয়াতে ওই বাড়ির সাথে এই বাড়ির মানুষদের বিশাল খাতির ছিল সেই সূত্রে রোহানও এই বাড়িতে আসা যাওয়া করত, এইবাড়ির সবকিছুই ওর চেনা।

– ‘আসবো।’

দুই ভাই বোন আড্ডার মাঝে চেনা কন্ঠস্বর শুনে সমানে তাকিয়ে দেখল রোহান দাঁড়িয়ে আছে। রোহানকে দেখা মাত্রই দিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল।

– ‘আরো রোহান আয় ভেতরে।’ (জয় হাসিমুখে বলল)
– ‘কি গল্প হচ্ছিল দুজনে।’
– ‘তোর বোনের রাগ ভাঙানোর প্ল্যান করছি রে।’ (করুন কন্ঠে)

রোহান কিছু বলল না। ছোট থেকে জয় আর রুহিকে কখনোই ঝগড়া করতে দেখেনি কিন্তু হঠাৎ করেই চারবছর আগে দুইজনের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায় যদিওবা বিষয়টা ওর কাছে স্পষ্ট নয় তবুও আন্দাজ বলে জয়ের সাথে ঝগড়ার কারনেই রুহি বাড়ি ছেড়েছিল।

– ‘জয়’দা একটা সত্যি কথা বলবে।’
– ‘কি বল।’
– ‘চারবছর আগে দিদিয়া কি তোমার কারনেই বাড়ি ছেড়েছিল!!’
– ‘হয়তো হ্যাঁ, আবার না।’
– ‘মানে?’
– ‘টিনেজার মেয়েরা একটু আবেগী বেশিই হয় আর তোর দিদিয়া একটু বেশিই ছিল তাই ঠিকভুল বিচার না করেই আবেগের বশবর্তী হয়ে বাড়ি ছাড়ে।’
– ‘তোমার কথার কিছুই বুঝলাম না। সবটা বলো প্লিজ।’

জয় মুচকি হাসল। রোহানের জানার আগ্রহটা দ্বিগুণ হয়ে উঠছে।

– ‘এই জয়দা বলো না।’
– ‘বাদ দে পুরানো কথা। এখন আইডিয়া দে কিভাবে তোর আধপাগলী দিদির রাগ ভাঙাব।’
– ‘এই খবরদার আমার দিদিয়ার নামে উল্টোপাল্টা বলবে না।’
– ‘যেটা সত্যি সেটাই বলেছি।’

**

রুহি নিজের রুমে আসলো ঠিকই কিন্তু কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারল না। মায়ের কথাটা বারবার মনে পড়ছে, সত্যি আগের দিনগুলো কতই না সুন্দর ছিল। এই বাড়িতে ভালো রান্নাবান্না হলেই জয়ের ডাক পড়ত আবার ওই বাড়িতে ভালো রান্না হলে রুহির ডাক পড়ত। হইচই, আড্ডাতে মাতিয়ে রাখত ওরা দুজন। অথচ এখন দুজনের মাঝে এতটা দূরত্ব। এই দূরত্ব কি কখনোই ঘুচবে না!!

রুহির নিজের অতীতের পাতাতে ডুব মারল।

সেইদিন ছিল বুধবার, কলেজের বসন্তবরণ উৎসব। রুহি তো প্রচন্ড একসাইটেড, কয়েকদিন ধরে প্রচন্ড প্ল্যান করেছে এটা করবে সেটা করবে করে। বন্ধুরা সবাই মিলে ঠিক করেছিল বাসন্তী রঙের তাঁতের শাড়ি পড়বে, চুলে ফুল গুঁজে বাঙালী নারী সাজবে। প্ল্যান মতোই রুহি শাড়ি বার করল কিন্তু সমস্যা বাঁধল ওহ শাড়ি পড়তে পারে না, এখন শাড়ি পড়বে কিভাবে!!

– ‘ওহ মা, মা….

রুহির চেঁচামেচির ধমকে ওর মা বিরক্ত হয়ে ওর ঘরে আসতে বাধ্য হলেন। এসেই এক ধমক দিয়ে বললেন,
– ‘কি হলো ছাগল বাচ্চার মতো ম্যা ম্যা করছিস কেন!’
– ‘মা তারমানে তুমি স্বীকার করলে তুমি ছাগল।’

কথাটা বলেই রুহি হেসে উঠল। রুহির মা থমথমে মুখ করে বললেন,
– ‘এই শয়তান মেয়ে বেশি না বকে কি জন্য ডেকেছিস বল।’
– ‘শাড়ি পড়িয়ে দাও না।’
– ‘কেন নিজে পড়তে পারিস না।’
– ‘জানোই তো পড়তে পারি না। পড়িয়ে দাও না প্লিজ।’ (আকুতি ভরা কন্ঠে)
– ‘পারবো নাহ।’

রুহির মা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চলে গেলেন। রুহি কাঁদো কাঁদো মুখ করে বিছানায় বসে পড়ল। কত শখ করেছিল শাড়ি পড়ে বাঙালী নারী সেজে একজনকে মুগ্ধ করবে কিন্তু বালাই ষাট মুগ্ধ করা তো দূর শাড়িই পড়তে পারে না। রুহি নিজেকে একগাদা বকা দিতে লাগল,

– ‘মেয়ে হয়েছিস কিসের জন্য হ্যাঁ, কোথায় শাড়ি পড়বি ছেলেদের ইমপ্রেস করবি তা না করে শাড়ি পড়ার জন্য অন্যের পায়ে ধরছিস।’ (রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে)

পরক্ষনেই চেঁচিয়ে উঠে বলল,
– ‘ওহ মা শাড়ি পড়িয়ে দাও না। ওহ মা মা গো দাও না শাড়ি পড়িয়ে।’

রুহির রাগে দুঃখে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসার উপক্রম। না পারছে শাড়ি পড়তে আর না পারছে চুপ করে সেটা মানতে। শেষে সিদ্ধান্ত নিলো একাই শাড়ি পড়বে, যা পারবে তাই পড়বে। শাড়িটাকে হাতে নিয়ে গোঁজাগুজির চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু শাড়ি পেঁচিয়ে যাচ্ছেতাই কান্ড।

রুহি আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো ফেস করে বিরবির করে বলল,
– ‘নাহ এই শাড়ি পড়া আমার দ্বারা হবে না, আমি মেয়ে না এলিয়েন ভাই! একটা শাড়িও পড়তে পারি না লজ্জা লাগা দরকার।’

সেইসময়ে রুহির ছোট কাকিয়া ভেতরে এসে রুহিকে এইভাবে শাড়ি পেঁচিয়ে থাকতে দেখে ফিক করে হেসে দেয়। রুহি তো লজ্জায় শেষ তাড়াতাড়ি করে শাড়িটা খুলতে চেষ্টা করে কিন্তু আরো জড়িয়ে যাচ্ছে। ওকে এইভাবে তাড়াহুড়ো করতে দেখে ওর কাকিয়া বলল,
– ‘আরে কি করছো আসতে। সাবধানে খোলো নাহলে আরো প্যাচ লেগে যাবে।’

রুহি কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও পারল না। শেষে করুন কন্ঠে বলল,
– ‘কাকিয়া পারছি না হেল্প মি।’

কাকিয়া মুচকি হেসে রুহির‌ শাড়িটা খুলে দিলো, তারপর যত্ন করে পড়াতে পড়াতে বলল,
– ‘মেয়ে মানুষদের এত অধৈর্য হলে চলে না। আর জানো মেয়ে মানুষরা শাড়ি পড়ে খুব যত্ন নিয়ে, তাদের কাছে শাড়িটা একটা মূল্যবান জিনিস বুঝলে।’
– ‘কিন্তু আমি তো শাড়িই পড়তে পারি না।’
– ‘একটু যত্ন নিয়ে চেষ্টা করলেই পারবে। আর একটা কথা সবসময়ে মনে রাখবে মেয়েদের শাড়ি পড়ার মতোই যত্ন নিয়ে সংসারকে আগলে রাখতে হয় তবেই সংসার টিকে থাকে। আর বড়ো হচ্ছো বুঝতে চেষ্টা করো সবকিছু বুজলে রুহু।’

রুহি মাথা নাড়ল ঠিকই কিন্তু কাকিয়ার কোনো কথাই ওর মাথাতে ঢুকল না।

কাকিয়া রুহিকে সুন্দর করূন শাড়ি পড়ে রেডি করিয়ে দিলো। রুহি খোঁপায় বেলী ফুলের মালা আটকে হাতে একডজন কাঁচের চুড়ি পড়ে হালকা মেকাপে নিজেকে সাজিয়ে তুলল। রুহি সাধারণত চোখে কাজল ব্যবহার করেনা কিন্তু আজকে হঠাৎ ইচ্ছা করল কাজল লাগাতে আবার যা তা নয় একেবারে গাঢ় করে কাজল। নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে রুহি চোখে গাঢ় করে কাজল লাগিয়ে নিলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে দেখে মুগ্ধ হলো, আজকে নিশ্চয়ই ওর প্রিয় মানুষটা ওকে দেখে মুগ্ধ হবে!

#চলবে….

শাড়ি পড়ার বিষয়টা নিয়ে কেউ আবার বলবেন না এত বড়ো মেয়ে শাড়ি পড়তে পারে না। সত্যি হলো এই যে আমি নিজেও শাড়ি পড়তে পারি না।🤥

আজকের পর্ব আপনাদের কেমন লাগল সেটা জানাবেন। আসসালামু আলাইকুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here