#এক_টুকরো_সুখ
#পর্ব_১৩
#লেখনীতে_শুভ্রতা_প্রাণ
“কি এক অলক্ষী পেটে ধরেছিলাম গো আল্লাহ। শান্তি দিলো না আমায় কখনো। এক দণ্ড সুস্থ হয়ে বসার জোগাড় নেই এই মেয়ের জন্য। ছোট থেকেই তো নিজের সর্বনাশা রূপের জন্য জ্বালিয়ে মেরেছে। আজ এ তো কাল সে এসেছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। তখন বিয়ে দিয়ে দিলেই বোধহয় বেঁচে যেতাম। তাও দিলো না তার বাপ। মেয়েকে শিক্ষিত বানাবে। পাচ্ছে এখন শিক্ষিত বানানোর ফল। কেবল দেখতে আসার কথা হলো তাতেই ছেলের এক্সিডেন্ট। ভবিষ্যতে কি হবে আল্লাহ জানে।”
“তা ভুল বলোনি মা। তোমার মেয়ের এই রূপই যত নষ্টের মূল। সবাইকে তো রূপ দেখিয়েই পাগল করে ফেলে। আমি বাবা কিছু বলবো না। আমার তো সব কিছুতেই দোষ দেখে লোকে।”
আম্মা বিলাপ করে যাচ্ছে আর সেই আগুনে ঘি দিচ্ছে আপা। না বুঝলাম ছেলের আমাকে দেখতে আসার কথা ছিলো তখন সে নিজের মামাকে আনতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করেছে। হয়তো ঠিকমতো মোটরসাইকেল সামলাতে পারেনি বা হুট্ করে অন্য কোনো গাড়ি সামনে এসে গেছে তাই এক্সিডেন্ট হয়েছে। ভাই এখানে আমার কি দোষ? আমি কি তাকে ধাক্কা দিয়ে মোটরসাইকেল থেকে ফেলে দিয়েছি? না তো! তাহলে আমি কেন এগুলো শুনবো? অদ্ভুত।
মা মেয়ের মরা কান্না আর আমাকে দোষারোপ করা দেখে ফুপু আমাকে ঘর থেকে বের হতে বারণ করলেন। আব্বা বাইরে কোথাও গেছে তাই মা মেয়েকে আপাতত থামানো যাবে না। এখন নিজেকেই সবটা হজম করে নিতে হবে। কি আর করার? নিলাম হজম করে!
ছেলে পক্ষের লোক দুদিন পরে আসবে শুনে মিনা আপাও চলে এলেন আমাদের বাড়িতে। এসে আম্মা আর আপার অমন কথাবার্তা শুনে এক দফা তর্ক করলো ওদের সাথে। কিন্তু ওরা যেন বুঝেও বুঝলো না। তারপর মিনা আপা ফ্রেশ হয়ে, খাওয়া দাওয়া সেরে এলো আমার কাছে। আমি তখন উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলাম চুপচাপ। আপা এসে পাশে বসলেন।
“আয়ু।”
হঠাৎ ডাকে চমকে তাকালাম।
“অসময়ে শুয়ে আছিস যে?”
“তেমন কিছু না আপা। ফুপু বললো ঘরে থাকতে তাই আরকি শুয়ে আছি। আর কিইবা কাজ আছে আমার এখন। তুমি কখন এলে? খাওয়া হয়েছে?”
“হুম একটু আগেই। তোর কি হয়েছে বল তো আয়ু।”
আপার কথায় কিছুটা অবাক হয়ে বললাম
“আমার আবার কি হবে?”
“তুই বিয়েতে রাজি হলি কেন? তুই তো দুপুরকে পছন্দ করিস।”
এবার যেন প্রাণপাখি উড়ে যায় যায় অবস্থা আমার। আপা বুঝতে পেরে গেছে! এখন কি হবে? যদি আব্বাকে বলে দেয়! ধরা পড়ে গেছি জেনেও মিছে মিছে বাঁচার একটা চেষ্টা করতে হবে। আমতা আমতা করে বললাম
“কিসব বলছো আপা। আমি কেনো দুপুরকে পছন্দ করতে যাবো? আর তাছাড়াও উনি তো বোধহয় তোমাকে পছন্দ করেন। আমার প্রতি যা আছে তা কেবলই ভালো লাগা। আর যদি বলো কথাবার্তার কথা তবে এটুকু উনি দুলাভাই এর ভাই হিসেবেই বলেছেন। এর বেশি কিছু না।”
আমার কথা গুলো শুনে মিনা আপা এমন ভাবে চাইলো যেন আকাশ থেকে পড়লো।
“এসব তুই কি বলছিস আয়ু? দুপুর আমার খুব ভালো বন্ধু। ভাইয়ের মতো বেস্ট ফ্রেন্ড আমার। ও আমাকে পছন্দ করে শুধু বন্ধু হিসেবে, আর কিচ্ছু নেই আমাদের মধ্যে। তোকে এসব ভুলভাল কে বোঝালো? ছি ছি ছি। আমার ভাবতেও লজ্জা লাগছে। দুপুর শুনলে কি মনে করবে কে জানে!”
চমকে গেলাম আমি। আমার ধারণা ছিলো দুপুর কম হলেও মিনা আপা দুপুরকে অনেক পছন্দ করে। কিন্তু এগুলো এখন আপা কি বলছে!
“তারমানে কি তুমি দুপুরকে পছন্দ করো না?”
“আরে পাগল আমি যদি দুপুরকে পছন্দই করবো তাহলে তোকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে জেনেও ওর কথা তুললাম কেনো তোর সামনে? মানে আয়ু তুই এগুলো ভেবে বসে আছিস? তুই? আমার বন্ধুটা তোকে কত ভালোবাসে,একপ্রকার পাগল তোর জন্য দুপুর। আর তুই কি না দুপুরকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিচ্ছিস! কাজটা কি ঠিক করছিস আয়ু?”
“আমি কীভাবে জানবো আপা যে তোমার বন্ধু আমাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে? সে কি কখনো বলেছে আমাকে?”
“বলতে কেনো হবে? তুই বুঝিস না? তুই রাফিদের সাথে কথা বললে ও রেগে যায়। তা দেখেও বুঝতে পারিসনি তুই?”
“অত কিছু বুঝি না আমি। এখন আর এসব বলে লাভ নেই। আব্বার ঠিক করা পাত্রকেই বিয়ে করছি আমি।”
“ঠিক আছে। তুই আমার কথা মানবি না তাহলে। আমিই মামাকে বলবো দুপুরের কথা।”
এই বলে আপা উঠে যেতে নিলেই আমি তাড়াতাড়ি হাত ধরে তাকে আটকে নিলাম।
“খবরদার আপা এই কাজ করো না। আব্বা ছেলেদের আসতে বলার আগেই আমার কাছে জিজ্ঞেস করেছিল আমার কোনো পছন্দ আছে কি না। কারো সাথে সম্পর্ক আছে কি না। তখন আমি আব্বাকে কিছুই বলিনি। আর কীভাবেই বা বলতাম। আমি কি আর জানতাম নাকি কিছু। আমি আব্বাকে একবার যখন বলেছি আব্বার দেখা ছেলেকেই বিয়ে করবো মানে তাই হবে। আব্বার খুশি নষ্ট করতে পারবো না আমি।”
মিনা আপা ধপ করে বসে পড়লো। আলতো করে দু’হাত আমার গালে রেখে বললো
“আর তোর খুশি! তার কি হবে আয়ু?”
আমি সামান্য হাসলাম। আমার আবার খুশি!
“আমি সবসময়ই খুশি আপা। এটা নিয়ে আলাদা করে ভাবার কিছু নেই। তাছাড়াও এখন দুপুরের কথা বললে আপা আর তার শাশুড়ি আমাকে ছেড়ে কথা বলবে না। একেই ছেলের এক্সিডেন্ট হওয়ায় আমার দোষ দিয়ে যাচ্ছে। তখন আর রক্ষে থাকবে না। আব্বাও কষ্ট পাবে। তারচেয়ে বাদ দাও এসব। খুশি মনে বিয়ে দেখো।”
মিনা আপা আমাকে আর কিছু না বলেই চলে গেলো। হয়তো কষ্ট পেয়েছে নিজের বন্ধুর কথা ভেবে। কিন্তু আমারই বা কি করার। ওরা তো আগে থেকে কিছু বলেনি আমাকে। তাহলে নাহয় আব্বা যখন জিজ্ঞেস করেছিল তখন বলতে পারতাম। কিন্তু এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আব্বা ছেলের মামাকে কথা দিয়ে ফেলেছেন। আমি এখন কিছু করলে আব্বার বদনাম হবে। তা হতে দেওয়া উচিত হবে না।
রাতে খাওয়ার সময় আম্মা আমাকে দেখে আরেক দফা উত্তেজিত হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন। মূল কথা ওই একটাই,আমি ভালো না। রুবি আপাও সুযোগ বুঝে বুঝে ঘা মারতে বাকি রাখছে না। এবার আর সহ্য হলো না আমার। সেই বিকেল থেকে এদের কথা চুপচাপ শুনে যাচ্ছি।
“সমস্যা কি তোমাদের আম্মা? না আসলে আমি করেছিটা কি বোঝাও আমাকে। কেন তোমরা ছেলের অবস্থার জন্য আমাকে দোষ দিচ্ছো? আর আপা তুমিই বা কেমন। আম্মা না হয় রাগের মাথায় বলছেন কিন্তু তুমি কেন? তুমি এখন অন্যের বাড়ির বউ। তোমাকে কে এত অধিকার দিয়েছে আমাকে আজেবাজে কথা শোনানোর? তোমরা কি ঠিক করেছো আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না তাই?”
দুইজনেই বেজায় চোটে গেলো আমার কথা শুনে। আম্মার থেকে বেশি রুবি আপা।
“দেখছো আম্মা তোমার মেয়ে আমাকে কীভাবে কথা শোনালো? আমি কি একা একা এসেছি তোমাদের বাড়িতে? নিজেরাই তো ফোন করে ডেকে আনলে। এখন এভাবে অপমান করছো কেনো?”
“তোর সাহস কিন্তু দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে আয়না। রুবি তোর বড় বোন হয়। তোর ভালো মন্দ নিয়ে কথা বলতে পারে না ও?”
“ভালো? এখানে কেমন ভালো দেখলে তোমরা? ফুপু তুমি কোনো ভালো দেখছো সেই বিকেল থেকে এই অবধি এদের কথার মধ্যে? মিনা আপা তুমি দেখেছো ভালো কিছু? রুবি আমার বড় বোন। এই এক দোহাই আর কত দেবে? বড় বোন হিসেবে আপার তো উচিত তোমাকে ঠান্ডা করা আম্মা। সেখানে আপা কোন যুক্তিতে তোমাকে আরো উস্কানি দেয়?”
ফুপু আর মিনা আপা চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। আম্মা আর আপা দুজন আমাকে একরকম চেপে ধরেছে। কেন তাঁদের কথায় উত্তর দিলাম আমি সেটাই হলো সমস্যা! এরমধ্যে আব্বা আর দুলাভাই বাজার থেকে ফিরলো। চেঁচামেচি শুনে আব্বা ছুটে এলেন রান্না ঘরে। আপা লোক দেখানো কান্না করছে। সাথে আম্মা বিলাপ করে চলেছে দেখে আমাকে আব্বা জিজ্ঞেস করলেন ঘটনা কি। সব বলার পর আব্বাও রেগে গেলেন।
“কি সমস্যা তোমার মুহিনের মা? আমার আয়ুকে তোমাদের মা মেয়ের সহ্য হয় না কেন? এরকম তো কথা ছিলো না রাবেয়া। বিয়ের আগে তো তুমি কথা দিয়েছিলে আমি যদি তোমার মেয়েকে নিজের সন্তানদের থেকে আলাদা না করি তবে তুমিও কখনো আমার ছেলেমেয়েদের অযত্ন করবে না। কিন্তু এখন কি করছো তুমি? রুবি আর আয়নাকে কেন এক চোখে দেখতে পারো না তুমি? কই আমি তো কখনো আয়না আর মুহিনের থেকে রুবিকে আলাদা করিনি।”
আব্বার রাগ দেখে ফুপু তাকে থামাতে গেলেন কিন্তু আব্বা থামলেন না। আপা আব্বার রাগ দেখে চুপসে গেলেও আম্মা হাল ছাড়লেন না। দ্বিগুন তেজ নিয়ে বললেন
“তুমি এক চোখে কখন দেখলে আয়নার বাপ? তোমার মেয়ে আয়নাকে কত শত লেখাপড়া করাচ্ছো, মোবাইল দিচ্ছো। আমার রুবিকে কখনো দিয়েছো?”
আব্বা বসে পড়লেন মেঝেতে। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়েছেন উত্তেজনায়।
“তুমি ভুল ভাবছো ভাবি। রুবি তো নিজেই লেখাপড়া করলো না। ভাই তো ওকেও স্কুলে দিয়েছিলো। ওই তো সারাদিন টো টো করে বেড়াতো পরে বললো পড়বে না। আর আয়ুকে মোবাইল দেওয়ার দরকার আছে এখন। ও কলেজে যাবে এখন থেকে। সুবিধা, অসুবিধা জানাতে হবে না বাড়িতে? এগুলো কেমন অবুঝের মতো কত বলছো তুমি ভাবি?”
আম্মা তাও দমলেন না। নিজের মতো বকবক করতে থাকলেন। এসব দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে ঘরে চলে এলাম আমি। আব্বা, দুলাভাই, মিনা আপা সব না খেয়ে শুয়ে পড়লো। আর ভালো লাগে না এসব। আমার আম্মা কেন অন্যদের মায়ের মতো হলো না কে জানে। আল্লাহ জানেন কোন পাপের ফলে এমন মা পেয়েছি আমি। রাতটা সবার কোনোরকম কাটলো সেদিন। পরেও দিনটাও কেমন মেঘলা কেটে গেলো। কারো সাথে কারো তেমন কথা নেই। যে যার মতো।
ওই দিন রাতে আবার দুপুরের কল এলো। মাঝে একদিন আসেনি। কেন কে জানে। কল ধরার ইচ্ছে না থাকলেও কি মনে করে যেন ধরেই ফেললাম। ফোন কানে নিয়ে ওপাশে থাকা মানুষটার প্রথম কথা শুনেই মাথায় আগুন ধরে গেলো আমার।
চলবে…?