#বিবর্ণ_বসন্ত
২২তম_পর্ব
~মিহি
কলেজ থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়েই রান্নাঘরে ঢুকলো সুমি। সকালে তাড়াহুড়োয় না খেয়েই বেরিয়েছিল। অনামিকাকে যদিও বলেছিল বাইরে খেয়ে নিবে কিন্তু বাইরের খাবার খেতেও ইচ্ছে হয়নি আজ। চটজলদি প্লেট নিয়ে পাতিলের ঢাকনা তুলতেই দেখলো ভাতে পানি দেওয়া। দুপুর কেবল দেড়টা। এখনি ভাতে পানি দেওয়ার কী ছিল বুঝলো না সুমি। এরই মধ্যে রাহেলা বানু পানি খেতে আসলেন রান্নাঘরে। সুমিকে প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন।
-‘এমন প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস যে?’
-‘এখনি ভাতে পানি কেন?’
-‘আরে আজ গরম বেশি পড়েছে তো তাই অনামিকা বললো সবাই খেয়ে ভাতে পানি দিয়ে রাখতে। তুই নাকি বাইরে থেকে খেয়ে আসবি!’
সুমি সংক্ষেপে ওহ বলে কথা শেষ করলো। অতঃপর রান্নাঘরের তাকে বিস্কুটের বয়াম খুঁজতে লাগলো। বয়ামটাও খুঁজে পেল না সেখানে।
-‘ফুফু, বিস্কুটের বয়াম কই?’
-‘ঐটা তো অনামিকার ঘরে। ওর সারাদিন কিছু না কিছু খেতে ইচ্ছে করে তো তাই।’
সুমি এবার আর কিছু বললো না। প্লেটটা রান্নাঘরে রেখেই ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। ক্ষুধায় ঘুমও আসছে না তবুও ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
রাহেলা বানু সুমির চলে যাওয়া দেখে হাসলেন। মনে মনে আওড়ালেন,’ভুল বোঝা বড্ড সোজা আর সেই ভুল বোঝাবুঝিটা দূর করা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ!’ রাহেলা বানুর এ সামান্য হাসির অন্তরালে একটা সম্পর্কের বিভৎস হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা ভেসে উঠছে। নিষ্ঠুর হাসিটা তার ঠোঁটে বহাল তবিয়তে থাকলো। রান্নাঘর থেকে বেরোতে বেরোতে পুরনো একটা গানের সুর গুনগুন করতে লাগলেন তিনি।
সুমির ঘুম ভাঙলো মাঝরাতে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে ভাবতেই তার অদ্ভুত লাগলো। সারাদিন না খাওয়া, পেট ব্যথায় মনে হচ্ছে নড়তেও পারবে না। সুমি উঠে লাইট জ্বালাতেই রাহেলা বানু প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। সুমি অবাক হলো। এত রাতে তিনি খাবারের প্লেট হাতে এ ঘরে কেন?
-‘ফুফু, এত রাতে তুমি এখানে?’
-‘দুপুরে তো কিছু খাইলি না। সেই কখন ঘুমাইলি, ভাবলাম ক্লান্ত তাই আর ডাকিনি। এখন খেয়ে নে।’
সুমির চোখ ছলছল করতে থাকে। মাকে হারানোর পর থেকে মনে একটা শুন্যতা বিরাজ করছিল। আজ অনেকদিন পর সেই মায়ের স্নেহটার পরশ পাচ্ছে যেন সে। পরক্ষণেই মনটা কিছুটা খারাপ হয়ে আসে। সারাটা দিন কেটে গেল, অনামিকা একটাবার তার খোঁজ নিল না? এতটাই বুঝি পর সে? হাতমুখ ধুয়ে চটজলদি খেতে বসলো সে।
______________________
-‘সোহরাব সুমি কি উঠেছে?’
-‘তুমি এখনো ঘুমাওনি অনামিকা! এমনিতেই পেটব্যথায় তুমি অস্থির আবার ঘুমোচ্ছোও না!’
-‘ঘুম আসছে না। দেখে আসেন তো সুমি উঠলো কিনা, না খেয়ে ঘুমিয়েছে ও।’
-‘চিন্তা করো না। ফুফু আছে ওর কাছে। তোমার যে সকাল থেকে পেটব্যথা একবার বলছো আমাকে? ডাক্তার দেখাতে হতো। কালকেই চেকআপ করাতে যাবো আমরা।’
-‘আরে কিছু হয়নি আমার, অযথা চিন্তা করছেন আপনি।’
-‘চুপ! যা বলছি তাই, ঘুমোও এখন।’
অনামিকা চোখ বন্ধ করলো। পেট ব্যথা ধীরে ধীরে কমছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল অনামিকা। সে জানলোও না কেউ একজন তাকে নিয়ে কতটা ভুল ধারণা মনে নিয়ে ক্ষোভ পুষছে! যাদের সবাই ভুল বোঝে তারা কী এক মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করে তা এখনো অনামিকা জানেনা তবে জানবে বোধহয় অতি শীঘ্রই।
সোহরাব অফিস থেকে হাফ ডে’র ছুটি নিয়েছে অনামিকাকে চেকআপ করানোর জন্য কিন্তু হঠাৎ একটা মিটিং পড়ে যাওয়াতে সে যেতে পারছে না হাসপাতালে। এদিকে অন্তরা বেগম একা অনামিকাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে পারবেন কিনা ভয় হচ্ছে সোহরাবের। তিনি নিজেও অসুস্থ মানুষ। শেষমেশ সোহরাব সুমিকে বললো অনামিকাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে। সুমি কিছু বলার সুযোগ পেল না। আজ তার ইমাদ ও আফ্রিনের সাথে দেখা করার কথা ছিল। সেটা অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ নয় কিন্তু সোহরাব একবার তাকে জিজ্ঞাসাও করলো না সে যেতে ইচ্ছুক কিনা। সুমির যাওয়ার কথা শুনে যেই না অনামিকা রাজি হলো, অমনি সে সুমিকে বললো সাথে যেতে। সুমির ইচ্ছের দাম নেই? কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো সুমির মাথায়। অনামিকার চোখমুখে খুশির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। অনামিকা ভেবেছে সুমি তার সাথে গেলে দুজনে একসাথে সময় কাটাবে। ভাবনাগুলোই বোধহয় আমাদের সাথে সবচেয়ে বড় প্রতারণাটা করে!
হাসপাতালে যথেষ্ট ভীড়। একজন কমবয়সী ডাক্তার সদ্য পাশ করে এই হাসপাতালে ইন্টার্নি করছেন। তার কেবিনেই যথেষ্ট ভীড় দেখা যাচ্ছে তবে তিনি মেডিসিন স্পেশালিস্ট। অনামিকা আর সুমি বসে আছে গাইনোকলজিস্টের কেবিনের সামনে। আচমকা সেই যুবক ডাক্তার নিজ কেবিন ছেড়ে বেরোতেই সুমির সাথে তার চোখাচোখি হয়। সুমি বিরক্ত হয়ে চোখ নামিয়ে ফেললেও ডাক্তারটির দৃষ্টি বহুক্ষণ সুমির উপর থেকে সরে না। শেষমেশ যখন অনামিকা সুমিকে নিয়ে গাইনোকলজিস্টের কেবিনে ঢুকলো, তখন ছেলেটির দৃষ্টি সরলো। স্মিত হেসে চুলে হাত বুলিয়ে আবারো কেবিনে ঢুকলো সে। কী উদ্দেশ্যে সে কেবিন থেকে বেরিয়েছিল তাও তার মনে নেই। শুধু মনে সুমির ছবিটাই গেঁথে থাকলো। ‘ডাক্তার অনীল?’ রোগীর ডাকে ঘোর কাটলো অনীলের। ততক্ষণে সে ঠিক করে ফেলেছে গাইনোকলজিস্ট ম্যামের থেকে সুমির ডিটেইলস বের করার উপায়।
________________________
-‘ডাক্তার কী বলেছেন?’
-‘সব ঠিক আছে সোহরাব। আপনি অযথা চিন্তা করবেন না।’
-‘সময়ই দিতে পারছি না তোমাকে।’
-‘অফিসে আরেকটা বিয়ে করে রেখে এসেছেন যে।’
-‘এরকম মনে হয় আমাকে?’
-‘হতেই পারেন।’
সোহরাব রাগ করে পাশ ফিরলো। অনামিকা তা দেখে মৃদু হাসলো। সোহরাব ইদানিং বাচ্চাদের মতো রাগ করতে শিখেছে। মাঝেমধ্যে তো ঠোঁট ফুলিয়েও বসে থাকে। আবার কখনো কখনো অনামিকার কোলে মাথা রেখে আজগুবি সব গল্পের আসর বসায় বাচ্চার সাথে।
-‘এই যে বসন্তের আব্বু, শুনছেন?বসন্ত কিন্তু বাবার মতো রাগ করবে কথা না শুনলে।’
-‘ঐ এক বুদ্ধি পেয়েছো। আজ ওর জন্য তোমায় ছেড়ে দিলাম যাও। আমার বাচ্চাটা আমাকে বোঝে তাও। তুমি তো ছাই বোঝো!’
-‘তাই নাকি? আমি রাগ করবো এখন যাও।’
অনামিকা রাগ করার কথা বললেও সোহরাবের তাকানোতে আর রাগ করতে পারলো না। সোহরাবের দৃষ্টিতে ইদানিং অদ্ভুত একটা মায়া লক্ষ করেছে অনামিকা। এ মায়ার সাগরে বারবার ডুবতে ইচ্ছে করে অনামিকার।
__________________________
রাতে সুমির মন খারাপটা কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ইমাদের সাথে কথা বলার ইচ্ছেটাও অনেকটা বেড়ে গেল। ইদানিং ইমাদের সাথে কথা না হলে তার পাগলামি ভাব হয়না তবে ইমাদের কথাবার্তা তাকে কিছুটা হলেও ভালো রাখে। এটা ভেবেই সুমি ইমাদের নম্বর ডায়াল করলো। নম্বর ওয়েটিং দেখে সুমি কল কেটে দিল। কল কেটে একটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করলো। পড়াশোনায় এখন ভালোই মনোযোগ বসেছে তার। একবার পড়তে নিলে টানা দুই-তিন ঘণ্টা পড়তেও ক্লান্তি আসে না। পড়তে পড়তে দেড় ঘণ্টা কখন পেরিয়েছে সত্যিই বুঝলো না সুমি। দেড় ঘণ্টা পর ফোন হাতে নিয়ে আবারো ইমাদের নম্বরে কল দিলো। আবারো ওয়েটিং! খানিকটা অবাক হলো সুমি। এতক্ষণ ধরে কার সাথে কথা বলছে? কল কাটার আগেই ইমাদ রিসিভ করেছে।
-‘কী সমস্যা তোমার? দেখছো তো ওয়েটিং, বারবার কল দিচ্ছো কেন?’
-‘এমনিতেই।’
-‘আমি তোমার কেনা গোলাম না! আমাকে টাকা দিয়ে কিনে রাখো নাই যে যখন ইচ্ছে তখন কল দিবা। তোমার সাথে বন্ধুর মতো বিহেভ করি মানে এই না যে তোমার সাথে প্রেম করতেছি। আমার অলরেডি প্রেমিকা আছে। তোমার ভাইয়ের অনুরোধে অনেক ভালো ব্যবহার করছি, আর নিতে পারতেছি না তোমারে। রেহাই দাও আমায় প্লিজ।’
কথাটুকু বলেই কলটা কেটে দিল ইমাদ। সুমি একবারও বলতে পারলো না সে মাত্র দুবার কল দিয়েছিল শুধু একটু কথা বলার জন্য। ইমাদের প্রেমিকা আছে জেনেও কষ্ট হচ্ছে না সুমির। কষ্ট হচ্ছে ইমাদ তাকে অযথা এতগুলো কথা শোনালো তার জন্য। বিগত কয়েক মাসে ইমাদ নিজেই সুমিকে সময় দিয়েছে, সুমি জোর করেনি অথচ আজ সব দোষটাই তার? নিয়তির পরিহাস মাঝেমধ্যে অবোধগম্য!
চলবে…
[আমার ভাগ্য আসলে অনামিকার মতো, সবাই খালি ভুলই বোঝে! :’)]