স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি #পর্ব_১৭

0
441

#স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
#পর্ব_১৭
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

বিকেলের মিষ্টি রোদ স্মৃতির মুখে আঁচড়ে পড়ছে। রৌদ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারছে না স্মৃতি। পরম আবেশে আঁখি জোড়া বন্ধ করে ফেলছে। এক হাতে রৌদ্রকে বৃথা দমানোর চেষ্টা করছে যাচ্ছে। এদিকে একজোড়া চোখ মুগ্ধ নয়নে স্মৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করে রেখেছে। যেন চোখের পলক ফেললেই স্মৃতি হারিয়ে যাবে। নিজের প্রেয়সীর দিকে নয়ন যেতেই আঁখি জোড়া স্থির হয়ে গিয়েছে। নিজের প্রেয়সীকে দুনয়ন ভরে দেখার মতো শান্তি কোথাও নেই। মানুষটা চোখের পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছে। মানুষটার কাজে ব্যাঘাত ঘটায় এক সুন্দরী রমণী। স্মৃতিকে আকাশী ভেবে পেছনে থেকে আলিঙ্গন করে বসে। আকষ্মিক ঘটনায় অবাক হয় দু’জনেই। একে ওপরের দিকে দৃষ্টিপাত করে রেখেছে।

–স্যরি আমি আকাশীর বেস্ট ফ্রেন্ড রিখিয়া। আমি আকাশী ভেবে, আপনাকে আলিঙ্গন করে ফেলছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। স্মৃতি আঁড়চোখে মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটি বেশ স্মার্ট। স্মৃতি হালকা হেসে বলল,

–আমি কিছু মনে করি নাই। আপনি আপনার বান্ধবীর কাছে যান। কথা গুলো বলেই সামনের দিকে এগিয়ে গেল। এমনিতেই বেশি মানুষ তার পছন্দ নয়। স্মৃতি একা থাকতে বেশি ভালোবাসে। রিখিয়া বিস্ময় নয়নে স্মৃতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। স্মৃতির গা-ছাড়া ভাবে সে বিরক্ত হয়েছে। তা তার মুখশ্রী দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সে তৎক্ষনাৎ আকাশীর দিকে এগিয়ে যায়। স্মৃতি পার্কের গাছের ফুলের সুগন্ধি নিচ্ছিল। তখনই দু-চোখ আটকে যায় আরাভের দিকে, দুই পকেটে হাত গুজে দীর্ঘির দিকে তাকিয়ে আছে। স্মৃতি আরাভের অনুমতি না নিয়ে, আরাভের একটা ছবি তুলে ফেলল। তখনই আরাভের কিছু বাক্য স্মৃতির কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল। আরাভ মুখশ্রীতে গম্ভীর্য ভাব ফুটিয়ে রেখে, স্মৃতিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–মেয়েদের সাইকেল চালানো উচিৎ নয়। মা যা বলে শুনতে হয়। তোমাকে রাস্তার মাঝে আর যেন সাইকেল চালাতে না দেখি। ভরা রাস্তায় অসভ্যের মতো সাইকেল চালালে মানুষ কি বলে? আরাভের কণ্ঠে এসে ধরা দিয়েছে একরাশ ক্রোধ। সে স্মৃতিকে উওর দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই, দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। স্মৃতি আরাভের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল। তারপরে রাগান্বিত হয়ে একা একাই বিরবির করতে লাগলো,

–উনি এখন আমার ব্যক্তিগত জীবনেও নাক লাগবে নাকি? আশ্চর্য! একবার খালি নাক গলাতে আসুক। আমিও তার নাক কেটে দিব। তিনি আমার শিক্ষক হন। যথেষ্ট সন্মান করি। তারমানে এই না যে, উনি আমাকে যা বলবেন। আমাকে তাই শুনতে হবে। কথা গুলো বলেই বোনের দিকে অগ্রসর হলো স্মৃতি।

মায়রা স্বামী-সন্তান নিয়ে পার্কে এসেছে। তখনই অভ্রের সাথে দেখা। স্রুতি অভ্রের এক হাত নিজের দু-হাতে আঁকড়ে ধরে আছে৷ মায়রাকে দেখে স্রুতির দু-হাতের বাঁধন আগলা হয়ে আসছিল। তখনই অভ্র স্রুতির হাত জোড়াকে থামিয়ে দেয়। স্রুতির হাতের ভাজে নিজের হাত এক করে দিল। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে স্রুতিকে ধরে রেখেছে। যেন ছাড়লেই স্রুতি হারিয়ে যাবে। স্রুতি অভ্রের ফোনে মায়রার ছবি দেখেছিল। সেদিন ভিষণ কষ্ট পেয়েছিল স্রুতি। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছিল। অভ্র মায়রার ছবি ডিলিট করে দিয়ে, কত বার যে মাফ চেয়েছিল স্রুতির কাছে তা অভ্রের জানা নেই। সেদিন অভিমানের পাল্লা ভিষণ ভারি হয়ে উঠেছিল। অভ্র নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে স্রুতিকে ভালো রাখার চেষ্টা করে, ভালোবাসার চেষ্টা করে। অভ্রের এই চেষ্টাই স্রুতিকে মুগ্ধ করে তুলে, স্রুতিকে ভালো রাখে৷ স্রুতির মনে একদল ভয়ের দানা এসে বাসা বাঁধে। সাথে শরীরের শিরা-উপশিরা জ্বলে উঠে। মেয়েটাকে স্রুতি একদম সহ্য করতে পারে না। সে-ও নিজের মনকে স্থির করে নিল। অভ্র কি বলে সেটা দেখার অপেক্ষা করছে। সে মায়রাকে পেয়ে, যদি স্রুতিকে ভুলে যায়। তার আগেই অভ্রের সাথে সংসার জীবন ত্যাগ করার পরিকল্পনা করে নিল সে। স্রুতির ভাবনার মাঝেই কিছু বাক্য স্রুতির কর্ণকুহরে এসে পৌঁছল।

–কেমন আছো অভ্র? এই মেয়েটা কে? নিশ্চয়ই তোমার গার্লফ্রেন্ড। আমার থেকে সুন্দর মেয়েকে বশ করেছো দেখছি। একটা কথা মনে রেখো। তোমার সাথে শুধু রিলেশন-ই করা যায়। তোমাকে বিয়ে করা যায় না। এই মেয়ে টাও তোমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিবে। তোমার মতো ছেলের সাথে সুন্দর মেয়েরা কিভাবে যে, সম্পর্কে আসে? সেটাই আমি বুঝতে পারিনা। কথা গুলো বলেই অভ্রের দিকে তাকালো মায়রা। অভ্রের দিকে তাকিয়ে হতাশ হলো সে। অন্য সময় অভ্রকে এমন কথা বললে, ছেলেটা বিশাল কিছু ঘটিয়ে ফেলত। তাহলে আজ কি এমন হলো? যে ছেলেটা এতটা শান্ত রয়েছে। মায়রাকে অবাক করে দিয়ে, হাসোজ্জল মুখশ্রী করে অভ্র বলে উঠলো,

–সে আমার প্রেমিকা না নয়। সে আমার মুগ্ধতা। আমার আস্তে আস্তে তিলে তিলে কষ্ট করে গড়ে তোলা ভালোবাসা। যার মুখশ্রী দেখে আমার রজনীর শেষ প্রহরে নিদ্রা ভাঙে, অফিস থেকে বাসায় এসে যার হাসিমাখা মুখশ্রী দেখে আমার আমার বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠে। যাকে কখনো বলা হয়নি। আমি তোমাকে ভালোবাসি। যার জন্য প্রতিদিন একটা করে বেলী ফুলের মালা নিয়ে এসে, আলমারিতে লুকিয়ে রেখেছি। ভয়ের কারণে দেওয়ার সাহস হয়ে উঠেনি। সে-ই তো আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমার বউ। আমার সুখ পাখি। যাকে আমি ভিষণ ভালোবাসি। যে রোজ আমার জন্য না খেয়ে বসে থাকে। যে কখনো আমাকে সন্দেহ করেনি। যে আমাকে শিখিয়েছে। ভালোবাসায় সন্দেহ না। বিশ্বাস টাই গুরুত্বপূর্ণ। প্রেমের মতো হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে কষ্ট পেতে চায়নি। তাই তো বিয়ে করে বউকে ভালোবেসেছি। বউ আর প্রেমিকা কখনো এক হয় না। প্রেমিকা চাইলে চলে যেতে পারে৷ কিন্তু বউ স্বামীর বিপদে খারাপ সময়ে পাশে থেকে বুঝিয়ে দেয়। বউরা কখনো প্রেমিকা হতে পারে না। আমার বউ তোমার থেকে যথেষ্ট সুন্দর। তোমার বাবার থেকে, আমার বউয়ের বাবার আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট ভালো। তোমার মতো মেয়ে আমার বউয়ের বাসায় দু’জন কাজ করে। ভালো হয়েছে। তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়েছো। তা-না হলে স্রুতির মতো শ্রেষ্ঠ উপহার আমি পেতাম না। স্রুতি আমার সেই সম্পদ যা আল্লাহর দেওয়া আমার কাছে শ্রেষ্ঠ উপহার। মা একটা কথা বলতো। আল্লাহ যা কেড়ে নেন। তার থেকে দিগুন ফিরিয়ে দেন। আমি তার প্রমান পেয়েছি। তোমার সাথে আমার কোনো দিক দিয়েই যায় না। শুধু শুধু তোমার পেছনে অবুঝের মতো পড়ে ছিলাম। তোমার বাবাকে বলে দিও। অভ্র সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে। বেকার ছিলাম বলে, অনেক কথা শুনিয়েছে। এখন আমি মাসে যে টাকা ইনকাম করি। তোমার মতো কয়েকটা মেয়ে বসে খেতে পারবে। তোমার যোগ্যতা এই বুড়ো লোক পর্যন্তই। তোমার মতো মেয়েরা অভ্রকে ডিজার্ভ করে না। অভ্র একান্তই স্রুতির ব্যক্তিগত চাঁদ। যার ওপরে শুধু স্রুতির অধিকার আছে। স্রুতি ছাড়া আমার সামনে কেউ উচ্চ স্বরে কথা বলতে পারে না। আর একবার যদি আমার সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলেছো। তাহলে তোমার অবস্থা কি হবে? সেটা বলে দিতে হবে না। নিজ চক্ষে দেখতে পাবে। তোমার মতো মিডল ক্লাস মেয়ের সাথে কথা বলে, আমি আমার মহামূল্যবান সময় অপচয় করতে চাই না। বউ আমার গরমে ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছে। চলো বউ। আমি তোমাকে আইসক্রিম কিনে দিচ্ছি। কথা গুলো বলেই স্রুতিকে নিয়ে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। মায়রা অভ্রের কথায় জ্বলে উঠলো। অপমানের মুখটা চুপসে রয়েছে। তা দেখে মায়রার বৃদ্ধ স্বামী হাসছে। মূলত তার সন্তানদের দেখাশোনা করার জন্য মায়রা বিয়ে করেছেন উনি।

স্রুতি অভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটা এত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে শিখলো কবে থেকে? মানুষটাকে যত দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে স্রুতি। সে মনে মনে কি ভেবেছিল? আর অভ্র কি করল? নিজেই নিজের ভাবনাকে ধিক্কার জানালো। আজকে অভ্রের জন্য গর্ব হচ্ছে স্রুতির। অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠেছে। অভ্র স্রুতিকে বসিয়ে দিয়ে আইসক্রিম নিয়ে আসতে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে আইসক্রিম নিয়ে চলে আসলো। তা যত্ন সহকারে স্রুতিকে খাইয়ে দিল। স্রুতির আর ভিষণ কান্না পাচ্ছে। সে অভ্রের থেকে এত ভালোবাসা পাবে। কখনো কল্পনাও করেনি। তার জীবন এতটা সুন্দর হবে। এটা কখনো ভাবতে পারেনি। স্রুতি অভ্রের কাঁধে মাথা রাখলো। অভ্র এক হাতে আগলে নিল নিজের প্রেয়সীকে। এমন সময় স্মৃতি এসে বসে পড়ে তাদের পাশে। এত মানুষ কোলাহল পূর্ণ পরিবেশে সে বেশ বিরক্ত। স্মৃতিকে দেখে দু’জনেই দুরত্ব বাড়িয়ে বসলো। স্রুতি বোনের বিরক্তি মাখা মুখশ্রীর দিকে গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে আছে। গভীর ভাবে স্মৃতিকে পর্যবেক্ষণ করছে। বোনকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, স্মৃতি রাগান্বিত হয়ে বলে উঠলো,

–তোমাকে বারবার করে বলে ছিলাম। আমি এই গরমের মধ্যে ঘুরতে আসবো না। একে তো গরমের মধ্যে আলুসিদ্ধ হচ্ছি। তার ওপরে এত কোলাহল পূর্ণ পরিবেশ। তুমি জানো না। আমি বেশি মানুষজন পছন্দ করি না। আমাকে টাকা দাও। আমি বাসায় চলে যাব৷ স্মৃতির কথায় স্রুতি রাগান্বিত হয়ে বলে উঠলো,

–তোর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে? সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমি তোকে একা ছাড়বো। চল আমরা সবাই মিলে এখনই বাসায় যাব। কথা গুলো বলেই তিনজন মিলে উঠে দাঁড়ালো। পার্কের আশেপাশে বাবা-মা আকাশী আর আকাশীর বান্ধবী কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। আরাভ এক জায়গায় বসে মনযোগ সহকারে ফোনে কিছু একটা করছে। অভ্র নিজের বাবা-মাকে ফোন করল। অভ্রের বাবা-মা জানালো। তাদের গরম লাগছিল। তাই তারা চারজন বাসায় চলে গিয়েছে। তাদের হাতের নাগালে পায়নি। তাই বলে আসতে পারেনি। অভ্র বিরক্ত হয়ে স্রুতির দিকে তাকিয়ে আছে। স্রুতি অভ্রের দিকে তাকিয়ে হাসছে। অভ্র স্রতির সাথে একা কিছু সময় কাটাতে চায়। কিন্তু সেটা কারো জন্য না কারো জন্য ভেস্তে যায়। আজকে যতই রাত হোক না কেনো? সে স্রুতিকে নিয়ে সারা শহর ঘুরবে। অভ্র আরাভকে ডেকে স্মৃতিকে বাসায় দিয়ে আসতে বলল। সাথে এটাও জানালো তার আর স্রুতির ফিরতে দেরি হবে। আরাভ প্রথমে রাজি হয়নি। কাজ আছে বলে, চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু স্মৃতির রাগ দেখে দমে যায়। স্মৃতি রাগ করে একাই চলে যাচ্ছিল। মেয়েটার যদি বিপদ হয়। সে কথা ভেবে স্মৃতির সাথে যেতে রাজি হলো। রিক্সার দু’জন পাশাপাশি বসে আছে। দু’জনের মাঝে রয়েছে বেশ দূরত্ব। কেউ কারো সাথে কথা বলছে। হয়তো ভেতরে জড়তা কাজ করছে। মাঝ রাস্তায় এসে আরাভ রিক্সাওয়ালকে দাঁড়াতে বলল। রিক্সা থেকে নেমে একটি ফুলের দোকানে গেল। সেখানে থেকে রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুল কিনে নিয়ে আসলো। আরাভের হাতে থাকা ফুলের সুবাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। রজনীগন্ধা ফুল থেকে মাতাল কথা সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে। স্মৃতি আরাভকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–ফুল গুলো কার জন্য স্যার? আরাভ সামনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখ করে বলল,

–আমার জন্য।

–আপনি ফুল ভালোবাসেন! কিছুটা অবাক হয়েই বলল স্মৃতি।

–হ্যাঁ।

–এই প্রথম দেখলাম। ছেলে মানুষ হয়ে ফুল ভালোবাসেন। স্মৃতির কথা শুনে আরাভ বিস্ময় নয়নে স্মৃতি দিকে একবার তাকালো। দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলল,

–ছেলে হয়ে ফুল ভালোবাসা কি অন্যায়?

–আপনি মনে হয় আমার কথায় বিরক্ত হয়েছেন। স্যরি স্যার আর কখনো আপনাকে প্রশ্ন করবো না। আর কথা বাড়ায় না স্মৃতি। সারা রাস্তা কথা হয় না দু’জনের। নিরবেই কেটে যায় কিছু মুহুর্ত। অবশেষে রিক্সা এসে থামে নিদিষ্ট গন্তব্যে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here