#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৫
সকলের চক্ষু যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম। স্বচ্ছের মুখে এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউই। উপস্থিত সকলে তখন হতবিহ্বল নয়নে চেয়ে আছে স্বচ্ছের দিকেই। সৌমিত্র নিজের বৃদ্ধ আঙ্গুলের নখ দাঁত দিয়ে কাটতে কাটতে বিড়বিড়িয়ে বলে ফেলল,
“নাও! ভাই আরো একটা বো/ম ফা/টিয়ে দিলো। ভাঔ আর বাবা দুজনেই তো চলাফেরা করা জীবন্ত বো/ম। কে কখন ফেটে যায় তার ঠিক নেই। এখন বাকি রইল বাবা ফেটে যাওয়ার। আল্লাহ্, জানে সামনে কী হতে যাচ্ছে।”
সৌমিত্রের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই রাগে ফেটে পড়লেন সরোয়ার সাহেব।
“তুমি কী বলছ সেটা আদেও বুঝতে পারছ স্বচ্ছ? মাথায় জ্ঞান রেখে কথা বলছ তুমি? ওই মেয়ের একটা বাচ্চা আছে। এ ব্যাপারে জানো তুমি?”
স্বচ্ছ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে ওঠে,
“জানব না কেন? সব জানি। বাচ্চার নাম ইথান। দেখতেও বেশ সুন্দর। সহজসরল একটা বাচ্চা।”
ছেলের কথায় যেন ভাষা হারালেন সরোয়ার সাহেব। স্বচ্ছ এমনভাবে ইথানের সম্পর্কে বলে যাচ্ছে যেন ইথানের সম্পর্কে সে রচনা জানতে চেয়েছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন তিনি। নিরাশ কণ্ঠে বললেন,
“আমাকে এই দিনও দেখতে হলো। আমার ছেলে কিনা এখন এমন একটা মেয়েকে ভালোবাসছে যার চরিত্রের কোনো ঠিকঠিকানাই নেই। আবার বড়ো মুখ করে বলছে সে মেয়েটাকে ভালোবাসে।”
মোহের চরিত্রের কথা ওঠামাত্র যেন কাঁপুনি ধরে গেল স্বচ্ছের শরীরে। ঘাড়ের রগগুলো একবার ফুলে উঠছে একবার বসে যাচ্ছে। নিজের ঘাড়ে কাঁপা হাত রেখে মাথা কাত করে ঘাড়ে জোরে জোরে চাপ দিতে থাকল সে। ক্রোধে নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে তার।
“ওর চরিত্র নিয়ে কোনো কথা বলবে না বাবা প্লিজ। আমি নিজের ভারসাম্য হারাচ্ছি।”
সরোয়ার সাহেব দুম করে উঠে দাঁড়িয়ে স্বচ্ছের মুখোমুখি এসে স্বচ্ছের বুকে ধাক্কা দিয়ে শুধালেন,
“বললে কী করবে তুমি? মা/রবে? হাত ওঠাবে নিজের বাপের উপর?”
সৌমিত্র ছুটে এলো। স্বচ্ছের হাত ধরে পিছু হটিয়ে দিয়ে নিজে সরোয়ার সাহেবের সামনে দাঁড়াল। সে জানে তার বড়ো ভাই আর বাবার রাগ একত্র হলে কত কিছু ঘটে যেতে পারে। সে দুজনকেই থামানোর চেষ্টা করে বলল,
“অনেক ঝগড়া হয়েছে। থামো তোমরা। বাবা কী করছ? তুমিও কি ভাইয়ের সাথে নিজের রাগে বোধবুদ্ধি হারালে?”
সরোয়ার সাহেব সৌমিত্রের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বললেন,
“তোমার ভাইয়ের মাথা পাগল হয়ে গেছে মেয়েটার জন্য। তোমার ভাইকে সামলাও। বোঝাও। ও কী করছে, কী বলছে ও নিজেও জানে না।”
“বাবা, ভাই নিজের জায়গা থেকে ঠিকই আছে। তুমি কেন এমন করছ বলো তো? সেদিন ইয়াকীনকে ডেকেছিলে। মোহকে কিড/ন্যাপ করিয়েছ। কেন করছ এসব? তুমি একজন সম্মানীয় মানুষ। তোমার কি এসব মানাচ্ছে? আর ভাই যদি মোহকে ভালোও বেসে থাকে তাহলে ক্ষতি কোথায় বলো? তার পছন্দ যদি মোহ হয় তাহলে তো আমাদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সংসার, বিয়ে সব ভাইয়া করবে। তার যদি আপত্তি না থাকে…”
সৌমিত্রকে মাঝখান থেকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন সরোয়ার সাহেব।
“তোমার বয়স এখনো হয়নি কী করলে কী সমস্যা হতে পারে এসব বোঝার। মোহের মতো মেয়েকে মেনে নিয়ে আমি নিজের রেপুটেশন খোয়াতে পারব না। গুনে গুনে বহু বছর লেগেছে আমার এই জায়গা পেতে। তোমাদের কী মনে হয়? এটা আমি নষ্ট করব?”
“তোমার কী মনে হয় বাবা? তুমি যা করেছ সেটা প্রকাশ পেলে তোমার সেই রেপুটেশন তুমি ধরে রাখতে পারবে?”
মিসেস জেবা ও ফারাহ দ্রুত এগিয়ে এলো স্বচ্ছের দিকে। স্বচ্ছের কাঁধে হাত রেখে মিসেস জেবা অসহায় গলায় বললেন,
“চুপ করো। তোমার বাবা হয় উনি। কথা বাড়িয়ো না। ঘরে যাও।”
সরোয়ার সাহেব ফের প্রশ্ন করেন,
“সেসব প্রকাশ কে করবে? তুমি?”
“যদি তুমি প্রকাশ করতে না পারো, যদি অনুতপ্ত হতে না পারো তবে আমাকেই তোমার ছেলে হওয়ার দরুণ কাজটা করতে হবে।”
সরোয়ার সাহেব এবার ধমকে উঠলেন,
“স্বচ্ছ!”
সৌমিত্র আবারও স্বচ্ছকে উদ্দেশ্য করে ঠাণ্ডা গলায় বলল,
“ভাই! মাথা গরম করো না। চলো, আমার সাথে ঘরে চলো। মাথা ঠাণ্ডা করো। রাগ নিয়ে কোনো সমাধান হবে না৷ বাবার মাথাটাও ঠাণ্ডা হতে দাও। তারপর একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে। পরে ভালো মনে বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে। এখন ঘরে চলো ভাই প্লিজ!”
মিসেস জেবারও স্বামীর বাহুতে হাত রেখে বললেন,
“ঠাণ্ডা হও তুমি। স্বচ্ছকে তো জানো ও কতটা মাথা গরম করা ছেলে। তুমি ওর সাথে তর্ক করতে গেলে কথা বাড়বে। ওকে আমি বোঝাব।”
সরোয়ার সাহেব আগের মতোই গম্ভীর সুরে বললেন,
“ওকে বলে দাও, জেবা। আমার বাড়িতে থেকে আমার বিরুদ্ধে কথা বলা বা কাজ করা আমি সহ্য করব না।”
স্বচ্ছের মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল আবার। তার সামনে থাকা মানুষটার এমন তৎপর আচরণ মেনে নিতে পারছে না সে। অ/ন্যায়ের পরেও যখন অনুনয়ের কোনো ছাপ দেখছে না যখন শরীর রি রি করছে তার। ফট করে বলে বসে,
“ঠিক আছে। তাহলে থাকব না তোমার বাড়িতে আমি।”
মিসেস জেবা বি/স্ফোরিত নয়নে তাকালেন। দাঁতে দাঁত চেপে ছেলেকে বললেন,
“চুপ করো। মুখে লাগাম দাও।”
সরোয়ার সাহেব তাচ্ছিল্য করে বলেন,
“আচ্ছা? তো কোথায় যাবে?”
“যেখানে ইচ্ছে চলে যাব। কিন্তু তুমি দোষ স্বীকার না করা অবধি এখানে আমি থাকব না।”
“তাই? তো কে আটকিয়েছে তোমায়? চলে যাও।”
ফারাহ চমকায়। সৌমিত্র চোখ কপালে উঠে যায়। ফারাহ হতভম্ব হয়ে বলে,
“বাবা ভাইয়া কোথায় যাবে?”
“সেটা ও বুঝে নেবে। এই বিলাসিতা জীবন তার পোষাচ্ছে না হয়ত।”
স্বচ্ছও এবার রাগের জের ধরে বলল,
“তাহলে একটা কথা শুনে রাখো বাবা। এইযে আমি যাচ্ছি। আর ফিরব না। না জানি এই বাড়িটাও কত মানুষের সাথে বেইমানি করে তৈরি করেছ। আমি এই বাড়িতে থাকব না। চলে যাচ্ছি।”
সরোয়ার সাহেব শাসিয়ে বলেন,
“হ্যাঁ, যাও যাও। আমিও দেখব তোমার কত মুরোদ। যেই ছেলে বাপের টাকা ছাড়া এক ধাপও চলতে পারে না সেই ছেলে কতদূর যেতে পারবে আমার জানা আছে। মনে রেখো, তুমি বাহিরে পা দেওয়া মাত্র তোমার ব্যাংক ব্যালেন্স, তোমার এটিএম কার্ড সমস্ত কিছু অচল হয়ে যাবে।”
স্বচ্ছ বাহিরের পানে পা বাড়িয়েছিল। থেমে গেল বাবার কথায়। পিছু ফিরে এলো। সোফার সামনে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখ সরোয়ার সাহেবের চোখে রেখে নিজের পকেট থেকে ম্যানিব্যাগ বের করে সেখানকার ভাঁজে ভাঁজে থাকা তিনটা কার্ড আর গাড়ির চাবি শব্দ করে রেখে দিলো টেবিলে। তার এমন কাজে হতবাক হলেন সরোয়ার সাহেবও। তিনি অবশ্য আশা করেন নি স্বচ্ছ এমন করতে পারে। তবুও শক্ত রইলেন তিনি। স্বচ্ছ ফের যেতে নিলে সৌমিত্র হাত চেপে ধরে তার।
“ভাই! কোথায় যাবে তুমি এই রাতে? কোথায় থাকবে? নিজের সমস্ত কার্ড, টাকা রেখে যাচ্ছো। এভাবে কোথায় যাবে? পাগল হয়ে গিয়েছ?”
ফারাহ স্বচ্ছের কাছে এসে নিজ ভাইকে আগলে দাঁড়িয়ে বলে,
“এত রাগ করতে নেই ভাইয়া। এভাবে কোথায় যাবে? টাকা নেই, গাড়ি নেই। সব ফেলে কী করে যাবে? মাথা ঠাণ্ডা করো।”
স্বচ্ছ নিজেকে নির্বিঘ্নে ছাড়িয়ে নিলো। বলল,
“দরকার পড়লে রাস্তায় কোনো গাড়ির নিচে ম/রে পড়ে থাকব তবুও এই লোকের বাড়িতে আসব না।”
স্বচ্ছ সদর দরজার কাছে চলে যায়। সৌমিত্র আটকাতে চেষ্টা করে। তার ফলস্বরূপ চ/ড়, থা/প্পড়, ধা/ক্কা পায় সে বড়ো ভাই থেকে। ফারাহ বারংবার ডাকতে থাকে। মিসেস জেবা কাঁদো কাঁদো গলায় চিৎকার দিয়ে ওঠেন,
“স্বচ্ছ তুমি যাবে না। মায়ের কথা শোনো।”
স্বচ্ছ পিছু ফিরে তাকায়। সরোয়ার সাহেব শক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“ওকে আজ কেউ বাঁধা দেবে না। ও নিজে একসময় ফিরে আসবে আমার বাড়ির দোরগোড়ায়।”
স্বচ্ছ বিড়বিড়িয়ে বলে,
“জীবনেও নয়।”
মায়ের মিনতি, ভাইয়ের বারণ, বোনের অনুরোধ ঠেলে দিয়ে বাহিরে চলে আসে স্বচ্ছ। সরোয়ার সাহেব ভার কণ্ঠে বলেন,
“একদিনেই বুঝে যাবে, জীবন কতটা কঠিন। এই বাবা ছাড়া সে কতটা অসহায় সে উপলব্ধি করবে খুব দ্রুত। একটু বুঝুক, কত ধানে কত চাল!”
মিসেস জেবা কেঁদে ফেললেন এবার। নারাজ হয়ে বললেন,
“তাই বলে ছেলেটাকে এভাবে চলে যেতে বলবে? ও কোথায় যাবে এই রাতে? তুমি কি ভুলে যাচ্ছো ও তোমারও ছেলে? ওর যদি কিছু একটা হয়ে যায় তখন কী হবে?”
সরোয়ার সাহেব কঠোর গলায় বলে ফেললেন,
“আমি ওকে বলেছি বাড়ি ছেড়ে দিতে? ও নিজে চেয়েছে। তাও ওই সামান্য মেয়েটার জন্য! আমি ভুলিনি ও আমার ছেলে। ভুলিনি জন্যই এতদিন ওর কোনো কাজে বাঁধা দিইনি। ও বলেছে, বাবা আমি এখনি রাজনীতিতে জড়াব না। আমি তাতে সম্মতি দিয়েছি। ও বলেছে, বাবা আমি জীবনটাকে এখন নিজের মতো আনন্দ করব। সেকারণে আমি ওকে কোনোরকম কাজের চাপ দিইনি। তার বদলে ও আমাকে কী দিলো? এই অপমান? আর তুমি কী ভাবলে জেবা? আমি ওর অপমান সহ্য করব?”
“তুমি এটা ভুলে যাচ্ছো ও মতোই জেদি। তুমি যদি জেদ ধরে ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারো তাহলে ও নিজেও জেদ ধরে বাড়িতে না আসার প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে পারে। ও কষ্টে শেষ হয়ে যাবে। তাও বাড়িতে আসতে চাইবে না। তুমি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। আমার ছেলে আমার কাছে থাকুক প্লিজ!”
জেবার কথায় সৌমিত্র বলে,
“আমি যাচ্ছি ভাইকে আনতে।”
সরোয়ার সাহেব আবারও আক্রোশে ফেটে পড়ে বললেন,
“না। ওকে কেউ নিয়ে আসবে না। ও নিজে এখানে ফিরে আসবে। বলেছি না? শুধু একটু যেতে দাও। ও যেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল সেখানেই উপস্থিত হবে। যার টাকা ছাড়া এক মুহূর্ত চলে না সে আর কতক্ষণ বাহিরে টিকতে পারবে! ও নিজেও উপলব্ধি করুক। বাপ ছাড়া ও কতটা অসহায়। ও যদি ফিরে আসে আমিও ওকে আগের মতোই মেনে নেব।”
সৌমিত্র তবুও যেন বিষয়টা মানতে পারল না। বলল,
“কিন্তু বাবা…”
সরোয়ার সাহেব ইশারায় থামালেন তাকে। বললেন,
“আর একটা কথাও না। আমার মুখের ওপর কথা বলা আমি পছন্দ করি না। আশা করি তুমি সেটা জানো? নাকি তোমারও ভাইয়ের মতো বাড়ির ছাড়ার ইচ্ছে হয়েছে?”
সৌমিত্র মাথা নত করল। নীরব হলো। সরোয়ার সাহেব এবার ক্লান্তির সুরে হাফ ছেড়ে বললেন,
“সামনে ভোটের অনেক কাজ আছে আমার। তাই অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে কেউ বিরক্ত করতে আসবে না। আমার বিশ্রাম দরকার। যে যার ঘরে চলে যাও। আর জেবা! কান্নাকাটি করবে না একদম। ওই ছেলে যে নিজের বাবার বিরুদ্ধে যায় সেই ছেলেকে নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করার কোনো মানেই হয়না।”
এই বলেই চলে গেলেন নিজ ঘরে সরোয়ার সাহেব। মায়ের মন মিসেস জেবার। কোনো বাঁধা কি মানে? চোখ দিয়ে আপনাআপনি বেরিয়ে যাচ্ছে অশ্রু। সৌমিত্র কাছে এলো মায়ের। মাকে আগলে ধরে শান্তনা দিয়ে বলল,
“এভাবে কেঁদো না মা। প্রেসার লো হয়ে যাবে তোমার। আমি আছি তো। সবসময় ভাইয়ের খোঁজ রাখব। তুমি চিন্তা করো না। ভাই ফিরে আসবে।”
মিসেস জেবা কেঁদে কেঁদে ছোটো ছেলের কাছে আবদার করলেন,
“দ্রুত স্বচ্ছকে তুমি নিয়ে এসো।”
“হ্যাঁ নিয়ে আসব। বলছি তো। ঘরে যাও।”
মিসেস জেবাকে শান্ত করে ঘরে পাঠাল সৌমিত্র। তবে তার মাথা থেকেই চিন্তা দূর হলো না যেন।
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। জ্বরের ঘোরে লিখেছি। বানানে বেশি ভুল থাকতে পারে। দুঃখিত। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]