#স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
#পর্ব_১৮
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
ক্লাস রুমের সাথেই ছোট্ট একটি কক্ষ আছে। যেখানে আরাভ তার কলেজের প্রয়োজনীয় জিনিস রাখে। শুধু আরাভই নয়। বিজ্ঞান বিভাগের আরো দু’জন শিক্ষক তাদের প্রয়োজনীয় বই, কাগজ, ক্লাস পরীক্ষার খাতা রাখেন। আরাভ পরীক্ষার খাতা দেখছিল। এমন সময় স্মৃতি আসে আরাভের কাছে। কয়েক অধ্যায়ের নাম বলে, আরাভকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–স্যার আমাকে এই কয়টা অধ্যায় একটু বুঝিয়ে দিবেন। পরীক্ষার আর বেশিদিন বাকি নেই। এগুলো অধ্যায়ে কিছু কিছু জায়গায় আমার বুঝতে সমস্যা হয়। আপনি যদি আমাকে বুঝিয়ে দিতেন। তাহলে আমার অনেক উপকার হতো। আরাভ গম্ভীর দৃষ্টিতে স্মৃতির দিকে তাকালো। ভয়ে মেয়েটার হাত-পা কাঁপছে। আরাভ কিছু বলল না। কণ্ঠে গম্ভীরতা বজায় রেখেই স্মৃতিকে বসতে বলল।
এভাবেই সাতদিন কেটে যায়। স্মৃতি নিয়মিত আরাভের কাছে একা একা পড়তে যায়। যা কলেজের কিছু টিচারদের নজর কাড়ে৷ এতে আরাভ নিজেও বেশ বিরক্ত। সে একজন শিক্ষক। চাইলেই মুখের ওপরে না করতে পারে না। মেয়েটা তো কোনো অন্যায় আবদার করেনি। পড়াশোনা শিখতে চেয়েছে। পড়ার সময় মেয়েটা তাকে বিরক্ত করে না। বিজ্ঞান ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা গুলো ভাবছিল আরাভ। এমন সময় রসায়নের শিক্ষক শহিদুল স্যার এসে, আরাভের পাশে দাঁড়ায়। সিনিয়র শিক্ষককে দেখে আরাভ সালাম দিল। শহিদুল কোনো ভনিতা না করে, বলতে শুরু করল,
–দেখো আরাভ শিক্ষকতা পেশাটা কিন্তু অনেক সন্মানের। তুমি কোনো ভাবে এই পেশাকে কলুষিত করো না। তোমাকে আমি কি বোঝাতে চেয়েছি। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো। মিথ্যা বলে খুশি করার চেয়ে, সত্য বলে আঘাত করা শ্রেয়। তুমি জানো আমি সব সময় মুখের ওপরে তেঁতো কথা বলতে ভালোবাসি। কথার মধ্যে কোনো ভনিতা আমি একদম পছন্দ করি না। কলেজে অল্পদিনে তোমার একটা ভালো নাম হয়েছে। সবাই তোমাকে অনেক পছন্দ করে। তোমাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু সবাই যে শুধু তোমাকে ভালোবাসবে। তার কোনো মানে নেই। কিছু কিছু লোক আছে। যারা তোমাকে ঘৃণাও করে। হিংসা করে। হিংসায় বশিভূত হয়ে, তোমাকে টেনে নিচে নামানোর চেষ্টা করছে। কথা গুলো আমার কানে এসেছে। তুমি একটা ছাত্রীকে একা একটা রুমে পড়াতে পারো না। তা-ও আবার কলেজের মধ্যে। মেয়েটাকে যদি এতই ভালোবাসো। তাহলে বিয়ে করে নাও। এভাবে আমাদের পেশা টাকে নষ্ট বানিয়ে দিও না। কথা গুলো বলেই এক মুহুর্ত বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। সবকিছু আরাভের মাথার ওপরে দিয়ে গেল। তবে সে আন্দাজ করতে পেরেছে। শহিদুল স্যার তাকে কেনো এ কথা বলল। আরাভ কোনো কথা না বলে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিল।
আজকাল স্মৃতির মধ্যে এসেছে বেশ পরিবর্তন। মেয়েটা আগের মতো পড়াশোনা করে না। বন্ধুদের সাথে এখানে সেখানে চলে যায়। সব সময় হাসিখুশি থাকে। মেয়েটার মাঝে গম্ভীরতা ভাব টাও কেটে গিয়েছে। মেয়ের এমন পরিবর্তনে চিন্তায় পড়ে গিয়েছে মুনিয়া বেগম। মেয়েটা কারো প্রেমে পড়লো না তো আবার। এই প্রেমই তার জীবন নষ্ট করে দিয়েছিল। যার মাসুল সারাজীবন গুনতে হচ্ছে। স্মৃতির মাকে মেয়ের প্রতি আরো কঠিন হতে হবে। সহজে ভেঙে পড়লে চলবে না। মেয়ে যদি বিপথে চলে যায়। তাহলে মেয়েকে সঠিক পথে নিয়ে আসার দায়িত্ব তার।
স্মৃতি বাহিরে থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে বোনের বাসায় চলে গেল। দুই বোন জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। অভ্র এসে যোগদান দেয় তাদের আড্ডায়। এমন সময় রিখিয়া আর আকাশী নিজের রুম থেকে বের হয়ে আসলো। ওদের দেখে স্রুতি রান্না ঘরে নাস্তা বানাতে চলে গেল। স্রুতির পেছনে পেছনে অভ্রও চলে গেল। স্মৃতি ভ্রু কুঁচকে রিখিয়ার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার হাতে এক গুচ্ছ লাল গোলাপ। পুরো শরীর কাঁপছে তার। হয়তো কোনো কিছু করতে চাইছে। আকাশী রিখিয়াকে সাহস যোগাচ্ছে। রিখিয়া সাহস নিয়ে আরাভের কক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তা দেখে স্মৃতির বুকের মধ্যেখানে ধক করে উঠলো। এতক্ষণে সে টের পেল। রিখিয়া ফুল নিয়ে কি করতে চাইছে। স্মৃতির ভাবনার মাঝেই রিখিয়া আরাভের কক্ষে প্রবেশ করল। আরাভ ল্যাপটপে কাজ করছিল। বিনা অনুমতিতে কক্ষ প্রবেশ করায়, সে বেশ বিরক্ত হয়েছে। রিখিয়াকে দেখে আরাভ মুখশ্রী কুঁচকে ফেলে। বিরক্তি মাখা মুখ করে বলে উঠলো,
–আপনার এখানে কি চাই? আপনি আমার বোনের বান্ধবী। আমার বোনের কক্ষে যান। আমি নিশ্চয়ই আপনার বান্ধবী নই। অযথা করে বলে আমার সময় নষ্ট করবেন না। আরাভের কথায় রিখিয়ার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। তরতর করে ঘামতে শুরু করেছে। পুরো শরীর শক্তিহীনতায় ভুগছে। ধীরে ধীরে সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। এত সহজে দমে যাওয়ার মেয়ে রিখিয়া নয়। সে আজকে নিজের মনের কথা প্রকাশ করেই ছাড়বে। রিখিয়া কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
–আমি আপনার ছোট। আপনি চাইলে, আপনি আমাকে তুমি করে বলতে পারেন। আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই। অনেকদিন ধরে বলতে চাইছি। কিন্তু সাহসে কুলিয়ে উঠেনি। আমার ইন্টার পরীক্ষার বেশি দেরি নেই। পরীক্ষা শেষ হলেই বাবা আমাদের নিয়ে ঢাকায় চলে যাবে। একবার যদি ঢাকায় চলে যাই। তাহলে মনের কথা, মনের সাথেই নিয়ে যেতে হবে। বুকভরা আক্ষেপ থেকে যাবে। একরাশ হাহাকার নিয়ে এই শহর ছাড়তে হবে। আমি হাহাকার আর আফসোস নিয়ে বাঁচতে চাই না। আমি সরাসরি বলতে চাই। সেদিন ছিল গোধুলি বিকেল বেলা। আমি আকাশীর কাছে আসছিলাম। আপনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছিলেন। বিকেলের মিষ্টি রোদ আপনার মুখশ্রীতে আঁচড়ে পড়ছিল। সেদিন আপনার সুন্দর্যটা অসম্ভব ভাবে বেড়ে গিয়েছিল। ফর্সা শরীরটাতে কালো রঙের শার্টটা একটু বেশিই চিকচিক করছিল। সেদিন আপনাকে দেখে আমি বিমোহিত হয়ে ছিলাম। আমার অনুভূতিরা আপনাতেই থেমে গিয়েছিল। অদ্ভুত ভাবে আমার ছোট্ট কোমল হৃদয়টি আপনার প্রেম পড়ে যায়। আপনি আমার থেকে বয়সে অনেক টাই বড়। কথাটা আপনি কিভাবে নিবেন। এসব কথা শোনার পরে আমাকে যদি আপনাদের বাসায় আসতে না দেন। সেই ভয়ে আমি এতদিন বলি নাই। আপনাকে দেখার লোভ আমার কোনোদিনই যাবে না। আপনাকে দেখার লোভে এতদিন চুপ ছিলাম। এখন যখন দেখলাম যাকে দেখার জন্য মনের নিষিদ্ধ ইচ্ছে গুলোকে দমিয়ে রেখেছিলাম। তাকে ছেড়ে, এই শহর ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হবে। চাইলে ও আকাশীর সাথে দেখা করার নাম দিয়ে এসে, আপনাকে দেখে যেতে পারবো না। আমি যদি ঢাকায় চলে যাই। আপনাকে দেখার লোভ জাগলে আমি আপনাকে কিভাবে দেখবো। আপনি আমাকে প্রত্যাখান করবেন না। আপনি আমাকে প্রত্যাখান করলে, আমার আ’ত্ম’হ’ত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। আপনাকে বড্ড ভালোবাসে ফেলছি। আপনাকে না দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই। আপনার কণ্ঠ স্বর শুনতে না পেলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আপনাকে দেখার জন্য আমি শতশত পাগলামি করি। আপনাকে পাবার আশায় রোজ রোজ মিথ্যা বলি। আপনি আমাকে কথা দিন। আমি ঢাকা যাবার পরে, আপনি আমার সাথে যোগাযোগ রাখবেন।
রিখিয়ার কথায় কোনো হেলদোল হলোনা আরাভের। সে আগের ন্যায় বসে আছে। ল্যাপটপটা অফ করে, উঠে দাঁড়ালো। চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলের ওপরে রাখলো। মুখশ্রীতে আগের গ্যায় গম্ভীরতা। সে রিখিয়ার কথায় রাগ করেছে নাকি খুশি হয়েছে। তা বোঝা খুবই দুষ্কর। আরাভ নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে পকেটের মধ্যে রাখলো। তারপরে কণ্ঠে কাঠিন্যতা এনে, গম্ভীর মুখে বলল,
–আমার কক্ষ থেকে বেড়িয়ে যান। কারো কক্ষে প্রবেশ করতে হলে, অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হয়। এটা আপনার জানা নেই। আপনার আমার কক্ষে প্রবেশ করার আগে, আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। একজন পুরুষ মানুষের কক্ষে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করতে, আপনার লজ্জা করল না। মেয়েদের যথেষ্ট সন্মান করি। তাই এখনো নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ রেখেছি। আমার কক্ষ থেকে বের হয়ে যান। পরবর্তীতে আমার বাসার আঙ্গিনায় যেন আপনাকে না দেখি। কথা গুলো বলেই আরাভ কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। আরাভের কথায় দমে যায়নি রিখিয়া। আরাভকে মানানোর জন্য আরাভের পেছনে ছুটলো। ড্রয়িং রুমে আসতেই আরাভ হাতে টান অনুভব করল। সে বাহিরে যাচ্ছিল। আচমকা হাতে টান পড়ায় বিরক্ত হলো সে। আরাভের পেছনেই স্মৃতি দাঁড়িয়ে ছিল। আরাভ ভেবেছে স্মৃতি। এখন স্মৃতি মাঝেমধ্যে আরাভের সাথে মজা করে। তবে আরাভকে স্পর্শ করার মতো দুঃসাহস কখনো দেখায়নি। রাগান্বিত হয়ে সামনের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। স্মৃতির জায়গায় রিখিয়া কে দেখে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। চোয়াল শক্ত করে, রিখিয়ার গালে ক’ষে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। আকষ্মিক ঘটনায় স্মৃতি নিষ্পলক ভাবে আরাভের দিকে তাকিয়ে আছে। তার আগে অন্য কেউ আরাভকে ছুঁয়েছে। কথাটার গভীরতা মাপতেই স্মৃতির ছোট্ট কোমল হৃদয়টি কেঁপে উঠলো। মনের গহীনের হাহাকারের আন্দলোন শুরু হয়ে গেল। সে যা ভেবেছিল। সেটাই হয়েছে। রিখিয়া নামের মেয়েটি আরাভকে ভালোবাসে। তবে কি সে আরাভকে হারিয়ে ফেলবে। মুহুর্তের মধ্যে স্মৃতির মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেল। স্মৃতি অচল মস্তিষ্ককে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তার শূন্য মস্তিষ্ক কিছুতেই কাজ করছে না। চিৎকার দিয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে স্মৃতির। সে কেনো নিজের মনের কথা আরাভকে জানাতে পারলো না। তার আগে কেন অন্য কেউ আরাভকে দখল করে নিল। স্মৃতির ভাবনার মাঝেই বজ্রকণ্ঠে আরাভ হুংকার ছাড়লো।
–আকাশী তোকে কতদিন বলেছি। তোর কোনো বান্ধবীকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসা যাবে না। তুই অতীতের সবকিছু ভুলে গিয়েছিস। নাকি আমাকে আবার দোষী বানিয়ের বিশাল শাস্তি দিতে চাইছিস। আমাকে তোদের পছন্দ না হলে, বলে দিতে পারিস। বাসা থেকে বের হয়ে যাব। কিন্তু তোর বান্ধবীকে দিয়ে প্রেমের প্রস্তাব পাঠানোর মানে কি? তোর বান্ধবীর সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক যায়। কোথায় সে? কোথায় আমি? রিখিয়া তোর সমবয়সী। আমি তাকে বোনের নজরে ছাড়া অন্য কোনো নজরে দেখি নাই। এতটুকু বাচ্চা মেয়ে আমাকে আ’ত্ম’হ’ত্যা করার হু’ম’কি দেয়। এত সাহস! আরাভের সামনে উচ্চ স্বরে কথা বলে। আমি জানি আমি অপরাধী। আমি নিষ্ঠুর। আমি একজন ব্যর্থ ভাই। আমি পারিনি নিজের বোনকে বাঁচাতে। নিজ হাতে নিজের বোনকে মৃ’ত্যু’র দিকে ঠেলে দিয়েছি। আমি খু’নি। আমি আমার বোনকে হ’ত্যা করেছি। তোরা আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে আয়। তবুও আমাকে খোঁচা দিয়ে অতীতের শাস্তি বর্তমানে দিস না। দিলে এমন ভাবে দিবি। যেন সেদিনই হয়। আমার পৃথিবীর শেষ দিন। আজকে তুই যে অন্যায় করেছিস। তার কোনো ক্ষমা হবে না আকাশী। আজকের পরে থেকে, তুই আমার সাথে আর কখনো কথা বলবি না। আরাভের কথা না শুনলে কি হবে বুঝতে পেরেছিস। এই মেয়েকে যেন আমার বাসায় আর না দেখি। এই মেয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাও। আরাভের হুংকারে পুরো পরিবেশ স্তব্ধ হয়ে গেল। সবাই নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। ছেলেটা খুব সহজে কথা বলে না। একবার কথা বললে, বাকিদের কথা বলার সাহস হয় না। আরাভের ভয়ংকর রুপ দেখে দমে গেল রিখিয়া। সে কান্না করতে করতে আকাশী দের বাসা থেকে বের হয়ে গেল। রোকেয়া বেগম ছেলেকে বোঝানোর জন্য এগিয়ে আসছিলেন। আরাভ কোনো কথা না বলে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। আকাশী দেওয়ালের এক কোণে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই রাগান্বিত হয়ে আকাশীর দিকে তাকিয়ে আছে।
চলবে…..